মুহররম ১৪৩২ হি: (১৮)

এসো কলম মেরামত করি

এসো কলম মেরামত করি

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

নাহ, সুনীলবাবুর রীতিমত গায়ে আগুন ধরানো কথা! মৃত্তিকা ও জলবায়ু সূত্রে তিনি নিজেও পূর্ববঙ্গের মানুষ এবং সম্ভবত খাছ ফারিদপুরের, কিন্তু ‘কঁলকাঁতায়’ গিয়ে অতিমাত্রায় চন্দ্রবিন্দু প্রয়োগ করতে শুরু করেছেন। তার মতে পূর্ববঙ্গীয়দের নাকের ভিতরে ‘মাংস’ বেশী, তাই তারা চন্দ্রবিন্দু উচ্চারণ করতে পারে না। সুনীলবাবুর অভিযোগটা আংশিক সত্য হলেও ‘নাকের ভিতরে মাংস বেশী’ এ উপসর্গটি তিনি যোগ করেছেন বোধহয়  গায়ে পড়ে ঝগড়া করার মতলবে।

(সম্ভবত বা হয়ত অর্থে ‘বোধহয়’ একসঙ্গে, অনুভূত হয় অর্থে আলাদা, যেমন- বোধহয় আমাদের প্রতি দাদাবাবুদের ঈর্ষা বোধ হয়।)  

এমনিতে সুনীলবাবুকে জ্ঞান দান করার উদ্দেশ্যে বলছি, আমাদের গায়ে গতরে একরত্তি ‘মাংস’ নেই, যা আছে সব গোশত। 

যাকগে, সুনীলবাবু! প্রতিজ্ঞা করছি, অচিরেই আমার ছাত্ররা আপনার সঙ্গে চন্দ্রবিন্দু প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবে, আশা করি তখন আমাদের প্রতি আপনার কোন ‘শেঁকায়াত’ থাকবে না এবং আমাদের নাক নিয়ে ইয়ার্কি করারও ‘সুঁযোগ’ থাকবে না!

তো শোনো ছেলেরা, এখনই চন্দ্রবিন্দুর মশক শুরু করে দাও একেবারে অ-আ থেকে।

***

অ-তে অবশ্য চন্দ্রবিন্দু তেমন একটা নেই। বিস্ময় প্রকাশ, বা সাড়া দেয়ার জন্য কেউ কেউ বলে, অ্যাঁ! তাতে চন্দ্রবিন্দু আছে।

আ-তে কয়েকটি চন্দ্রবিন্দু আছে। যেমন, অাঁক, মানে দাগ বা রেখা। তো পেন্সিল দিয়ে কাগজে অাঁক দিতে চন্দ্রবিন্দু লাগে, কারণ আঁক-এর মূল হচ্ছে অঙ্কন (ঙ+ক সংযুক্ত)। তো অঙ্কন-এর ঙ অাঁক-এ এসে চন্দ্রবিন্দু হয়েছে।

ছবি অাঁকা মানে অঙ্কন করা, আর আঁকা ছবি মানে অঙ্কিত ছবি। প্রাণীর ছবি তো আমরা অাঁকি না, প্রকৃতির ছবি আঁকি; তো ছবিঅঙ্কন-প্রতিযোগিতায়, গ্রাম, নদী, সবুজ বনানী, কিংবা সাদা সাদা মেঘের ফাঁকে নীল আকাশ, যে ছবিই তুমি আঁকো এবং ছবিটি তোমার যত সুন্দরই হোক, চন্দ্রবিন্দু ছাড়া যদি ‘আকো’, পুরস্কার পাবে না, পাবে শুধু তিরস্কার।

আঁকাবাঁকা পথ চলতে হলেও চন্দ্রবিন্দু চাই, এবং একটি নয়, দু’টি, নইলে কপালে দুর্ভোগ আছে; পথ হারিয়ে শুধু পেরেশান হবে। যাকে জিজ্ঞাসা করবে, মুখস্থ বলে দেবে, ‘সামনে যান’।

অাঁকা ও আঁচড় কাটা তো প্রায় একই জিনিস। নখ দিয়ে আঁচড় কাটে, আর চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ায়। তো চন্দ্রবিন্দু দিয়ে অাঁচড়ালে চুলগুলো বেশ পরিপাটি হয়।

আঁখ ও আঁখি মানে হলো চক্ষু, কবিতায় ব্যবহৃত হয়। কে যেন বলেছেন, ‘আঁখিজলে মোর বুক ভাসে’। আরেকটা আখ হলো ইক্ষু। চন্দ্রবিন্দু ছাড়াই, তাতে প্রচুর রস থাকে, চন্দ্রবিন্দুতে বরং রস কমে যায়।

‘তোমাকে দেখার জন্য মনটা আমার সেই কবে থেকে আঁকুপাঁকু করছে!’ কারো কারো মন আবার আঁকুবাঁকু করে। তা যেমনই করুক, কষ্ট করে দু'টো চন্দ্রবিন্দু দিয়ো, সুনীলবাবুকে কটাক্ষ করার সুযোগ দিয়ো না।

কোনকিছু আঁকড়ে ধরার জন্যও চন্দ্রবিন্দু চাই। আমার এক ছেলে লিখেছে, পুষ্পকে আমি সারা জীবন ‘আকরে’ ধরে রাখবো। উত্তরে লিখেছিলাম, বাবা, ঠিকমত আঁকড়ে ধরো, নইলে হাত থেকে পড়ে যেতে পারে; তখন আবার আমাকে দোষ দিয়ো না যেন!

অাঁকড়া মানে কিছু ঝুলিয়ে বা আটকে রাখার জন্য বাঁকানো লোহা বা আংটা, ইংরেজিতে বলে ‘হুক’। আমি তো চন্দ্রবিন্দু দিলাম, তুমি কষ্ট করে লোগাত খুলে দেখে নিয়ো।

অাঁকশি, বা অাঁকুশি, জিনিসটা হলো গাছ থেকে ফল পাড়ার জন্য বাঁকানো দন্ড। শৈশবে গ্রামের বাড়িতে অাঁকশি দিয়ে লিচুগাছ থেকে লিচু পেড়েছি, চন্দ্রবিন্দুর কথা তখন জানা ছিলো না।

আঁচ মানে আন্দায, অনুমান, ধারণা। ‘এমনটি যে ঘটবে তা আমি আগেই আঁচ করতে পেরেছিলাম।’ ‘তোমার উচ্চারণ থেকেই আঁচ করা গেছে যে, লিখতে সময় তুমি চন্দ্রবিন্দু ছাড়া ‘আচ’ লিখবে, আর মাস্টার- মশায়ের কানমলা খাবে।’

আবার আঁচ মানে আগুনের হালকা তাপ। ‘মা মেয়েকে বললেন, উনুনের এক আঁচেই চেহারা এমন লাল, তো রান্না শিখবে কীভাবে?’

‘মাথার উপর মায়ের আঁচলের ছায়া থাকা’ মানে মা বেঁচে থাকা, তো যাদের মাথার উপর এখনো মায়ের আঁচলের ছায়া আছে তারা বড় ভাগ্যবান। ‘মায়ের আঁচল-ধরা ছেলে’ মানে যে ছেলে সবসময় মায়ের আঁচল ধরে থাকে, অর্থাৎ মায়ের সঙ্গে সঙ্গে থাকে। মা বলেন, ‘তুই আমার সাতরাজার ধন, খোদার কাছে আঁচল পেতে তবেই না তোকে পেয়েছি।’

খাবার খেয়ে আমরা হাত-মুখ ধুই, আর দাদাবাবুরা আঁচায়, শুনতে কি খুব ভালো লাগে! তাতে আবার চন্দ্রবিন্দু!

মানুষের শরীরে আঁচিল থাকে, আর অাঁচিলে চন্দ্রবিন্দু থাকে, কিন্তু মুশকিল হলো, লিখতে গিয়ে মনে থাকে না।

রাখাল হাঁটু পানিতে নেমে আঁজলা ভরে পানি পান করে। এক আঁজলা পানি, এক আঁজলা ফুল, এমনকি এক আঁজলা চালও হতে পারে, তবে চন্দ্রবিন্দু না থাকলে পানি বলো, ফুল বলো, আর চাল বলো, হাতের ফাঁক গলে সব পড়ে যাবে। সংস্কৃত শব্দটি হচ্ছে অঞ্জলি, তাহলেই বোঝো, অাঁজলায় কেন চন্দ্রবিন্দু লাগে!

আঁটসাঁট পোশাক পরা ভালো নয়, তা তো জানো, কেন ভালো নয় তা জানো না! কারণ অাঁটসাঁট পোশাকে একসঙ্গে দু’টি চন্দ্রবিন্দুর বোঝা বহন করতে হয়।

আটা দিয়ে রুটি তৈরী করো, তাতে চন্দ্রবিন্দু নেই, আর সব আঁটা-তে চন্দ্রবিন্দু আছে। যেমন, ‘জানতে পারি, মনে মনে কী ফন্দি আঁটছো।’ ‘এ ছোট্ট জায়গায় এত লোক আঁটবে কেন!’ ‘তুমি যে চালাক, নাহ, তোমার সঙ্গে আর এঁটে ওঠা যাবে না।’ ‘যা চোর-ডাকাতের ভয়, দরজার খিলটা ভালো করে এঁটে দাও তো।’

‘আম খাবে তুমি, আঁটি গোণবো আমি, এই বুঝি ইনসাফ?!’ কে আম খেলো, কে আঁটি গুণলো, আমার তাতে কিছু যায় আসে না। আমি শুধু বলবো, চন্দ্রবিন্দুটার প্রতি খেয়াল রেখো।

এই আঁটি মানে কী, মানে বড় বীচি; আরেকটি আঁটি মানে তৃণ বা শস্যের বেঁধে রাখা গুচ্ছ, শাকের আঁটি, ঘাসের আঁটি, মুলোর আঁটি, ইত্যাদি। চাষী বলে, ‘পাটখড়িগুলো আঁটি বেঁধে রাখো।’

অনেক কষ্টের পর যদি সামান্য একটু কষ্টও আসে, সহ্য করা যায় না, তখন বলে, ‘এ তো দেখছি বোঝার উপর শাকের আঁটি!’ অর্থাৎ বোঝাটা তো কোনক্রমে সহনীয় ছিলো, কিন্তু তার উপর

সামান্য একটি শাকের আঁটি যুক্ত হওয়ায় আর ভার বহন করা সম্ভব হচ্ছে না।

আঁটকুড়ে, মানেটা লোগাতে দেখো, আর চন্দ্রবিন্দুটা দেখো এখানে।

কী, মরা লোকটাকে জানাযার খাটিয়ায় উঠে বসতে দেখে ভূত দেখার মত ‘আতকে’ উঠেছো?! ভয়ের কিছু নেই, আসলে লোকটা মরেনি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, চন্দ্রবিন্দুটা গেলো কোথায়? চন্দ্রবিন্দু থেকে যদি বাঁচতে চাও তাহলে বলো, ‘চমকে উঠেছি’।

তোমার ‘আতকে’ ওঠা দেখে আমিও কিন্তু আঁতকে উঠেছি, মানে চমকে উঠেছি!

ত-টা অবশ্য খন্ডৎ চলতে পারে।

লোকটার কথা শুনে আঁতে ঘা লাগে। আঁত/ৎ মানে অন্ত্র, আর তা থেকেই এসেছে চন্দ্রবিন্দু। এই যা! অন্ত্র মানেও তো বোঝো না! মানে হলো নাড়ী। (‘নাড়িভুঁড়ি’ কিন্তু হ্রস্ব-ইকার, আর ভুঁড়ির সাইজটা যেমনই হোক, চন্দ্রবিন্দু চাই!)

আঁতাত, একটি রাজনৈতিক শব্দ। মানে হলো পরস্পরের যোগসাজশ বা বন্ধুত্ব। নিজেদের মধ্যে আঁতাত অটুট রাখতে হলে কী করতে হবে? উত্তরটা তুমিই বলো, বুদ্ধির পরীক্ষা হোক না!

আঁতিপাঁতি করে খোঁজা মানে তন্নতন্ন করে সর্বত্র খোঁজা। বলো দেখি, এখানে চন্দ্রবিন্দু ক’টি?!

ভালো কথা, আজকেই পেলাম চিঠিটা, মেয়েটির হাতের লেখা যেমন সুন্দর, তেমনি বানানে নির্ভুল। ছোট্ট একটি সমস্যা ছিলো শুধু, ‘চন্দ্র বিন্দু’ আলাদা করে লিখেছে। আমারই দোষ, আগে সাবধান করিনি কেন!

যাদের জ্ঞানের আলোতে বিশ্ব আলোকিত হলো, আজ তাদের ঘরে আঁধার কেন বলো?! আঁধার মানে অন্ধকার, তাহলে বলো তো, চন্দ্রবিন্দু ছাড়া কি ‘অাঁধার দূর হতে পারে?

আঁশ ও আঁষ (দ্বিতীয়টির ব্যবহার কম) মানে সূক্ষ্ম তন্তু বা রোঁয়া। পাটকে আদর করে বলা হতো, ‘সোনালী আঁশ। কাঁচা পয়সা আসতো যে! এখন আর আসে না, সোনালী অাঁশও বলা হয় না। এখন তো পাট জাগ দেয়ার পানিও নেই। দাদাবাবুরা খালি গাঙ্গে বাঁধ দেয়, আর চন্দ্রবিন্দুটা ভুলেও বাদ দেয় না। আমরা বাঁধা দেই চন্দ্রবিন্দু দিয়ে, তাই আমাদের বাধায় কাজ হয় না, পানিও আসে না!

আরেকটা হলো মাছের আঁশ। রুইমাছের আঁশ ছিলো আমাদের খেলার পয়সা। যার কাছে যত অাঁশ সে তত পয়সাওয়ালা!

যা! শেষ শব্দটি হলো কিনা আঁস্তা -কুড়, মানে আবর্জনা ফেলার স্থান! ঐ যে বলে, ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়া! যাদের চন্দ্রবিন্দুজ্ঞান নেই তারা কিন্তু ভাষার আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হতে পারে।

আমার এক ছাত্র বলে, সে চন্দ্রবিন্দু দেবে অাঁস্তাকুড়ে-এর ‘কুড়ে’-তে। লোগাত দেখিয়ে তবে তাকে ঠান্ডা করেছি।

 

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা