রবিউল আউয়াল ১৪৪০হিঃ (৩/৭)

বিজ্ঞান বিচিত্রা

আ ব হা ও য়া র পূ র্বা ভা স

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

‘আবহাওয়ার পূর্বাভাস’ বলে একটা কথা আধুনিক কালে আমরা বেশ শুনতে পাই। অর্থাৎ বিভিন্ন লক্ষণ ও আলামত থেকে সামনের আবহওয়া সম্পর্কে একটা আগাম ধারণা লাভ করা এবং সেটা জনসাধারণের মাঝে প্রচার করা।

প্রথম দিকে প্রযুক্তিগত সমর্থনের অভাবে আবহাওয়ার পূর্বাভাসগুলো যথেষ্ট ত্রুটিপূর্ণ হতো, এমনকি এমনও হয়েছে যে, যেমন পূর্বাভাস দেয়া হলো, বাস্তব অবস্থা তার সম্পূর্ণ বিপরীত! তবে বর্তমানে প্রযুক্তির উন্নতির ফলে, বিশেষ করে আবহাওয়া-

বিষয়ক উপগ্রহ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের কারণে আবহাওয়ার পূর্বাভাস যথেষ্ট নির্ভুল হয়।

আবহাওয়ার পূর্বাভাসে জরুরি বিষয়?

প্রথমত বায়ুর চাপ ওঠানামা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা, দ্বিতীয়ত বাতাসে বিদ্যমান আর্দ্রতা জানা, তৃতীয়ত বাতাসের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে নিখুঁত ধারণা অর্জন করা। এ তিনটি বিষয়ে যত নির্ভুল তথ্য জানা থাকবে, এক দু’দিন আগে আবহাওয়া সম্পর্কে তত নির্ভুল পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব হবে।

আগে এ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী শব্দটির ব্যবহার ছিলো, পরে আবহাওয়া বিজ্ঞানীগণ তাদের ভুল বুঝতে পারেন যে, ভবিষ্যদ্বাণী করা মানুষের সাধ্যের ভিতরে নেই; মানুষ শুধু পারে পূর্বাভাস দিতে।

যেভাবে শুরু

১৬৪৩ সালে বায়ুর চাপ মাপার জন্য ব্যারোমিটার উদ্ভাবিত হয়। ফলে বায়ুর চাপ ওঠানামা সহজেই জানা সম্ভব হয়। বায়ুর চাপ কমে যাওয়ার মানে হলো ঝড়ের সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়া।

১৬৬৪-এ উদ্ভাবিত হয় বায়ুম-লের আর্দ্রতাপরিমাপক যন্ত্র হাইগ্রোমিটার।

১৭১৪ সালে উদ্ভাবিত হয় তাপ পরিমাপের যন্ত্র থার্মোমিটার।

মোটামুটি এ তিনটি হলো আবহাওয়া সম্পর্কে ধারণা লাভের মূল ভিত্তি। এ তিন প্রকার তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায় ঝড় কখন কোথায় জন্ম নিতে পারে।

আবহাওয়ার দিকনির্ণয়

বড় একটা সমস্যা ছিলো ঝড়ের গতিবিধি সম্পর্কে অবগতি অর্জন করা যে, ঝড় কোনদিকে কত বেগে ধাবিত হচ্ছে বা হতে পারে! অনেক পরে একটি পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়, যার মূল কথা হলো, মেঘের উদ্দেশ্যে বেতার তরঙ্গ প্রেরণ করা যা মেঘের বৃষ্টিকণা ও বরফকণায় আঘাত পেয়ে ফিরে আসে। তাতে আবহওয়াবিদ বুঝতে পারেন ঝড়ের গতি কোন দিকে হতে পারে।

পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে আবহাওয়া-বিষয়ক তথ্য দ্রুত সংগ্রহ করার জন্য ১৮৬০-এর দিকে উদ্ভাবিত হয় বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ।

এরপর পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য আবহাওয়াকেন্দ্র স্থাপিত হয় এবং কেন্দ্র থেকে কেন্দ্রে দ্রুত তথ্য প্রেরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

কৃত্রিম আবহাওয়া-উপগ্রহ

আবহাওয়া পর্যবেক্ষণে মৌলিক অগ্রগতি অর্জিত হয় ১৯৬০ সালে যখন প্রথম কৃত্রিম আবহাওয়া-উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করা হয়। এখন বহু আবহাওয়া-উপগ্রহ নিয়মিত পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে এবং ভূকেন্দ্রগুলোতে প্রতিনিয়ত আবহাওয়াচিত্র প্রেরণ করতে থাকে। আবহাওয়াবিদগণ ঐ সব তথ্য-উপাত্ত ও চিত্র বিশ্লেষণ করে পূর্বাভাস প্রস্তুত করে থাকেন।

আবহাওয়া ও কম্পিউটার

আবহাওয়ার বর্তমান অবস্থা জানতে পারা সতর্কতা অবলম্বনের জন্য মোটেই যথেষ্ট নয়। এর জন্য প্রয়োজন কয়েক ঘণ্টা আগে, এমনকি সম্ভব হলে কয়েকদিন আগে আবহাওয়ার পরবর্তী অবস্থা জানতে পারা।

এজন্য ১৯১৫ সালের দিকে একটি ধারণা পেশ করা হয়। তা এই যে, বায়ুম-ল যেহেতু পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম মেনে চলে সেহেতু অঙ্ক ও গণিত ব্যবহার করে আবহাওয়ার ‘পরবর্তী’ অবস্থা জানা যেতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, কথিত সূত্র ও জটিল অঙ্ক এত সময় নিতো যে, পূর্বাভাস প্রস্তুত হওয়ার আগেই তার কার্যকরতা শেষ হয়ে যেতো।

কম্পিউটার উদ্ভাবনের পর পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হয়। বড় ও জটিল হিসাবগুলো দ্রুত সমাধান করা সম্ভব হয়। আগে হিসাব-জটিলতার সময়গত কারণে ছয়ঘণ্টা পরপর আবহাওয়ার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হতো, অথচ সঠিকতার কাছাকাছি পূর্বাভাসের জন্য প্রয়োজন ছিলো পনেরো বা সর্বোচ্চ ত্রিশমিনিট পরপর তথ-উপাথ্য বিশ্লেষণ করা। বর্তমানে কম্পিউটারের কল্যাণে সেটা সম্ভব হচ্ছে। এখন আবহাওয়াবিদগণ পৃথিবীর উপরিভাগকে বর্গজালিতে ভাগ করে নিয়েছেন। তাতে প্রতিটি বিন্দু ৮০ কিলোমিটার দূরত্বে স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটা বর্গের উপরস্থ বায়ুম-লের প্রবাহ, চাপ, তাপ ও আর্দ্রতা পর্যবেক্ষণ করা হয় বিভিন্ন মাত্রার বিশটি উচ্চতা থেকে। পৃথিবীব্যাপী তিনহাজার পাঁচশরও বেশী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণকেন্দ্রে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটারে বিশ্লেষণ করে আবহাওয়াবিদগণ পরবর্তী পনেরো মিনিটের আবহাওয়া সম্পর্কে পূর্বাভাস দেন। পরবর্তী পূর্বাভাসগুলো খুব দ্রুত সম্পন্ন হয়ে যায়। ফলে একটি কম্পিউটার এই ‘পনেরো মিনিটপদ্ধতি’র সাহায্যে মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যে সারা পৃথিবীর পরবর্তী ছয় দিনের আবহাওয়ার ‘নিখুঁত’ পূর্বাভাস প্রস্তুত করতে পারে।

আবহাওয়া-মানচিত্র

আবহাওয়ার পূর্বাভাস যথাসম্ভব নিখুঁত করার জন্য প্রাপ্ত তথ্যগুলো বিন্যস্ত করে একটি আবহাওয়া-মানচিত্র তৈরী করা হয়। যেমন সমচাপরেখা হচ্ছে মানচিত্রে কোন্ কোন্ স্থানে একই বায়ুচাপ বিরাজ করছে তা নির্দেশকারী সংযোগরেখা।

পক্ষান্তরে সমতাপরেখা হচ্ছে মানচিত্রের কোন্ কোন্ স্থানে একই তাপমাত্রা বিরাজ করছে তা নির্দেশকারী সংযোগরেখা।

একই ভাবে বায়ুর গতি ও শক্তি নির্দেশ করার জন্য রয়েছে আলাদা রেখা। ঠা-া ও গরম বায়ুর সংযোগস্থল বোঝানোর জন্যও রয়েছে কিছু রেখা।

তবে মনে রাখতে হবে, শুধু কম্পিউটারিক বিশ্লেষণের উপর পূর্ণরূপে নির্ভর করা সম্ভব নয়, বরং আবহাওয়াবিদ নিজেও এক্ষেত্রে তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে নির্ধারক ভূমিকা পালন করেন। এভাবে প্রযুক্তি ও মানব-অভিজ্ঞতার মিশ্রণেই তৈরী হতে পারে যথাসম্ভব নির্ভুল আবহাওয়া-পূর্বাভাস। তারপরো স্বীকার করতেই হবে যে, বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে নির্ভুল পূর্বাভাস দেয়া এখনো সম্ভব হচ্ছে না। এর বড় একটা কারণ হলো, আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি বড় জটিল ও দ্রুত পরিবর্তনশীল। যে সমস্ত প্রাকৃতিক সূত্র আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে এখনো বিজ্ঞানীরা ভালোভাবে তা বুঝতে পারেন না।

পৃথিবীর সমস্ত আবহাওয়াবিজ্ঞানী-দের প্রতি আমাদের আকুল আবেদন,  প্রকৃতি ও আবহাওয়া যিনি সৃষ্টি করেছেন, মহাপ্রজ্ঞাবান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ, আপন কালামে তিনি আবহাওয়া, মেঘ ও বায়ু সম্পর্কে যেসকল আয়াত নাযিল করেছেন সেগুলো গভীরভাবে অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা করুন। তাহলে আবহাওয়াবিষয়ে আপনাদের জ্ঞানের পরিধি বহু গুণ বৃদ্ধি পাবে এবং বিশ্ববাসী তা দ্বারা উপকৃত হবে। পক্ষান্তরে আল্লাহ তা‘আলার সর্বব্যাপী কুদরত সম্পর্কে জ্ঞান পরিপক্ব হবে, যা -আশ্চর্য নয় যে,- ঈমান ও বিশ্বাস পথ উন্মুক্ত করে দেবে।

আল্লাহ তা‘আলা নিজেও মানুষকে এ বিষয়ে চিন্তা করার আহ্বান জানিয়েছেন।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা