মুহাররম ১৪৪৫ হিঃ

সংযোজিত

আমার মা! আমার জান্নাত!!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

পৃথিবীতে যুগে যুগে দেশে দেশে মায়ের কথা অনেক সন্তানই লিখেছেন এবং বলেছেন। তাদের মধ্যে বহু সাধারণ মানুষ যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন কিছু অসাধারণ মানুষ। কিন্তু কেউ কি মায়ের জীবদ্দশায় লিখেছেন, ‘মায়ের কাহিনি, সন্তানের যবানি’! বোধহয় না। আল্লাহ্ জানেন, আমার অন্তরে কেন এমন ইচ্ছে বা আকুতি উদিত হলো! মায়ের জীবদ্দশায় মায়ের কথা লেখার আকুতি!! শুরু থেকে যা কিছু ঘটলো এবং যেভাবে ঘটলো সব তো এখনো সমুজ্জ্বল আমার চোখের সামনে। তাতে আমি তো নিশ্চয়তার সঙ্গে বলতে পারি, আমি নিজের ইচ্ছায় লেখা শুরু করিনি। অদৃশ্য একটি শক্তি আমাকে উদ্দীপ্ত করেছে লেখার জন্য।

এই তো সেদিনের কথা! রাতের ঘড়ি দু’য়ের ঘর পার হয়েছে। পুষ্পের কাজ চলছে। আমার ঘরে আমি তখন একা, তবে ঝিরঝির একটা অনুভূতি হলো যে, একা হলেও আমি নিঃসঙ্গ নই। জানালা পথে ঐ যে দেখা যায় আকাশ, মনে হলো ‘আকাশ’ আমাকে সঙ্গ দিচ্ছে। আকাশে তখন চাঁদ নেই, জোসনা নেই, তাহলে! কিন্তু তারাদের ঝিলিমিলি তো ছিলো! তারাদের ঝিলিমিলি পার হয়ে আরো দূর থেকে, বহু দূর থেকে অন্যরকম একটি আলোর ঝিকিমিকি যেন আমার অন্তর্জগতে প্রতিফলিত হলো। খুব কোমল ও মোলায়েম স্বরে, শিশিরের স্নিগ্ধতা মেখে আমার ভিতরের কে যেন আমাকে বললো, এখন বড় সুন্দর সময়! এখন নতুন কিছু লেখো! এমন কিছু যা হবে একান্তভাবে তোমার মায়ের পাক কদমের জন্য তোমার কলমের এবং কলবের নাযরানা!

অদৃশ্যের তাড়না, অদৃশ্যের প্রেরণা এবং অদৃশ্যের নির্দেশনা, এগুলো বড়দের মুখে শুনেছি, নিজের জীবনেও ‘আলোছায়া’র মত কিছু না কিছু অনুভব করেছি, কিন্তু সেদিন মনে হলো অত্যন্ত জীবন্ত অনুভব! অদৃশ্য থেকে কে যেন আমার সামনে একটা আলোর রশ্মি তুলে ধরলো। সেই আলোকরশ্মি অনুসরণ করে, নিজেই জানি না, কখন আমি লিখতে শুরু করলাম। কলব থেকে কলমের মুখ হয়ে লেখাটি যখন স্নিগ্ধ আলোকিত একটি অবয়ব লাভ করলো, হৃদয়ের গভীরে তখন যে প্রশান্তি অনুভূত হলো তা প্রকাশ করার সঠিক ভাষা সত্যি আমার জানা নেই! এখনো মনে হলে সেই পুলকের, সেই প্রশান্তির শীতল প্রলেপ যেন হৃদয় অনুভব করে।

হৃদয় ও আত্মার এমন স্বর্গীয় প্রশান্তি এবং কলব ও রূহের এমন জান্নাতি কায়ফ-সুরূর যখন কেউ অর্জন করে, তখন প্রথম যে কথাটা মনে হয়, খুব কাছের, খুব আপন যারা, তাদের কেউ যদি কাছে থাকতো, লেখাটা তাকে যদি পড়ে শোনাতে পারতাম! আমার কলমের সঙ্গে, কলবের সঙ্গে, আমার লেখার সঙ্গে সবচে’ নিবিড় সম্পর্ক আমার ছোট্ট মেয়েটির! তারপর আমার ছেলেটির। দু’জনেই তখন বহু দূরে, হিজাযের খুব নিকটে! মেয়েটির তখন এমন কিছু অবস্থা ছিলো যে, হঠাৎ করে ঘুম থেকে জাগানো, মনে হলো, অসঙ্গত। ছেলেটিকেই জাগালাম। বললাম, বাবা, মাফ করো, তোমাকে জাগাতেই হলো। এখন, রাতের এই নির্জনতায় আল্লাহ্ আমাকে সম্ভবত জীবনের শ্রেষ্ঠ লেখাটি দান করেছেন। তোমার বাবার সেই লেখা শোনবে বাবা!

সে বললো, আব্বু, শুনবো এবং পড়বো! তার আগে তোমাকে বলি জাযাকাল্লাহ্, আমাকে জাগানোর জন্য! বুঝতে আমার একটু সময় লাগলো। আধুনিক প্রযুক্তির কথা কী আর বলবো, দূরকে করেছে কত নিকটের; নিকটকে করেছে কত দূরের! আমি জাওয়ালে পড়ে শুনালাম, আর দুই হাসুবের মধ্যে সংযোগ তৈরী করে বাবা আমার লেখাটি একই সঙ্গে পড়লো!

আমি প্রথমে তো অবাক হলাম শুধু এটা ভেবে যে, এত দূর থেকে আমার হাসুবের লেখা পড়া যাচ্ছে! তারপর বিস্মিত হলাম, যখন ছেলে আমার হাসূবে লিখলো, আর আমাকে বললো, তুমি যদি লেখো, আমার হাসূবে সেটা মুদ্রিত হবে! অবাক হলাম, বিস্মিত হলাম, তবে মনে একটা প্রশ্ন বিঁধলো কাঁটার মত, ‘এ যুগে আমরা খুব বেশী উন্নতি করেছি। প্রযুক্তির সামান্য কিছু সুবিধা অর্জনের জন্য, হৃদয়ের কী বিপুল সম্পদ হাতছাড়া করেছি! আগের যুগে মানুষ যুক্তি ও প্রযুক্তির গোলকধাঁধা থেকে মুক্ত ছিলো, বোধ ও বুদ্ধিতে পরিচ্ছন্ন ছিলো, আর হৃদয়বৃত্তিতে ছিলো সমৃদ্ধ! এখন...! সবাই শুধু ভাবি, কত কী পেলাম, একবারও ভাবি না, কত কী হারালাম!

তো লেখাটি পড়ে ও শুনে আমার বাবা, যেমন আশা করেছিলাম তেমনি অভিভূতি ও মুগ্ধতা প্রকাশ করলো। রাতের নির্জনতার স্নিগ্ধতা বাবাকে যেন আমার অন্তরের আরো কাছে নিয়ে এলো। বললাম, সকালে তোমার আপুকে আমার পক্ষ হতে পড়ে শুনিয়ো।

***

লেখাটি পুষ্পে প্রকাশিত হলো। ভাবনায় ছিলো না, আমার ময়ের দৃষ্টির আলো দ্বারা এ লেখা কখনো ধন্য হবে। কখনো লেখাটি তাঁর সামনে আসবে, আর তিনি পড়বেন।

যা আমার ভাবনায় ছিলো না, এমনকি কল্পনায়ও না, আল্লাহ্ তা করলেন এবং .. এবং লেখাটি পড়ে আমার মা এমন সন্তুষ্ট হলেন, এমন আপ্লুত হলেন যে, স্বভাবকে অতিক্রম করে কিছুটা উচ্ছাসের সঙ্গে তা প্রকাশও করলেন। এমন একটি লেখার পরম প্রাপ্তিকে সমৃদ্ধ করে রাখার জন্য আল্লাহর প্রতি শোকর ও কৃতজ্ঞতারূপে মায়ের খিদমতে...!

আসমানের লীলারহস্যের এখানেই হতে পারতো ইতি, কিন্তু হলো না! অদৃশ্যের সেই আলোকরশ্মি আমাকে বোধহয় কল্যাণের পথে আরো অনেক দূর নিয়ে যেতে চাইলো। আমার পুত্র, যাকে আমি বলি, ‘বাবা’, আমাকে পথ দেখালো, তারই কথায় উদ্দীপ্ত হয়ে একই লেখা দ্বিতীয় বার লেখা হলো। তাতে লেখাটি আকারে অবয়বে এবং প্রকারে প্রকৃতিতে আরো যেন সজীব, আরো যেন জীবন্ত হলো! এখানেও কি হতে পারতো না ঘটনার ইতি! কিন্তু না, হলো না। আবার লেখা হলো কিছু নতুন কথা, তারপরো এই যে এখনো লেখা হচ্ছে অন্যরকম কিছু কথা। এরপরের কথা জানেন আমার আল্লাহ্। আমি শুধু প্রার্থনা করি, কলমের কালি যেন আল্লাহর রহমতে আলো হয়েই ঝরতে থাকে, আজ, আগামী কাল এবং চিরকাল! প্রত্যেক মায়ের মাতৃসত্তায় আমার মায়ের আলোকিত সত্তার যেন ছায়াপাত হয়। প্রত্যেক মায়ের কোলে প্রতিটি সন্তান যেন মাতৃহৃদয়ের কল্যাণ-শিশিরে আরো অধিক স্নাত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে।

একবার ভাবি,  এ তো বড় পিচ্ছিল, ঝুঁকিবহুল পথ! এবার না হয় থামি, এবার না হয় ফিরে আসি। কিন্তু আমার ভিতরের সত্তা যেন আমাকে বারণ করে বলে, নিজের ইচ্ছায় তো কলম তুলে নাওনি, নিজের ইচ্ছায় কেন কলম রাখবে। যাঁর উপর ভরসা করে শুরু করেছো তাঁরই উপর ভরসা করে এবং তাঁরই সন্তুষ্টির আশা বুকে নিয়ে লিখতে থাকো। এ লেখা তো শুধু তোমার লেখা নয় এবং নয় শুধু তোমার মায়ের জন্য। এ লেখা তো আলোর পথের প্রত্যাশী প্রতিটি সন্তানের লেখা! এ লেখা তো এমন প্রতিটি মায়ের জন্য, সন্তানের কল্যাণ-কামনায় যার বুকের কম্পন ও হৃদয়ের স্পন্দন নিবেদিত । আল্লাহর রহমতে এখন আমি এ বিশ্বাস ও প্রত্যয়ের সঙ্গে  লিখবো আমার মায়ের কথা যে, মায়ের সন্তুষ্টির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হবে, তারপর আমার দেশের, আমার ভাষার প্রতিটি সন্তান মাতৃমমতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে এবং কল্যাণসিক্ত হবে।

আমি জানি, প্রতিটি কথার ক্ষেত্রে আমাকে হতে হবে সত্যের প্রতি এবং সততার প্রতি বিশ্বস্ত। কারণ মায়ের বুকের ফোঁটা ফোঁট দুধের প্রতি যেমন রয়েছে আমার সারা জীবনের দায়, তেমনি রয়েছে কলমের ফোঁটা ফোঁটা কালির প্রতি মৃত্যু পর্যন্ত আমার দায়বদ্ধতা।

***

নানীর সঙ্গে আম্মার একটি দিনের যে মধুর দৃশ্য আমার স্মৃতিপটে এখনো ভাস্বর হয়ে আছে তা এখানে উল্লেখ করতে চাই।

সম্ভবত তখন চোয়াত্তর সাল। নানী হঠাৎ এমন কঠিন অসুস্থতার মধ্যে পড়লেন যে, সবাই যার যার মত করে পেরেশান হয়ে পড়লো। আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক ডা. আমানুল্লাহ্, আব্বার সঙ্গে যার কিছুটা অন্তরঙ্গতা ছিলো, তাকেও বিচলিত মনে হলো। ফোঁটা ফোঁটা স্যালাইন যাচ্ছে, আর তিনি কখনো তাকান সেদিকে, কখনো নানীর রোগপাণ্ডুর মুখের দিকে। হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, ‘দেখেন, আল্লায় কী করে’! একজন চিকিৎসকের মুখে এমন শব্দ উচ্চারিত হলে রোগীর আপনজনদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা তো বলাই বাহুল্য। আব্বা পর্যন্ত শব্দ করে কেঁদে উঠলেন।

আম্মাও শুনতে পেয়েছেন চিকিৎসকের মন্তব্য, শুনতে না পাওয়ার কারণ ছিলো না। পর্দার আড়ালে নানীর খুব কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে তাকালাম। কিন্তু না, আম্মা ছিলেন আমার চিরকালের আম্মার মতই! ভিতরে হয়ত শঙ্কিত, বিচলিত, কিন্তু বাইরে সম্পূর্ণ শান্তসমাহিত। তিনি ধীর পদক্ষেপে গেলেন কলপাড়ে। আমি পিছনে পিছনে গেলাম। পানি ভরে দিলাম। তিনি অযু করলেন, সব সমসময়ের মত ধীর শান্ত ভাবে। নামাযে দাঁড়ালেই আব্বাকে মনে হতো শান্ত, আম্মাকে মনে হতো প্রশান্ত। সেদিন জায়নামাযে আম্মাকে মনে হলো একই রকম প্রশান্ত এবং আত্মসমাহিত।

নামাযে মুনাজাতে আল্লাহর কোন কোন বান্দার মুখমণ্ডলে এমন প্রশান্তি বিরাজ করে এবং নূরানিয়াতের এমন উদ্ভাস ঘটে যে, বিশ্বাস করতেই হয়, আল্লাহর কাছে এখন তিনি প্রার্থনার স্তর অতিক্রম করে মিনতির স্তরে উপনীত হয়েছেন! তারপর মনে হলো, এখন আর মিনতি নয়, রীতিমত দাবী! সবশেষে মনে হলো, আল্লাহ্ তাঁর দাবী পূর্ণ করবেন বলে আশ্বাস লাভ করেছেন! আমার মায়ের সেদিনের নামায ও মুনাজাত দেখে আমার তেমনই মনে হলো, তিনি তাঁর মায়ের আরোগ্য লাভের আশ্বাস লাভ করেছেন।

আমি খুব কাছে বসে ছিলাম। সালাম ফিরিয়ে তিনি আমার দিকে তাকালেন, আহ্ কী নূরানিয়াত, কী আলোকোদ্ভাস ছিলো তখন আমার মায়ের মুখমণ্ডলে! এখনো তাঁর নামাযে ও জায়নামাযে নূর থাকে, নূরানিয়াত থাকে, কিন্তু সেদিন ছিলো অন্য স্তরে, অন্যমাত্রায়, অন্যরকম! সেই অন্যরকম যে কেমন অন্যরকম, ভাষায় প্রকাশ করার সাধ্য আমার নেই। দূর অতীতেও মায়ের মুখের হাসিকে আমার মনে হতো জান্নাতের হাসি, এখনো মনে হয়। ঐ রকম মৃদু কোমল ও স্নিগ্ধ হাসিটি মুখে ফুটিয়ে তিনি বললেন, চিন্তা কইরো না, আল্লাহ্ চাহে তো তোমার নানী ভালা হইয়া যাইবো।

কোন কারণ নেই, কোন যুক্তি নেই এবং নেই যুক্তির অনুকূলতা, তবু আমি বিশ্বাস করলাম, মা যখন বলছেন, নিশ্চয় আল্লাহর কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েই বলছেন! ইনশাআল্লাহ্ নানী ভালো হয়ে যাবেন। যে সময়ের জন্য এবং যে মানুষটির জন্য আল্লাহর নবী বলেছিলেন:   لَـوْ أَقْـسَـمَ عَـلَـى اللهِ لَأَبَـرَّه সেই সময়ের সঙ্গে এবং সেই মানুষটির সঙ্গে হয়ত আমার আম্মার কোন ‘ছায়াসম্পর্ক’ গড়ে উঠেছিলো। কোন সন্তানের জন্য তার মায়ের এমন সময়ের সঙ্গ ও সান্নিধ্য হতে পারে বহু কল্যাণের উৎস, যদি সন্তান...! হায়, তেমন সন্তান কি হতে পেরেছি! হতে পারবো কখনো! হতে চাই হে আল্লাহ্, আমি হতে চাই!

খুব দীর্ঘ ও জটিল কোন চিকিৎসা ছিলো না। একটিমাত্র স্যালাইন ছিলো সেটাও শেষ হওয়ার আগে নানী চোখ মেলে তাকালেন, মনে হলো একটু হাসির আভাস আছে মুখে। ডাক্তার শুধু বললেন, আলহামদু লিল্লাহ্। আম্মা! তিনি আবার দাঁড়ালেন জায়নামাযে। তাঁর ‘হাজাতের ছালাত’ রূপান্তরিত হলো শোকরের ছালাতে! একই দৃশ্য দেখেছি, আরো পরে আম্মা যখন প্রসবের যন্ত্রণায় অস্থির ছিলেন, আর নানী জায়নামাযে বসা ছিলেন। মা ও মেয়ে দু’জনেরই জায়নামাযের দৃশ্য ছিলো প্রায় অভিন্ন। একটা পার্থক্য যদি বলতে হয় তাহলে এই যে, নানী আব্দার পেশ করতেন, তাঁর মেয়ে করেন মিনতি নিবেদন!

একবার কী কারণে যেন নানী নারায হলেন। তখন তিনি বয়সের এমন স্তরেই ছিলেন যে, নারাযির জন্য কোন অবলম্বনের প্রয়োজন ছিলো না। কিন্তু আম্মা সারা দিন পেরেশান ছিলেন যে, মায়ের নারাযির অবস্থায় যদি মউত হয়, আমার কী হাশর হবে! অনেক চেষ্টা করে, অনেক অনুনয় বিনয় করে মাকে সন্তুষ্ট করে তবেই তিনি স্বস্তি লাভ করেছিলেন। আমরা কি মায়ের এ গুণটি পেয়েছি! মায়ের মনে কষ্ট তো হরহামেশা দিই, দিতেই থাকি। কখনো মায়ের মনের কষ্ট দূর করার চেষ্টা কি করি। কলেমা নছীব না হওয়ার ওয়ায তো করি, উপদেশ তো দিতে থাকি, নিজের জীবনে তার রূপায়ণ কি করি?! বিশেষ করে মায়ের বড় সন্তান আমি! সেই যে মা বলেছিলেন, ‘কষ্ট দিলেও তুই দিবি, শান্তি দিলেও তুই দিবি।’ কষ্টের কারণ তো হতেই থাকি, মায়ের শান্তির কারণ কি কখনো হতে পেরেছি? আল্লাহ্, তুমি মাফ করো। আল্লাহ্, তুমি তাওফীক দান করো, আমীন।

***

নানী যখন নিজের ঘরে নিজের ছেলের সঙ্গে থাকেন। তখন মামা কোথাও গেলে নানীর সঙ্গে আমার থাকা হতো। ঐ সময়ের বহু স্মৃতি, বহু কথা আমার অন্তরের নিভৃতে সংরক্ষিত রয়েছে। নানী তার শৈশবের দুঃখের কথা বলতেন, সুখের কথা বলার মত একটা দু’টোই ছিলো। হাঁ, যখন তিনি নববধুরূপে নানার জীবনে এলেন, তখন থেকে সুখের মুখ দেখতে শুরু করেছেন। সচ্ছলতা ছিলো না, বরং অভাব ছিলো, তবে নানার সঙ্গে নানীর জীবনে সুখের অভাব ছিলো না। এটা নানী নিজের মুখে আমাকে অনেকবার বলেছেন। আসলে আমার নানা, যেমন মায়ের কাছে শুনেছি, বিত্তসম্পন্ন ছিলেন না, তবে চিত্তসম্পন্ন ছিলেন। 

একবার নানীকে জিজ্ঞাসা করলাম, নানা কি কখনো আপনার জন্য ফুল এনেছেন।অন্ধকারে নানীর চেহারা তো দেখতে পাইনি, তবে হাসির মৃদু শব্দ শুনতে পেলাম। নানী বললেন, ‘তোমাগো যুগ কি তখন আছিলো! তবে মুহব্বত পাইছি অনেক। খালি বলতেন, তোমারে তো সুখে রাখতে পারলাম না! এই কথাটা শুনলেই তো খুশিতে মন ভইরা যাইতো! আমার কোন বই প্রকাশিত হলে নানীর হাতে যখন দিতাম, একই কথা বারবার বলতেন, নানার গুণটা তুমি পাইছো ভাই! যখন শুনতাম, নানার সঙ্গে অপূর্ব একটি আত্মিক বন্ধন অনুভব করতাম। তখন মনে হতো, নানাকে দেখিনি, তবু যেন নানাকে দেখেছি!

আর একটি দু’টি কথা বলেই নানীর প্রসঙ্গের সমাপ্তি টানি। আখেরাতের জন্য নানীর অস্থিরতা ও ব্যাকুলতা ছিলো অদ্ভুত, যদি বলি ছোট্ট মেয়ের অস্থিরতা এবং অবুঝ মেয়ের ব্যাকুলতা, বোধহয় ঠিক হয়। শুধু যদি বলেছি, চিন্তা কইরেন না, আল্লায় আপনেরে মাপ কইরা দিবো ইনশাআল্লাহ, ব্যস নানীর মুখে হাসি! সমস্ত অস্থিরতা বিলুপ্ত। আস্তে করে বলতেন, আচ্ছা আলহামদু লিল্লাহ! কিছুক্ষণ পরেই আবার, কও তো ভাই, আমার কী অবস্থা হইব? আবার সান্ত্বনা, আবার হাসি! দেখে আমার বড় আনন্দ হতো, আর বিশ্বাস হতো এমন সহজ সরল বুড়িকে আল্লাহ্...!

***

ব্যস আর একটি কথা! সম্ভবত সেটাই ছিলো নানীর সঙ্গে আমার শেষ দেখা এবং শেষ কথা! আমার স্ত্রী কোলে করে নানীকে আম্মার ঘর থেকে পাশে আমাদের এখানে নিয়ে এলেন। আমার চৌকিতে বসিয়ে দিলেন। আমি তো হতবাক। স্ত্রী বললেন, নানী জোর করলেন তোমার কাছে আনার জন্য। অনেক বললাম, আপনের নাতীরে ডাক দেই! কিন্তু না, একই কথা! আমারে কোলে কইরা লইয়া যাও। স্ত্রীকে সরিয়ে, যেন মনের কত গোপন কথা, এভাবে বললেন, কও তো ভাই, তোমার নানার সঙ্গে আমার দেখা হইবো নি!? আল্লাহর অসীম রহমতের কথা স্মরণ হলো, আর সেই ভরসায় ‘বুড়ী মানুষের যুবতী হৃদয়’কে আনন্দিত করার ইচ্ছা হলো। পূর্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে বললাম, ইনশাআল্লাহ্! জান্নাতে নানার সঙ্গে আপনার দেখা হবে! নানা তো জান্নাতে আপনার ইন্তিযারে আছেন!হে আল্লাহ্, নানার প্রতি আমার নানীর ভক্তিভালোবাসার লাজ রক্ষা করো, নানীকে বলা আমার সান্ত্বনার লাজ রক্ষা করো। জান্নাতে তাঁদের এমন মিলন দান করো, যার পরে আর কোন বিচ্ছেদ নেই!

আমার কথা শুনে নানীর বার্ধক্যজর্জরিত মুখমণ্ডলে এমন একটি সজীব হাসির উদ্ভাস দেখা দিলো যে, তার সঠিক চিত্র তুলে ধরার জন্য আমার কাছে উপযুক্ত কোন উপমা নেই। শুধু মনে হলো, আল্লাহ্র নবী যে বলেছেন, কোন বুড়ী জান্নাতে যাবে না, জান্নাতে তো যাবে যুবতী হয়ে। তো জান্নাতের সেই যুবতী বধুটির মুখমণ্ডলের ছাপ যেন দেখতে পেলাম, আমার থুত্থুরে বুড়ী নানাীর নির্জীব চেহারায়! 

***

নানীর শেষ সময়টা অতিবাহিত হয়েছে মৃত্যুশয্যায়, যখন তিনি কাউকে চিনতেন না, তার বড় মেয়েকেও না। সম্ভবত সেবা ও চিকিৎসার সুবিধার জন্য নানীকে রাখা হয়েছে দোতালার একটি কামরায়। সিঁড়ি অতিক্রম করে নানীকে দেখতে যাওয়া আম্মার জন্য ছিলো খুব কঠিন, বরং প্রায় অসম্ভব! তারপরো আম্মা গিয়েছেন কয়েকবার! তাঁর নিজের স্বাস্থ্য ও কষ্টের কথা চিন্তা করে আমরা না করতাম, তিনি শুনতেন না, কিছুটা যেন মনক্ষুণ্নই হতেন এবং ...!

আমি তখন হযরত পুরের প্রাঙ্গণে। ই‘তিকাফের জন্য আম্মার ইজাযত ও দু‘আ নিয়ে রওয়ানা হবো। স্ত্রী তখন আশরাফাবাদে ছিলেন। তাকে সঙ্গে নিয়ে আম্মার খিদমতে হাযির হলাম। দেখি, আম্মার চোখে পানি! তাঁর এ নীরব কান্নার সঙ্গে আমি পরিচিত। বুঝতে পারলাম, মায়ের কষ্টের কথা চিন্তা করে আমার মায়ের অন্তরের জগতে ঝড় বয়ে যাচ্ছে! গড়িয়ে পড়া ফোঁটা ফেঁটা চোখের পানি তারই সামান্য আভাসমাত্র। আম্মা বিদায় দিলেন, আর বললেন, যেন কত দূর থেকে, কত মরুভ‚মি পার হয়ে পৌঁছলো কণ্ঠস্বর! বললেন, তোর উপরে আমার কোন হক আছে নি! বেশ বিচলিত হলাম! এমন করে তো মা কখনো বলেননি, কখনো বলেন না! আবার কাছে গিয়ে বসলাম, পায়ের বুড়ো আঙুল স্পর্শ করে বললাম, আম্মা! আমার পুরা অস্তিত্ব, আমার রক্তের প্রতিটা ফোঁটাই তো আপনার কাছে ঋণী! আম্মা বললেন, তাহলে ই‘তিকাফের সময় আম্মার জন্য খাছ কইরা দু‘আ করিছ। আমার মনে হয়, আম্মার সময় হইয়া গেছে। আম্মার যেন কষ্ট না হয়, আম্মার যেন ঈমানের সঙ্গে, আসানীর সঙ্গে খাতিমা নছীব হয়, খাছ কইরা এই দু‘আ করিছ!

হযরতপুর প্রাঙ্গণে ইনফিরাদি দু‘আ যেমন করেছি, তেমনি তালিবানে ইলমকে নিয়ে ইজতিমা‘ঈ দু‘আও করেছি। নানীর জন্য তখন আমারও হৃদয়টি অত্যন্ত বিগলিত ছিলো।ই‘তিকাফের তৃতীয় বা চতুর্থ দিন দুপুরে খবর এলো, আখেরাতের সফরে নানী রওয়ানা হয়েছেন। আছরের পর নূরিয়ার প্রাঙ্গণে জানাযা, নূরিয়ার মাকবারায় দাফন! প্রথমে যে কথাটি আমাকে কঠিনভাবে বিচলিত করলো তা এই যে, এ ছদমা আম্মা বরদাশত করতে পারবেন তো! হে আল্লাহ্, আম্মাকে তুমি ছবর দান করো। ই‘তিকাফ থেকে বের হয়ে সঙ্গে সঙ্গে রওয়ানা হলাম। আল্লাহর গায়বী মদদে যেভাবে গাড়ী যোগাড় হলো এবং আছরের জামাত ও জানাযায় যেভাবে হাযিরি সম্ভব হলো, তা সত্যি বিস্ময়ের বিষয়। ধরেই নিয়েছিলাম, যথাসময় পৌছা সম্ভব হবে না। আম্মাকে দেখার জন্য বাসায় আর আর উঠিনি, সরাসরি নূরিয়ায় গেলাম। ইকামত হচ্ছে। জামাতে শরীক হলাম। শরীর এমনভাবে কাঁপছিলো, যেন পড়ে যাবো! অসুস্থতাও ছিলো, আবার শোকের আঘাতও ছিলো।

জানাযা হলো। মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। মনে হলো রহমানের পক্ষ হতে মারহূমার জন্য রহমতের ইশারা! দাফনের সময় কার হাত ধরে যেন দাঁড়িয়ে ছিলাম, চোখের ঝাপসা দৃষ্টি দিয়েই দেখলাম, উনষাট বছরের বিধবা, কবরের বিশ্রামস্থলে অবতরণ করলেন, ইনশাআল্লাহ্ আরামের সঙ্গেই বিশ্রাম করার জন্য! পুরুষ মাইয়েতকে তো বলা হবে, ‘নাম কানাওমাতিল আরূস!’ নারী মাইয়েত কী বলা হবে, জানা নেই। তবে অন্তর বেশ প্রশান্তির সঙ্গে সাক্ষ্য দিলো, ঐ যে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, .... পূর্ণ ইতমিনানের সঙ্গে দিল সাক্ষ্য দিলো, ইনশাআল্লাহ্ প্রিয়তমের সঙ্গে তাঁর মিলন হবে অনন্তকালের জন্য।

তখনো মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে! কাছের মানুষেরা আমার জন্য পেরেশান ছিলো, আমি কিন্তু নিশ্চিন্ত ছিলাম যে, রামাযানের শেষ দশক, ইফতারের সময়, ইনশাআল্লাহ্ এটা রহমতের বৃষ্টি! কোন কষ্ট হবে না! হয়ওনি! ভিজা কাপড়েই ছিলাম হযরতপুরে ইতিকাফের স্থানে ফিরে আসতে বেশ রাত হয়েছিলো। অনেক চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলাম। আম্মার সঙ্গে দেখা না করে যাওয়া ঠিক হবে না। ইফতারের পাঁচ মিনিট আগে আম্মার খেদমতে হাযির হলাম। মাশা‘আল্লাহ! আশ্চর্য এক আত্মনিমগ্নতার সঙ্গে তিলাওয়াত করছেন, তবে নিঃশব্দ তিলাওয়াত! চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে, কোরআনের পাতাও সেই অশ্রুতে ভিজছে! মায়ের এ দৃশ্য জীবনে এই প্রথম দেখলাম। হয়ত আর দেখা হবে না। বাকি জীবনের জন্য এ দৃশ্যটি আমার জন্য শুভ্র সুন্দর একটি সঞ্চয় হয়ে থাকলো।

যদ্দুর মনে পড়ে, আম্মা ইফতার করলেন, একটু পানি দ্বারা। নামাযের পর কিছুক্ষণ আম্মার পায়ের কাছে বসে থাকলাম। নানীর মউতের সময়ের কিছু অবস্থা বললেন। আম্মার দিলে মাশাআল্লাহ্ খুব ইতমিনান যে, মুমিনের মউত যেমন সুন্দর হওয়ার কথা তেমনি সুন্দর হয়েছে। মুমিনের দিলের এই যে, বিশেষ করে মায়ের জন্য সন্তানের দিলের এই যে সাক্ষ্য আল্লাহর কাছে এর মূল্য অনেক।

***

নানীর কথা একটু দীর্ঘ করে বললাম, নানার কথাও বলতে চাই একটু বিশদ করে। আম্মার নিশ্চয় ভালো লাগবে। নিজের মায়ের কথা, বাবার কথা, বুড়ো সন্তানেরও তো বলতে এবং শুনতে ভালো লাগে! বিশেষ করে সেটা যদি হয় নিজের সন্তানের কলম থেকে! আমারও অনেক সৌভাগ্য যে, আম্মাকে তাঁর আম্মার কথা, আব্বার কথা লিখে শোনাতে পেরেছি। আল্লাহ্ তাওফীক দিয়েছেন। তোমার শোকর হে আল্লাহ্! তোমার শোকর! 

(লেখাটির বিন্যাস অসুন্দর হওয়ার জন্য দুঃখিত!)

(চলবে ইনশাআল্লাহ্)

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা