রমযান ১৪৩০ হিঃ (১৩)

এসো কলম মেরামত করি

এসো কলম মেরামত করি

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

বাংলাভাষায়, এমনকি ইংরেজীতে কী বিপুল পরিমাণ আরবী শব্দ রয়েছে, কিংবা যা আরবী শব্দমূল থেকে উদ্গত শব্দ রয়েছে তা কি আমরা জানি? জানি না। মাওলানা সৈয়দ সোলায়মান নদবী (রহ) দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছিলেন যে, ইংরেজী ভাষায় হাজারের উপর শব্দ হবে যা আরবী থেকে এসেছে, তার লেখা থেকেই জেনেছিলাম, ইংরেজী আর্থ শব্দটি মূলত আরবী আর্‌দ শব্দটিরই প্রায় অবিকৃতরূপ। কিছুদিন আগে আমাদের প্রিয় ছাত্র হাসীবুর রহমান মিশর থেকে একটি মূল্যবান গবেষণাগ্রন্থ পাঠিয়েছে। নাম, ‘রিহলাতুল কালিমাত’ বা শব্দের অভিযাত্রা। গবেষক তার এই গবেষণাকর্মের পিছনে কী বিপুল ত্যাগ ও শ্রম স্বীকার করেছেন ভাবতেও অবাক লাগে। আজ সকালে ‘ম্রিয়মাণ’-এর বানান দেখতে বাংলা একাডেমির অভিধান খুলেছিলাম, হঠাৎ নযরে পড়লো ম্যাগাজিন শব্দটি, যার অর্থ হলো সাময়িক পত্রিকা (ইউনিভার্সিটির বাংলা ম্যাগাজিনে একটি মূল্যবান গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।), পাঁচমিশালি বিষয় (টেলিভিশনের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান), যেখানে বারুদ রাখা হয় (বন্দুকের ম্যাগাজিন)। শব্দটি বাংলায় এসেছে ইংরেজী থেকে, আর ইংরেজীতে এসেছে আরবী থেকে। আরবী শব্দটি হলো, ‘মাখাযিন, মাখযান-এর বহুবচন। বিষয়টি আমার জানা ছিলো না, পেয়ে খুশী হলাম। এটাকেই বলে শব্দের অভিযাত্রা। বহু দিন থেকে আমার একটি আকাঙ্ক্ষা, আমাদের মাওলানাদের একজন বা কয়েকজন যদি প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করে এবিষয়ে গবেষণা করতেন যে, বাংলাভাষায় কী পরিমাণ আরবী শব্দ ব্যবহৃত হয়, তাহলে আমার ধারণা বিস্ময়কর ‘নতিজা’ বের হয়ে আসবে। কিন্তু আমাদের তো যোগ্যতার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন শুধু সনদের। এরকম একটি গবেষণাপত্র বের হলে বাংলাভাষার জগতে এখনই আমাদের মর্যাদা অনেক উপরে উঠে যেতো। কেউ জানতে চাইতো না, গবেষক মাওলানার কাছে কোন সনদ আছে কি না! মা ও আম্মা শব্দটি দিয়েই শুরু করা হোক না। হিন্দু পণ্ডিতরা বলতে চান, এর মূল হচ্ছে সংস্কৃত অম্বা। অথচ আরবী ভাষার এত সহজ শব্দ উম্মুন যেন তাদের নযরে পড়তেই চায় না। আমি বলি, তোমাদের সংস্কৃত অম্বা যে উম্মুন থেকে আসেনি তার প্রমাণ? আব্বা শব্দটাতে এসে বেচারারা বড় বেকায়দায় পড়ে বলে দিয়েছে, ওটা ‘মুসলমানি’ শব্দ। আরে বাবা, মুসলমানি, কি হিন্দুয়ানি, তা পরে দেখবো, শব্দটা তো আরবী! তোমরা বলো বাবা, আমরা বলি আব্বা, এই তো পার্থক্য। আচ্ছা চলো, তোমাদের সংস্কৃত পিতা-এর খোঁজখবর নাও। এটি যে, ‘আবাত’ থেকে এসেছে তা অস্বীকার করা কি খুব সহজ? মূর্খ লোকদের পক্ষে সহজ, কিন্তু ভাষা ুবিজ্ঞানীদের মানতেই হবে, যারা শব্দের অভিযাত্রা সম্পর্কে এবং তার আশ্চর্য রূপপরিবর্তন সম্পর্কে অবগত। তারা একথাও স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, অবগত এবং অবহিত শব্দদু’টিরও মূল হচ্ছে ওয়াকিফ। তহবিল তছরুফ যে আরবীভাষার দু’টি মাছদার অনেকদিন আমার ভাবনায় আসেনি। ‘তুলকালাম’ কাণ্ড অনেক লিখেছি, বুঝেছি অনেক পরে। অনেক চিঠির মুসাবিদা এবং ‘ড্রাফট’ তৈরী করেছি বিভিন্ন প্রয়োজনে, কিন্তু এর মূল যে ‘মুসাওয়াদা’ তা ভেবে দেখিনি। কত শুনেছি ইস্তিফা শব্দটি, খঁটি আরবী শব্দ। আদালতের ভিতরে গেলে তো আরবী আর ফারসির ছড়াছড়ি। একসময় আমরা শাসক ছিলাম যে! খোদ আদালত শব্দটি! কাজি যদিও এখন শুধু ‘নিকা’ পড়ান, একসময় তিনি ছিলেন মহামান্য আদালতের বিচারক! যখন রাজ্য যায় তখন সবই যায়, আদালতের কাজিকে তখন কাবিননামা লিখে সংসার চালাতে হয়। মর্জি শব্দটির পরিচয় জানার মর্জি আমাদের কখনো হয়নি। হোমরা চোমরা তো বলি, বুঝতে পারিনি যে, তা এসেছে হিময়ার থেকে। হিন্দুদের উলুধ্বনি যে ইলাহধ্বনি এবং জোকারধ্বনি যে যিকির ধ্বনি থেকে এসেছে, অনেক ভাষাগবেষক এখন তা স্বীকার করতে শুরু করেছেন। মাঝিমাল্লা কত বলি, কত লিখি, ‘মাল্লাহ’ শব্দটি কমই মনে পড়ে। শীতকালে যখন লেপ গায়ে দেই তখন লিহাফ শব্দটি কি মনে পড়ে? আমরা বলি ‘যাওয়া’, কিন্তু এর মূল যে আরবী ‘যাহাাব’ তা আমাদের জানা নেই। এমনকি কৃষকের জমির আইলটি পর্যন্ত আরবী ???? থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো আড়াল, প্রতিবন্ধক, পার্থক্যরেখা, ইত্যাদি। পাখীর ডানার মূল কী? অন্যকিছু না, আরবী শব্দ জানাহ্‌। বাঁধ ও আরবী ?? যে একই শব্দের ভিন্নরূপ তাও আমরা কখনো ভেবে দেখিনি। অথচ ভেবে দেখার বিষয় ছিলো যে, আলিম সমাজের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া বাংলাভাষায় যদি এত বিপুল পরিমাণে আরবী শব্দ প্রবেশ করতে পারে, তাহলে আলিমসমাজ শুরু থেকেই যদি বাংলাভাষার নেতৃত্ব গ্রহণ করতেন তাহলে আরো কত অসংখ্য আরবী (ফার্সি) শব্দ বাংলাভাষায় স্বচ্ছন্দ্যে স্থান করে নিতে পারতো এবং আজ বাংলা ভাষার চেহারা সূরত কী দাঁড়াতো! উদাহরণের অভাব নেই এবং আশা করি তার প্রয়োজনও নেই। আমি বলতে চাই, বাংলাদেশের আলিমগণ তাদের মাতৃভাষাচর্চা করছেন না কেন? এটা তো আমাদের উপর মাতৃভাষার হক, আর মানুষের হোক, বা মানুষের মুখের ভাষার, কারো হক নষ্ট করার ফল কখনো ভালো হতে পারে না, না আখেরাতে, না দুনিয়াতে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, বাংলাভাষার ভাণ্ডারে এখনো বিপুল পরিমাণ আরবী-ফারসি শব্দের প্রবেশ করার সুযোগ আছে। যদি আমরা একটু মমতার সঙ্গে বাংলাভাষায় কলম ধরি। কিন্তু তার আগে আমাদের বাংলাভাষা শিখতে হবে এবং মুখে ও কলমে এ ভাষার উপর এমন দখল অর্জন করতে হবে যাতে বাংলাভাষার মানুষ ভাষার ক্ষেত্রে আমাদের নেতৃত্ব মেনে নিতে বাধ্য হয়। ভাষার ক্ষেত্রে আমাদের যে কোন মত ও সিদ্ধান্তকে যেন ‘শেষ কথা’ বলে মনে করা হয়, অথচ আজ বাংলাভাষায় অজ্ঞতাই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের বৈশিষ্ট্য। কত বড় লজ্জার কথা এটা! ভাষাটা শিখতে হবে, ভাষার উপর দখল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ভাষার ইতিহাস জানতে হবে। ভাষাবিজ্ঞান ও ধ্বনিতত্ত্ব জানতে হবে। তারপর বাংলাভাষার উপর ব্যাপক, বিস্তৃত ও মৌলিক গবেষণায় নামতে হবে। আমরা হয়ত জানিও না যে, আমাদের শত্রুরা গবেষণার নামে বাংলাভাষার উপর রীতিমত দস্যুতা চালিয়েছে। বাংলাভাষা ও বাঙ্গালীজাতির ইতিহাস বিকৃতি ঘটিয়েছে। এমনকি বাংলাভাষার জন্মপরিচয় ও বংশসূত্র পর্যন্ত পরিবর্তন করে ফেলেছে। যদি একথা বলা হয় যে, বাংলাভাষার মূল হচ্ছে আরবীভাষা তাহলে? আমার মনে হয়, সবার আগে চমকে ওঠবেন আমাদের সম্মানিত আলিম সমাজ। কারণ জন্মের পূর্ব থেকে তারা শুনে এসেছেন এবং মেনে এসেছেন, বাংলাভাষা হলো হিন্দুয়ানি ভাষা, এ ভাষায় কোন নূর নেই। অথচ চমকে ওঠার মত কথাই বাস্তব সত্য, আর এত দিন যা বলে আসা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। বস্তুত শাসক ইংরেজ এবং তাদের সেবাদাস হিন্দু- পণ্ডিতরা নিজেদের হীন স্বার্থে প্রচার করেছেন যে, হিন্দুদের পবিত্র ধর্মীয় ভাষা সংস্কৃত হচ্ছে বাংলাভাষার জননী এবং বাংলা- ভাষা হলো সংস্কৃতের সন্তান। সংস্কৃত ভাষার ক্রোড়েই সে প্রতিপালিত। হিন্দু পণ্ডিতদের দাবী মতে বাংলাভাষার সিংহভাগ শব্দ হলো তৎসম বা সংস্কৃত থেকে আগত, অথচ বাংলাভাষা পরিচয় গ্রন্থে স্বয়ং রবিন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘বানানের ছদ্মবেশ ঘুচিয়ে দিলেই দেখা যাবে, বাংলায় তৎসম শব্দ নেই বললেই চলে।’ বলাবাহুল্য যে, আমাদের অজ্ঞতার সুযোগেই বাংলাভাষার এই মিথ্যা জন্মপরিচয়টি প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে বাংলাভাষার উপর হিন্দুরা তাদের দখলি স্বত্ব কায়েম করে নিয়েছে এবং নির্বিবাদে তা মেনে নিয়ে মায়ের মুখের ভাষার প্রতি আমরা চরম অন্যায় করেছি। এখন আমাদেরই দায়িত্ব বাংলাভাষার প্রকৃত জন্মপরিচয় উদ্ধার করা এবং অকাট্য প্রমাণ দ্বারা তা প্রতিষ্ঠিত করা।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা