রমযান ১৪৩০ হিঃ (১৩)

কাশগর ও কায়রো

ইরানে আমেরিকার অপরাধঃ মুসাদ্দিক থেকে আহমদি নেজাদ

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

ইরান সম্পর্কে আমেরিকার একটি অতীত অপরাধের (ভুলের নয়) খণ্ডিত স্বীকৃতি প্রদান করেই বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট সাহসী, সত্যবাদী, বাস্তববাদী এবং আরো কত কী বলে মুসলিম বিশ্বের বাহবা পেলেন, অথচ কেউ একবারও ভেবে দেখছে না যে, মিস্টার ওবামাও ইরানের ক্ষেত্রে একই উদ্দেশ্যে একই অপরাধ করে চলেছেন। আর অতীত অপরাধের স্বীকৃতি! সেটা না করে তো ওবামা সাহেবের উপায়ও ছিলো না। মার্কিন সংবিধানের বাধ্যবাধকতার কারণে পঁচিশ বছর পর পর রাষ্ট্রীয় গোপন দলিল প্রকাশ করতে হয়। তা থেকে বিশ্ববাসী এমনিতেই জেনে গিয়েছে, অতীতে ১৯৫৬ সালে আমেরিকা তার নিজের স্বার্থে ইরানে কী জঘন্য অপরাধ করেছিলো! হয়ত একই ভাবে আজ থেকে পঁচিশবছর পর প্রকাশ পাবে, বুশ এবং তার উত্তরসূরী ওবামা ইরানের বিরুদ্ধে কী জঘন্য অপরাধ করেছেন এবং করে চলেছেন, কিন্তু সেই বিলম্বিত জ্ঞান না ইরানের কোন কাজে আসবে, না মুসলিম বিশ্বের বাকি দেশগুলোর। আসলে শিক্ষা গ্রহণের জন্য ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকা চরম মূর্খতারই নামান্তর। শিক্ষা যা নিতে হয় নিতে হবে অতীত থেকে। সুতরাং মার্কিন সরকারের প্রকাশিত গোপন দলিলপত্রের আলোকেই আমরা তলিয়ে দেখতে চাই, পঞ্চাশের দশকে ইরানে কী ঘটেছিলো এবং কেন ঘটেছিলো, সর্বোপরি তখন ইরানী জনগণ ও মুসলিমবিশ্বের কী করণীয় ছিলো, আর তারা কী করেছে? তাহলে খুব সহজেই আমরা বুঝতে পারবো, ইরানে আমেরিকা এখন কী করছে এবং কেন করছে? আর ইরানী জনগণ ও মুসলিমবিশ্ব কী করছে, অথচ তাদের কী করণীয় ছিলো? ডঃ মুসাদ্দিক ছিলেন ইরানের অত্যন্ত জ্ঞানী, বিচক্ষণ ও জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। ইরানের জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় সম্পদ রক্ষায় তিনি ছিলেন আপোশহীন। ১৯৫১ সালে তিনি মার্কিন পদলেহী শাহের ইরানে প্রধানমন্ত্রী হন এবং বৃটিশদের হাত থেকে তেলসম্পদ উদ্ধার করার জন্য তেল জাতীয়করণ করেন। এজন্য বৃটিশ তেল কোম্পানী (ইচ বা ইৎরঃরংয চবঃৎড়ষরঁস) কে তিনি উপযুক্ত ক্ষতিপূরণও দান করেন, যা ছিলো নযিরবিহীন। কিন্ত বৃটিশ সরকার পাগলা কুকুরের মত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। প্রথমে তারা বৃটেনের ব্যাংকে রক্ষিত ইরানের তেল বিক্রি থেকে লব্ধ বিপুল পরিমান সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে। (৪০-এ দেখুন) (এবিষয়টি আমি এখনো বুঝতে পারি না যে, কেন তেল বিক্রির অর্থ ইউরোপ আমেরিকার ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা হয়, বা রাখতে হয়, আর ওরা যখন তখন তা বাজেয়াপ্ত করার সাহস পায়? এর কি কোন সমাধান নেই?) তারপর অর্থনৈতিক অবরোধ এবং তেলের বাজারে ইরানী তেল নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে ইরানী অর্থনীতিকে পঙ্গু করে ফেলা হয়। ফল এই দাঁড়ায় যে, যে ইরানী জনগণের স্বার্থে মুসাদ্দিক তেল জাতীয়করণের বিপ্লবী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তারাই তার প্রতি বিরূপ হয়ে উঠতে শুরু করে, আর সেটাকে কাজে লাগিয়ে বৃটিশ গোয়েন্দারা ইরানের রাজপথে ব্যাপক নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। তারপরো মুসাদ্দিক শক্ত হাতে সবকিছু শামাল দিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু বৃটেন তেলের লোভে বশীভূত করে আমেরিকাকেও মাঠে নামায়। তখন একদিকে বিবিসি মুসাদ্দিক সরকারের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রচারযুদ্ধ শুরু করে, অন্যদিকে সিআইএ অতি সঙ্গোপনে কোটি কোটি ডলার ও বিপুল অস্ত্র যুগিয়ে ব্যাপক নাশকতা ও গেরিলা যুদ্ধের জন্য কয়েকটি বিপথগামী গোষ্ঠীকে প্রস্তুত করে, যা হতভাগ্য মুসাদ্দিকের পক্ষে আর শামাল দেয়া সম্ভব হয়নি। তিনি উৎখাত হন এবং সামরিক আদালতে তার কঠিন সাজা হয়। পুরো সময়টায় মুসলিম বিশ্ব ছিলো নীরব দর্শক, আর ইরানী জনগণ তাদের বন্ধু শাসককেই ভেবেছে দেশের স্বার্থবিরোধী! গোপন দলীল প্রকাশ হওয়ার পর আজ তারা বুঝতে পেরেছে যে, মূর্খতার কারণে সেদিন কীভাবে তারা সাম্রাজ্যবাদীদের হাতের ক্রীড়নক হয়েছিলো এবং তখন থেকে বিপ্লবপূর্বকাল পর্যন্ত বৃটিশ-মার্কিন তেলকোম্পানীগুলো কী অবাধে ইরানী তেল লুণ্ঠন করেছে। আজ এত বছর পর শুধু এতটুকু বলেই এত বড় জঘন্য অপরাধ থেকে মিস্টার ওবামা মুক্ত হতে চান যে, ‘ইরানের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে আমেরিকার ভূমিকা ছিলো।) অথচ একই অপরাধ তিনি নিজেই এখন করে চলেছেন ইরানে। আহমদি নেজাদের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বিপুল জনপ্রিয় সরকারকে উৎখাতের একই রকম ষড়যন্ত্র এখন চলছে এবং ওবামার অন্তত ‘জ্ঞাতসারে’। আমরা জানতে চাই, একটি গণতান্ত্রিক মুসলিম দেশের আভ্যন্ত-রীণ বিষয়ে এমন ন্যাক্কারজনকভাবে নাক গলানোর অধিকার কে দিয়েছে আমেরিকাকে? কোন দেশের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে কি না, নির্ধারণের অধিকার কি সে দেশের সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষের, না আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের? বহু মুসলিম দেশেই তো আমেরিকার পছন্দের গণতন্ত্র নেই, বরং সেখানে চলছে চরম একনায়কতন্ত্র ও ‘মধ্যযুগীয়’ রাজতন্ত্র, অথচ সেসব দেশ সম্পর্কে আমেরিকার মাথাব্যথা নেই কেন? এমনকি মার্কিন স্বার্থের অনুকূলে হলে সামারিক স্বৈরশাসকের সাথেও তাদের দুস্তি হতে পারে, কেন? মুসলিম বিশ্বে ইরানই একমাত্র দেশ যেখানে বিপ্লবোত্তর ত্রিশ বছরে দশবার নির্বাচন হয়েছে এবং কখনো কারচুপি বা অনিয়মের অভিযোগ উঠেনি, সর্বোপরি প্রতিটি নির্বাচনে জনসম্পৃক্ততা ছিলো ইউরোপ আমেরিকার যে কোন নির্বাচনের চেয়ে অনেক বেশী। সংস্কারবাদী নেতা খাতেমি তো দু’দুবার সত্তর শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন, যখন খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ছিলো রক্ষণশীলদের নিয়ন্ত্রণে। এমন একটি গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যসম্পন্ন এবং দীর্ঘ নির্বাচনী অভিজ্ঞতার অধিকারী দেশের বিরুদ্ধে কেন এমন উঠে পড়ে লেগেছে আমেরিকা ও তার তাবেদার পশ্চিমা বিশ্ব? ইরানের সামপ্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে? আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের খায়েশ ছিলো, মুসাভি জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসুন। এ উদ্দেশ্যে বিশ্বমিডিয়া মুসাভির পক্ষে এবং আহমদি নেজাদের বিপক্ষে এমন প্রচারযুদ্ধ চালিয়েছিলো যে, ইরানী জনগণের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়, মুসাভি অতীতে যাই ছিলেন, ক্ষমতার মোহে এখন তিনি মার্কিন স্বার্থের সেবক। নির্বাচনের আগে এমনকি মার্কিন ও পশ্চিমা নিরপেক্ষ এবং আধানিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালিত প্রায সবক’টি জরিপে সার্বিকভাবে আহমদি নেজাদ বিপুল ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন। পশ্চিমা বিশ্বের জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল এবিসি ও সিবিএস-এর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত গুরুত্বপূর্ণ জরিপেও বলা হয়েছিলো যে, নির্বাচনে ৮৯ শতাংশ ভোটার অংশ নেবে এবং আহমদি নেজাদ দ্বিগুণের বেশী ব্যবধানে জয়ী হবেন। নির্বাচনের পর মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়াল্টার মেবেন একটি ব্যাপকভিত্তিক জরিপ চালিয়ে ঘোষণা করেন, কারচুপির কোন আলামত নেই। তার চেয়ে বড় কথা, এর আগের নির্বাচনে তো এই আহমদি নেজাদই সংস্কারপন্থী ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট রাফসানজানীকে দ্বিগুনের বেশী ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ড হয়েছিলেন, যখন তার পরিচিতি ছিলো খুব সামান্য। সেই নির্বাচন সম্পর্কেও কোন অভিযোগ নেই। আমেরিকা ও তার তবেদার পশ্চিমা বিশ্ব এখনো নির্বাচনি কারচুপির প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে, অথচ বস্তুনিষ্ঠ কোন প্রমাণ তারা তুলে ধরতে পারেনি যে, তাদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে প্রদত্ত ভোটগুলো আহমদি নেজাদ কোথায় কীভাবে এমন বেমালুম হজম করে ফেললেন! মুসাভি ও তার সমর্থক ইহুদি মিডিয়া যে সকল অবাস্তব সন্দেহভিত্তিক আপত্তি স্থাপন করেছে তার দাঁতভাঙ্গা জবাব ইরান সরকার তো দিয়েছেই, এমনকি নিরপেক্ষ পশ্চিমা পর্যবেক্ষকরাও দিয়েছেন; তারপরো হায়েনাদের বিষদাঁত ভাঙ্গেনি। ইরানের রাজপথে একই ভাবে চলছে সহিংসতা ও জালাও-পোড়াও-এর বীভৎসতা, যা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে মুসাদ্দিক আমলের নাশকতা ও সহিংসতার ভয়াবহ ইতিহাস। নেদা নামের এক ইরানী তরুণীর নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে বিশ্বমিডিয়ায় চলছে তোলপাড়। জাতিসঙ্ঘ মহাসচীব পর্যন্ত, ফিলিস্তিনীদের ক্ষেত্রে যার ‘সুখনিদ্রা’র রয়েছে ঈর্ষণীয় ঐতিহ্য, তিনি এবং প্রেসিডেন্ট ওবামা রীতিমত মাতম শুরু করেছেন, যদিও চীনের উরঘুই মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর যে পাশবিক নির্যাতন চলছে সে সম্পর্কে তাদের কারো মুখেই টুশব্দ নেই। সর্বপোরি বিক্ষোভকারী ধারণকরা কোন ভিডিও ফুটেজে পুলিশের গুলি করার প্রমাণ নেই, অথচ নেদা নিহত হয়েছে গুলির আঘাতে, আর বিশজন নিহতের মাঝে অন্তত পাঁচজন পুলিশ নিহত হয়েছে। পঞ্চাশের দশকে জাতীয়তাবাদী নেতা ডঃ মুসাদ্দিকের বিরুদ্ধে পরিচালিত সুপরিকল্পিত নাশকতা ও সহিংসতার ঘটনা এবং বর্তমানের ঘটনা একেবারেই অভিন্ন। তখন মর্মান্তিক পরিণতি বরণ করে নিতে হয়েছিলো মুসাদ্দিককে। তার অপরাধ ছিলো, তিনি চেয়েছিলেন ইরানের জাতীয় সম্পদ তেলের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে। আজকের স্বাধীনচেতা আহমদি নেজাদের অপরাধ আরো বড়। তিনি চান তার দেশ ইরানকে পারমাণবিক শক্তির অধিকারীরূপে দেখতে। তিনি চান তার দেশকে শক্তি ও সামর্থ্যের দিক থেকে এমন একটি অবস্থানে নিয়ে যেতে যেখানে অন্য কোন দেশ তাকে আদেশ দেবে না, উপদেশও দেবে না, বরং প্রতিটি সিদ্ধান্ত সে নিজে গ্রহণ করবে। তিনি চান তার দেশের সম্পদ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে ব্যয় করতে। সুতরাং তিনি আজ আমেরিকা ও ইহুদীরাষ্ট্র ইসরাইলের চক্ষুশূল। যে কোন মূল্যে আহমাদি নেজাদের পতনই এখন তাদের কাম্য। এজন্য তারা এমনই মরিয়া যে, জঘন্য থেকে জঘন্য পন্থা ও কৌশল অবলম্বনেও তারা পিছপা হবে না। তবে আমেরিকা ও তার তাবেদাররা যদি একটি সত্য মনে রাখেন তাহলে সেটা হবে তাদের নিজেদের পক্ষেই মঙ্গলজনক, আর তা এই যে, গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক, আর বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশক এক নয়; একই ভাবে আহমদি নেজাদ ও মুসাদ্দিকও এক নন। (নয়াদিগন্ত, বৃহঃ ১৬জুলাই প্রকাশিত, ‘আরেক রঙ্গিন বিপ্লবের আয়োজন’ অবলম্বনে রচিত)

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা