জুমাদাল আখেরা ১৪৩১হিঃ (১৬)

এসো কলম মেরামত করি

এসো কলম মেরামত করি

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

লেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো উপমা ও রূপক-এর ব্যবহার। একটি সুন্দর উপমা ও রূপকের সুন্দর প্রয়োগ বক্তব্যকে পাঠকহৃদয়ের খুব কাছে নিয়ে আসে। তবে উপমা ও রপকের প্রয়োগে সচেতনতা দরকার। একটি উপমা হয়ত একটি ক্ষেত্রে সুন্দর, কিন' সেটাই অন্যক্ষেত্রে অসুন্দর হতে পারে। সুতরাং ব্যাপক অধ্যয়ন ও অুনশীলনের মাধ্যমে উপমা ও রূপক প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের রুচিশীলতা অর্জন করতে হবে এবং বুঝতে হবে, কোন উপমা কোথায় সুন্দর এবং কোন রূপক কোথায় যথার্থ। আরবী অলঙ্কার শাস্ত্রে বিষয়টি আমরা বিশদভাবে অধ্যয়ন করেছি, সুতরাং আমাদের এ বিষয়ে ভুল হওয়ার কথা নয়। কারণ সব ভাষারই অলঙ্কার মৌলিকভাবে অভিন্ন। নীচের আলোচনাটি দেখো- সাধারণত একজন লেখক তার গ্রনে'র ভূমিকায় ঐ ব্যক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন যিনি বইটি লিখতে তাকে উৎসাহিত করেছেন এবং বিভিন্নভাবে তাগিদ ও তাগাদা দিয়ে তার কাছ থেকে লেখাটি বলতে গেলে আদায় করে নিয়েছেন। এক্ষেত্রে একেকজন একেক রকম ভাষা, ভঙ্গি ও শৈলী ব্যবহার করেন। কেউ কেউ সাধারণ, তবে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় বলেন, আবার কেউ উপমা ও রূপকের সাহায্য গ্রহণ করেন। যেমন একজন লিখেছেন- ‘অমুক তরুণ আলেম জোঁকের মত লেগে থেকে পাণ্ডুলিপিটি আদায় করেই ছেড়েছেন।’ বলো দেখি, ‘জোঁকের মত লেগে থাকা’ দৃশ্যটি কি খুব সুন্দর? তাও একজন আলিমের ক্ষেত্রে? জোঁক তোমার কোন উপকার করে না, শুধু শরীর থেকে রক্ত শোষণ করে নেয়। হাঁ, তুমি যদি কোন সুদী মহাজন সম্পর্কে বলো যে, সুদ আদায় করার জন্য গরীব খাতকের সঙ্গে সে জোঁকের মত লেগে থাকে তাহলে এ উপমাটাই হবে তাৎপর্যপূর্ণ ও হৃদয়গ্রাহী। বই আমি বেশী পড়িনি, তবে নিজের রুচি থেকে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, বাংলাসাহিত্যের মান্য কোন লেখক এরূপ ক্ষেত্রে এরূপ উপমা ব্যবহার করেননি। অবশ্য তুমি যদি তরল রসিকতা করে লিখতে চাও তাহলে এখানে তুমি কাবুলিওয়ালা শব্দটি ব্যবহার করতে পারো। যেমন, অমুক তরুণ আলিম ঠিক যেন সেযুগের ‘কাবুলিওয়ালা’র মত লেগে থেকে...। এটা মোটামুটি চলতে পারে, যদি ব্যক্তিটির সঙ্গে তোমার সম্পর্ক তেমন রসিকতাকে প্রশ্রয় দেয়। তবে আলিম শব্দটি ‘বহরহাল’ পরিহার করতে হবে। আরেকটি কথা, পাণ্ডুলিপির প্রশ্ন আসতো যদি এখানে ব্যক্তিটি প্রকাশক হতেন। যেহেতু ব্যক্তিটি প্রকাশক নন, বরং তোমার পিয়জন, যিনি শুধু চান যে, তোমার কলম থেকে সুন্দর লেখা বের হয়ে আসুক সেহেতু তোমাকে এভাবে বলতে হবে, ‘তিনি আমার সঙ্গে ছায়ার মত লেগে থেকে লেখাটি বের করে/ শেষ করিয়ে ছেড়েছেন।’ পুরো বাক্যটি যদি প্রকাশকের বিষয়ে হয়, আর প্রকাশক লেখককে প্রতারণা করে থাকে তাহলে অবশ্য আলোচ্য উপমাটি চলতে পারে, যেমন- ‘প্রকাশক ভদ্রলোক জোঁকের মত লেগে থেকে শেষ পর্যন- পাণ্ডুলিপিটি আমার কাছ থেকে নিয়েই/আদায় করেই ছাড়লেন।’ *** বাংলায় ‘করাল গ্রাস’ ব্যবহার কার হয়। যেমন, ‘দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে বহু জনপদ শেষ হয়ে গেলো’। সংস্কৃতে করাল মানে কী? মানে বড় বড় দাঁতওয়ালা ভয়ংকর কিছু। তো দুর্ভিক্ষ যেন বড় বড় দাঁতওয়ালা ভয়ঙ্কর কোন জন', যা মুখ হা করে মানুষজন গিলে খাচেছ। গ্রাস করার সাথে মুখের সম্পর্ক আছে। সুতরাং করাল গ্রাস-এর ব্যবহার গ্রহণযোগ্য এবং দুর্ভিক্ষের ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য। বন্যার ক্ষেত্রেও চলতে পারে, এমনকি অশ্লীলতার ক্ষেত্রেও; যেমন অশ্লীলতার করালগ্রাসে যুবসমাজের ভবিষ্যত...। কিন' একজন লিখেছেন, ‘অশ্লীলতার কালো গ্রাস থেকে সাহিত্যকে মুক্ত করতে হবে।’ এটি ‘গ্রাস’-এর সঠিক বিশেষণ নয়। গ্রাস কালো, লাল, বা সাদা হয় না। হয়ত ভাবা হয়েছে, করাল গ্রাস তো সবারই জানা, তাতে একটু নতুনত্ব আনা যাক, কিন' নতুনের মধ্যে অধিকতর উৎকর্ষ থাকা চাই। তিনি লিখেছেন, ‘অশ্লীলতার কালো গ্রাস থেকে সাহিত্যকে মুক্ত করার প্রেরণা নিয়ে আমাদের আজ কলম ধরতে হবে।’ এখানে ‘প্রেরণা’-এর প্রয়োগ সঠিক, কিন' একই পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, ‘যে কবিতায় বা সাহিত্যে অশ্লীলতায় প্রেরণা দান করার মর্ম পাওয়া যায় সেটাই নিন্দনীয় ও অপছন্দনীয়।’ এখানে ‘প্রেরণা’ শব্দের প্রয়োগ ঠিক নয়। কারণ প্রেরণা-এর ব্যবহার হলো ভালোর ক্ষেত্রে, পক্ষান-রে মন্দের ক্ষেত্রে বলা হয় ‘প্ররোচনা’। তাই লোগাতে প্ররোচনা-এর অর্থ লেখা হয়েছে উসকানি। উদাহরণ দেয়া হয়েছে, বন্ধুদের প্ররোচনায় পড়ে ..., লোভের প্ররোচনায় পড়ে...। আর প্রেরণা-এর অর্থ লেখা হয়েছে উদ্দীপনার সঞ্চার। উদাহরণ দেয়া হয়েছে, সৃষ্টির প্রেরণা, লেখার প্রেরণা, দৈব প্রেরণা, নারী চিরকাল পুরুষকে সততা ও সত্যের প্রেরণা যুগিয়েছে। মানুষ শয়তানের প্ররোচনায় মন্দ কাজ করে এবং সাধুর প্রেরণায় সৎ জীবনে ফিরে আসে। আরেকটি বিষয়, ‘অপছন্দনীয়’ হচ্ছে হালকা শব্দ, তার চেয় কঠোর শব্দ হচ্ছে ‘নিন্দনীয়’, সুতরাং নিন্দনীয়-এর পরে অপছন্দনীয়-এর মত লঘু শব্দের ব্যবহার গ্রহণযোগ্য নয়। ‘অনুভূতির স্ফুরণ ও প্রকাশ’ সম্পর্কে একই কথা। স্ফুরণ হচ্ছে প্রকাশ ও বিকাশের সর্বোচ্চ রূপ। সুতরাং স্ফুরণ-এর পর প্রকাশ শব্দটির ব্যবহারের অবকাশ নেই, বিকাশ শব্দটি কিছুটা হলেও চলতে পারে। একই গ্রনে'র লেখক লিখেছেন, ‘ইতিবাচক সাহিত্যের বিপুল ভাণ্ডার গড়ে তোলা উচিত। কারণ অখাদ্য, কুখাদ্য থেকে মানুষকে বাঁচানোর পথ শুধু সতর্কবাণী প্রদান নয়; সুখাদ্য সরবরাহ করা, সুখাদ্য সংগ্রহের পথ চিনিয়ে দেয়া। সচেতনতা ও হিম্মতের সঙ্গে সেই সুখাদ্য প্রস'তের জন্য দরকার বিশুদ্ধ বিশ্বাস ও চিন-ার ধারক অগণিত শব্দকারিগরের, বেশুমার কলম যোদ্ধার।’ ভাণ্ডারের বিশেষণরূপে তিনটি শব্দ এখানে দিচ্ছি, তুমি বিবেচনা করে দেখো, এখানে কোনটি সর্বোত্তম- বিপুল/ বিশাল/ সমৃদ্ধ ভাণ্ডার। সরবরাহ করা এবং চিনিয়ে দেয়া-এর সঙ্গে ‘প্রদান’-এর পরিবর্তে প্রদান করা অধিকতর উপযুক্ত হবে। নচেৎ লিখতে হবে, ... বাঁচানোর পথ শুধু সতর্কবাণী প্রদান নয়; সুখাদ্যের পরিবেশন, সুখাদ্য সংগ্রহের পথপ্রদর্শন। যেভাবেই লিখি, প্রদান ও সুখাদ্য-এর মাঝখানে একটি ‘বরং’, থাকা উচিত। যেমন, ‘কারণ অখাদ্য, কুখাদ্য থেকে মানুষকে বাঁচানোর পথ শুধু সতর্কবাণী প্রদান নয়, বরং সুখাদ্য সরবরাহ করা, সুখাদ্য সংগ্রহের পথ চিনিয়ে দেয়া। ‘ তদ্রূপ লেখা উচিত, সুখাদ্য সরবরাহ করা এবং সুখাদ্য সংগ্রহের পথ চিনিয়ে দেয়া। ‘অখাদ্য ও কুখাদ্য’ লিখতে হবে, কিংবা ‘অখাদ্য-কুখাদ্য’, ‘অখাদ্য, কুখাদ্য’ নয়। আতফ-এর ক্ষেত্রে ‘সচেতনতা ও হিম্মত’ তেমন গ্রহণযোগ্য নয়। লেখা যেতে পারে, ‘সাহস ও হিম্মতের সঙ্গে’, কিংবা ‘হিম্মত ও অটুট মনোবলের সঙ্গে’ কিংবা ‘সচেতনতা ও উদ্দীপনার সঙ্গে’। অগণিত ও বেশুমার-এ অতিশয়তার দোষ রয়েছে। কারণ কলমযোদ্ধা পাবে কোথায়! আমাদের দরকার বেশুমার নয়, বরং কিছু সংখ্যক কলমযোদ্ধা, সেটাও তো পাওয়া কঠিন। আর সাহিত্যকে যেখানে কুখাদ্য ও সুখাদ্য-এর সঙ্গে উপমা দেয়া হয়েছে সেখানে আমরা সাহিত্যের সুখাদ্য প্রস'ত করার জন্য সুযোগ্য কারিগরের কথা বলতে পারি, শব্দকারিগর নয়, কলমযোদ্ধা তো কিছুতেই নয়। কলমযোদ্ধার প্রয়োজন হয় সহিত্যের ময়দানে লড়াই, যুদ্ধ ও মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে, সুখাদ্য প্রস'ত করার ক্ষেত্রে নয়। আমাদের একটি বড় দুর্বলতা এই যে, আমরা কিছু চৌকশ শব্দ শিখে যত্রতত্র তা ব্যবহার করতে লেগে যাই, যথার্থ ব্যবহার হলো কি না ভেবে দেখার কষ্ট স্বীকার করি না। এধরনের দুর্বলতা সংক্রামক ব্যাধি ও ছোঁয়াচে রোগের মত। তাই আমি বলি, সাহিত্য শেখার সত্যি যদি ইচ্ছা থাকে তাহলে এধরনের বইও অখাদ্য মনে করে পরিহার করা উচিত। আসলে চর্চা ও অনুশীলনের ভিত্তিভূমি ছাড়া যে লেখা তৈরী হবে তা এমনই হবে। আমি এখনো বলছি, আগে নিভৃতে নিবিড় চর্চা-অনুশীলন করো, মান্য লেখকদের সাহিত্য গভীর অভিনিবেশসহ অধ্যয়ন করো এবং আস'াভাজন কারো কাছে লেখার অনুশীলন করো, তারপর পাঠকের সামনে পরিবেশনের জন্য লেখা শুরু করো, এবং সেটাও মুদ্রণে দেয়ার আগে উপযুক্ত কাউকে দেখিয়ে নাও। তখন সেটা সত্যিকার অর্থেই হবে সুখাদ্য। হে আল্লাহর আমার কথা যেন হয় আমার সমপ্রদায়ের কল্যাণের জন্য। নিয়তে যদি খুঁত থাকে, তুমি তা শুধরে দাও, আর সাহিত্যসাধনায় আমাকে এবং আমার সকল ভাইকে একই রকম তাওফীক দান করো, আমীন।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা