মুহাররম ১৪৪৫ হিঃ

এসো কলম মেরামত করি

সৈনিকের জন্য অস্ত্রের প্রশিক্ষণ এবং লেখকের জন্য কলমের প্রশিক্ষণ সমান প্রয়োজন

আজকের প্রসঙ্গ: সাহিত্যের সাধনা কোন পথে!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

লেখে অনেকে. লিখতে জানে খুব কম মানুষ! কথাটা অনেক আগে একজন বড় লেখককে বলতে শুনেছি! কথাটার তাৎপর্য তখন বুঝতে পারিনি। নিজে যখন লিখতে শুরু করেছি, তখন ধীরে ধীরে কথাটার মর্ম কিছুটা উপলব্ধি করেছি! আর অবাক হয়ে ভেবেছি, কত বড় সত্য কত সহজে তিনি উচ্চারণ করেছেন! তারপর যখন অন্তর দিয়ে চাইলাম, এবং দিন-রাত এক করে চেষ্টা শুরু করলাম, আমার ছেলেরা যেন কলম হাতে নেয় এবং লেখার সাধনায় অত্মনিয়োগ করে তখন.. তখন অত্যন্ত মর্মান্তিক ভাবে আমার উপলব্ধি হলো,  লেখার জগতে সেই মহান সাধক কত তিক্ত সত্য উচ্চারণ করেছেন কত বেদনার সঙ্গে! এটাই এখন জগতে বড় সত্যগুলো একটি, ‘লেখে অনেকে, লিখতে জানে খুব কম মানুষ!

পক্ষান্তরে লেখার প্রতি যত্ন আছে, মমতা আছে; লেখার জন্য সাধনা আছে, আত্মত্যাগ আছে, কলমের জন্য জীবন উৎসর্গ করার আকুতি আছে, এমন মানুষ এখন ‘লেখার বাজারে’ শুধু বিরল নয়, দুর্লভ! লেখার অঙ্গনে বললাম না, বললাম, লেখার বাজারে। সচেতনভাবেই ‘বাজার’ শব্দটা ব্যবহার করেছি। যত তিক্তই হোক এ সত্য স্বীকার করতেই হবে যে, লেখার সঙ্গে এখন মুদ্রার এমন গভীর সম্পর্ক যে, লেখা এখন আর জ্ঞানের বাহন নয়, লেখা এখন আর জ্ঞানের সম্পদ নয়; লেখা এখন রীতিমত বাজারের পণ্য! তাই তো বই যেখানে পাওয়া যায়, লেখক ও পাঠকের যেখানে আসা-যাওয়া, সেই ‘পবিত্র’ স্থানটির নাম ‘বাংলা’ বাজার! জ্বি, আমার মত, তোমার মত লেখক তো বেশ গর্বের সঙ্গে বলে, দু’দিন হলো, আমার নতুন বই বাজারে এসেছে! অথচ স্বচ্ছন্দে বলা যায়, ‘পাঠকমহলে/কিতাবমহলে এসেছে। একসময় হিন্দুবাবুরা আরবী/ ফারসি শব্দ এলেই নাক সিটকাতেন। আল্লাহর রহমতে সে অবস্থা তো এখন নেই! এখন তো হিন্দু লেখকরাও কিছুমাত্র শরম না করে আরবী ফারসি শব্দ হযম করে নিচ্ছেন! আল্লাহর রহমতে যে বলেছি, একেবারে প্রত্যক্ষ অর্থেই। আমাদের মেহনতের কোন ওছীলা ছিলো না, যা হয়েছে, ওছীলাহীনভাবে সরাসরি আল্লাহর রহমতেই হয়েছে। আমরা তো এখনো আরবী ফারসি শব্দ ব্যবহার করতে শরম করি যে, ‘পাছে লোকে কিছু বলে!’

কথা ছড়িয়ে যাচ্ছে। তো বলছিলাম, যদি নিঃসঙ্কোচে, ‘নিঃশরমে’ আরবী শব্দ ব্যবহার করতে চাই। তাহলে বলতে পারি, ‘দু’দিন হলো, আমার নতুন বই মাকতাবায় এসেছে।আমিও বোধহয় আরবী শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে শরম ত্যাগ করতে পারিনি। তাই শুরুতে এত লম্বা ভূমিকা জুড়ে দেয়া! সেদিন এক মাওলানা প্রকাশক আফসোস করলেন, হুযূর অনেক আশা কইরা বইয়ের ব্যবসায় আসছি। অনেক পুঁজি খাটাইছি, কিন্তু ‘বইয়ের বাজার’ এমনই মন্দা যে,...!আচ্ছা, শব্দ যদি মানুষের চিন্তাচেতনা ও মনমানসিকতার আয়না তাহলে, প্রায় পুরোটা জীবন ইলমের সন্নিধ্যে যাপনকারি এই মাওলানা প্রকাশকের সঙ্গে ঐ মহলের একজন বেনিয়া প্রকাশকের সঙ্গে পার্থক্য কোথায়! আমাকে মাফ করো, কিংবা একজন জুতাব্যবসায়ীর সঙ্গে। প্রশ্ন হতে পারে, লেখার সঙ্গে এবং লেখকের সঙ্গে এসব কথার কী সম্পর্ক! কিন্তু কথা হলো! তুমি যদি বই বাজারের ঐ ব্যবসায়ী প্রকাশকের জন্য ‘মুদ্রা উপার্জনের জন্য লিখতে চাও তাহলে আর কোন ঝামেলাও নেই, জটিলতাও নেই, পথও সংক্ষিপ্ত! ঐ যে লেখার জগতের মহান সাধক বলেছেন, ‘লেখে অনেকে, লিখতে জানে কম মানুষ। তুমি কি সেই অনেকের একজন হবে! তোমার সঙ্গে আমার তাহলে কোন সম্পর্ক নেই। তোমার পথ পূবে, আমার পশ্চিমে।

তুমি যদি লেখার সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে চাও তাহলে সবার আগে চিন্তা চেতনা ও মনমানসিকতার মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন আনো। জুতার বাজার ও মাছের বাজারের মত বইয়ের বাজার কখনো বলো না, কখনোই না! আর কখনো দোকানে বই কিনতে যেয়ো না, মাকতাবায় যাও বই সংগ্রহ করার জন্য। বইটার দাম/ মূল্য কতো, বলো না। বলো, অর্থমূল্য কত! কারণ জ্ঞান ও ইলমের বাহক কোন বই বা কিতাবের দাম ও মূল্য কেউ দিতে পারবে না। কোটি টাকা দিয়েও না। সবচে’ ভালো হয় যদি বলো, বইটির হাদিয়া কত! তবে শব্দটি যেন নিছক শব্দ না হয়, চেতনাপূর্ণ শব্দ যেন হয়। ইচ্ছে না হলে, আমার লেখা তুমি পড়ো না। আমি তাই বলবো, তাই লিখবো, চিরকাল যা সত্য বলে বিশ্বাস করে এসেছি। আমি তো সে পথেই তোমাদের ডাকবো যে পথে আমি কল্যাণ দেখেছি; যে পথে আমি...জুতার দোকানে বা মাছের বাজারে গিয়ে যা করো, মাকতাবায় গিয়ে বই নিয়ে তেমন ‘দরাদরি’ করো না। এভাবে বলতে পারো, এর মূল্য তো আমি দিতে পারবো না, কেউ পারবে না। তবে এই পরিমাণ অর্থ আমি দিতে পারি, যা আমার সাধ্যের ভিতরে আছে।

***

জায়গা ফুরিয়ে আসছে, অথচ মূল কথাটি এখনো শুরু করা সম্ভব হয়নি। যথাসম্ভব সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করছি। আমি জানি না, কলমের স্পর্শ তুমি কী উদ্দেশ্যে গ্রহণ করেছো। দ্বীনের জন্য, উম্মাহর জন্য এবং আল্লাহর জন্য তুমি যদি সাহিত্যের সাধক হতে চাও তাহলে তোমার হৃদয় ও আত্মাকে এবং কলব ও রূহকে ঐ সমস্ত মানবিক গুণ অর্জন করতে হবে যা আল্লাহ্ আমাদের কাছে চান। অর্থাৎ তোমাকে ‘আল্লাহ্ওয়ালা’ হতে হবে, তবে, ‘হাতে তাসবীহ্’ এমন আল্লাহ্ওয়ালা নয়, বরং হাতে কলম এবং আল্লামা বিল কলমের আল্লাহ্ওয়ালা। তোমার পরবর্তী সাধনা হবে, কলম ও কলব যেন একত্ম হয়ে যায়। কলম যেন কলবকে সঙ্গ দান করে, আবার কলব যেন কলমকে সঙ্গ দান করে। বিশ্বাস করো, এটা যদি হয় এবং হয়ে যায় তাহলে তোমাকে আর লিখতে হবে না এবং লেখার জন্য ভাবতে হবে না; তোমার হৃদয় থেকে লেখার ঝর্ণা প্রবাহিত হবে। হাঁ, ঐ প্রবাহটা সবসময় আসে না, প্রবাহের প্রতীক্ষায় থাকতে হয়। যখন প্রবাহ শুরু হয় তখন- আখেরাতের কথা বলছি না- ‘দুনিয়া ও মা ফীহা’ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে কলমের সঙ্গে আত্ম-সমাহিত হয়ে যাও। সেটা দুপুর বারোটা হোক, বা রাত তিনটা!

***

আমাদের বড় একটা সমস্যা হলো, শুরুতেই আমরা ঐসমস্ত বিষয় নির্বাচন করি, যার জন্য দেমাগ ও মস্তিষ্কের এবং আকল ও বুদ্ধির প্রয়োজন হয়। পদে পদে তথ্যের  জন্য কিতাব দেখতে হয়। উদূর্তে তাই বলা হয় ‘মযমূন নিগারি’। তখন বিষয় ও তথ্য এবং তথ্যের তাহকীক ও পর্যালোচনাই হয় প্রধান বিষয়, ভাষা হয় শুধু বিষয় ও তথ্যের বাহন। এভাবে কখনো তুমি সাহিত্যের সাধক হতে পারবে না। তোমাকে লেখার উপাদান ও মযমূন সংগ্রহ করতে হবে জগত ও প্রকৃতি থেকে, যার জন্য প্রয়োজন শুধু এবং শুধু দৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টি, প্রয়োজন শুধু এবং শুধু হৃদয় ও হৃদয়বৃত্তি! তেমার দৃষ্টি যেন তাই দেখতে পায় যা তোমার অন্তর্দৃষ্টি দেখতে চায়। জগত ও প্রকৃতির সান্নিধ্যে তুমি যেন তাই অনুভব করো যা তোমার হৃদয় অনুভব করতে চায়। এক কথায়, তোমার আল্লাহ্ জগত ও সৃষ্টিজগতের পরতে পরতে যা কিছু সৌন্দর্য ও মাধুর্য রেখেছেন, যাকিছু বাণী ও বার্তা রেখেছেন, তুমি যেন তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারো। এককথায় তোমার আত্মা যেন প্রকৃতির আবেদন এবং ঊর্ধ্বজগতের আহ্বান শুনতে পায়। যখন যে অবস্থায়ই তুমি থাকো, তোমার কলম যেন প্রকৃতির আবেদনে এবং ঊর্ধ্বজগতের আর্হ্বানে সাড়া দিতে পারে। এই স্তরটি অতিক্রম করার পর তুমি যখন বুদ্ধিবৃত্তিক ও তথ্যভিত্তিক কোন লেখা লিখবে তখন সেই লেখার বাহন ভাষা হবে না, সেই লেখার বাহন হবে সাহিত্য, যার সম্পর্কে আমাদের পেয়ারা নবী বলেছেন, ‘লাসিহরান’! তখন... থাক আর কত বলবো, ‘তখন’!

আমার পেয়ারে ভাই, এখানে এমন কিছু কথা আমার কলমে এসে গিয়েছিলো, যা সত্য হলেও, পাঠকের বুঝের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো। তাই সেটা মুছে দিয়েছি। আবার সুযোগ হলে, আরো কিছু কথা হয়ত বলতে চাইবো। এখন শুধু এ কথা বলে বিদায় নেই- সাহিত্যের সাধনায় আমি যে পথ অনুসরণ করেছি এবং সামান্য হলেও সামনে যেতে পেরেছি, সেটাই এখানে তোমার সামনে তুলে ধরতে চেয়েছি! বাকি, আল্লাহ্ হাফিয! ওয়া হুয়াল ওয়াহ্হাব!

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা