যিলক্বদ ১৪৩০হিঃ (১৪)

তোমাদের পাতা

আমাদের কয়েকটি মৃত্যু!

লিখেছেনঃ নোমান আসলাম বাইতুস্‌সালাম

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট
একটি গাছ একসময় সবুজ-সজীব ছিলো, একসময় তা শুকিয়ে যেতে লাগলো। গাছটির ফলে-ফুলে ও স্নিগ্ধ ছায়ায় যারা বড় হয়েছিলো তারা তাদের সাধ্যের ভিতরে সবটুকু চেষ্টাই করলো গাছটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য; হাঁ, শুধু বাঁচিয়ে রাখার জন্য। শুধু এতটুকুই ছিলো তাদের সবার প্রাণের ব্যাকুলতা; গাছটি আগের মত সবুজ-সজীব না হোক, সেই স্নিগ্ধ ছায়া আর না থাকুক, তবু গাছটি শুধু বেঁচে থাকুক। কিন্তু না, গাছটি বাঁচলো না। ডালগুলো কবেই শুকিয়ে গিয়েছিলো, পাতাগুলো আগেই ঝরে গিয়েছিলো, এবার শুকনো কাণ্ডটাও পড়ে গেলো মাটিতে। শিকড়গুলো যে আলগা হয়ে গিয়েছিলো মাটি থেকে! এ উপমাটাই আমার মনে পড়লো আজ আমাদের বর্ষের এক ছাত্রভাইয়ের আব্বার ইনতিকালের খবর শুনে। দেশে, বিদেশে বিভিন্ন চিকিৎসার মাধ্যমে তারা প্রাণপণ চেষ্টা করেছে তাদের বাবাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। হাজারো রকম তদবীর করেছে; আল্লাহর দরবারে চোখের পানি ফেলেছে; কাকুতি-মিনতি করেছে; হে আল্লাহ, ‘আব্বাকে তুমি শুধু বাঁচিয়ে রাখো। তিনি বিছানায় শুয়ে থাকুন, তবু বেঁচে থাকুন। কিন্তু তিনি বাঁচলেন না, তার জীবনের নিভু নিভু প্রদীপটি বাতাসের সামান্য একটি ঝাপটায় শেষ পর্যন্ত নিভেই গেলো! যখন ‘আজল’ এসে যায় তখন সজল চোখের মিনতি ব্যর্থ হয়ে যায়। মৃত্যুর সময় তার বড় কষ্ট ছিলো একথা ভেবে যে, সন্তানদের তিনি অনেক কষ্ট দিয়ে যাচ্ছেন! সন্তানদের কষ্ট! আর সারাটা জীবন তিনি যে সন্তানদের জন্য রক্ত পানি করেছেন! বাবাদের তা মনে থাকে না, মনে থাকে শুধু সন্তানদের কষ্টের কথা! বাবারা এজন্যই তো বাবা! *** কিছুদিন আগে আমাদের আরেক ছাত্রভাইয়ের আম্মা একইভাবে চিরবিদায় গ্রহণ করেছেন। একই রকম চেষ্টা ও দৌড়-ঝাঁপ, একই রকম আকুতি ও মিনতি এবং একই রকম প্রার্থনা ও অশ্রুপাত এবং ..এবং একই পরিণতি! অনেক রক্তের প্রয়োজন ছিলো, আমরা সবাই অসহায় ও দিশেহারা আমাদের ছাত্রভাইটির পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। হাসিমুখে রক্ত দিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রক্তের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলো। জীবন যখন ফুরিয়ে যায়, রক্তের প্রয়োজনও ফুরিয়ে যায়। *** কিছুদিন পর আবার এলো মৃত্যুর ডাক, আবার চলে গেলেন আমাদের বর্ষের একজনের মা। তার মৃত্যু ছিলো অনেক কষ্টের। অসহায়ের মত চেয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার ছিলো না। যে মা ফোঁটা ফোঁটা দুধ দিয়ে সন্তানের জীবন রক্ষা করেছেন, সেই সন্তানেরা শেষ মুহূর্তে তাদের মায়ের মুখে দিতে পারেনি ওষধের কয়েকটি ফোঁটা। কারণ আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো তাদের সামর্থ্যের শেষ বিন্দুটুকুও। ফোঁটা ফোঁটা পানি অবশ্য তারা দিতে পেরেছিলো মায়ের মৃত্যুযন্ত্রণাকাতর মুখে! আর তাতেই মরণপথের যাত্রী মা ফিরে তাকিয়েছিলেন সন্তানের মুখের দিকে এবং যেন ঘোলাটে চোখের নীরব চাহনি দ্বারা জানিয়েছিলেন কৃতজ্ঞতা। ফোঁটা ফোঁটা দুধের বিনিময়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি পেয়েও কৃতজ্ঞ! মায়েরা এজন্যই তো মা! হায়, এযুগের সন্তান এমন মা-বাবার জন্য তৈরী করে ‘বৃদ্ধাশ্রম’। ধিক তোমাকে হে আধুনিক শিক্ষা! হে আধুনিক সভ্যতা! আর হে আল্লাহ তোমার শোকর, তুমি আমাদের দান করেছো, ‘রাব্বিরহামহুমা’-এর শিক্ষা। জীবনের চলার পথে শুরুতেই যারা হারিয়ে ফেলে বাবার স্নেহছায়া এবং মায়ের মমতার আঁচল তারাই বুঝতে পারে তার মূল্য এবং বুঝতে পারে জীবন কত কঠিন, আর জীবনের রোদ কত প্রখর! আল্লাহ তাদের সবাইকে ছবর ও সান্ত্বনা দান করুন, আল্লাহ তাদের জীবনের চলার পথ মসৃণ করুন। সবার মাকে, বাবাকে আল্লাহ শান্তিতে রাখুন। এখনো যাদের মা-বাবা বেঁচে আছেন আল্লাহ তাদের দীর্ঘ ও সুখী জীবন দান করুন। আমীন।
শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা