কাশ্মীরসংখ্যা

কচি ও কাঁচা

তুমিই কি আমার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

তুমিই কি আমার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে!

বুড়ির বয়স এখন আশি বছর। বার্ধক্যের ভারে একেবারে যেন নূয়ে পড়েছেন! গায়ে যে সেলোয়ার-কামিছ ও দোপাট্টা রয়েছে তাও বুড়ির বয়সেরই মত জরাজীর্ণ ও শতচ্ছিন্ন!

যাদের বয়স এখন ত্রিশবছর তারাও বাচ্চা বয়সে বুড়ীকে এ অবস্থায়ই দেখে এসেছে। রাস্তার পাশে বসে থাকে সারা দিন। হাতে বহু পুরোনো ছবি, বাচ্চা মেয়ের। কেউ যদি কিছু দেয়, চুপচাপ খেয়ে নেয়, আর শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, কখনো ছবিটার দিকে, কখনো পথের দিকে।

কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে, নানীমা, এখানে বসে আছেন কেন? ছোট্ট একটা জবাব আসে, যা এখন তেমন ভালো করে বোঝাও যায় না, ‘আমার মেয়ে এ পথ দিয়ে যাবে তো, তার অপেক্ষায় বসে আছি!

আপনার মেয়েকে চিনবেন কীভাবে?

কেন, ওর তাছবীর আছে না আমার কাছে! এই বলে হাতে ধরা ছবিটা দেখায়!

কেউ জানে না, কে এই বুড়ি? কীভাবে হারিয়েছে তার মেয়ে? ...

***

ডা. শাযিয়া! শৈশবে মা-বাবা হারানো কাশ্মীরী মেয়ে। এক এতীমখানায় লাওয়ারিছ হিসাবেই বড় হয়েছে। বড় শক্ত মেয়ে! শুরু থেকেই তার প্রতিজ্ঞা ছিলো, জীবনের কাছে পরাজিত হবে না। সংগ্রাম করবে এবং জীবনকে জয় করবে। তাই করেছে! তাকদীর তাকে সাহায্য করেছে। এখন সে ডাক্তার, গরীব রোগীদের সেবা করাই তার জীবনের লক্ষ্য। শাযিয়া কিছুদিন হলো কাশ্মীরের অনন্তনাগ হাসপাতালে এসেছে। প্রতিদিন যাওয়ার পথে বুড়িকে দেখতে পায় শাযিয়া। ধীরে ধীরে তার জানা হয় বুড়ির পরিচয় এবং ...!

শাযিয়া মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞা করে, তারপর বুড়ির কাছে গিয়ে বসে, ‘সালাম আম্মাজান!’

বুড়ি অবাক চোখে তাকায়, কঙ্কালসার হাতটা তুলে শাযিয়ার চোখমুখ ছুঁয়ে দেখে, তারপর কাঁপা ঠোঁটে, কতকটা যেন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করে, তুমি কি আমার বেটি ফউযিয়া! ফুযি!

ডা. শাযিয়ার চোখে পানি এসে যায়! কোনমতে কান্না রোধ করে বলে, হাঁ আম্মাজান, আমি আপনার বেটি ফাউযিয়া, ফুযি!

বুড়ি ডা. শাযিয়াকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। কোথায় হারিয়ে গেলি তুই ফুযি! কত বছর হলো তোকে খুঁজে ফিরছি! সিপাহীরা তোকে কষ্ট দেয়নি তো!

শাযিয়া চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারে না। সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে, না আম্মাজান, কষ্ট দেয়নি। শুধু আটকে রেখেছিলো। আজ ছাড়া পেয়েই তো চলে এলাম!

বুড়ি পূর্ণ স্বস্তির সঙ্গে বলে ওঠে, দেখ বেটি আমার বুকটা ধরে দেখ, কী শান্তি হয়ে গেছে! আমার সব কষ্ট দূর হয়ে গেছে!

শাযিয়া বুড়িকে বড় যত্ন করে নিজের কাছে নিয়ে আসে! ধুয়ে মুছে নতুন কাপড় পরিয়ে দেয়। জিজ্ঞাসা করে, কিছু খাবেন মা! দুধ দেবো! শেমাই! একটুকরো রুটি!

বুড়ির যেন ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে। কোনমতে বলে, তোকে হারানোর শোকে কতদিন ঘুমাইনি বেটি! আমাকে একটু ঘুমুতে দে!

শাযিয়া পরম যত্ন ও মমতার সঙ্গে, যেন তার গর্ভধারিণী মা, পরিচ্ছন্ন বিছানায় শুইয়ে দেয়।

সেই ঘুম আর ভাঙ্গেনি বুড়ির!

 

আমি তোমাদের শোনাতে চাই

আমি তোমাদের শোনাতে চাই, দূর অতীতের একটি কাহিনী! কাহিনী মানে সত্য ঘটনা, যা একদিন ঘটেছিলো, মদীনার পুণ্যভূমিতে! যা মুসলিম উম্মাহ্ প্রতিটি শিশুর জন্য, কিশোরের জন্য গৌরবের এবং গর্বের। ফিলিস্তীনের শিশুরা যেমন গর্ব করতে পারে তেমনি গর্ব করতে পারে আরাকানের শিশুরা এবং কাশ্মীরের ছেলেরা মেয়েরা। গর্ব করতে পারে যে কোন যুগের, যে কোন দেশের মুসলিম শিশু, মুসলিম কিশোর। সেই ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি, সাহস ও বীরত্বের; শিক্ষা নিতে পারি শৈশব থেকে, কৈশোর থেকে, এই ছোট বয়স থেকেই সত্যের পক্ষে এবং বাতিলের বিরুদ্ধে লড়াই করার।

যে ঘটনাটির কথা তোমাদের বলতে চাই তা মদিনার দুই কিশোরের। ওরা দু’টি আপন ভাই, মানে সহোদর।

কত হবে তাদের বয়স, বার থেকে তের, এর বেশী নয় কিছুতেই! কিন্তু সাহস! বড় বড় বীর পুরুষের চেয়ে সাহস তাদের কম ছিলো না! খালি হাতে সিংহের সামনে দাঁড়াতে বলো, দাঁড়িয়ে যাবে, একটুও ভয় পাবে না! দু’ভাইকে নিয়ে মায়ের গর্ব ছিলো অনেক। মা, বলতেন, আমার ছেলে

দু’টি তো এখনই মুজাহিদ! বড় হয়ে হবে আরো বড় মুজাহিদ! হকের জন্য, সত্যের জন্য তারা জান দেবে, শহীদ হবে! আমি হবো দুই শহীদের মা!

বাবা বলতেন, আমার ছেলেরা দ্বীনের ঝা-ণ্ডা বুলন্দ করার জন্য লড়াই করবে এবং শহীদ হবে! আমি হবো দুই শহীদের বাবা! শহীদের যেমন অনেক মর্যাদা আল্লাহ্র কাছে হাশরে তেমনি অনেক মর্যাদা শহীদানের মা-বাবার। একদিন হলো কী! যা হলো তা না হয় একটু পরে বলি, আগে জানিয়ে দিই দু’ভাইয়ের নামদু’টো! তা ঠিক! নামের চেয়ে গুরুত্ব বেশী কাজের! মানুষ তো আর নাম দ্বারা বড় হয় না, বড় হয় কাজ দ্বারা। ধরো এক যুবকের নাম হলো মুজাহিদুল ইসলাম, কিন্তু জিহাদের ময়দানে গেলো না জীবনে একবারও, কী লাভ হলো এত বড় একটা নাম গলায় ঝুলিয়ে! কিংবা নাম রাখা হলো আসাদুল ইসলাম, মানে ইসলামের সিংহ, কিন্তু এমন বুযদিল যে, বেড়াল যদি একটু জোরে মিউঁ করে, ভয় পেয়ে যায়! কী লাভ হলো এত বড় একটা নাম দিয়ে!

হাঁ, কাজটাই হলো আসল। তো এসো, আগে কাজের কথাই বলি! আল্লাহর নবী বদরযুদ্ধে গেলেন। দু’ভাই, যাদের কথা এতক্ষণ ধরে বলা হচ্ছে, তারাও গেলো বড়দের সঙ্গে। মদীনা থেকে তারা এই প্রতিজ্ঞা করে বের হলো, আবু জাহেল আমাদের নবীজীকে নাকি অনেক কষ্ট দিয়েছে! ওকে কতল করে তবেই আমরা ক্ষান্ত হবো!

মানুষ তো শুনেই অবাক! বলে কি এইটুকুন বাচ্চা দু’টো! আবু জেহেলের মত বীর যোদ্ধা! তাকে কিনা কতল করবে দুধের শিশু!

এবার শোনো কী ঘটলো বদরের ময়দানে!

‘চাচা, আমাদের একটু দেখিয়ে দিন তো, আবু জেহেলটাকোথায়!’

যাকে জিজ্ঞাসা করা হলো তিনি অবাক হলেন, তবে দেখিয়ে দিলেন, ঐ যে...!

ব্যস, আর কথা নেই! বাজপাখী কীভাবে ছুটে যায় শিকারের দিকে, দেখেছো! ঠিক সেভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়লো দু’ভাই আবু জেহেলের উপর এবং কতলই করে ফেললো, যেমন প্রতিজ্ঞা করেছিলো। এবার শোনো দু’ভাইয়ের নাম, মু‘আয বিন আফরা এবং মু‘আওয়ায বিন আফরা! মুসলিম উম্মাহর গর্ব ওরা দু’জন!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা