জিলহজ্ব ১৪৪০ হিঃ (৩/৮)

কাশগর ও কায়রো

বিজেপি নেতাদের কেন বাংলাদেশবিদ্বেষ!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির জাতীয় ও আঞ্চলিক নেতৃবৃন্দ বেশ কিছুদিন থেকে যেভাবে বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য দিয়ে চলেছেন সেটাকে এখন আর ‘ভোটের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক জ¦ালানী’ বলে উড়িয়ে দেয়ার বা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বিশেষ করে বিজেপির মঞ্চে নরেন্দ্র মোদির পাশে আখলাকহত্যার চিহ্নিত আসামীদের সগৌরব উপস্থিতি থেকেই অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। মোদির কাশ্মীরবিষয়ক মন্তব্য নিছক ভোটের রাজনীতি মনে করলে ভুলই করা হবে। উল্লেখ্য, সম্প্রতি এক নির্বাচনী সমাবেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মন্তব্য করেছেন, তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী হলে প্রথম যে কাজটি করবেন তা হলো, ভারতের সংবিধান থেকে কাশ্মীর রাজ্যের যে বিশেষ মর্যাদার ধারা রয়েছে তা বাতিল করা।

সাম্প্রদায়িকতা ও ভোট-সাম্প্রদায়িকতা দু’টা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয় এবং আলাদা-ভাবেই তা দেখা উচিত, যদিও ভোট- সাম্প্রদায়িকতাও কম ঘৃণ্য নয়। ভোটের সম্প্রদায়িকতা ভোট পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে ভোটের পর জাতীয় নীতিনির্ধারণে তার কোন প্রভাব পড়ে না। পক্ষান্তরে সম্প্রদায়িকতা হলো বিশেষ কোন সম্প্রদায়ের প্রতি লালিত ঘৃণা ও বিদ্বেষ যার প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে স্থায়ীভাবে অনুভূত হয় এবং জাতীয় নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রেও তার প্রভাব গভীরভাবে পড়ে।

বলাবাহুল্য, বিজেপির কাশ্মীরবিষয়ক বক্তব্য এবং আসামবিষয়ক কর্মকা- গভীর সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ থেকেই উদ্ভূত। সুতরাং পরিস্থিতি নির্বাচনের পর আরো গুরুতর হতে বাধ্য। যদিও কাশ্মীরসমস্যা একটি মুসলিমসমস্যা হিসাবে পরোক্ষভাবে হলেও বাংলাদেশের মুসলিম জনগণের জন্য যথেষ্ট উৎকণ্ঠার বিষয়, তবে আসামের পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য অদূর ভবিষ্যতে একটি জ¦লন্ত সমস্যারূপে সামনে আসতে যাচ্ছে বলে পর্যবেক্ষকমহল আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। সুতরাং এখন থেকেই বাংলাদেশের সরকার ও জনগণকে পূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

ভারতের আদমশুমারিতে মুসলিম জনসংখ্যা কম করে দেখানোর একটা প্রবণতা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বরাবর দেখা যায়, তারপরো সরকারীভাবে স্বীকৃত যে, সেখানে মুসলিম জনসংখ্যা পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা থেকেও বেশী। একই ভাবে বাংলাভাষী মুসলিম জনসংখ্যাও বাংলাদেশের জনসংখ্যার কাছাকাছি। ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বিচারে সমগ্র বাংলা, আসাম, ত্রিপুরা, উড়িষ্যা-বিহার মিলে বৃহৎ বাংলা নামে একটি একক শক্তিশালী রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ছিলো অনিবার্য। কিন্তু হয়নি। কেন হয়নি? হলে কারা আজ লাভবান হতেন? ১৯০৫ সালে কারা ‘বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ’ বলে বিলাপ করলো? রবি বাবুর তাতে কী ভূমিকা ছিলো? ১৯৪৭ সালে কারা আবার বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদন করেই ক্ষান্ত হলো? আজ বাংলাদেশের মানচিত্র কেন শুধু পূর্ববঙ্গে আটকা পড়লো? কেন আসাম, বিহার, ত্রিপুরা আমাদের হাতছাড়া হলো, এগুলো এখন ইতিহাসের বিষয়। যদিও কোলকাতার বুদ্ধিজীবী বাবুরা এবং তাদের এদেশীয় তাবেদাররা ইতিহাস নিয়ে যথেষ্ট স্বেচ্ছাচার চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু কোন সন্দেহ নেই, ইতিহাসের সত্য যথাসময়ে স্বমহিমায় প্রকাশ পাবেই।

ইতিহাসের দায় ইতিহাসের কাঁধে রেখেই আমরা এখন শুধু আসামের অসহায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাগ্য নিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের মুসলিমবিদ্বেষ, বাঙ্গালীবিদ্বেষ এবং বাংলাদেশের প্রতি বিদ্বেষ সম্পর্কেই কিছু কথা বলতে চাই। সেই সঙ্গে তাদেরও মুখোশ উন্মোচন করতে চাই, কথায় কথায় যারা ‘চেতনা’ ফেরি করে বেড়ান, অথচ দেশ ও জাতির ক্রান্তিকালে চেতনা হারিয়ে ফেলেন।

***

বিভাগপূর্বসময় থেকে আসামে বসবাসকারী লাখ লাখ বাঙ্গালীকে নয়, বরং মুসলিম বাঙ্গালীকে ‘বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের ভিতরে ঠেলে দেয়ার নীলনক্শা ইতিমধ্যে প্রায় তৈরী হয়ে গিয়েছে। আসামে বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু হওয়া এনআরসি প্রকল্প এখন সমাপ্তির পথে। তাতে নাগরিকত্ব তালিকা থেকে চল্লিশ লাখের মত বিশাল সংখ্যার বাঙ্গালী মুসলিম নাগরিকত্ব হারাতে

বসেছে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে অবৈধরূপে অনুপ্রবেশকারী। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা অমিত শাহ থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজ্যের, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিজেপি নেতৃবৃন্দ হুঙ্কার দিয়েই যাচ্ছেন, তালিকা থেকে বাদপড়া নাগরিকদের ‘বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীরূপে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর। বর্তমানে ভারতে নির্বাচন চলছে। অভিজ্ঞমহল আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, নির্বাচনে বিজেপি আবার ক্ষমতায় এলে এনআরসি প্রকল্পের বাস্তবায়নপর্ব শুরু হয়ে যাবে। (বিজেপি ক্ষমতায় এসে গিয়েছে এবং ঘড়ির কাঁটা এগিয়েই চলেছে) তখন সীমিত সম্পদ ও বিপুল জনসংখ্যার ভারে আক্রান্ত বাংলাদেশ বর্তমান রোহিঙ্গাসমস্যার চেয়ে কয়েকগুণ বড় এক স্থায়ী সমস্যার মুখে পড়বে। তখন পরিস্থিতি কী গুরুতর রূপ নিতে পারে, ভাবতেও গা শিউরে ওঠে।

***

আশ্চর্যের বিষয় হলো, খোদ ভারতে বিজেপি সরকারের উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ হচ্ছে। পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী, যিনি বাংলাদেশকে তিস্তার একফোঁটা ‘জল’ দিতে নারায, তিনিও তার নিজের প্রয়োজনে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশকারী বলে যাদের দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে তারা বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী নয় কিছুতেই। ইতিহাসের ধারায় এবং উভয় তরফা অর্থনৈতিক প্রয়োজনে ভারতেরই একরাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে মানুষ বসতি স্থাপন করেছে। আসামরাজ্যের বিপুল পরিমাণ পতিত জঙ্গলভূমির আবাদকারিতে এই বসতি স্থাপন-কারীদের বিপুল অবদান রয়েছে।’

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী আরো বলেছেন, ‘আসামের লাখ লাখ বাঙ্গালী মুসলিমকে নাগরিকত্বহীন করার কারণে পশ্চিবঙ্গ ও উত্তরপূর্ব ভারতে রক্তক্ষয়ী সঙ্ঘাত শুরু হতে পারে, যার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ হতে বাধ্য।’

এদিকে মমতাকে ঘায়েল করার জন্য, পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি নেতৃবৃন্দ হুমকি দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গেও আসামের অনুরূপ তালিকা করার কথা বলে।

এই যখন ভারতের অবস্থা তখন বাংলাদেশ নিঝুমপুরীর রূপ ধারণ করে আছে। আমরা সত্যি বুঝতে পারি না, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এ কেমন চরিত্র যে, কথায় কথায় যারা হুঙ্কার ছাড়ে কল্পিত শত্রুর বিরুদ্ধে, তারা ভারতের বাংলাদেশবিরোধী কর্মকা-ের প্রতিবাদে ‘কানে দিয়েছি তুলো, পিঠে বেঁধেছি কুলো’ সেজে বসে আছে! কিন্তু তাদের জানা উচিত অন্ধ সেজে থাকলে প্রলয় বন্ধ হয় না।

রোহিঙ্গাবিপর্যয়ের সময় আমরা লজ্জাজনক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। এবার অন্তত ঝড় ওঠার আগেই সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে এবং সর্বপ্রকার সতর্কতামূলক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় সেদিন হয়ত দূরে নয় যেদিন আবার আমাদের বলতে হবে, ‘আমরা যদি একবেলা খাই, আসাম থেকে আসা চল্লিশ লাখ মানুষও খাবে।’

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা