শাবান ১৪৩৯ হিঃ (৩/৪)

সম্পাদকের রোযনামচা

সম্পাদকের রোযনামচা

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

সম্পাদকের রোযনামচা

২৯-৬-৩৯ হি.

পুষ্পের সম্পাদনাকে অবলম্বন করে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা তো হলো!

যে জিনিসটা আমাকে বেশী পীড়া দেয় তা হলো লেখার প্রতি কারো কারো অযতœ, অবহেলা, অবজ্ঞা ও নিশ্চেষ্টতা। এভাবে যদি লেখা শেখা এবং লেখক হওয়া যেতো তাহলে তো দেশ এত দিনে লেখকের ভিড়ে ...।

যে কোন কাজে সফলতার জন্য পরিশ্রম ও সাধনা অপরিহার্য, লেখা ও কলমচালনার মত নাযুক বিষয়ে তো এটা আরো বড় সত্য। মানুষের চেষ্টার অসাধ্য কিছু নেই, কিন্তু আমরা চেষ্ট করি কতটুকু!

একথাগুলো এখন বেশী করে মনে পড়লো দু’টি কারণে। প্রথম কারণ, একজন একটি লেখা পাঠিয়েছে ছেঁড়া কাগজে। শুরু থেকে শেষ, অযতেœর ছাপ। অথচ লেখার শেষ বাক্যটি হলো, ‘আমি স্বপ্ন দেখি ইসলামী সাহিত্যের আকাশে এক উজ্জ্বল তারকা হওয়ার।

দেখো, স্বপ্ন দেখতে বাধা কোথায়? অনেক তারকার মেলায় আকাশে এখনো জায়গা আছে নতুন তারকার! তবে...

দ্বিতীয় কারণ, নয়াদিগন্তের একটি ছবি। অস্ট্রেলিয়ার এক প্রতিবন্ধী যুবক হুইল চেয়ারে করে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেষ্ট জয়ের অবিশ্বাস্য এক অভিযানে নেমেছেন। স্কট ডোলান নামে ২৮বছরের এ যুবক বলেন, অদম্য ইচ্ছাশক্তি থাকলে যে, যে কোন বাধা অতিক্রম করে যে কোন লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব সেটা আমি প্রমাণ করতে চাই।

মূল অভিযানের আগে দীর্ঘ নয় মাস তিনি কঠোর অনুশীলন চালিয়েছেন। গত শুক্রবার শুরু হয়েছে তার মূল অভিযান।

এই যুবকের মত একজনও কি আছে কলমের সাধনার জগতে! তারপরো যারা স্বপ্নের কথা বলে...

১-৭- ৩৯ হি.

‘না’ বলুন; ‘হাঁ’ বলুনÑ এটা এখন লেখার অঙ্গনে বেশ চালু জিনিস। মাদক ও নেশা দ্রব্যকে না বলুন। দেশীয় পণ্যকে হাঁ বলুন, ইত্যাদি। এটা ইংরেজির অনুকরণে বাংলায় শুরু হয়েছে, যা খুব সাদামাটা ও ‘মুবতাযাল’ উসলূবÑ অভিজাত ও মহাগুরুত্ব-পূর্ণ কোন ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ গ্রহণযোগ্য নয় বলেই মনে হয়। সূদ এমন বিষয়, যার বিরুদ্ধে স্বয়ং আল্লাহ যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন! যদি আমি লিখি, সূদকে ‘না’ বলুন; খুবই হালকা হয়ে যায়। সুদ শুধু ‘না’ বলার বিষয় না, প্রচ-ভাবে ঘৃণা করার বিষয়। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়...; যা বলতে হয় তা বলা হয়ত সঙ্গত হবে না।

৩-৭-৩৯ হি.

আলকুদসসংখ্যা ৪৯ পৃ. শিরোনাম হলো, ‘হতাশ কেন হও! ঐ দেখো আশার আলো!!’ প্রথমে ছিলো, ‘হতাশ হয়ো না, ঐ যে আশার আলো দেখা যায়!’ প্রথমে মনে হলো, নিষেধের পরে আদেশ/অনুরোধ ভালো হবে, শব্দও একটা কম হবে। তাই লিখলাম, ‘হতাশ হয়ো না, ঐ দেখো আশার আলো!’ তারপর মনে হলো, প্রশ্নের শৈলীতে নিষেধের বক্তব্য আরো জোরালো হয়। তাই লিখলাম, ‘হতাশ হও কেন! ঐ দেখো আশার আলো!!’

এই শিরোনামের নীচে একটি বাক্য, ‘কিন্তু যদি আমরা অতীতের দিকে ফিরে তাকাই তাহলে সহজেই বুঝতে পারবো যে, আল্লাহ্র রহমত থেকে নিরাশ হওয়ার কোন কারণ নেই।’ দৌড়ের উপর লেখা এমনই হয়! শব্দ খরচ হয়েছে প্রচুর, বক্তব্য সামান্য। দেখুন তো যদি লিখতাম, ‘কিন্তু আমাদের গৌরবময় অতীত শিক্ষা দেয় যে, আল্লাহ্র রহমত থেকে...’ কেমন হতো? আসলে যতœ ও পরিচর্যার কোন বিকল্প নেই।

অবশ্য প্রথম বাক্যটির পক্ষে বলা যায় যে, এখানে যে দৃশ্যটি রয়েছে, সামনের অন্ধকার পথের জন্য আলোর সন্ধান পাওয়ার আকুতি নিয়ে ব্যাকুল বে-কারার মুসাফিরের পিছনের দিকে ফিরে ফিরে তাকানোর যে দৃশ্যটি, দ্বিতীয় বাক্যে তা অনুপস্থিত। বাক্যটি একটু পরিমার্জিত হতে পারে এভাবে, ‘কিন্তু যদি অতীতের কাছে ফিরে যাই, সেখানে এ শিক্ষাই পাবো যে, ... 

৯-৭- ৩৯ হি.

আলকুদ্সসংখ্যার সম্পাদকীয়তে ‘ঢাল’-এর জলছাপ দিয়ে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, সময় আবার পিছনের দিকে ফিরে যাবে, প্রযুক্তির অস্ত্রনির্ভর যুদ্ধের পরিবর্তে আবার শুরু হবে সাহস ও বীরত্বনির্ভর সম্মুখ লড়াই। আর সে যুদ্ধে আল্লাহর ইচ্ছায় তারাই হবে জয়ী যারা সাহস ও শৌর্যের অধিকারী।

১০-৭- ৩৯ হি.

আলকুদস্সংখ্যার সম্পাদকীয়-এর প্রথম পাতার শেষ বাক্যটি হলো, ‘আমাদের ঈমান সুপ্ত তবে মৃত নয়’; এমন হলে মনে হয় ভালো হতো, ‘আমাদের ঈমান সুপ্ত, তবে বিলুপ্ত নয়’।

১২-৭-৩৯ হি.

একজন নামী লেখকের একটা লেখার প্রথম বাক্য হলো, ‘কালের বাগানে কলমের লাঙ্গল চালিয়ে সময়ের চাষ করেন শিল্পী।’

মনে হতে পারে, বেশ তো বাক্যটি! নতুনত্বের আনকোরা ছাপ রয়েছে!! কিন্তু একটু চিন্তা করলে দেখা যাবেÑ

(ক) কালের মূল বৈশিষ্ট্য হলো প্রবাহ। বাগানে অবশ্য বিভিন্ন মৌসুম আসে যায়, কিন্তু এটা বাগানের মূল্য বৈশিষ্ট্য নয়, মূল বৈশিষ্ট্য হলো ফুল ও ফল এবং সবুজের সজীবতা। সুতরাং ‘কালের বাগান’ উপমাটি সুসঙ্গত নয়।

(খ) ‘কলমের লাঙ্গল দিয়ে চাষ করা’, এখানে যে চিত্রকল্পটা আপনার সামনে মূর্ত হয় তাকি খুব হৃদয়গ্রাহী?! হৃদয়গ্রাহিতা যে কোন চিত্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতার জন্য অপরিহার্য।

(গ) সময়ের চাষ করা, কথাটা যথেষ্ট দুর্বোধ্য; পড়বো, আর বুঝে ফেলবো, এমন তো নয়ই, অনেক চিন্তাভাবনার পরো বুঝে আসার কথা নয়। যদি এমন করে বলি, ‘কালের বাগানে কলমের লাঙ্গল চালিয়ে সময়ের/ জীবনের ফসল উৎপন্ন করেন যারা... হয়ত অপেক্ষাকৃত ভালো হবে।

এটা আমার মত; মতান্তর হতেই পারে, তবে যে কোন মত চিন্তা-পুষ্ট ও যুক্তিসমৃদ্ধ হওয়া উচিত। শুধু ‘আমি মনে করি’ বলা যথেষ্ট নয়।’

১৩-৭-৩৯ হি.

তৃতীয় সংখ্যাটি ছাপার ক্ষেত্রে যে অভাবনীয় জটিলতা হলো, কী আর বলবো! তিনবার ছাপাখানা বদল করতে হয়েছে।

কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করতে হয়, ‘আমার বাবা’ যথেষ্ট সঙ্গ দিয়েছে। প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে, পত্রিকার পুরো সজ্জা, মূল কাজ সে-ই করেছে। প্রচ্ছদে মেঘের আড়াল থেকে ‘পুষ্প’ যেভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে! যেন আসমানের দান আসমান থেকে নেমে আসছে!

তাছাড়া সুলতান আব্দুল হামীদ রহ. সম্পর্কে লেখাটা, মনেই হয় না, এর লেখক, কলমের পথে নতুন মুসাফির। উর্দুতে বলে, ‘আল্লাহ্ ক্যেের, যোারে ক্ব্যল্যম আওর যিয়াাদা!’

আমার দু‘আ তার জন্য, তাঁর প্রজন্মের প্রতিটি উদ্যমী ও নিবেদিতপ্রাণ তরুণের জন্য, আল্লাহ সবাইকে দান করুন, নূরে কলম এবং যোরে কলম।

১৪-৭-৩৯ হি.

আল্লাহর রহমতে যথেষ্ট লেখা এসেছে এবং আসছে। সামগ্রিক-ভাবে আশাপ্রদ এবং আমার সম্পাদনার জন্য বড় সহায়ক। আল্লাহ করুন, এখান থেকে কিছু নতুন কলম যেন উঠে আসে, শানদার, জানদার এবং ঈমানদার!!

জীবনের পড়ন্ত বেলায় এখন তামান্না তো এটাই যে, নতুন প্রজন্ম এগিয়ে আসুক, পূর্ণতার সঙ্গে, ঋদ্ধতার সঙ্গে এবং আত্ম-নিবেদনের সঙ্গে। আমি চাই বার্ধক্যগ্রস্ত কাঁধ থেকে তরুণ কাঁধে দায়িত্বটা তুলে দিতে।

১৫-৭-৩৯ হি.

আল্লাহ্র রহমতের কি কোন শেষ আছে! গত সংখ্যার সম্পাদকীয় কী হবে, কীভাবে হবে, ভেবে যখন হয়রান। তখন কীভাবে যেন নয়াদিগন্তে মাসুদ মজুমদারের লেখাটা নযরে এসে গেলো, আর আমি আস্ত সম্পাদকীয়টা পেয়ে গেলাম। কারো যদি ইচ্ছা হয়, নয়াদিগন্তে /.../ তারিখের লেখাটা দেখতে পারে। যথেষ্ট ফায়দা হবে বলে আশা করি। মাসুদ মজুমদার আমার দেখা মানুষদের কেউ নন, তবে তার লেখা আমার পছন্দ! চিন্তায় গভীরতা এবং বিষয়বস্তুর প্রতি আন্তরিকতা রয়েছে। বিশ্বাস থেকে লেখেন এবং লেখার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করেন। আমার এরকমই মনে হয়েছে। তাকে ‘জাযাকাল্লাহ্!’

১৬-৭-৩৯ হি.

অধিকাংশ লেখা মাদরাসাতুল মাদীনাহ্র ছাত্রদের! কিন্তু পুষ্প তো শুধু মাদরাসাতুল মাদীনাহ্র নয়, আমার দেশের প্রতিটি শিশু, কিশোর ও তরুণের। পুষ্পের জন্য আমি চাই সবার কলমের কালি! সবার চোখে পানি!! সবার হৃদয়ের স্পন্দন!!

১৭-৭-৩৯ হি.

আল্লাহর যত শোকর আদায় করি, কম হবে। কিছু ছেলের মধ্যে, চিন্তার সমৃদ্ধি দেখতে পাই, লেখার মধ্যেও অনুভব করি দরদের ছাপ! হোক না, খুব সামান্য মাত্রায় এবং ন্যূনতম স্তরে। পথ যত অতিক্রম করবে, সামনের দিকে যত অগ্রসর হবে, তত.... ইনশাআল্লাহ্।

একটি ছোট্ট ছেলে লিখেছে তার রোযনামচায়, ‘আদীব হুযূর এত কষ্ট করে এত মমতার সঙ্গে আমাদের জন্য লিখছেন, আমরা যদি যতেœর সঙ্গে তা না পড়ি এবং তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করি তাহলে ক্ষতি কার? আমাদেরই তো!!

দূর থেকে খুব নিকটের তোমাকে আমার শুভ কামনা হে প্রিয়!!

১৮-৭-৩৯ হি.

একজন লিখেছে, এসব ‘পাথুরে অনুশোচনায়’ কী কাজ হবে! অনুশোচনার ছিফাতরূপে শব্দটা খুবই ‘পাথুরে’!! হয়ত উদ্দেশ্য, এমন অনুশোচনা যাতে হৃদয়ের বিগলিতি নেই। এক্ষেত্রে মুফরাদ ছিফাতের পরিবর্তে প্রলম্বিত শৈলী উত্তম, যথাÑ কী হবে এমন অনুশোচনায় যাতে হৃদয়ের উত্তাপ নেই, অশ্রুর উষ্ণতা নেই!!

১৯-৭-৩৯ হি.

তৃতীয় সংখ্যা এখনো ছাপাখানায় এবং  বেশ জটিলতার আবর্তে পড়েছে। তবে আমি বসে থাকতে প্রস্তুত নই। চতুর্থ সংখ্যার কাজ ইতিমধ্যে শুরু করেছি এবং প্রায় ২৫ পৃষ্ঠা লেখা হয়েছে। তৃতীয় প্রকাশনা আমার পরিকল্পনার বাইরে শুরু যখন হয়েছেই, নিজেকে উজাড় করেই দিতে চাই তাদেরকে যারা সত্যিকার অর্থেই পেতে চায় পুষ্পের সুবাস।

সম্পাদকীয়টা শুরু করেও থমকে আছে। ভিতর থেকে সেই প্রবাহটা আসছে না, যার দ্বারা একটি লেখা হয় হৃদয়রসে সিক্ত এবং আলোর পরশে ...!

মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক, এই সব সাপ-বিচ্ছুর দংশন থেকে আমাদের ‘কোমল’ প্রজন্মকে কীভাবে রক্ষা করা যাবে, কোন উপায় দেখতে পাচ্ছি না।

মাওলানা আব্দুল মালিক ছাহেবের সঙ্গে কথা হলো। তাঁকে অনুরোধ করলাম, এবিষয়ে কিছু লেখার জন্য। সর্বমহলে তাঁর কথার গুরুত্ব ও কদর রয়েছে।

এ বিষয়ের উপরই সম্পাদকীয় লেখার নিয়ত করেছি এবং শুরুও করেছি। বাকি আল্লাহর ইচ্ছা।

২২-৭-৩৯ হি.

স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা নামে নতুন বিভাগ শুরু করছি এ সংখ্যা থেকে। এ বিষয়ে আমাদের জ্ঞান ও সচেতনতা খুবই কম।  আমাদের কিছু সন্তান একটু যদি জেগে ওঠে।

গত সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ। এর প্রয়োজনীয়তা তো আরো বেশী!

প্রত্যক্ষরূপে ধর্মীয় বিষয়ই শুধু হবে আমাদের লেখার ক্ষেত্র, এটা ঠিক নয়। জীবন ও জগতের সবকিছুই হতে লেখার বিষয়, যাতে উদ্ভাসিত হবে আল্লাহর কুদরতের কারিশমা!!

৮-৮-৩৯ হি.

উম্মে আফনান বললো, দুপুরে এমন একটা নির্জনতা বিরাজ করে, মনে হয়, নৈঃশব্দের সাগরে ডুবে আছি। এর মধ্যে একটা দু’টো পাখী কুরুণ স্বরে কাকে যেন ডাকে, তখন মনে হয়, আমার ভিতরের পাখীটাই বুঝি আমাকে ডাকে!

আমি বললাম, আম্মু, ভিতরের সেই পাখীটার কথাই এবার লিখেছি ‘আমাকে’ শিরোনামে। এসো তোমাকে শোনাই। তুমিই হবে আমার এ লেখাটির প্রথম ‘শ্রোতা’।

শোনালাম। আমার বিশ্বাস, সব লেখাই তো আল্লাহর দান, তবে এ লেখাটি সরাসরি আল্লাহর দান! এ লেখাটির জন্য আমি আমার জীবনের সমস্ত সম্পদ হাসিমুখে উৎসর্গ করতে পারি।

একদিন দুপুরে হযরতপুরে, সুন্দর একটি নির্জনতা ছিলো, যাকে বলে ‘মনকেমনকরা’ নির্জনতা!

এমন সময় একটি কোকিল বারবার ডাকছিলো বড় করুণ সুরে! তাতে অনির্বচনীয় এক ভাবতরঙ্গ জেগেছিলো হৃদয়ে গভীরে।

একটা প্রশ্ন বারবার মনকে দোলা দিয়ে যায়, কে এই পাখীটি? কার জন্য তার এ করুণ ডাক?

দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। বিষণœ সূর্যটি আমাকে আরো বিষণœ করে বিদায় নিলো। পশ্চিম দিগন্তে আশ্চর্য রকম লাল আভা, যা অগে দেখিনি! মন তাতে আরো যেন কেমন করে উঠলো।

কোকিলটি কি তার সঙ্গীকে হারিয়েছে?! হয়ত তাই! এরপর কল্পনায় যত দৃশ্য দেখতে পেলাম। কল্পনার রঙতুলিতেই তা লিখলাম। নিজের অজান্তেই চোখ থেকে তখন অশ্রু ঝরছে, আজকের নির্জন দুপুরের দুঃখী পাখীটির প্রতি সহানুভূতির কারণে। আমার কল্পনার সেই লেখাটিই হলো, ‘সঙ্গীর জন্য পাখীর মর্মবেদনা’।

লেখাটি শেষ হলো গভীর রাতে। একটি লেখা শেষ হওয়ার পর যে তৃপ্তি অনুভব করার কথা তা হলো না!

মনে হলো, এখনো আমি আমার অন্তরের প্রশ্নটির উত্তর পাইনি! কে  ঐ পাখীটি? কার জন্য ছিলো তার এমন করুণ ডাক! হঠাৎ ভিতর থেকেই যেন একটা উদ্ভাস আমাকে আলোকিত করে দিলো! সেই পাখিটি আমার ভিতরের আমি নই তো!! তার ডাক কি আমারই জন্য!!

এমনও তো হতে পারে, আমার ভিতরের সেই পাখীটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য নির্জন দুপুরের ঐ পাখীটিকে ‘পাঠানো’ হয়েছিলো!!

বিশ্বাস হলো, কিংবা বিশ্বাস করতে ভালো লাগলো যে, এটা আমার প্রতি আকাশের করুণা!! হয়ত তিনি চান, আমি যেন আমার ভিতরের দিকে তাকাই। আমার ভিতরের ‘আমি’কে যেন চিনতে পারি! রূহ ও আত্মা নামের সেই ‘আমি’ যার কথা কোরআন সুন্নায় এসেছে! মৃত্যুর সময় যা বের হয়ে যায়, কারো ভিতর থেকে কষ্ট পেয়ে, কারো ভিতর থেকে শান্তি পেয়ে! যা কাউকে অভিশাপ দিয়ে যায়, কাউকে মুবারকবাদ দিয়ে যায়। সেটাকেই আধ্যাত্মবাদীরা ‘পাখী’ বলে কল্পনা করেন।

তো কল্পনায় দেখতে পেলাম আমার ভিতরের সেই পাখীটিকে অপরিচয় থেকে ধীরে ধীরে পরিচয়, তারপর অন্তরঙ্গতা, তারপর কিছু কথোপকথন। সেই কল্পনা কলমের ঝরণা বেয়ে প্রবাহিত হলো কাগজের বুকে ‘আমাকে’ শিরোনামে। লেখা শেষ হলো, আর বড় মধুর এক আত্মিক প্রশান্তিতে আমার অন্তর্সত্তা অবগাহন করলো। একই উৎস থেকে একই সঙ্গে দু’রকমের দু’টি লেখা সম্ভবত জীবনে এই প্রথম। শোকর আমার আল্লাহর!

১২-৮-৩৯ হি.

ছেলে জানে না, আমি এখন মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। আমার চোখের দু’টি তারা থেকে ওর জন্য কল্যাণপ্রার্থনার শিশির ঝরছে।

আমার থেকে একটু দূরে বসে লিখছে ‘সুলতান আব্দুল হামীদ রহ.’ ...। একটা তন্ময়তা, একটা আচ্ছন্নতা, একটা আত্ম-সমাহিত অবস্থা তার চারপাশে যেন একটা আলোর বলয় তৈরী করেছে! একটা লেখা হয়, লেখক লেখার বাইরে অবস্থান করেন! আরেকটা লেখা হয়, লেখক লেখার ভিতরে প্রবেশ করে নিজেকে তার মধ্যে বিলীন করে দেন। তখনই হয় আলোকিত লেখা! আল্লাহর শোকর আমার দুর্বল কমযোর ছেলের মধ্যে এই তন্ময়তাটি এসেছে। আল্লাহ দান করেছেন। এ লেখা পড়ে কে কী ভাবলো, তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আল্লাহ সাক্ষী, আমার কোন তালিবে ইলমের মধ্যে যদি এটা দেখতে পেতাম একই রকম খুশী হতাম। আমি তো সারাটা জীবন ওদের পিছনেই ফানা করেছি। কিছু তো হলো না!! হলো না তো হলোই না। জীবনের পড়ন্ত বেলায় যাওয়ার আগে আল্লাহ ছেলের মধ্যে এই কাক্সিক্ষত রূপটি দেখালেন। অথচ তার কলমের জন্য একদিন সময় দিয়েছি, মনে তো পড়ে না। তবে একটা আকুতি ছিলো ...!

ব্যস, নেয়ামতের তাহদীছ করলাম। নিয়তের ত্রুটি আল্লাহ যেন সংশোধন করে দেন। আল্লাহ নযরে বদ থেকে হেফাযত করেন। আমি বড় দুঃখী মানুষ। রিক্ত, নিঃশ্ব মানুষ স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় বিপর্যস্ত একজন মানুষ। যাওয়ার আগে আমার ‘কলম’টি কোন আমানতদার হাতের কাছে রেখে যেতে চাই। সেই হাত একটি কেন, একশটি হতে পারে। কামনা তো তেমনই ছিলো! স্বপ্ন তো তেমনই দেখেছিলাম। আমার এই স্বপ্নের পূর্ণতার জন্য যারা দু‘আ করবে আল্লাহ তাদের উত্তম থেকে উত্তম বিনিময় দান করুন।

১৪-৮-৩৯ হি

এবারের প্রথম কথায় প্রথমে লিখেছিলাম, ‘ইসলামের পরিচয়, ঈমান ও ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক, শুধু এটুকু কি যথেষ্ট নয় তোমার কাছ থেকে একটু সদয় ব্যবহার ও সৌজন্যপূর্ণ আচরণ পাওয়ার জন্য?

লিখলাম কিন্তু মনে হলো, ঠিকমত যেন হলো না! আগের সঙ্গে একটু তাকরার হয়ে যাচ্ছে! তাছাড়া খুব গতানুগতিক। হঠাৎ পছন্দের বাক্যটি পেয়ে গেলামÑ

ইসলামের পরিচয়, ঈমান ও ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক, শুধু এটুকু কি যথেষ্ট নয় তোমার মুখের একটু হাসি, তোমার অন্তরের একটু উত্তাপ পাওয়ার জন্য?

দু’টি বাক্য পাশাপাশি রেখে তুলনা করে পড়া যেতে পারে। আশা করি, পার্থক্যটি বুঝতে কষ্ট হবে না।

তারপর লিখেছিলামÑ

হয়ত আমার দাবী, আব্দার বা অনুরোধ রক্ষা করা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু এই কথাটা কি তুমি একটু হাসিমুখে, একটি সৌজন্যের সঙ্গে বলতে পারতে না।

খুব কী আবেদনপূর্ণ হলো?! হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়, এমনকি হলো?! হলো না!

কী হতে পারে! চিন্তা করে কিছু খুঁজে পাই না। হঠাৎ একটি আরবী লেখা নযরে এলো

الرفض والاعتذار আর সঙ্গে সঙ্গে চিন্তার মধ্যে ঝিলিক দিয়ে উঠলোÑ

হয়ত আমার দাবী, আব্দার বা অনুরোধ রক্ষা করা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু প্রত্যাখ্যান ও অক্ষমতার পার্থক্যটুকু কি রক্ষা করা যায় না!

১৬-৮-৩৯ হি.

৭৯ পৃষ্ঠার শিরোনামহীন লেখাটি আকাশের দানরূপে হঠাৎ করে পেলাম একজনের ছোট্ট একটি কষ্ট দেয়া থেকে। প্রথমে লিখেছিলাম, চলার পথে কেউ আনন্দ দেয়, কেউ কষ্ট দেয়...

মনে হলো, উভয় ক্ষেত্রে একই উসলূব হলে উভয়ের সমমর্যাদা প্রকাশ পায়। অথচ প্রথমজনের প্রতি কৃজ্ঞতা হৃদয়ের, দ্বিতীয়জনের প্রতি কৃতজ্ঞতা যুক্তির। তাই উভয় অংশের মধ্যে পার্থক্য প্রকাশ করা দরকার। তখন লিখলামÑ

চলার পথে যাদের দেখা পাই, কেউ দেয় আনন্দ, কারো কাছ থেকে পাই কষ্ট।

এখন মনে হচ্ছে এমন হলে আরো ভালো হতোÑ

 কেউ দেয় ফুল, কেউ দেয় কাঁটা।

‘সমমর্যাদা প্রকাশ পায়’ প্রথমে মনে হয়েছিলো, এখন মনে হচ্ছে, আনন্দ ও কষ্ট এবং ফুল ও কাঁটা এ দু’টো দ্বারা এমনিতেই পার্থক্য নির্ধারিত হয়ে যায়! অন্তরে সমমর্যাদার ধারণা আসে না।

এগুলো হলো চিন্তা, সব চিন্তা ঠিক হবে, জরুরি নয়, তবে লেখার প্রতিটি অংশ সম্পর্কে বিভিন্ন দিক থেকে, বিভিন্নভাবে চিন্তা করা অবশ্যই দরকার।

১৪-এর পাতায় ডান দিকে শেষ লাইনে ছিলো, ‘পুষ্পকে আমাদের মনে হয় ব্যথার মলম!’

আমার মনে হলো, ফার্মেসিভাব এসে গেছে। তাই সম্পদানা করে লিখেছি, ব্যথার উপশম। ‘কলম আমার ব্যথার মলম’ এটা ঠিক আছে। কলম শব্দটির প্রতিবেশিতার কারণে এখানে ঐ ভাবটা আসে না, চিন্তায় শুধু সান্ত¦নার ভাবটা আসে।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা