যিলক্বদ ১৪৩০হিঃ (১৪)

সম্পাদকের রোযনামচা

সম্পাদকের রোযনামচা

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

২০-১০-৩০ হিঃ

‘বাইতুল্লাহর মুসাফির’-এর সম্পাদনা সম্পূর্ণ করা গেলো না। সবাই পরামর্শ দিলেন, যেভাবে আছে সেভাবেই এখন ছাপা হোক; কারণ পুষ্প অনেক পিছিয়ে যাচ্ছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরামর্শটি মেনে নিতে হলো। আজ পুষ্পের কাজ শুরু করলাম। সম্পাদকীয়টি আগেই লেখা ছিলো।

পুষ্পের বন্ধু মুহম্মদ আনাসকে গত সংখ্যার সম্পাদক নির্বাচন করা হয়েছিলো, কারণ তার লেখা ‘কলম আমার সঙ্গী’ (যা গত সংখ্যায় পৃষ্ঠা-১৭এ ছাপা হয়েছে) থেকেই আমি এসংখ্যার সম্পাদকীয় ‘কলমের প্রতি কৃতজ্ঞতা’ লেখাটির প্রেরণা লাভ করেছিলাম। তার লেখাটি সম্পাদনা করতে গিয়ে হৃদয়ের গভীরে অপূর্ব একটি তরঙ্গদোলা অনুভূত হলো, ‘কলম আমার দিলের যখমে মরহম রেখে দেয়’ বাক্যটি আমাকে এমনই আত্মহারা করলো যে, আমি হারিয়ে গেলাম ভাবের জগতে। হঠাৎ আমার ভিতরে রিমঝিম করে উঠলো একটি কথা, ‘কলম আমার ব্যথার মলম’। হৃদয়ে যখন ভাবের তরঙ্গ জাগে তখন লিখতে হয় না, লেখা তখন এসে যায়। আমার লেখাটিও মুহূর্তের মধ্যে এসে গিয়েছিলো।

২৫-১০-৩০ হিঃ

আমার জীবনে সুখের এবং আত্মিক আনন্দের অল্প যে ক’টি দিন আছে, আজকের দিনটি সেগুলোর মধ্যে একটি। আজ ‘বাইতুল্লাহর মুসাফির’ ছাপা হয়ে এসেছে। সন্ধ্যার পর শাহাদাত প্রথমে আমার হাতে ফুলের তোড়া তুলে দিয়ে আমাকে অভিনন্দন জানালো, তারপর ‘বাইতুল্লাহ মুসাফির’ হাতে দিলো। যদিও এধরনের আড়ম্বর আমার পসন্দ নয়, তবু তাকে তিরস্কার করলাম না; কারণ সে যা করেছে হৃদয় থেকেই করেছে। প্রথম নোসখাটি দিলাম ...

২৬-১০-৩০ হিঃ

আমার মেয়েদু’টির অনুভব অনুভূতি আমাকে খুবই অভিভূত করে। আর কিছু না হোক, ওরা কিছু সুন্দর অনুভব অনুভূতি অর্জন করতে পেরেছে, আলহামদু লিল্লাহ। বড় মেয়েকে বললাম, আগামীকাল কুরিয়ার সার্ভিসে তোমার জন্য ‘বাইতুল্লাহর মুসাফির’ পাঠিয়ে দিচ্ছি। সে বললো, না, আব্বু! আমি নিজে এসে তোমার হাত থেকে নেবো। তোমার হাত থেকে নেয়ার সৌভাগ্য লাভের জন্য অল্প ক’টি দিন আনন্দের সঙ্গেই আমি প্রতীক্ষার বেদনা বরণ করে নেবো। এরকম অনুভূতি মানুষকে হৃদয়ের সম্পদে অনেক সমৃদ্ধ করে।

২৭-১০-৩০ হিঃ

‘বাইতুল্লাহর মুসাফির’ যখন আল-কাউছারে প্রকাশিত হয় তখন প্রারম্ভটা ছিলো এই- ‘পৃথিবীর সব মানুষেরই কোন না কোন স্বপ্ন থাকে এবং স্বপ্ন দেখেই মানুষ বেঁচে থাকে। স্বপ্নই মানুষের জীবন এবং স্বপ্নই জীবনের অবলম্বন।’

গ্রন্থাকারে প্রকাশের জন্য যখন সম্পাদনা করতে বসলাম, হঠাৎ মনে হলো, বাইতুল্লাহর মুসাফির সমাপ্ত করা হয়েছে ‘আল্লাহ’ এই মহান শব্দটি দিয়ে, যদি কিতাবের প্রথম শব্দটিও ‘আল্লাহ’ হয় তাহলে কত ভালো হয়! তদ্রূপ প্রথমে আলোচনা হওয়া দরকার আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্কের স্বরূপ এবং বাইতুল্লাহর হাকীকত ও তাৎপর্য; তারপর যদি যিয়ারাতে বাইতুল্লাহর স্বপ্নের কথা বলা হয় তাহলে বিষয়টি অনেক বেশী আবেদনপূর্ণ ও মর্মসমৃদ্ধ হয়।

কীভাবে লেখা যায়, ভাবতে ভাবতে কয়েক দিন চলে গেলো। তারপর হঠাৎ মযমূনটি দলে এসে গেলো এবং এক মজলিসেই লেখা হয়ে গেলো। আসল কথা হলো, কলমকে মমতা ও ভালোবাসা দিতে হবে এবং লেখাকে দিতে হবে প্রয়োজনীয় যত্ন ও পরিচর্যা। তাহলেই লেখা হবে সুন্দর ও হৃদয়গ্রাহী। বাইতুল্লাহর মুসাফির প্রথম পৃষ্ঠায় একটি বাক্য আছে এরকম, ‘যে বান্দা যত বেশী চায়, তার প্রতি আল্লাহ তত বেশী খুশী হন।’

‘হন’ শব্দটির এখানে প্রয়োজন ছিলো না; তদুপরি ‘বেশী খুশী’-এর একত্র উচ্চারণ ততটা সুন্দর নয়। যদি বলা হতো, ‘যে বান্দা যত বেশী চায়, তার প্রতি আল্লাহ তত বেশী রাযী-খুশী’ তাহলে আরো ভালো হতো।

৯-১১-৩০ হিঃ

লেখার সম্পাদনা করতে করতে এখন আমার অবস্থা এই যে, স্বপ্নেও আমি সম্পাদনা দেখি। কিছু দিন আগে দেখি, একটি বাক্য লিখেছি, ‘জীবনে সুখ যত বেশী হবে, জীবন তত দ্রুত ফুরিয়ে যাবে, আর জীবনে দুঃখ যত বেশী হবে জীবন তত দীর্ঘ হবে।’ তারপর স্বপ্নেই মনে হলো, বাক্যটি দীর্ঘ হয়ে গেছে, তদুপরি গাঁথুনিটা হয়েছে শিথিল। এভাবে লেখা যেতে পারে, ‘সুখের জীবন দ্রুত ফুরিয়ে যায়, দুঃখের জীবন হয় দীর্ঘ। হোক না দুঃখের, তবু জীবন যেন দীর্ঘ হয়!’

ঘুম থেকে জেগে প্রথম বাক্য এবং সম্পাদিত বাক্য দু'টোই লিখে ফেললাম। পরে মনে হলো, শেষের কথাটি শুরুতে হলে এবং এভাবে হলে ভালো হবে- ‘সুখের চেয়ে দুঃখই আমার প্রিয়, কারণ সুখের জীবন দ্রুত ফুরিয়ে যায়, আর দুঃখের জীবন হয় দীর্ঘ।’ বক্তব্যের প্রথম অংশটি যেহেতু কৌতূহলোদ্দীপক, সেহেতু স্রোতা পরবর্তী অংশে গিয়ে এর কারণ জানার জন্য আগ্রহী হবে। পক্ষান্তরে ‘সুখের জবীন দ্রুত ফুরিয়ে যায়.... এটি স্বাভাবিক কথা, যা সবাই জানে, সুতরাং তা পরবর্তী বক্তব্যের প্রতি পাঠকচিত্তকে আকৃষ্ট করবে না। এভাবে স্বপ্নের মধ্যেই একটি বাক্য ও তার সম্পাদনা পেয়ে গেলাম।

আজ স্বপ্নে দেখি, বানানভুলের জন্য একছাত্রকে তিরস্কার করছি। সে বলছে, মাদরাসায় পড়ে আমাদের কোন ভবিষ্যৎ নেই। কথাটা শুনে কষ্ট হলো, তাই রাগত স্বরে বললাম, ভবিষ্যৎ বানান করো। সে বললো, দন্ত্য-স। আমি বললাম, মাদরাসায় পড়ার কারণে নয়, আসলে ভবিষ্যতের বানান জানা নেই বলে আমাদের কোন ভবিষ্যৎ নেই। প্রসঙ্গত, যদি খণ্ড-ৎ এর ব্যবহার বাংলায় রয়েছে, আমার মনে হয়, অতি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র ছাড়া খণ্ড-ৎ এর পরিবর্তে ‘ত’ ব্যবহার করাই ভালো। কারণ একই শব্দে ভিন্ন অবস্থায় ‘ত’ ব্যবহৃত হয়, যেমন- ভবিষ্যতে, জগতে, বিদ্যুতের সংকট, ইত্যাদি।

১০-১১-৩০ হিঃ

গত সংখ্যার সম্পাদকীয়টি আজ আবার পড়লাম। আমার ধারণা, পুষ্পের লেখাগুলো আমি যতবার পড়ি, কোন পাঠক ততবার পড়ে না। সমালোচনার দৃষ্টিতে যত পড়ি আমার তত ফায়দা হয়। সম্পাদকীয়টিতে একটি বাক্য আছে এরকম- ‘তারা যখন আভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলেন, বা প্রতিশ্রুতি দেন তখন সত্য বলেন, কখনো মিথ্যা বলেন না এবং ভুলেও কোন মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেন না।’

আগে সম্ভবত ভাবিনি, এখন মনে হচ্ছে বাক্যটি সুন্দরই হয়েছে। ‘সত্য বলেন, কখনো মিথ্যা বলেন না’, এদু’টি বাক্যের সম্পর্ক হচ্ছে কথা বলার সাথে, সুতরাং বলা যায়, ‘সত্য কথা বলেন, মিথ্যা কথা বলেন না’, কিন্তু তাতে পুনরুক্তিদোষ ঘটবে। ‘মিথ্যা বলেন না’ এটি হচ্ছে তাকীদবাক্য, অর্থাৎ ‘সত্য বলেন’ বাক্যটিকে জোরালো করা হয়েছে। সেজন্য ‘কখনো’ শব্দটিকে সংযুক্ত করে বলা হয়েছে, ‘কখনো মিথ্যা বলেন না।’ এতে বাক্যটির জোরালোতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

তৃতীয় বাক্যটির সম্পর্ক হচ্ছে প্রতিশ্রুতির সঙ্গে। যেহেতু মিথ্যা কথা বলার চেয়ে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়া গুরুতর, তাই প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রে ‘ভুলেও’ কথাটি যোগ করা হয়েছে। বাক্যগুলো দু’ভাবে পড়ে পার্থক্যটা বোঝা যেতে পারে।

  • (ক) {তারা যখন কোন কথা বলেন, বা প্রতিশ্রুতি দেন} সত্য বলেন, মিথ্যা বলেন না এবং মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেন না। (এখানে ‘মিথ্যা’ শব্দটির পুনরুক্তি কানে বাজতে শুরু করেছে।)
  • (খ) সত্য বলেন, কখনো মিথ্যা বলেন না এবং ভুলেও কোন মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেন না। (প্রথম বাক্যটির চেয়ে পরবর্তী বাক্যদু’টি ক্রমান্বয়ে বড় হয়েছে। (এখন ‘মিথ্যা শব্দটির পুনরুক্তি কানে ততটা বাজে না)

আরেকটি বাক্য এই- ‘পক্ষান্তরে আন্তর্জাতিক নীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে অমুসলিম বিশ্বের সঙ্গে তারা বলেন অসত্য বা অর্ধসত্য, আর মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বলেন নির্জলা মিথ্যা। আমাদের সঙ্গে তারা সত্য কথা বলেন না, এমনকি অর্ধসত্যও না। তাদের প্রতিটি কথা হয় মিথ্যা এবং প্রতিটি প্রতিশ্রুতি হয় মিথ্য।’

এখানে শুধু ‘আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে’ লিখলে চলতো, কিন্তু ‘নীতি ও রাজনীতি’তে আলাদা সৌন্দর্য রয়েছে।

‘অমুসলিম বিশ্বের সঙ্গে তারা বলে অসত্য বা অর্ধসত্য’- এখানে ‘মিথ্যা’-এর পরিবর্তে ‘অসত্য’ ব্যবহার করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, অমুসলিম বিশ্বের সঙ্গে মিথ্যা বলারও একটা মাত্রা থাকে। তাছাড়া যদি বলা হতো ‘মিথ্যা বা অর্ধসত্য’ তাহলে ‘অর্ধসত্য’ শব্দটির সৌন্দর্য থাকতো না।

‘তাদের প্রতিটি কথা হয় অসত্য এবং প্রতিটি প্রতিশ্রুতি হয় মিথ্যা।’

বাক্যটি এভাবেও লেখা যেতো, ‘তাদের প্রতিটি কথা ও প্রতিশ্রুতি হয় মিথ্যা।’ কিন্তু বাক্যটির গতিময়তা তাতে ব্যহত হয়। যদি বলা হয়, ‘তাদের প্রতিটি কথা যেমন মিথ্যা হয়, তেমনি প্রতিটি প্রতিশ্রুতিও হয় মিথ্যা।’ তাহলে শব্দস্ফীতি ঘটে।

‘তাদের প্রতিটি কথা হয় মিথ্যা এবং প্রতিটি প্রতিশ্রুতিও হয় মিথ্যা।’ এখানে শব্দস্ফীতি নেই, কিন্তু পুনরুক্তিটা হবে খুবই দোষের। তাই ‘মিথ্যা’এর প্রতিশব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আর কথার বিপরীতে ‘অসত্য’ এবং প্রতিশ্রুতির বিপরীতে ‘মিথ্যা’-এর ব্যবহারও যথার্থ হয়েছে।

১২-১১-৩০ হিঃ

বর্তমান সংখ্যায় ‘তোমাকে’ এই শিরোনামে কী লিখবো এখনো খুঁজে পাচ্ছি না। আসলে ভিতর থেকে লেখার প্রবাহ যেটা, সেটা এখনো আসেনি। আল্লাহ যেন আসান করে দেন।

১৫-১১-৩০ হিঃ

বর্তমান সংখ্যার প্রথম কথা ও শেষ কথা লেখা হলো গতকাল। আজ পাঠকবন্ধুদের লেখাগুলো নিয়ে বসলাম। বেশ ভালো কিছু লেখা এসেছে। এসংখ্যার সম্পাদক নির্বাচনের জন্য তিনজনের সংক্ষিপ্ত তালিকা করেছি। সেখান থেকেই একজনকে চূড়ান্ত করা হবে। আল্লাহ যেন সবাইকে কবুল করেন।

১৭-১১-৩০ হিঃ

গত সংখ্যায় বিভিন্ন প্রকারের এত ভুলভ্রান্তি রয়ে গেছে যে, রীতিমত লজ্জাজনক বিষয়। অন্তত একজন যদি সাহায্যকারী হতো! কিন্তু আমার চারপাশে যারা বাস করে তারা আমার সঙ্গে বাস করে না। কথাটা অভিযোগের নয়, এমনকি অনুযোগেরও নয়, শুধু আক্ষেপের।

২০ - ১১ - ৩০হিঃ

১২-৪ তারিখে আমার এক প্রিয় ছাত্র মাহমূদুল হাসান লালমাটিয়া থেকে পরামর্শমূলক দীর্ঘ একটি চিঠি লিখেছে। পুষ্প যাতে ভিতরে-বাইরে আরো সুন্দর হয় এবং আরো বেশী গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয় সেজন্য সে কিছু সুচিন্তিত পরামর্শ পেশ করেছে। চিঠিটি পড়ে খুব ভালো লাগলো। আল্লাহ তাকে উত্তম বিনিময় দান করুন, আমীন।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা