রবিউছ ছানী ১৪৪৫ হিঃ

তোমাদের পাতা

আসুন বাঁচার চেষ্টা করি!

গীবত থেকে তাওবা করার পদ্ধতি

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

গীবত থেকে তাওবা করার পদ্ধতি 

 

الحمد لله رب العالمين والعاقبة للمتقين؛ والصلاة والسلام على رسوله الكريم؛ وعلى آله وأصحابه أجمعين؛ أما بعدহাকীমুল উম্মত হযরত থানবী রহ. বলেন, যদি কারো সম্পর্কে গীবত হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে আল্লাহ্র কাছে ইস্তিগফার যেমন করতে হবে তেমনি যার গীবত করা হয়েছে তার কাছেও মাফ চাওয়া জরুরি। তবে গীবতের বিশদ বয়ান দেয়া ঠিক নয়। কেননা তা আরো কষ্টের কারণ হবে। শুধু এটুকু বলা যথেষ্ট যে, আপনার সম্পর্কে যা বলেছি, শুনেছি সব মাফ করে দিন। (আনফাসে ঈসা, পৃ. ১৫১)এখানে হযরত হাকীমূল উম্মত থানবী রহ. গীবতের গোনাহ থেকে তাওবার উপায় বলেছেন। গীবতের আসল সম্পর্ক হলো হুক‚কুল ইবাদের সঙ্গে, বান্দার হকের সঙ্গে। কারণ এতে (মুসলিম বা অমুসলিম) বান্দার হক নষ্ট করা হয়। আর বান্দার হক বান্দা মাফ না করা পর্যন্ত মাফ হয় না। সুতরাং আমার কারণে যদি কারো শারীরিক, মানসিক, বা অন্যকোন প্রকার কষ্ট হয়ে থাকে তাহলে শুধু তাওবা দ্বারা তা মাফ হবে না, বরং ঐ বান্দার মাফ করা জরুরি।যে গোনাহের সম্পর্ক আল্লাহ্র হকের সঙ্গে, নামাযে অবহেলা, নযরের খেয়ানত ইত্যাদি, এগুলোও অবশ্যই বড় গোনাহ, তবে এদিক থেকে এগুলো সহজ যে, এগুলো শুধু আল্লাহ্র হক, সতুরাং বান্দা যদি অন্তর থেকে লজ্জিত হয়, অনুতপ্ত হয়, আর ভবিষ্যতে ঐ গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার প্রতিজ্ঞা করে তাহলেই আশা করা যায়, আল্লাহ্ তার তাওবা কবুল করবেন এবং গোনাহ মাফ করে দেবেন। পক্ষান্তরে বান্দার হক থেকে মাফ পাওয়া এত সহজ নয়। যতক্ষণ না বান্দা নিজে মাফ করবে, যার  হক নষ্ট করা হয়েছে, ততক্ষণ তা মাফ হবে না।তো বুঝতে হবে যে, কারো গীবত করা ঐ প্রকারের গোনাহ, অর্থাৎ এর সম্পর্ক হলো বান্দার হকের সঙ্গে। সুতরাং গীবত করার পর কেউ যদি শুধু তাওবা করে যে, আয় আল্লাহ্, আমার গীবতের গোনাহ মাফ করে দেন, তাহলে মাফ হবে না, যতক্ষণ না ঐ বান্দার কাছে মাফ চাওয়া হবে, যার গীবত করা হয়েছে। এজন্যই হযরত থানবী রহ. বলেছেন, কারো গীবত হলে ইস্তিগফার তো করবেই, তাওবা তো করবেই, তবে যার গীবত করা হয়েছে তার কাছে মাফও চাইতে হবে।গীবতের বিবরণ জরুরি নয়হযরত থানবী রহ. বলেছেন, ‘তবে গীবতের বয়ান শোনানো জরুরি নয়। কারণ তাতে তো তার কষ্ট আরো বাড়বে। যেমন তাকে একথা বলা যে, অমুক সময় অমুকের সামনে তোমার গীবত করেছি, তোমার এই এই দোষ বলেছি, এখন আমাকে মাফ করে দাও। এতে তো তার কষ্ট পাওয়ার আশঙ্কা আছে। সুতরাং বিশদ বয়ানের পরিবর্তে শুধু এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, আমি তোমার কোন গীবত করে থাকলে তুমি মাফ করে দাও। দেখুন, আল্লাহ্ কত সহজ রাস্তা খুলে রেখেছেন।‘বলা-শোনা’ মাফ করে দাওআমাদের বড়দের মধ্যে একটি নিয়ম আছে বড়ই প্রজ্ঞাপূর্ণ। ছোট থেকেই শুনে আসছি, যখনই দু’চারজন কিছু সময়ের সঙ্গে একত্র হতেন এবং তাদের মধ্যে বিভিন্ন কথাবার্তা হতো, তখন বিদায়ের সময় একে অপরকে বলতেন, ‘ভাই বলা-শোনা মাফ করে দাও।’ যা বলেছি বা শুনেছি তাতে যদি তোমার কষ্ট পাওয়ার মত কিছু থাকে তাহলে তা মাফ করে দাও।’কারণ ঘরে বা সফরে যেখানেই হোক দু’চারজন একত্র হলে পরস্পরের কিছু না কিছু হক নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই বিদায়ের সময় সাধারণভাবেই মাফ চেয়ে নে য়া ভালো। নইলে পরে যখন মনে পড়বে, অমুক সাক্ষাতের সময় অমুকের এই হক তো আমার দ্বারা নষ্ট হয়েছে তখন মাফ চাওয়ার জন্য তাকে কোথায় খুঁজে বেড়াবে! কে জানে, পাওয়া যাবে কি না, মাফ চাওয়ার সুযোগ হবে কি না। সুতরাং আলাদা হওয়ার আগেই মাফ চেয়ে নেয়া ভালো। বাক্যটি এমন সর্বব্যাপী যে, সমস্ত হকের বিষয় তাতে এসে যায়, গীবতের বিষয়টাও এসে যায়। হযরত থানবী রহ.র নীতিআমি হযরত ডাক্তার আব্দুল হাই আরেফী রহ.র কাছে শুনেছি, হযরত থানবী রহ. বলতেন,  যখন কেউ বলে যে, আপনার গীবত করেছি, আমাকে মাফ করে দিন। আমি তখন বলি, ভাই মাফ তো অবশ্যই করে দেবো, তবে আমাকে বলো, কী গীবত করেছো? যার হক নষ্ট করা হয়েছে, তার তো অধিকার আছে, ঐ হক সম্পর্কে জানার! এর একটা উপকার তো এই হতো যে, আমার দোষ সংশোধন করার সুযোগ হতো। কারণ গীবত সবসময় মিথ্যা হওয়া তো জরুরি নয়, সত্যও তো হতে পারে!দ্বিতীয়ত এর দ্বারা জানা যেতো যে, আমার অগোচরে মানুষ আমার সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করে। সামনাসামনি তো মানুষ প্রশংসাই করবে, ভালোই বলবে। তবে তোমার পিছনে লোকে তোমার সম্পর্কে কী বলে সেটা জানা তোমার জন্য খুবই উপকারী। কারণ সবসময় প্রশংসা শুনতে থাকলে আত্মতুষ্টির ভাব আসার আশঙ্কা থাকে, কারণ তখন ভাবতে পারে, মানুষ যখন আমার এত প্রশংসা করছে তখন আমার মধ্যে কোন গুণ ও পূর্ণতা নিশ্চয় আছে! তো তখন তুমি নিজে তোমার চিকিৎসা করতে পারবে একথা ভেবে যে, সামনাসামনি প্রশংসা হলে কী হবে. পিছনে তো মানুষ তোমার এই এই দোষ বলে! এজন্য হযরত থানবী রহ.র কাছে যারা গীবতের জন্য মাফ চাইতে আসতো, তিনি তাদের বলতেন, মাফ তো অবশ্যই করবো, তবে আগে আমাকে বলো, কী কী গীবত করেছো!সংশ্লিষ্ট সবার কাছে সংক্ষেপে মাফ চেয়ে নাওএখন কথা হলো, যার সম্পর্কে গীবত করেছি বলে জানা আছে তার কাছে মাফ চেয়ে নেয়া তো সহজ, কিন্তু পিছনে কত মানুষের গীবত করেছি, তা তো মনে নেই। এখন কি তাদের তালিকা তৈরী করে মাফ চাইতে হবে! আমার আব্বাজান হযরত মুফতী মুহম্মদ শফী রহ. বলতেন, আরে ভাই, জান্নাত তো পেতে চাও, তো জান্নাত পাওয়া কি এত সোজা! সুতরাং আগে খুব কাছের মানুষদের, ঘরের মানুষ, চাকর নওকর, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী, তারপর দূরের পরিচিত মানুষ-জন, সবার তালিকা তৈরী করো তারপর তাদের কাছে গিয়ে (বা পত্র লিখে, ফোন করে) সংক্ষেপে মাফ চেয়ে নাও যে, ভাই, কখন কোন অসতর্ক মুহূর্তে তোমার কী গীবত করেছি, বা কী হক নষ্ট করেছি, আল্লাহ্র ওয়াস্তে মাফ করে দাও, তোমাকেও আল্লাহ্ মাফ করে দেবেন।সুবহানাল্লাহ্, দেখুন নবীর সুন্নত!আমার, আপনার কী আর মূল্য! যিনি দোজাহানের সরদার, যিনি উম্মতের জন্য উসওয়াতুন হাসানাহ, রাসূলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, দেখুন, দেখুন, ছাহাবা কেরামের মজলিসে মাফ চেয়ে বলছেন, আমার উপর যদি কারো হক থাকে তাহলে আমার থেকে তা আদায় করে নাও! কেউ যদি শারীরিক কষ্ট পেয়ে থাকো তাহলে হয় শোধ নাও, নয় মাফ করে দাও!সুবহানাল্লাহ্, এক ছাহাবী দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! একদিন আপনি আমার কোমরে আঘাত করেছিলেন, সেই হক আমার পাওনা আছে! আল্লাহ্র নবী বললেন, তাহলে তুমিও আমার কোমরে আঘাত করে বদলা নিয়ে নাও।ছাহাবী কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! তখন আমার কোমরে কাপড় ছিলো না, এখন তো আপনার কোমরে কাপড় রয়েছে!রহমতের নবী তখন অ¤øান বদনে কাপড় সরালেন। ছাহাবী তখন কী করলেন! তাঁর তো নিয়ত ছিলো মোহরে নবুয়তে চুমু খাওয়া! তো তিনি সামনে এসে মোহরে নবুয়তে চুমু খেলেন, আর বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্, এটাই হলো আমার বদলা!কিন্তু আল্লাহ্র নবী তো নিজেকে এমনভাবে প্রস্তুত রেখেছিলেন যে, সাধারণ থেকে সাধারণ এবং ছোট থেকে ছোট মানুষও যদি তার পাওনা নিতে চায় যেন নিতে পারে! আসলে অন্তরে যখন আল্লাহ্র ভয় এবং আখেরাতের চিন্তা থাকে তখন মাফ চাওয়া দ্বারা দুনিয়ার যে বাহ্যিক লজ্জা, অপমান সেটাকে কিছুই মনে হয় না। কিন্তু নফস ও শয়তান আমাদের চিন্তায় এটাকে এতই কঠিন করে রেখেছে যে, মাফ চাইলে তো নাক কাটা যাবে! মানুষের সামনে ছোট হয়ে যাবে, ইজ্জত চলে যাবে! আরে, আখেরাতের নাজাতের জন্য আমরা তো এমন হাযারো লজ্জা ও বেইজ্জতির জন্য খুশিমনে তৈয়ার!আমার আব্বাজানের মাফ চাওয়াআমার মুহতারাম আব্বাজান, হযরত মাওলানা মুফতী মুহম্মদ শফী রহ. যখন হাসপাতালে জ্ঞান ফিরে পেলেন তখন প্রথম আমাকে যা বলেছিলেন তা হলোÑ ‘পরিচিত সবার কাছে আমার পক্ষ হতে একটি আবেদন লিখে পাঠাও যে, আমি যদি কারো গীবত করে থাকি, বা কারো কোন ক্ষতি করে থাকি তাহলে সে যেন বদলা নিয়ে নেয়, বা আমাকে মাফ করে দেয়।আলহামদু লিল্লাহ্, আমি আব্বাজানের হুকুম পালন করেছিলাম।মোটকথা, বান্দার হক থেকে মাফ পাওয়ার জন্য শুধু তাওবা ইস্তিগফার যথেষ্ট নয়, বরং যার হক, তার কাছ থেকেও মাফ পেতে হবে। আর গীবত বান্দার হক, সুতরাং যার গীবত করা হয়েছে তার কাছে মাফ চাওয়া জরুরি, আর যদি জানা না থাকে তাহলে সাধারণভাবে সবার কাছে মাফ চাওয়া কর্তব্য যেমন আব্বাজান রহ. করেছেন।যার গীবত করেছো তার প্রশংসা করোএরপর হযরত থানবী রহ. বলেছেন, ‘এটাও জরুরি যে, যাদের কাছে তার গীবত করেছো তাদের সামনে তার প্রশংসা করে প্রমাণ করো যে, তোমার আগের কথা ভুল ছিলো। (প্রাগুক্ত)কারণ মাফ তো চেয়েছো, তাওবাও করেছো, কিন্তু গীবতের মাধ্যমে মানুষের মনে তার সম্পর্কে তুমি যে ঘৃণা ও ভুল ধারণা সৃষ্টি করেছো তার ক্ষতিপূরণও তো জরুরি। সুতরাং তার প্রশংসা করো এবং বলো, আমার আগের কথা ভুল ছিলো।এরপর তিনি বলেন, ‘যদি তোমার গীবত সত্য হয়ে থাকে তাহলে এভাবে বলো যে, শুধু একথার কারণে তার প্রতি খারাপ ধারণা করো না, কারণ আমারই তো ঐ কথার উপর পূর্ণ আস্থা নেই। এমন করে বলাটা ভুলও নয়, কারণ অহী ছাড়া কোন কথার উপর পূর্ণ আস্থা রাখা যায় না। (প্রাগুক্ত)দেখুন, কী প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ! কারণ অগোচরে যে দোষের কথা বলেছি তা সত্য হলেও গীবত, আর মিথ্যা হলে তো অপবাদ! তো গীবত সত্য হলে তো বলতে পারি না যে, ঐ কথা মিথ্যা ছিলো; তবে এভাবে অবশ্যই বলতে পারো যে, ঐ কথার উপর আমার পূর্ণ আস্থা নেই। কারণ আমি যা সত্য ভাবছি, তা সত্য নাও হতে পারে, কারণ তা তো অহী নয়, আর অহী ছাড়া কোন সত্যের উপরো পূর্ণ আস্থা রাখা যায় না। সুতরাং এভাবে বললে আশা করি, ঐ গীবতের ক্ষতিপূরণ হয়ে যাবে।যার গীবত হয়েছে সে যদি মৃত হয়!এরপর হযরত থানবী রহ. বলেন, যার গীবত করা হয়েছে সে যদি মৃত হয় তার থেকে মাফ পাওয়ার উপায় হলো, তার জন্য মাগফিরাত ও আজরের দু’আ করতে থাকা, অন্তত যতক্ষণ না এ আশা জাগে যে, সে আমাকে মাফ করে দিয়েছে। (প্রাগুক্ত)অর্থাৎ আমার দ্বারা যার গীবত হয়েছে সে যদি মারা গিয়ে থাকে (মৃত ব্যক্তির যদি গীবত করা হয়ে থাকে) তাহলে তার কাছ থেকে মাফ পাওয়ার কী উপায় হবে! বান্দার জন্য আল্লাহ্ সে উপায়ও রেখেছেন। আর তা হলো, আমি যেন ঐ মৃত ব্যক্তির জন্য মাগফিরাতের দু‘আ করি, তার আজর ও ছাওয়াবের জন্য দু‘আ করি। সারাজীবন যেন দু’আ করতেই থাকি। অন্তত যতক্ষণ না দিল সাক্ষি দেয় যে, মাহূম ব্যক্তি আমাকে মাফ করে দিয়েছে। তো বান্দার হক কঠিন বিষয়, কোন সন্দেহ নেই, বিশেষ করে যদি সে মারা গিয়ে থাকে তাহলে তো কঠিনতা আরো বেড়ে যায়! তবে আল্লাহ্র রহমত ও মাগফিরাত থেকে কোন অবস্থায় নিরাশ হওয়ার কারণ নেই যে, এখন মাফ পাওয়ার উপায় কী! উপায় তো আল্লাহ্ রেখেছেন, এখন আমি যেন তা গ্রহণ করি।নিরানব্বই জনের কতলকারী!যে যালিম নিরানব্বইজন নিরপরাধ মানুষকে কতল করেছে তারও  মাফ পাওয়ার উপায় আছে!বুখারী শরীফের বর্ণনা থেকে জানা যায়, আগের যামানায় এক ব্যক্তি নিরানব্বই জন্য নিরপরাধ মানুষকে হত্য করেছে। অন্যায় তো করেছে, কিন্তু পরে অনুতাপ হলো, আর তাওবার ফিকির হলো। তখন সে এক বুযুর্গের কাছে গেলো যে, আমি তো এত বড় পাপ করেছি, তো এখন আমার জন্য তাওবার কি কোন উপায় আছে! ঐ বুযুর্গ আলিম ছিলেন না, শুধু ইবাদত গুযার ছিলেন। তিনি সোজা বলে দিলেন, না তোমার মাফের কোন উপায় নেই, কারণ বান্দার হক তো তাওবা দ্বারা মাফ হয় না! আর বান্দার কাছে মাফ চাওয়ার তো সুযোগ নেই!লোকটি তখন ঐ বুযুর্গকে এই বলে কতল করে ফেললো যে, মাফ যখন নেই তখন একশ পুরা করতে দোষ কী!কিন্তু অনুতাপ-অনুশোচনা তার পিছু ছাড়লো না। তখন সে আরেক বুযুর্গের কাছে গেলো যিনি আলিমও ছিলেন। ঘটনা শুনে তিনি বললেন, আল্লাহ্র রহমত থেকে কে নিরাশ করতে পারে! তোমারও মাফের উপায় আছে। এক কাজ করো, অমুক গ্রামে কিছু নেক মানুষ আছেন, তুমি তাদের ছোহবতে থাকো, আর তাওবা করতে থাকো।নেককারদের ছোহবতে থাকার কথা সম্ভবত এ জন্য বলা হয়েছে যে, তাতে দিল নরম হবে এবং খাঁটি তাওবা নছীব হবে, তখন যাদের কতল করেছে তাদের জন্য দিল থেকে দু‘আ আসবে। তো সে রওয়ানা তো হলো, কিন্তু মাঝপথে আল্লাহ্র হুকুমে ফিরেশতা তার রূহ কব্য করলেন। তখন দুই ফিরেশতাদলের মধ্যে বিবাদ হলো। রহমতের ফিরেশতাদল বললেন, সে তো তাওবা করে নেককারদের ছোহবতে থাকার জন্য রওয়ানা হয়েছে, সুতরাং তার রূহ আমরা  নেবো। আযাবের ফিরেশতাদল বললেন, এত বড় পাপী! তাছাড়া বের হলে কী হবে, নেককারদের গ্রামে যেতে তো পারেনি। সুতরাং তার রূহ আমরা নেবো।তখন আল্লাহ্ ফিরেশতাদের বিবাদের মীমাংসা এভাবে করলেন যে, মেপে দেখো, মউতের সময় সে কোন্ এলাকার বেশী কাছে ছিলো, যেখান থেকে বের হয়েছে সেখানের, না যেখানের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে সেখানের! মেপে দেখা গেলো, নেককারদের বস্তির সামান্য নিকটে ছিলো।আসলে হয়ত আল্লাহ্ আপন কুদরতে তাকে নেককারদের বস্তির কাছে করে দিয়েছিলেন। তো আল্লাহ্ বললেন, যেহেতু সে তাওবা করেছে, আবার নেককারদের বস্তির বেশী কাছে পৌঁছে গিয়েছে সেহেতু আমি তাকে মাফ করে দিলাম।নিরাশ কেন হই!সুতরাং আল্লাহ্র রহমত থেকে নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। আমার দ্বারা যাদের হক নষ্ট হয়েছে তারা মারা গিয়েছে বলে মাফের পথ কিন্তু বন্ধ হয়নি। প্রথম কথা হলো, বান্দার হকের গুরুতরতা যেন আমি বুঝতে পারি এবং কোনভাবেই যেন বান্দার হক নষ্ট না করি। তারপরো যদি হয়ে যায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে যেন ঐ বান্দার কাছে মাফ চেয়ে নেই। পক্ষান্তরে কোন কারণে যদি মাফ চাওয়ার ছ‚রত না থাকে, যেমন ঐ বান্দার মৃত্যু হয়ে গিয়েছে, বা অন্য কিছু, তাহলেও আমি নিরাশ হবো না, বরং আল্লাহ্র কাছে দু‘আ করতে থাকবো যে, আয় আল্লাহ্! তুমি দয়া করে তোমার ঐসমস্ত বান্দার মাগফিরাত নছীব করো, আর আমার প্রতি তাদের সন্তুষ্ট করে দাও, যাতে তারা তাদের হক ছেড়ে দেয়।এভাবে আসলে তো সারা জীবন তাদের জন্য দু‘আ করতে থাকা উচিত, অন্তত ততক্ষণ পর্যন্ত তো করতেই হবে যতক্ষণ না দিল সাক্ষি দেয় যে, ইনশাআল্লাহ্ তারা আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে গিয়েছে এবং নিজের হক ছেড়ে দিয়েছে।আসল কথা হলো, গোনাহগার বান্দাদের আল্লাহ্ পরিষ্কার অভয় বাণী শুনিয়েছেনÑ (আয় নবী) আপনি বলুন, হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর (বিভিন্নভাবে) যুলুম করেছো, তোমরা আল্লাহ্র রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ্ সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেবেন। তিনি তো গাফ‚রুন, রাহীম!সান্ত¡নার এ মহান আয়াতের আলোকে হযরত থানবী রহ. সর্বদা চেষ্টা করতেন, গোনাহগার মানুষ যেন নিরাশার দিকে না যায়।  গোনাহ্গার মানুষকে তিনি রহমতের খোলা পথগুলো দেখাতেন, আর সেই পথে চলার তারগীব দিতেন।দেখুন, শিরক থেকে জঘন্য গোনাহ তো দুনিয়াতে কিছু নেই। কারণ আল্লাহ বলেছেন, আল্লাহ্ তাঁর সঙ্গে শিরক করা কখনো মাফ করবেন না, এর চেয়ে কম পর্যায়ের গোনাহ যাকে ইচ্ছা করেন মাফ করে দেবেন। তবু দেখুন, বান্দার জন্য শিরক থেকেও তাওবা করার পথ তিনি খোলা রেখেছেন। আশি বছরের কাফির-মুশরিকও যদি কুফুর ও শিরক থেকে তাওবা করে, আল্লাহ্ তার তাওবা কবুল করেন এবং তাকেও মাফ করে দেন।শয়তানের ধোকাখুব মনে রাখতে হবে যে, শয়তান প্রথমে তো নফসকে রহমতের কথা বলে গোনাহের প্ররোচনা দেয় এবং গোনাহে ডুবিয়ে দেয়, কিন্তু যখন অনুশোচনা হয় তখন শয়তান মানুষের অন্তরে এমন হতাশা ও নিরাশা সৃষ্টি করে যে, তুমি তো এত বড় বড় গোনাহ করেছো, যার কারণে (আমার মতই) আল্লাহ্র রহমত ও মাগফিরাতের দুয়ার থেকে বিতাড়িত হয়ে গিয়েছো। এখন তো জাহান্নাম ছাড়া তোমার কোন ঠিকানা নাই।তারপর শয়তান নফসে ইনসানকে আরো ভয়ঙ্কর কুমন্ত্রণা দেয় যে, যখন মাফ নাই, মাগফিরাত নাই তখন আর গোনাহ থেকে দূরে থেকে কী লাভ। তার চেয়ে বরং যে কয়দিন বেঁচে আছো, মউজ মস্তি করো, খাহেশাত পুরা করো।কিন্তু ভাই, উপরের আয়াত আবার স্মরণ করো। কোন অবস্থাতেই নিরাশ হওয়া মুমিনের কাজ নয়। মনে রাখতে হবে যে, আমার কোন গোনাহ আল্লাহ্র রহমত থেকে বড় হতে পারে না, যেমন হাদীছে এসেছে।কবি আবূ নাওয়াসের তাওবাআব্বাসী আমলের বিখ্যাত আরব কবি আবূ নাওয়াস ছিলেন খাহেশাতের পথে চলা মানুষ। মৃত্যুর পর জনৈক ব্যক্তি তাকে স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞাসা করে, আল্লাহ্ তোমার সঙ্গে কী আচরণ করেছেন?তিনি বললেন, কী আর বলবো! মৃত্যুর সময় এমন ভয় হলো যে, আমার কী উপায় হবে! এই ভয়ের অবস্থায় আমি তিনটি কবিতা লিখলাম, যার উছিলায় আল্লাহ্ আমাকে মাফ করে দিয়েছেন। তারপর স্বপ্নে তিনি ঐ লোককে এই কবিতাগুলো শুনিয়েছেনÑ يـا رَبِّ إنْ عَـظُـمَـت ذُنُـوبـي كَـثْـرَةًفَـلَـقـدْ عَـلِـمْـتُ أنَّ عَـفْـوَكَ أَعْـظَـمُআয় রাব্ব, আমার গোনাহ্ যদি হয় বেশুমার/ তোমার ক্ষমারও নাই তো সংখ্যাশুমারإنْ كانَ لايَـرجُـوكَ إلَّا مُـحْـسِـنُفَـبِـمَ يَـلُـوذُ وَيَـسْـتَـجِـيـرُ الـمجـرمপুণ্যবান ছাড়া নাই যদি কারো আশা/পাপীতাপী কার পরে করিবে ভরসা!وَمَـدَدْتُ يَـدَيَّ إلَـيْـكَ تَـضَـرُّعًـافَـلَـئِـنْ رَدَدْتَ يَـدَيَّ فَـمَـنْ ذا يَـرْحَـمُতোমার দুয়ারে পেতেছি হাত কাতর ভিখারী/ফিরিয়ে দাও যদি, কার রহমের আশা করি!স্বপ্নের মানুষটিকে আবূ নাওয়াস বলেন, আবেগে উচ্ছ¡াসে এ কবিতা আবৃত্তি করতে করতে আমার মৃত্যু হলো, আর আল্লাহ্ বললেন, যাও এই কবিতার উছিলায় তোমাকে মাফ করে দিলাম।আবূ নাওয়াসের কাব্যসঙ্কলনে এ কবিতা ছিলো না। কারণ এটা  ছিলো মৃত্যুর সময়ের রচনা, যার কথা ঐ স্বপ্নের আগে কারো জানা ছিলো না। যিনি স্বপ্ন দেখেছেন তিনি স্বপ্নের বয়ানসহ কবিতার শ্লোকতিনটি আবূ নাওয়াসের কবিতা সঙ্কলনে যুক্ত করেছেন।পাপকে ঘৃণা, পাপীকে নয়এ জন্য বুযুর্গানে দ্বীন বলেন, পাপকে তো অবশ্যই ঘৃণা করবে, তবে কোন পাপীকে ঘৃণা করো না। কারণ কারো বাহ্যিক অবস্থা দেখে জান্নাতী বা জাহান্নামী ফায়ছালা করা গুরুতর অন্যায়। আমাদের তো জানা নেই যে, কার কোন আমল আল্লাহ্র পছন্দ হয়ে গেলো, আর তার সারা জীবনের গোনাহের মাগফিরাত হয়ে গেলো। পক্ষান্তরে কার কোন্ কাজ অপছন্দ হলো, আর সারা জীবনের নেকি বরবাদ হয়ে জাহান্নামে চলে গেলো।এজন্য হযরত থানবী রহ. বলেন, প্রত্যেক মুমিনকে আমি তার বর্তমান অবস্থার বিচারে এবং প্রত্যেক কাফিরকে তার ঈমানের সম্ভাবনার বিচারে আমার চেয়ে উত্তম মনে করি। ‘সম্ভাবনার বিচারে’ কথাটার অর্থ এই যে, হয়ত কখনো আল্লাহ্ তাকে ঈমান নছীব করলেন, আর সে ঈমানে আমলে আমার চেয়ে আগে বেড়ে গেলো।এজন্য মানুষের বাহ্যিক অবস্থা যতই মন্দ হোক, তুমি তার মন্দ কাজকে ঘৃণা করতে পারো, যেমন সে মদখোর, তো এই মদাসক্তিকে তুমি ঘৃণা করো, তবে তার মানবসত্তাকে কখনো ঘৃণা করো না; কারণ হতে পারে, আল্লাহ্ তাকে তাওবার তাওফীক দিলেন, আর সে যমীন থেকে আসমানের উচ্চতায় পৌঁছে গেলো। পক্ষান্তরে তাকে ঘৃণাকারী মানুষটা কোন বদ আমলে লিপ্ত হলো, আর তাওবা নছীব হলো না।আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে দ্বীনের উপর  সঠিকভাবে চলার তাওফীক দান করুন, আমীন।

وآخر دعوانا أن الـحمد لله رب العـالـمـيـن 

তরজমা/আমাতুল্লাহ্ তাসনীম সাফফানা

(চলবে ইনশাআল্লাহ্)

 


শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা