যিলক্বদ ১৪৩০হিঃ (১৪)

এসো কলম মেরামত করি

এসো কলম মেরামত করি

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

এত চেষ্টা করা হচ্ছে; এতভাবে, এত করে বলা হচ্ছে, কিন্তু আমাদের সচেতনতা মোটেই আসছে না। যেমন গাফেল উদাসীন ছিলাম তেমনই রয়ে যাচ্ছি। গাফলত ও উদাসীনতার একটা জগদ্দল পাথর যেন আমাদের উপর চেপে বসেছে, কিছুতেই সেটাকে নামানো যাচ্ছে না। অথচ আমরা কথা বলছি অনেক বড় বড় এবং স্বপ্ন দেখছি বিশাল বিশাল। এ যন্ত্রণা কি চিরকালই আমাকে দগ্ধ করতে থাকবে! মুক্তি ও আনন্দের শুভদিনটি কি কখনো আসবে না এ জীবনে! প্রিয় পাঠক! তুমি কি বুঝতে পারছো, কোন যন্ত্রণার কথা বলছি এতক্ষণ? বানান ভুলের যন্ত্রণা! যেমন করুণ অবস্থা আমার প্রিয় ছাত্রদের তেমনি বেহাল অবস্থা পুষ্পের সুপ্রিয় পাঠক-লেখকদের! জালালাইনের মত তাফসীরগ্রন্থ এবং হিদায়ার মত ফিকাহর কিতাব যারা পড়ে তাদের বয়স কেমন হবে এবং ইলমি ইসতি‘দাদ ও জ্ঞানযোগ্যতা কেমন হওয়ার কথা! তেমন একজন ছাত্রকে বললাম সাব্বুরায় রীতি-নীতি শব্দটি লিখতে; সে লিখলো ‘রিতি-নিতি’! বলো, এ দুঃখ কোথায় রাখি! এ তো গেলো আমার ছাত্রদের অবস্থা। এবার শোনো পুষ্পের পাঠক-লেখকদের কথা। এক বন্ধু একটি লেখা পাঠিয়েছে ‘কোন পথে আমাদের মুক্তি?’ শিরোনামে। কিন্তু মুক্তির পথ বাতলে দেয়ার মত চিন্তাশীল এই লেখকবন্ধুটি মোটামুটি ছয়শ শব্দের লেখাটিতে বানান ভুল করেছে প্রায় ছাব্বিশটি! তাহলে সত্যি সত্যি এখন ভাবতে হয়, ‘কোন পথে আমাদের মুক্তি?’ বন্ধুটি লিখেছে, সমাজ এখন ‘আত্নঘাতি’ পথে চলেছে, সুতরাং ‘ধংশ’ ও বরবাদি এই সমাজের জন্য ‘অনিবার্জ’। তুমিই বলো, সমাজের দ্বীনী ও ইলমী নেতৃত্ব দেবে যারা তারা যদি ‘আত্নঘাতি’ হয় তাহলে সমাজ আত্মঘাতী পথে চলবে, তাতে অবাক হওয়ার কী আছে! আর সেই সমাজের ধ্বংস তো অনিবার্য হবেই! যদি না আল্লাহ অনুগ্রহ করে রক্ষা করেন। আমি সবসময় বলে আসছি, নিয়মিত রোযনামচা লেখো এবং প্রতিদিন বাংলা লোগাত খুলে তিনটি শব্দের বানান দেখো, ইনশাআল্লাহ তাতে লেখারও উন্নতি ঘটবে এবং বানানভুলের লজ্জা থেকেও মুক্তি ঘটবে। কিন্তু খোদ আমার ছেলেরাই এ উপদেশের উপর আমল করে না! এতো গেলো আমার প্রিয় ছাত্র এবং পুষ্পের পাঠক-লেখক বন্ধুদের কথা; এবার শোনো আমার নিজের অবস্থা। তার আগে শোনে আরেকটি কথা। এতদিন ‘জগদ্দল’ শব্দটি ব্যবহার করে আসছি, যার অর্থ হলো, এমন ভারি কোন বস্তু যাকে কোনভাবেই সরানো যায় না। শব্দটির মূল রূপটি কী, তা কখনো ভেবে দেখিনি। আজ এখানে শব্দটি ব্যবহার করতে গিয়ে মনে মনেই লজ্জা পেলাম যে, অন্যদের উপদেশ দিচ্ছি লোগাত দেখার, অথচ নিজেই তো দেখছি না! বে-আমলের নছীহতে কাজ হবে কেন! যাক, লোগাত খুলে যা দেখলাম তা তোমাদের বলে দিচ্ছি। আমি যা জানলাম ৫৬ বছর বয়সে, তোমরা তা জেনে যাচ্ছো কত বছর বয়সে যেন! কারো পনেরো, কারো বিশ, আর কারো পঁচিশ। এভাবে জানতে থাকো না! জেনে জেনে আমাদের চেয়ে এগিয়ে যাও না। তোমরা আমাদের ছাড়িয়ে যাওয়াতেই তো আমাদের আনন্দ! তো লোগাত খুলে দেখি, জগদ্দল এবং জগদ্দলন দু’ভাবেই ব্যবহার রয়েছে। জগদ্দল পাথর এবং জগদ্দলন শিলা। মূল রূপ হচ্ছে, জগৎ+ দল বা দলন। অর্থাৎ এমন ভারী বস্তু যা জগতকে দলন করে, দলিত মথিত করে। ফিরে আসি আগের কথায়। আরবী ব্যাকরণের পরিভাষায় যদি বলি, তাহলে বলতে হয়, ৎ ও দ হচ্ছে কারীবুল মাখরাজ। তাই ৎ-কে দ- দ্বারা বদল করে দ-কে দ-এর মধ্যে ইদগাম করা হয়েছে। এভাবে আরবী ব্যাকরণের সাহায্যে যদি আমরা বাংলাব্যাকরণ বুঝতে চেষ্টা করি তাহলে কত সহজ হয় তাই না! আমরা এ সুযোগটা নিচ্ছি না কেন? এখনো এধরনের বাংলা ব্যাকরণের ‘কিতাব’ তৈরী হচ্ছে না কেন? কেন? ফিরে আসি আগের প্রসঙ্গে। নিজেকে আমি ভাবি পুষ্পের সম্পাদক, আর কিছু মানুষ ভাবে, আমি ভালো লেখক; অথচ আমার লেখায়ও কী মারাত্মক বানানভুল! এত দিন আমি লিখতাম, ‘প্রবাহমান নদী’; এই সেদিন একবন্ধু ভুলটা শুধরে দিয়ে বললেন, লিখতে হবে প্রবহমান নদী। কী লজ্জা! অথচ আমি কিনা অন্যের বানানভুল নিয়ে পেরেশান! আমি ভাবতাম, ‘প্রবাহ’ থেকে হয়েছে প্রবাহমান; আসল ঘটনা হলো ‘বহমান’ থেকে হয়েছে প্রবহমান। ‘প্র’ হচ্ছে একটি উপসর্গ, যা বিভিন্ন শব্দের শুরুতে যুক্ত হয়ে উৎকষ, আধিক্য, প্রাচুর্য, ব্যাপকতা ইত্যাদি ভাব প্রকাশ করে। যেমন, পিতামহ মানে দাদা, তার উপরে যেতে হলে শুরুতে ‘প্র’ উপসর্গ যোগ করে বলি, ‘প্রপিতামহ’ মানে পিতামহের পিতা, বা দাদার বাবা। তদ্রূপ বৃদ্ধ মানে বুড়ো, আর প্রবৃদ্ধ মানে অতিবৃদ্ধ, যদিও এর তেমন ব্যবহার নেই। কোন শব্দ আবার শুধু লোগাত দেখে ব্যবহার করতে যাওয়া ঠিক নয়, দেখতে হবে সাহিত্যিকদের কলমে এর ব্যবহার আছে কি না। যে সব শব্দ লোগাতে আছে, কিন্তু ব্যবহারে নেই সেগুলো আরবীতে বলে ‘মাতরূক বা মাহজূর’। সবভাষাতেই প্রচুর মাতরূক শব্দ আছে, যা লোগাতে দেখা যায়, কিন্তু ভাষায় ও সাহিত্যে তার ব্যবহার দেখা যায় না, সেগুলো তোমরা আবার ব্যবহার করতে যেয়ো না। বৃদ্ধির শুরুতে ‘প্র’ যোগ করে বলি প্রবৃদ্ধি, তাতে অর্থের ক্ষেত্রে বিশিষ্টতা যোগ হয়, অর্থাৎ অর্থনৈতিক ভাবে উন্নতি ও সমৃদ্ধি। অর্থনীতির শাস্ত্রে এ শব্দটি খুব প্রচলিত। তো বহমান মানে যা বয়ে চলেছে। তার শুরুতে প্র যোগ করে যদি বলি প্রবহমান তাহলে অর্থের বৃদ্ধি ঘটবে; অর্থাৎ যা খুব বেগে বয়ে চলেছে। মোটকথা, বানানের বিশুদ্ধতার ক্ষেত্রে আমি, তুমি-আমরা সবাই লজ্জাজনকভাবে পিছিয়ে আছি; এমনকি পিছিয়ে থাকার অনুভূতি থেকেও আমরা পিছিয়ে আছি। এক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই পূর্ণ সচেতন ও সচেষ্ট হতে হবে। বানানবিশুদ্ধতা হচ্ছে ভাষার একেবারেই প্রাথমিক স্তর। এটা সবাইকে অর্জন করতে হবে। প্রসঙ্গত, বানানভুল, বানানত্রুটি, বানানশুদ্ধি, বানানবিশুদ্ধতা ইত্যাদি একসঙ্গে লিখতে হবে। তবে ‘ভূল, এ বানান ভুল’ বাক্যটিতে আলাদা হবে। উপরে ‘প্র’ উপসর্গের কথা এসেছে; সে সম্পর্কে আরো কিছু আলোচনা হতে পারে। বক্তা মানে যে কথা বলে। প্রবক্তা মানে সুবক্তা; এখানে অর্থের আধিক্য এসেছে। আবার প্রবক্তা মানে যিনি কোন মত জোরে শোরে প্রচার করেন, এখানে অর্থের বিস্তার ঘটেছে। বচন মানে কথা, উক্তি, আর প্রবচন মানে বহু প্রচলিত এবং জ্ঞানগর্ভ কথা বা উক্তি। প্রসঙ্গত, গর্ভ মানে ভিতর ও মধ্য। তো জ্ঞানগর্ভ কথা মানে যে কথার ভিতরে জ্ঞান রয়েছে এবং সারগর্ভ আলোচনা মানে যে আলোচনার ভিতরে সার বা উৎকৃষ্ট পদার্থ রয়েছে। তদ্রূপ শূন্যগর্ভ প্রতিশ্রুতি মানে যে প্রতিশ্রুতির ভিতরটা শূন্য। বানান প্রসঙ্গে ফিরে আসি, কিছু কিছু বানান আছে, যেখানে দুই রকম বানান প্রচলিত রয়েছে। যেমন বাড়ি/ী, পাখি/ী, গাড়ি/ী, বেশি/ী; আগে দীর্ঘঈকার লেখা হতো, এখন হ্রস্বইকার লেখা হয়। এক্ষেত্রে যে কোন একটি অনুসরণ করা যায়, কিন্তু উভয় বানানের মিশ্রণ দোষণীয়, যদিও আমি নিজেই এ দোষে কঠিনভাবে আক্রান্ত। প্রসঙ্গত, দীর্ঘঈকার এবং হ্রস্বঈকার নয়, তদ্রূপ দীর্ঘইকার এবং হ্রস্বইকার নয়, ইকার এবং ঈকার, তদ্রূপ উকার এবং ঊকার আলাদা বিষয়। ঈপ্সা মানে পাওয়ার ব্যাকুল ইচ্ছা, ঈপ্সিত মানে কাঙ্ক্ষিত। ‘কোন পথে আমাদের মুক্তি?’-এর লেখকবন্ধুটি লিখেছে, ‘যে কোন মূল্যে আমাদের পৌঁছতে হবে ইস্পিত লক্ষ্যে। বন্ধুটিকে ধন্যবাদ যে, সে মূল্য চিনতে ভুল করেনি এবং লক্ষ্যও ঠিক রেখেছে। তবে তাকে আমি সতর্ক করতে চাই যে, সে যেন কখনো ইস্পিত লক্ষ্যে পৌঁছার চিন্তা না করে, বরং তাকে পৌঁছতে হবে ঈপ্সিত লক্ষ্যে। প্রসঙ্গত, ঈপ্সা ও লিপ্সা, প্রায় সমার্থক, তবে লিপ্সা হয় মন্দ ক্ষেত্রে। বলা হয়, মদলিপ্সা, অর্থলিপ্সা, যশোলিপ্সা ইত্যাদি। আর এগুলো একসঙ্গে লিখতে হবে। লীপ্সা বানানটি কিন্তু ভুল। প্রসঙ্গত, লিপ্সা ও লিপ্সু ব্যবহৃত শব্দ, কিন্তু ঈপ্সা ও ঈপ্সু ব্যবহৃত শব্দ নয়। ঈপ্সিত ব্যবহৃত হলেও, লিপ্সিত ব্যবহৃত নয়। যশ (যশঃ) শব্দটি সম্পর্কে কিছু কথা। এটি সংস্কৃত শব্দ, এর শেষে বিসর্গ আছে। (বিসর্গ নিজে কিন্তু বিসর্গ ধারণ করে না, অর্থাৎ বিঃসর্গ লেখা ভুল।) যশ শব্দটি যখন অন্যশব্দের সঙ্গে যুক্তরূপে আসে, তখন কখনো বিসর্গ থাকে, আর কখনো তা ওকারে পরিবর্তিত হয়, যেমন- যশঃকীর্তন, যশোগান, যশোগাঁথা যশোধন, যশোভাগ্য ইত্যাদি। যশস্বী মানে যশ-এর অধিকারী, এখানে ওকার নেই, কারণ এটি একই শব্দ, শেষে শুধু প্রত্যয় যুক্ত হয়েছে। তাহলে বিসর্গ কোথায়? বিসর্গটি ‘স’-এ পরিবর্তিত হয়েছে। (কারণ যশ-এর সংস্কৃত রূপ হচ্ছে যশস্‌ >যশঃ) অর্থাৎ বিসর্গটি এখানে মূল রূপে ফিরে এসেছে। ‘কোন পথে আমাদের মুক্তি?’-এর লেখক বন্ধু লিখেছে, ‘যারা যোগ্যতা অর্জন করবে না তারা প্রতিযোগীতায় হেরে যাবে এবং ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।’ ঠিক কথা। যোগ্যতা অর্জন করতেই হবে, আর ভাষার যোগ্যতার প্রথম ক্ষেত্রটি হলো বিশুদ্ধ বানান। তবে ‘প্রতিযোগীতা’ লেখা কিন্তু যোগ্যতার আলামত নয়! পুষ্পের পিছনের কোন সংখ্যায় এসম্পর্কিত আলোচনা রয়েছে। যেমন, প্রতিযোগী/ প্রতিযোগিতা, বিরোধী/ বিরোধিতা, অভিমুখী/ অভিমুখিতা, প্রতিদ্বন্দ্বী/ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইত্যাদি। প্রসঙ্গত, অভিমুখী মানে কোন দিকে গমনোদ্যত বা গমনশীল, বলা হয়, ‘ঘরমুখী মানুষের ঢল’। এর স্ত্রীলিঙ্গ হচ্ছে -মুখিনী। তব্‌ে পোড়ামুখি এবং চন্দ্রমুখী, এখানে মুখি ও মুখী হচ্ছে স্ত্রীলিঙ্গ। অতৎসম শব্দে -মুখি, আর তৎসম শব্দে -মুখী হয়। আবারো বলছি, আমি নিজেও খুব কম জানি; তবে এসো, আমরা একসঙ্গে মিলেমিশে শিখতে চেষ্টা করি। বাংলাভাষা আমাদের, বাংলা-ভাষা থাকবে আমাদের নিয়ন্ত্রণে।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা