শাবান ১৪৩১হিঃ (১৭)

এসো কলম মেরামত করি

এসো কলম মেরামত করি

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

কিছু দিন আগে লেখার বীজ সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম, আজ একই বিষয়ে কিছু বলতে চাই। তোমার সামনে এই যে সবুজ সুন্দর ছায়াদার গাছটি। এর মূলে আছে ছোট্ট একটি বীজ। কেউ একজন সেই বীজটি মাটিতে রোপণ করেছিলো। তারপর তা থেকে দু’টি পাতার ছোট্ট একটি অঙ্কুর বের হয়েছিলো। তারপর ধীরে ধীরে তা বড় হয়েছে; শাখা-প্রশাখা বিস-ার লাভ করেছে; ফল হয়েছে, ফুল হয়েছে। বহু দিনের বহু যত্ন-পরিচর্যার পর সেই বীজ থেকে বের হওয়া ছোট্ট অঙ্কুরটি আজ সবুজ, সুন্দর, ছায়াদার এক গাছ। বীজ ছাড়া গাছ হয় না; আবার বীজ মাটিতে রোপণ না করে ফেলে রাখলেও তা থেকে অঙ্কুর হয় না; আবার অঙ্কুরের যত্ন-পরিচর্যা না করলে, নিয়মিত পানি না দিলে তা বড় হয় না। একটি লেখা সম্পর্কেও একথা সমান সত্য। তোমার সামনে এই যে সুন্দর একটি লেখা, যা পড়ে তুমি আনন্দ পাও, শিক্ষা লাভ করো, যা থেকে তুমি জীবনের চলার পথে পাথেয় অর্জন করো, শুরুতে এটি ছিলো একটি ছোট্ট বীজ। লেখক হঠাৎ একদিন একটি বীজ পেলেন। বীজটি তিনি তার চিন-ার জমিনে রোপণ করলেন, তা থেকে দু’টি পাতার ছোট্ট একটি অঙ্কুর বের হলো। তারপর লেখক সেই লেখা-অঙ্কুরটির যত্ন-পরিচর্যা করতে থাকলেন পরম ধৈর্য ও সাধনার সঙ্গে। সেই অঙ্কুর ধীরে ধীরে বড় হলো এবং একটি পূর্ণ ‘লেখাবৃক্ষ’-এর রূপ ধারণ করলো। লেখক যদি বীজটি পেয়ে অবহেলা করতেন এবং চিন-ার জমিনে রোপণ না করে ফেলে রাখতেন, তাহলে কিন' লেখার অঙ্কুরটি বের হতো না। তারপর লেখক যদি নিয়মিত যত্ন ও পরিচর্যা না করতেন তাহলে সেই অঙ্কুরটি ধীরে ধীরে বড় হয়ে একটি পূর্ণ লেখার রূপ ধারণ করতো না, যা থেকে মানুষ এখন চিন-ার ছায়া এবং জ্ঞানের ফুল ও ফল লাভ করছে। সব গাছ বটগাছ হয় না, হয় না তালগাছ। বড় গাছ যেমন আছে তেমনি আছে ছোট গাছ। লেখাও তেমনি বড় বা ছোট হতে পারে। সব গাছ যেমন বটগাছ হয় না, তেমনি সব লেখাও বিরাট আকারের হয় না, ছোট্ট কলেবরের ছোট্ট লেখাও হতে পারে। তবে ছোট বা বড় যে কোন লেখার জন্ম, বৃদ্ধি ও বিকাশের প্রক্রিয়াটি কিন' এক ও অভিন্ন। পার্থক্য শুধু একটি বিষয়ে। গাছের বীজ তুমি যে কোন সময় সংগ্রহ করতে পারো সামান্য পয়সার বিনিময়ে, কিন' একটি লেখার বীজ তুমি ইচ্ছা করলেই পাবে না এবং যখন তখন পাবে না। গত সংখ্যার ‘শেষকথা’টি পড়ো। লেখাটি কি তোমার ভালো লেগেছে? তোমার কি মনে হয়, লেখটি থেকে তোমার হৃদয় ও আত্মা প্রশানি-র স্নিগ্ধ কোন ছায়া লাভ করছে; শিক্ষার ফুল ও জ্ঞানের ফল লাভ করছে? এই লেখাটি তৈরী হতো না যদি হঠাৎ একদিন একটি সুন্দর বীজ না পেতাম। কীভাবে পেলাম সেকথাই এখন বলছি। একটি দৈনিক পত্রিকায় একদিন একটি ছবি দেখলাম। খরায় অনাবৃষ্টিতে জমি ফেটে চৌচির। জমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ঐ জমির কৃষক, যেন সর্বহারা একজন মানুষ। চোখের ঘোলা দৃষ্টিতে যেন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, তার সামনে শুধু অন্ধকার ভবিষ্যত। ছবিটি আমার হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করলো। অচেনা অজানা সেই কৃষকটির প্রতি আমি অত্যন- সহানুভূতি বোধ করলাম। আন-রিকভাবে দু‘আ করলাম, আল্লাহ যেন এই অসহায় কৃষকের এবং দেশের সকল কৃষকের কষ্ট দূর করে দেন, যারা নিজেদের ক্ষয় করে এবং শরীরের ঘাম ঝরিয়ে আমাদের জন্য ফসল ফলায়, অথচ বিপদের সময় আমরা তাদের পাশে দাঁড়ানোর কথা ভাবি না। ঠিক তখন, একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে আমি একটি লেখার বীজ পেয়ে গেলাম। আমিও তো এই কৃষকের মত! ফসল বুনে সেই ফসল ঘরে তুলতে না পারা কৃষক এবং ছাত্র গড়ার মেহনত বিফলে যাওয়া শিক্ষক, উভয়ের অবস'া তো একই! তো এটি হলো সেই বীজ, যা থেকে তৈরী হয়েছে শেষকথা লেখাটি। এরকম বা এর চেয়ে হৃদয়বিদারক কত ছবি, কত দৃশ্য আমরা দেখি, কিন-ু আমাদের অন-রে কোন ভাব ও ভাবনার উদয় হয় না; হৃদয়ে ব্যথা ও বেদনা অনুভূত হয় না, ফলে লেখার প্রেরণা আসে না। হয়ত আল্লাহ আমাকে একজন দুঃখী কৃষকের প্রতি মন কেঁদে ওঠার প্রতিদান দিয়েছেন একটি লেখার বীজ উপহার দেয়ার মাধ্যমে। যাই হোক, বীজ থেকে লেখাটা কীভাবে তৈরী হলো এবার সংক্ষেপে তা বলি। আমি ভাবলাম, প্রথমে লিখবো কৃষকের স্বপ্নের কথা, মাঠে ফসল করার সময় তার মনে কত স্বপ্ন ছিলো! তারপর লিখবো তার স্বপ্ন বিপর্যস- হওয়ার বেদনার কথা। তো ‘স্বপ্নের আনন্দ ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা’ এই হলো লেখার দু’টি বাহু। এদু’টিকে সমপ্রসারিত করলেই ধীরে ধীরে লেখাটি সুন্দর অবয়ব লাভ করবে, আর পরিশিষ্টে লিখবো তা থেকে কী শিক্ষা পেলাম সেটা। এভাবে লেখাটা হতে পারতো, কিন' হঠাৎ মনে হলো, ফসলের মাঠ থেকে বাগানে চলে আসি, আর ফসল পুড়ে যাওয়া হতভাগ্য কৃষক থেকে বাগান উজাড় হয়ে যাওয়া মালীর কাছে চলে আসি! এ প্রসঙ্গে পরে আরো কিছু বলার ইচ্ছা আছে। আরেক দিন। সারা পৃথিবীতে, এমনকি বিপর্যস- জীবনের এই বাংলাদেশেও তখন চলছে বিশ্বকাপ-উন্মাদনা। সবক’টি পত্রিকা খেলা ও খেলোয়াড়দের দখলে। এদেশের খেলোয়াড়দের তো মাঠে কোন কাজ নেই, তারা কী আর করবেন, বিশ্বকাপ সম্পর্কে পত্রিকায় কলাম লেখা শুরু করলেন বিশেষজ্ঞ তকমা ধারণ করে। এমনকি যারা কবি তারাও কবিতা ছেড়ে বিশ্বকাপের উপর কলাম লেখা শুরু করলেন। তেমনি এক কবি হলেন ‘রাবীন্দ্রিক শ্মশ্রুমণ্ডিত’ কবি নির্মলেন্দু গুণ। এই কবি সাহেবের ভালো একটি গুণ এই যে, তিনি সোজাসাপ্টা কথা বলেন। তো তিনি একদিন বিশ্বকাপে তার নিজস্ব কলামে লিখলেন- ‘প্রায় প্রতিটি খেলা সম্পর্কে আমার ভবিষ্যদ্বাণীগুলো ফলে যাওয়ায় আমি নিজেই কিছুটা অবাক, সেই সঙ্গে কিছুটা দুঃখিত। দুঃখিত, কারণ আমার ধারণা ছিলো পাঠকের পক্ষ হতে প্রচুর প্রশংসা পাবো। কিন' না, কোন পাঠকের কাছ থেকেই কোন প্রশংসা আসেনি, এমনকি পত্রিকাকর্তৃপক্ষের তরফ থেকেও সামান্য একটি ধন্যবাদও আসেনি। মনটা এত খারপ হলো যে, ভাবলাম, আর লিখবোই না। কিন' ... আমি লিখি এবং লেখার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করি। এটা ঠিক আছে, কিন' অর্থ উপার্জনই তো লেখার একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, সবার জানা থাকা উচিত যে, পাঠকের কাছ থেকে আমি আমার লেখার প্রশংসাও চাই। ... কবি সাহেবের কোন কবিতা আমি পড়িনি, কিন' খেলার লেখাটা পড়ে আমার ভিতরে আশ্চর্য এক আলোড়ন সৃষ্টি হলো। হৃদয়ের পর্দায় যেন আমারই উদ্দেশ্যে একটি প্রশ্ন ভেসে উঠলো; কেন, কিসের জন্য এবং কার জন্য তুমি লেখো? প্রশ্নটি ভেসে উঠলো এবং আমি একটি লেখার বীজ পেয়ে গেলাম। এজন্য কবি সাহেবের প্রতি আমি আন-রিক কৃতজ্ঞ। ‘লেখা কিসের জন্য এবং কার জন্য?’ এই বীজ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে এ সংখ্যার ‘প্রথমকথা’ লেখাটি। বীজ থেকে দু’টি অঙ্কুর বের হয়েছে, আমার লেখা পাঠকের উপকারের জন্য, তবে পাঠকের উদ্দেশ্যে নয়, একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে। আর লেখাটি সমপ্রসারিত হয়েছে এবং শাখা বিস-ার করেছে এ আলোচনা দিয়ে যে, প্রতিটি লেখায় শব্দের আড়ালে লেখকের কিছু আবেগ, অনুভূতি গচ্ছিত। যে পাঠক তা অনুভব করতে পারে সেই হলো আদর্শ পাঠক। এসম্পর্কে পরে আরো কিছু কথা বলার ইচ্ছে আছে। আরেক দিন। একজন আমাকে সুন্দর একটি উপহার দিয়ে বললো, ‘আপনার কাছ থেকে শুধু পেয়ে এসেছি, দিতে পারিনি কিছু। এ সামান্য উপহার আমার অন-রের গভীর কৃতজ্ঞতার সামান্য প্রকাশমাত্র।’ তার কথায় আমি অভিভূত হলাম, আর সঙ্গে সঙ্গে ছোট্ট একটি লেখার বীজ পেয়ে গেলাম। ‘আল্লাহ আমাদের কত কিছু দিয়েছেন এবং দিয়ে চলেছেন, কিন' আমরা আল্লাহকে কী দিয়েছি?’ এ বীজটি থেকেই তৈরী হয়েছে গত সংখ্যার কিশোর পাতার ‘বাতাসের প্রতি কৃতজ্ঞতা’-এর নীচের ছো্‌ট্ট লেখাটি। আরেক দিন আমার এক স্নেহাস্পদ আমাকে একটি ব্যথা দিলো এবং ব্যথাটি আমি পেলাম। একবার ইচ্ছে হলো বলি, তোমার কাছে শ্রদ্ধা যার প্রাপ্য, তাকে যদি এমন কষ্টদায়ক কথা বলো তাহলে তো তোমারই ক্ষতি। বললাম না। খুব শান-ভাবে এবং নীরবে ব্যথাটি বরণ করে নিলাম, আর মনে মনে বললাম, তুমি আমাকে ব্যথা দিয়েছো, আমি তোমাকে ফুল দেবো। তারপর মনে হলো, সেটা যদি গাছের ফুল না হয়ে লেখার ফুল হয় তাহলে কেমন হয়! গাছের ফুল তো দু’দিনেই শুকিয়ে যাবে, লেখার ফুল থাকবে বহুকাল এবং হয়ত চিরকাল, তাছাড়া লেখার ফুল দ্বারা উপকৃত হতে পারে অনেকে। হঠাৎ করে আলোর উদ্ভাসের মত এই চিন-াটি আমার সামনে উদ্ভাসিত হলো যে, লেখার ফুলটি যদি হয় গাছের ফুলকে কেন্দ্র করে তাহলে কেমন হয়? আমার স্নেহাষ্পদ আমাকে বলেছিলো, আপনার প্রতি আমার এই এই অবদান, অথচ আপনি...! তো আমি লেখাটি শুরু করতে পারি এই চিন-াকে কেন্দ্র করে যে, ফুল আমাদের দান করে, না আমরা ফুলকে দান করি? এবং ফুলের প্রতি আমাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত? এই চিন-ার উপর তৈরী হলো গত সংখ্যার ৩১তম পৃষ্ঠার ছো্‌ট্ট লেখাটি, যার বীজটি আমি পেয়েছি ‘ব্যথার দান’রূপে।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা