রমযান ১৪৩০ হিঃ (১৩)

কাশগর ও কায়রো

রক্ত ঝরছে পূর্বতুর্কিস্তানে

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

জিনজিয়াং বলা হউক, বা সিনচিয়াং, এর আসল নাম হলো পূর্বতুকিস্তান, কিন্তু এ নাম এখন নিষিদ্ধ। এখানে উইঘুর নামে তুর্কীবংশোদ্ভূত একবিরাট মুসলিম জনগোষ্ঠী বাস করে। তবে মুসলিম বিশ্ব তাদের সম্পর্কে খুব কমই জানে। হিজরী প্রথম শতকেই পূর্বতুকিস্তানে ইসলাম প্রবেশ করেছে। অষ্টম শতকে তাদের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য কাস্পিয়ান সাগর থেকে মাঞ্চুরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। এখানেই ঐতিহাসিক সিল্করুট-এর অবস্থান, যার কারণে তৎকালীন বিশ্ববাণিজ্যের একটা বিরাট অংশের উপর ছিলো তাদের নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু সতের শতকে ‘হান’ নামে পরিচিত চীনাদের হাতে উইঘুর সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এর পর থেকে কয়েকবারই উইঘুর মুসলিম জনগোষ্ঠী অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা চালায়। অবশেষে ১৮৬৪ সালে চীনাদের বিতাড়িত করে তারা কাশগরিয়া রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে, যার রাজধানী ছিলো কাশগর। কিন্তু ১৮৭৬ সালেই চীনাদের হাতে পূর্বতুকিস্তানের পতন ঘটে, এমনকি এই নামটিরও বিলুপ্তি ঘটে এবং চীনারা এর নাম রাখে জিনজিয়াং। বিশাল চীনের সমগ্র জ্বালানী চাহিদার বিরাট অংশ পূর্বতুর্কিস্তান থেকেই পূর্ণ হয়। তাই যে কোন মূল্যে এটি নিজেদের দখলে রাখতে চীনারা বদ্ধপরিকর। এজন্য কমিউনিস্ট বিপ্লবের আগে ও পরে চীন সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে আসছে সিনচিয়াং এবং উইঘুর জনগোষ্ঠীর ইসলামী পরিচয় মুছে ফেলতে। বস্তুত উইঘুর মুসলিমদের উপর দীর্ঘ শতাব্দী ধরে যে ভয়াবহ পাশবিক নির্যাতন ও নিপীড়ন চলে আসছে তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। অথচ চীনের পাশেই রয়েছে দুটি মুসলিম দেশ পাকিস্তান ও আফগানিস্তান, কিন্তু তারা কেউ জানতেও চায়নি, কারাকোরাম পর্বতমালার ওপারে অসহায় উইঘুর মুসলিমদের ভাগ্যে কী ঘটছে রক্তপিপাসু লালফৌজের হাতে, শুধু মুসলিম হওয়ার অপরাধে। তাদেরকে শিক্ষা বঞ্চিত রাখা হয়েছে এবং অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এবং ঠাণ্ডা মাথায় তাদেরকে দূরদূরান্তের এলাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, আর অসংখ্য চীনা বসতি স্থাপন করে নিজেদের ভূখণ্ডেই উইঘুর জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হয়েছে। রাজধানী উরুমচি ও কাশগরসহ বড় বড় শহরে জন- সংখ্যার সত্তর শতাংশই এখন হান এবং সব ব্যবসাবাণিজ্য তাদের দখলে। ইউঘুর মুসলিমরা যখনই রুখে দাঁড়াতে চেষ্টা করেছে, তাদের নির্মমভাবে দমন করা হয়েছে। সর্বশেষ ঘটনা ঘটেছে গত জুলাই মাসের শুরুতে। উইঘুর মুসলিমদের পিঠ যখন একেবারে দেয়ালে ঠেকে গেছে তখন অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে টেংক-কামানের সামনেই তারা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। ফলে এবার তাদের উপর নেমে এসেছে অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে ভয়াবহ নির্যাতন নিপীড়ন। একদিনেই বিক্ষোভরত দেড় শতাধিক মুসলিমকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। সমস্ত মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জুমুআর দিন কারর্ফিউ দিয়ে সবাইকে ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। যারাই রাস্তায় বের হতে চেষ্টা করেছে তারাই বন্দুকের নিশানা হয়েছে। উইঘুর মুসলিম নেতৃবৃন্দ দাবী করেছেন, এখন পর্যন্ত দশহাজার উইঘুর যুবক নিখোঁজ হয়েছে। কেউ জানে না, তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে। নিরস্ত্র অসহায় মানুষের উপর এত বড় একটি পাশবিক হত্যাযজ্ঞের পরো জাতিসঙ্ঘ ও আমেরিকা কেন নিশ্চুপ তার কারণ তো কিছুটা হলেও আমরা বুঝি। তারা এখন ব্যস্ত তেহরানের রাজপথে বিক্ষোভকারীদের মানবাধিকার রক্ষার কাজে। কিন্তু মুসলি বিশ্ব! ওআইসি! তাহলে কি হতভাগ্য এই মুসলিমদের পাশে আজ দাঁড়াবার কেউ নেই! তবে একটা কথা তো ইতিহাসের নির্মম সত্য, তা এই যে, কোন মুসলিম জনপদ ও জনগোষ্ঠীকে চিরকাল দাবিয়ে রাখা যায় না, বিশেষত মুসলিম জনগোষ্ঠী কখনোই যুলুম, নির্যাতন ও পরাধীনতা মেনে নেয়নি। তাদের মাঝে যখন জিহাদ ও শাহাদাতের ঘুমন্ত জাযবা জেগে ওঠে তখন পৃথিবীর যে কোন শক্তিকেই ওরা গুঁড়িয়ে দিতে পারে। সিনচিয়াং জনপদের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও ইতিহাসের পাঠ ভিন্ন হতে পারে না। ইরানের প্রায় সমান এই বিশাল জনপদে হাজার বছর ধরে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাস। ইতিহাস সাক্ষী, তারা কখনো কারো ক্ষতি করেনি। এমনকি যখন প্রয়োজন হয়েছে তারা চীনের মূল ভূখণ্ডের অধিবাসীদের সাহায্যই করেছে। সুতরাং নিজেদের দ্বীন-ঈমান, ইজ্জত-আবরু ও আযাদি রক্ষার জন্য তারা জানমালের যে কোন কোরবানি দিতে কখনো পিছপা হবে না। শুধু দেখার বিষয় হলো, মুসলিম উম্মাহ তাদের উইঘোর মুসলিম ভাইদের দুর্দিনের কতটুকু সাড়া দেয়ে।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা