মুহররম.১৪৪০হিঃ (৩/৬)

তোমাদের পাতা

মাদরাসা তুল মাদীনাহর চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস ও প্রত্যয়

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট



১৪৩৮/৩৯ হিজরীর পঞ্চম বর্ষের তালিবানে ইলমের উদ্দেশ্যে আদীব হুযূরের বয়ান। তা. ২৪/৮/৩৯ হি.

বিসমিল্লাহ ও হামদ-ছালাতের পর। আমার পেয়ারে তালিবানে ইলম। তোমরা যারা এখন পঞ্চম বর্ষে আছো; হযরতপুরের প্রাঙ্গণে তোমরাই হলে সর্বোচ্চ জামাত। আশরাফাবাদে ষষ্ঠ ও সপ্তম বর্ষের শিক্ষার্থীরা রয়েছে। কিন্তু শুরু থেকেই তোমরা এখানে বিভিন্ন দিক থেকে অনেক বেশী যত্ন ও তারবিয়াত পেয়ে এসেছো। সমষ্টিগতভাবেতোমাদের সম্পর্কে অন্যরকম কিছু জাযবা, কিছু আশা ও প্রত্যাশা এবং কামনা ও আকাক্সক্ষা আমি অন্তরে পোষণ করি। সংক্ষেপে যদি বলি, সেটা হলো-‘সামনের জীবনে তোমরা মাদরাসাতুল মাদীনাহ ও মাদানী নেছাবের চিন্তা-চেতনা সর্বোচ্চ স্তরে অন্তরে লালন করবে এবং এই কাফেলাকে বহু দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে; তোমরা হবে আমাদের চলার পথের নিবেদিতপ্রাণ ‘সঙ্গী’। সর্বোপরি তোমাদের সজীব বুকে আমি আমার ভাঙ্গাবুকের স্বপ্নগুলো অর্পণ করে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবো।’এটা আমার আজকের নয়, বহু দিনের, বহু বছরের কামনা। তোমাদের আগে যারা ছিলো তাদের সম্পর্কেও আমার অন্তরে এ কামনাই ছিলো। কিন্তু এখনো তা কামনাই রয়ে গেছে। ‘কত বর্ষণ হয়, কত মেঘ ডাকে, ময়ূর তবু পেখম মেলে না!’***অনেক দিন থেকে তোমাদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করছি, কিন্তু কিছুবলার জন্য ভিতর থেকে যে প্রেরণা ও আকুতি, যে داعيةও অনুপ্রাণিকা জাগ্রত হওয়া দরকার, যার দ্বারা বক্তব্যে প্রাণসজীবতা সৃষ্টি হয়, তাপ ও উত্তাপ সৃষ্টি হয়, ফলে হৃদয় থেকে বের হয়ে হৃদয়ে প্রবেশ করে, সেই দা‘ইয়া বা অনুপ্রাণিকা ভিতর থেকে অনুভূত হচ্ছে না। এজন্য বারবার ইচ্ছে হওয়া সত্ত্বেও, এমনকি দু’একবার তোমাদের সামনে বসেও কিছু বলা আর হয়নি।হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নাদাবী রহ. বলেন, ‘অনেক সময় এমন হয় যে, ভিতর থেকে বলার কোন জাযবা আসছে না, কিন্তু হাজিরানে মজলিসের ইখলাছ ও আন্তরিকতা, তাদের আগ্রহ, উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনার কারণে ভিতরে এমন মউজ ও ভাবতরঙ্গ সৃষ্টি হয়ে যায় যে, অপ্রস্তুত অবস্থায়ও হঠাৎ করেই কথা বলার জন্য দিল তৈয়ার হয়ে যায়।’এখন তো مذكرات سائح في الشرق العربيতরজমা করছি। সম্ভবত আল-আযহার ও কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মিশ্র সমাবেশ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘ইসলামের জন্য নিবেদিত-প্রাণ যুবকদের এমন বিপুল সমাবেশ এবং তাদের জোশ-জাযবা ও আবেগ-উচ্ছ্বাস দেখে আমার মধ্যেও আশ্চর্য এক মউজ ও তরঙ্গ অনুভূত হলো। কোন রকম পূর্ব-প্রস্তুতি ছাড়াই যুবকদের আবেদনে সাড়া দিয়ে কথা বলার জন্য দাঁড়িয়ে গেলাম। ...’হযরত আলী মিয়াঁর মতে তাঁর সেদিনের বক্তব্যটি ছিলো জীবনের সেরা বক্তব্যগুলোর একটি এবং শ্রোতাদের অন্তরে তার কল্যাণ-প্রভাব তাদের অভিব্যক্তি থেকেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিলো।সবার ক্ষেত্রেই এটা হয়। বড়দের জীবনেও হয়েছে। আমাদের মত সাধারণ মানুষের জীবনেও হয়। অনেক সময় মজলিস থেকে মুতাকাল্লিম কথা বলার প্রেরণা লাভ করেন, আবার অনেক সময় খুব আবেগ ও জাযবা নিয়ে কথা বলার জন্য দাঁড়ান, কিন্তু মজলিস থেকে ইনকিবায পয়দা হয়, অন্তর চুপসে যায়। আর কথা আসতে চায় না। জোর করে কিছু বলার চেষ্টা করলেও সেই স্বতঃস্ফূর্ততা আর থাকে না।এ জন্য মজলিসের হালত এবং শ্রোতাদের অবস্থাই যে দায়ী হবে তাও নয়। এমনও হয় যে, জীবন্ত ও সজীব জলসা, কিন্তু মুতাকাল্লিম  নিজের অবস্থার কারণে নির্জীব ও মুনকাবিয হয়ে পড়েন।তো আজ তোমাদের সামনে বসার পর হঠাৎ করেই ভিতরে সেই বহু কাক্সিক্ষত داعيةবা প্রেরণা অনুভব করছি। আল্লাহ যেন বক্তা ও শ্রোতা উভয়কে পূর্ণ কল্যাণ ও উপকার দান করেন, আমীন।***প্রথমবর্ষে তোমরা কতজন ছিলে? ৮৪জন। প্রতিবছরই কিছু তালিবে ইলম আমার জীবন থেকে, মাদরাসাতুল মাদীনাহর জীবন থেকে ঝরে পড়েছে। এখনপঞ্চমবর্ষে তোমরা আছো কতজন? মাত্র ৩২জন! অর্ধেকেরও বেশী তালিবে ইলম আমার জীবন থেকে, মাদরাসতুল মাদীনাহর জীবন থেকে হারিয়ে গেছে!তারা এখন কোথায়? যদি এমন হয় যে, আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেলেও ইলমের চলমান কাফেলা থেকে তারা ছিটকে পড়েনি; জীবন গড়ার যে সংগ্রামসাধনা, তা থেকে তারা বিচ্যুত হয়নি, বরং জীবনের উন্নতি ও অগ্রগতির পথে তারা স্থির রয়েছে; অবিচল পদক্ষেপে তাদের পথচলা অব্যাহত রয়েছে তাহলে তো আমাদের ব্যর্থতা সত্ত্বেও সান্ত¡নার বিষয় হবে যে, এখানে না হোক, অন্যখানে হচ্ছে; আমাদের কাছে না হোক, অন্যদের কাছে হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা যদি হয় বিপরীত; আমাদের অবহেলার কারণে, বা তাদের নিজেদের গাফলতের কারণে এখান থেকে যাওয়ার পর যদি ইলমের চলমান কাফেলা থেকেই তারা পিছিয়ে পড়ে তাহলে তো মর্মবেদনার সীমা থাকে না। কারণ প্রতিটি তালিবে ইলম তার পরিবারের ‘চশমো চেরাগ’! মা-বাবার অন্তরে আশার একমাত্র প্রদীপ!! প্রতিটি তালিবে ইলম আমাদের কাছে উম্মাহর আমানত এবং উম্মাহর সম্পদ। কামনা তো করি, এ বাগান থেকে কোন কলি যেন না ঝরে। সবাই যেন পূর্ণ ফুল হয়ে ফোটে এবং তার পরিবারে, তার সমাজে, সর্বোপরি উম্মাহর জীবনে সুবাস ছড়ায়। কিন্তু যত তিক্তই হোক বাস্তবতাকে অস্বীকার করার উপায় কী? বাস্তবতা তো এই যে, ৮৪জন নিয়ে শুরু হয়েছিলো ইলমের পথে, জীবনগড়ার সংগ্রামসাধনার পথে আমাদের যাত্রা, এখন আছে ৩২জন। ভবিষ্যতের কথা জানেন শুধু আল্লাহ। এখনো আমাদের কামনা, আর কোন কলি যেন ফুল হয়ে ফোটার আগে ঝরে না যায়।এই যে চিত্রটা তোমাদের সামনে তুলে ধরলাম, এটা কিন্তু শুধু আমাদের নয়। সারা দেশের সমস্ত মাদারেসেরই এটা অভিন্ন চিত্র; অন্যত্র পরিস্থিতি বরং আরো নাযুক, আরো মর্মান্তিক।পার্থক্য শুধু এই যে, আমাদের কাদীম নেছাবের মাদারেসে প্রতিবছরই আসা-যাওয়া ও ওঠা-নামার ব্যবস্থা রয়েছে। তাই সেখানে ‘জোয়ার থেকে ভাটা’ বোঝা যায় না। প্রথমবর্ষে যদি আশিজন থাকে, দাওরাতুল হাদীছে দেখা যায় নব্বইজন। অর্থাৎ ভাটার পরিবর্তে আরো জোয়ার! কিন্তু যদি তালাশ করা হয়, প্রথমবর্ষের আশিজনের কতজন দাওরা পর্যন্ত এসেছে, আর মাঝপথে কতজনের আসা-যাওয়া ঘটেছে, তাহলেই প্রকৃত চিত্র সামনে আসবে, যা খুব প্রীতিকর নয়। অর্থাৎ প্রতিটি মাদরাসায় যারা আছে, শিকড়হীন ও ভাসমান অবস্থায় আছে। মাদরাসার প্রতি, শিক্ষক ও মুরুব্বির প্রতি, নিযাম ও ফিকরের প্রতি আমরা নিবেদিত নই! কোন কিছুর প্রতি আমরা অনুগত ও একাত্ম নই! প্রতিটি মাদরাসায় আমরা ‘লোকাল ট্রেনের ওঠা-নামার যাত্রী’। যখন যার ইচ্ছা ওঠে, যখন যার ইচ্ছা নেমে যায়। পথের শুরু থেকে শেষ পর্যন্তের যাত্রী খুব কমই পাওয়া যায়। কোন মাদরাসার, কোন শিক্ষকের, কোন মুরুব্বির নিজস্ব উৎপাদন নেই; নিজস্ব সৃষ্টি নেই; ভালো-মন্দ মিলিয়ে নিজের গড়ে তোলা কোন সম্পদ নেই। সে জন্য কোন আফসোসও নেই।মাদরাসাতুল মাদীনায় এবং মাদানী নেছাবে শুরু থেকে এ জিনিসটি আমি চেয়েছিলাম। আমার কামনা বলো, আকাক্সক্ষা বলো, আর স্বপ্ন বলো, এ-ই ছিলো যে, মাদরাসাতুল মাদীনায় যারা আসবে, প্রথম থেকেই আসবে এবং মৃত্যু পর্যন্ত মাদরাসাতুল মাদীনাহর আত্মিক সন্তানরূপেই থাকবে। মাঝখানে কেউ আসবে না, আর আসার পর মাঝখান থেকে কেউ যাবে না। ভালো হোক, মন্দ হোক, তারা হবে আমাদেরই হাতে গড়া, মাদরাসাতুল মাদীনাহ ও মাদানী নেছাবেরই ভাবসন্তান।আমাদের মাদারেসে একটি পরিভাষা রয়েছে। মাদরাসার তালিবানে ইলমকে বলা হয় ‘আবনাউল মাদরাসাহ’। তোমরাও হয়ত শুনেছো। তো আমি সত্যিকার অর্থে أبناء مدرسة المدينة তৈয়ার করতে চেয়েছি। আহলে মাদারেস যে বলে, ‘আবনাউল মাদরাসাহ’, আমার মতে এটা সঙ্গত নয়; যেমন সঙ্গত নয় অন্যের সন্তানকে  নিজের সন্তান বলা। হাঁ, এক্ষেত্রে বলা যায় فضلاء المدرسةবা متخرجو المدرسةবাংলায় যদি বলি, ‘মাদরাসার ফারেগীন’। ‘আবনাউল মাদরাসাহ’ বলার নৈতিক অধিকার তখনই থাকে যখন তালিবে ইলমকে শুরু থেকে শেষ, জন্ম থেকে মৃত্যু গড়ে তোলার দায়িত্ব পালন করা হয়।তো মাদরাসাতুল মাদীনায় এবং মাদানী নেছাবে এটাই আমার আকাক্সক্ষা ও স্বপ্ন ছিলো। এই যে তোমরা ৩২জন এখানে আছো। দোষ-গুণ ও ভালো-মন্দ সব মিলিয়ে তোমরা মাদরাসাতুল মাদীনাহর সন্তান, মাদানী নেছাবের ফসল। তোমাদের মধ্যে যা কিছু গুণ ও ভালো তার অধিকার আমার, আমাদের; অন্য কেউ এর অধিকার দাবী করতে পারে না। আবার তোমাদের মধ্যে যা কিছু দোষ ও মন্দ তার দায়ভারও আমার, আমি তা অস্বীকার করতে পারি না। কারণ তোমরা শুরু থেকে هذا كتابথেকে এখানেই ছিলে; আমার তত্ত্বাবধানেই তোমাদের প্রতিপালন ও গড়ে ওঠা। মাদরাসাতুল মাদীনাহর পরিবেশেই তোমাদের দিন-রাত যাপিত হয়েছে। এই যে প্রতিদিন তোমরা ফুলের সজ্জা আমাকে তৈরী করে দাও, এর সৌন্দর্যের কৃতিত্ব একান্তভাবে আমার। কারণ আমার ছেলেরা এটা তৈরী করে, তাও বাইরে থেকে ফুল সংগ্রহ করে নয়, বরং মাদরাসারই বাগানের ফুল ব্যবহার করে। তোমরা দেখেছো নিশ্চয়, পুষ্পের পাতায় আমি এভাবেই লিখেছি। ‘আমার ছেলেরা’ বলতে এবং লিখতে বড় গৌরব ও তৃপ্তিবোধ হয়। আবার যারা মাগরিবের পর দেয়াল টপকে বাজারে গিয়েছিলে; খায়রুল আমাকিন থেকে র্শারুল আমাকিনে গিয়েছিলে, এর দায়ভারও আমাকেই বহন করতে হবে। আমার ছেলেরাই করেছে এটা, মাদরাসাতুল মাদীনাহর সন্তানদেরই কর্ম এটা। মানে  মৌচাক থেকে শুধু মধুটুকু নেবো, আর মৌমাছির হুল ফোটানোর যন্ত্রণা গ্রহণ করবো না, শারাফাত ও আভিজাত্যের কাছে এটা আশা করা যায় না। তোমাদের মৌচাকের মধু যেমন আমার, তোমাদের হুলের দংশন-যন্ত্রণাও আমার। সব মিলিয়েই জীবন।হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.কে বলতে শুনেছি, ‘ছাত্ররা হইল উস্তাদের আমলনামা, মাদরাসার আমলনামা।’ হযরত রহ. বলতেন, ‘আপনারা নিজেরাই নিজ নিজ আমলনামা বিচার করেন এবং সংশোধনের, পাকছাফ রাখনের চেষ্টা করেন।’তো আমি নিজেকে, মাদরাসাতুল মাদীনাহকে এবং মাদানী নেছাবকে সেভাবেই গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। যেহেতু শুরু থেকে শেষ, তালিবানে ইলম এখানের ছায়ায়, এখানের পরিবেশে, এই নেছাবের তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত সেহেতু এখানকার তালিবানে ইলম আগাগোড়া আমাদেরই আমলনামা; দোষ-গুণ ও ভালো-মন্দ মিলিয়ে আমাদেরই কর্মফল। তো তালিবানে ইলমের হালাত থেকেই বিচার করতে পারি, আমরা কতটা কামিয়াব, কতটা না-কাম।এতদিন তো কিতাবখানা থেকে, هذا كتابথেকে শুরু হতো, অনিবার্য সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের মাক্তাব ছিলো না। তারপর অনেক ছাত্র হিফযখানা থেকে বিচিত্র সব উপসর্গ নিয়ে আসে। এখন তো মাক্তাবের কচি-কোমল শিশুরা আমাদের কাছে আসছে; এখন তো হিফযের ইন্তিযামও আমাদের এখানেই হতে চলেছে, সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতি ও চিন্তা-চেতনার উপর। এখন তো বলতে হবে, একেবারে জন্ম থেকেই দোষ-গুণ সবই আমাদের। পুরো আমল-নামাই আমাদের। ভাবলে যেমন পুলকিত হওয়ার বিষয়, তেমনি ‘কণ্টকিত’ হওয়ার মত বিষয়।***তো তোমরা পঞ্চমবর্ষের তালিবানে ইলম আমাদেরই আমলনামা, আমাদেরই কর্মফল। আমি যদি নিরপেক্ষভাবে বিচার করি, তাহলে বলতে হবে, আমাদের অযোগ্যতা, অনাচার, অবহেলা এত সীমাহীন যে, শুরু থেকে যারা আমাদের কাছে এসেছিলো, মাদরাসাতুল মাদীনায় দাখেল হয়েছিলো, সেটাই ছিলো আশ্চর্যের বিষয়। যারা চলে গেছে, তাদের চলে যাওয়াটাই ছিলো স্বাভাবিক, বরং তোমাদের এই বত্রিশজনও থাকার কথা ছিলো না। কারণ শুরুতে না হলেও এখন তো আমাদের সবকিছু তোমাদের সামনে অনাবৃত। বাকি এটা আল্লাহর ফযল ও করম যে, চৌরাশিজন থেকে সঙ্কুচিত হতে হতে বত্রিশজনে এসে থেমেছে। আল্লাহ যেন তাওফীক দান করেন তোমাদের সবাইকে নিয়ে যেন পথের শেষে আখেরি মানযিলে কামিয়াবির সঙ্গে পৌঁছতে পারি। মাদরাসাতুল মাদীনাহ এবং মাদানী নেছাবের নামে শিক্ষা-দীক্ষার জগতে যে ‘আযীম ইান্কিলাব ও মহান বিপ্লব সৃষ্টির আন্দোলন শুরু হয়েছে, আগামী জীবনে তোমরাও যেন তাতে নিজ নিজ ভূমিকা পালন করতে পারো এবং যথাযোগ্য অবদান রাখতে পারো, আমীন।***আমার একটি দু‘আ আছে। সবসময় আমি আমার আল্লাহর কাছে এই দু‘আটি করি. ‘মাদরাসাতুল মাদীনাহর, মাদরাসাতুছ্-ছূফাফার, মাদানী নেছাবের, মাদানী মানযিলের অতীতের, বর্তমানের, ভবিষ্যতের সমস্ত তালিবানে ইলমকে, আয় আল্লাহ তুমি আদর্শ তালিবে ইলম বানিয়ে দাও; তাদেরকে উম্মতের হিদায়াতের ওছীলা বানিয়ে দাও; তাদেরকে ছাহিবে দস্তরখান বানিয়ে দাও। اللهم اجعلهم هداة مهديـيـن‘ছাহিবে দস্তরখান’ এটি বড় তাৎপর্যপূর্ণ দু‘আ। অর্থাৎ নিজেদের রিযিকের চিন্তা তো তারা করবেই না, বরং তাদের ওছিলায় যেন বহু মানুষের মর্যাদাপূর্ণ রিযিকের ইনতিযাম আল্লাহ করে দেন। এটাই ছিলো যুগে যুগে আমাদের আকাবিরীনে উম্মতের শান। শুধু আমাদের মহান পূর্ববর্তীগণের দস্তরখানের কাহিনী যদি বয়ান করি, একটা ‘দফতর’ পূর্ণ হয়ে যাবে। নিকট অতীতে হযরত মাদানী রাহ.-এর ছিলো তেমনি এক ‘শাহানা দস্তরখান’, যার উল্লেখ করেছেন হযরত আলী মিয়াঁ রহ. তাঁর পুরানে চেরাগ কিতাবে।তো এটা হলো আমার সবসময়ের দু‘আ এবং আল্লাহর শানে রহম ও শানে করমের কাছে আশা এই যে, তিনি তাঁর গোনাহগার বান্দার দু‘আ কবুল করবেন ইনশাআল্লাহ।বান্দা যখন নিজের সমস্ত গান্দেগি সত্ত্বেও আল্লাহর রহমতের কাছে কবূলিয়াতের আশা নিয়ে দু‘আ করে, আল্লাহ মেহেরবান তা অবশ্যই কবুল করেন। অনেকে দীনতা প্রকাশ করার নিয়তে বলে, আমার মত গোনাহগারের দু‘আ কি আর কবুল হইব?! এটা খুবই গর্হিত চিন্তা। বিনয় ও দীনতার আবরণে শয়তানের বড় রকমের ধোকা। আসলে সে খালিক ও মাখলূকের পার্থক্য বোঝে না। খালেক ও মাখলূকের মধ্যে মোটা দাগের যে পার্থক্য সেটা নির্বোধেরও বোঝা দরকার। যে সকল পার্থক্য বোঝার জন্য কলব দরকার, আকল ও বুদ্ধি দরকার সেগুলো সবার পক্ষে বোঝা কঠিন হতে পারে। কিন্তু মোটা দাগের পার্থক্য তো বুঝতে হবে। যেমন, খালিকের কাছে চাইলেই পাওয়া যায়। যোগ্যতা ছাড়াই পাওয়া যায়। মাখলূকের কাছে যোগ্যতা ছাড়া চাওয়া যায় না। আবার চাইলেই পাওয়া যায় না। বান্দা চাইলে খালিক খুশী হন, মাখলূক না চাইলে খুশী হয়।আরে নির্বোধ, তুমি যদি নিজেই ফায়ছালা করে ফেলো নিজের দু‘আ সম্পর্কে, তাহলে আল্লাহ আর কী করবেন! তুমি শুধু দু‘আ করো মাওলার দয়া, মায়া ও করুণার উপর ভরসা করে কবুলিয়াতের আশা ও বিশ্বাসের সঙ্গে।***বুঝতে পারছি, আমার কথা বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে; গুছিয়ে বলতে পারছি না। ভিতরে যখন ভাবের তরঙ্গ-জোয়ার শুরু হয় তখন এমনই হয়। যে কথাটা বলার জন্য এত দিন ধরে অস্থির হয়ে আছি সেটা এখন বলার চেষ্টা করি।পাকভারত উপমহাদেশের সুবিস্তীর্ণ অঞ্চলে, এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত মাদরাসা নামে হাজার হাজার দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এই যে জাল বিস্তার করা হয়েছে, এগুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী? যদি বলি, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলকে সন্তুষ্ট করা, কোরআন ও সুন্নাহর ইলমের প্রচার প্রসারের চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করা, সালাফে ছালিহীনের অনুসারী তালিবানে ইলমের জামাত তৈরী করা, কিংবা যদি বলি, যুগের উপযোগী তালিবানের ইলমের... তাহলে এটা হবে সাধারণ লক্ষ্য ও উদদ্দেশ্য। কোন মাদরাসাই এ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বাইরে হতে পারে না। কোন্ মাদরাসা বলবে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সন্তুষ্ট করা তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত নয়? শুধু মাদরাসা কেন, এটা তো যে কোন মুমিনেরই জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য! তদ্রƒপ সালাফে ছালিহীনের অনুসারী তালিবানে ইলমের জামাত তৈরী করা, কোন্ মাদরাসা বলবে যে, এটা তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নয়? ... এমনকি যুগের উপযোগী তালিবানে ইলম, এটাও সমস্ত মাদারেসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হতে পারে।এখন কথা হলো, সকল মাদরাসার এই যে, সাধারণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তা অর্জনের পথ ও পন্থা কী? এ পথে অগ্রসর হওয়ার কর্মকৌশল ও রূপরেখা কী? এখানে এসে দেখা দেয় মাদরাসার সঙ্গে মাদরাসার ভিন্নতা ও বিভিন্নতা; দেখা দেয় আলাদা বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা।তো উপরে যে প্রশ্ন, তার উত্তর কিন্তু ঐ সাধারণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নয় যা অলিখিতভাবে সকল মাদরাসারই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বলে গণ্য। এখানে তোমাকে বলতে হবে, বিশেষ কিছু  লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যা মাদরাসাকে মাদরাসা থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য, স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য দান করে। এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করাই হলো উপরোক্ত প্রশ্নের উদ্দেশ্য। তো এক্ষেত্রে মূল কথা হলো, উপমহাদেশে যদিও মাদরাসা অসংখ্য, তবে কাওমি মাদারিসের তালিম ও নেযানে তা‘লীমের ক্ষেত্রে  মৌলিকভাবে স্বতন্ত্র চিন্তাধারা মাত্র দু’টি, দেওবন্দ ও নদওয়া। তো কিছু স্বতন্ত্র চিন্তা-চেতনা এবং বিশ্বাস ও প্রত্যয়ের লালন-প্রতিপালন এবং কিছু স্বতন্ত্র নীতি, পন্থা ও কর্মকৌশল অনুসরণের  লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তো দেওবন্দের দারুল উলূম হচ্ছে একটি ছাহিবে ফিক্র মাদরাসা। এই দেওবন্দী ফিকির ও চিন্তাধারা অনুসরণ করে উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠেছে অসংখ্য মাদরাসা। এগুলোর আলাদা ও স্বতন্ত্র চিন্তাধারা নেই। কিছু পার্শ্বভিন্নতা হয়ত আছে, তবে মৌলিকভাবে এগুলো দেওবন্দী চিন্তাধারার অনুসারী।তদ্রƒপ আলাদা কিছু চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস ও প্রত্যয় এবং পন্থা ও কর্মকৌশল অবলম্বন করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নদওয়াতুল উলামা ও তার দারুল উলূম। সুতরাং দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামা হলো একটি ছাহিবে ফিকর মাদরাসা। এই নাদাবী ফিকির ও চিন্তাধারা অনুসরণ করে বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠেছে অসংখ্যমাদরাসা। এখানেও একই কথা। এগুলোর স্বতন্ত্র কোন চিন্তাধারা নেই। কিছু পার্শ্বভিন্নতা হয়ত রয়েছে, তবে মৌলিকভাবে এগুলো নদওয়াতুল উলামার চিন্তাধারার অনুসারী।মাদানী নেছাবও তালিম-তারবিয়াত এবং নেছাব-নেযাম ও ইন্তিযামের  ক্ষেত্রে একটি নতুন চিন্তাধারা। কিছু স্বতন্ত্র চেতনা, বিশ্বাস ও প্রত্যয় এবং কিছু স্বতন্ত্র নীতি, পন্থা ও কর্মকৌশল ধারণ করেই মাদানী নেছাবের আত্মপ্রকাশ। তো এই মাদানী নেছাবের চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস ও প্রত্যয়ের লালন প্রতিপালনের উদ্দেশ্যে মাদরাসাতুল মাদীনাহর প্রতিষ্ঠা। সুতরাং মাদরাসাতুল মাদীনাহ একটি ছাহিবে ফিকর মাদরাসা।(এখানে ইন্তিযাম শব্দটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পরে সুযোগ হলে এসম্পর্কে বলার ইচ্ছে আছে।) এখানেও একই কথা, এই মাদানী চিন্তাধারা অনুসরণ করে বিভিন্ন স্থানে কিছু মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে এবং সেগুলোর কিছু পার্শ্বভিন্নতা থাকতে পারে, তবে মৌলিকভাবে সেগুলো হবে মাদানী চিন্তাধারার অনুসারী। আমাদের দেশে একটা কথা আছে, ‘মেখল তরযের মাদরাসা’, ‘হাটাজারি তরযের মাদরাসা’। এই তরয কেমন? আজকের যুগে এর উপকারিতা ও কার্যকরতা কতটুকু সেটা অবশ্য আলাদা প্রশ্ন। তবে তরয ও পদ্ধতি হিসাবে এটি স্বীকৃত। তো এই তরয অনুসরণ করে যেসব মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হবে সেগুলোর নতুন কোন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থাকার কথা নয়। এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, এটা মেখল তরযের/ হাটহাযারি তরযের/দেওবন্দী তরযের/নদওয়া তরযের মাদরাসা।একই ভাবে কেউ যদি বলে, এটা মাদানী তরযের মাদরাসা, বলতে পারে। এতটুকুই ঐ মাদরাসার অস্তিত্বের বৈধতার জন্য যথেষ্ট।মানে হলো, প্রতিটি মাদরাসা নতুন, স্বতন্ত্র ও স্বকীয় চিন্তাধারার অধিকারী ছাহিবে ফিকির হবে, এটা কোনদিন হয়নি, হবেও না এবং হওয়া উচিতও নয়। চিন্তাধারা হয় একটি দু’টি; তার অনুসারী মাদরাসা হতে পারে অসংখ্য।(নতুন চিন্তাধারার উদ্ভব হয় সময়ের প্রয়োজনে এবং তার বিকাশও হয় সময়েরই প্রয়োজনে, এমনকি তার ‘সমাপ্তি’ও হয় সময়েরই প্রয়োজনে।)***বহু যুগের ব্যবধানে যুগেরই প্রয়োজনে নতুন ও স্বতন্ত্র একটা চিন্তাধারার আত্মপ্রকাশ ঘটে, আর সেটাকে অনুসরণ করে বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এটাই স্বাভাবিক এবং এর মধ্যেই উম্মাহর কল্যাণ নিহিত। তবে চিন্তাধারা অনুসরণে যদি মৌলিক বিচ্যুতি ঘটে তখনই বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। বলা হবে দেওবন্দী তরযের মাদরাসা, কিন্তু দেওবন্দী চিন্তাধারা থেকে ঘটবে বিচ্যুতি, বলা হবে নদওয়ার তরযের মাদরাসা, কিন্তু নদওয়ার চিন্তাধারা থেকে হবে বিচ্যুত, এটা ফিতনা ছাড়া আর কিছু নয়। এতে শুধু বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যই সৃষ্টি হয়।এজন্য আমি যে চিন্তাধারার অনুসারী হবো তা আমাকে পূর্ণাঙ্গ-রূপে উপলব্ধি করতে হবে এবং তার সঙ্গে পূর্ণরূপে একাত্ম হতে হবে। তারপর ঐ চিন্তাধারার বাস্তবায়নে সাধ্যের সবটুকু ব্যয় করতে হবে।আল্লাহ তা‘আলার অশেষ রহমতে মাদরাসাতুল মাদীনাহ(তা‘লীম-তারবিয়াত, নেছাব-নেযাম ও ইন্তিযাম, মূলত এই তিনটি ক্ষেত্রে)কিছু নতুন চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস ও প্রত্যয় এবং কিছু স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে আজ থেকে ত্রিশবছর আগে।সঙ্গতভাবেই আমরা এ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারি যে, মাদানী নেছাব ও মাদরাসাতুল মাদীনাহর চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস ও প্রত্যয় কী; তার পথ ও পন্থা এবং কর্মকৌশলই বা কী?আমার পেয়ারে তালিবানে ইলম। তোমরা এই ৩২জন এখন মাদানী নেছাব ও মাদরাসাতুল মাদীনাহর পঞ্চম বর্ষের ছাত্র। তো এই স্তরে আসার পর তো এ বিষয়ে তোমাদের পূর্ণ জ্ঞান, উপলব্ধি ও একাত্মতা অর্জিত হওয়া অপরিহার্য। এই নেছাবের, এই মাদরাসার ভাবসন্তানরূপে যদি তুমি পরিচয় দিতে চাও তাহলে তো এ বিষয়ে তোমার অবশ্যই ‘শারহে ছাদার’ থাকতে হবে যে, তুমি কোথায় আছো এবং কেন আছো? তাহলে তো অবশ্যই তোমাকে মাদরাসাতুল মাদীনাহ ও মাদানী নেছাবের চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস ও প্রত্যয়কে অন্তর দিয়ে গ্রহণ করতে হবে! তার পথ ও পন্থা এবং কর্মকৌশল সম্পর্কে তোমাকে পূর্ণ উপলব্ধি অর্জন করতে হবে এবং তা অনুসরণ করতে হবে।***মাদানী নেছাব এ চেতনা ও বিশ্বাস লালন করে যে, তালিবে ইলম হচ্ছে মাদরাসার ‘আত্মিক সন্তান’! শব্দটির উচ্চারণ যত সহজ, মর্ম ও তাৎপর্য ততই কঠিন। উভয় তরফে এর জন্য রয়েছে কিছু অধিকার এবং কিছু দায়বদ্ধতা। এককথায় তালিবে ইলম মাদরাসার প্রতি থাকবে পূর্ণ অনুগত ও একাত্ম। পক্ষান্তরে তালিবে ইলমের জীবনের প্রতিটি প্রয়োজনে মাদরাসা সাধ্যের সবটুকু নিয়ে থাকবে তার পাশে, ঠিক মায়ের মত। তখনই শুধু মাদরাসা হতে পারে সত্যিকারের অর্থে ‘মাদারে ইলমী’ এবং তালিবানে ইলম হতে পারবে আবনাউল মাদরাসা। এটাই হলো ‘আত্মিক সন্তান’-এর মূল চেতনা। এ চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাস হলো মাদরাসাতুল মাদীনাহর ‘প্রাণসম্পদ’। আমরা আমাদের সাধ্যমত এ চেতনা ধারণ ও লালন করে চলেছি। এ বিষয়ে বিশদ আলোচনার এখানে আশা করি প্রয়োজন নেই।বাকি আমাদের ছেলেরা এ চেতনা কতটুকু ধারণ করছে সেটা অবশ্যই তাদের গভীরভাবে চিন্তা করে দেখার বিষয়।আমরা একেবারে প্রথমবর্ষে (এখন মাক্তাবে) একেবারে কাঁচা অবস্থায়, নরম মোমের অবস্থায় তোমাদের গ্রহণ করেছি। তারপর যেভাবেই হোক, এ পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের এনেছেন। শিক্ষা-জীবনের শুরু থেকে তালিবানে ইলমের দুখূল হবে, আর এই দুখূল হবে সারা জীবনের জন্য। মউত পর্যন্ত তা থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। এই চিন্তা-চেতনা মাদরাসাতুল মাদীনাহ ও মাদানী নেছাবের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। এটা মৌলিক বিষয়। ‘আত্মিক সন্তান’ এ চেতনার জন্য; ‘আমার সন্তান’ এ পরিচয়সত্তা অর্জনের জন্য এটা খুবই জরুরি। ‘আমার সন্তান’ তাকেই আমি বলতে পারি যে আলিফ-বা ও ক খ থেকে  আমারই কোলে প্রতিপালিত হয়েছে এবং আমারই কাছ থেকে চিন্তা-চেতনা, বোধ ও বিশ্বাস এবং পথ ও পাথেয় গ্রহণ করে জীবনের চলমান কাফেলায় শামিল হয়েছে।তোমাদের কাছে এটাই আমার অনুরোধ, আমার মিনতি, এই চিন্তা চেতনায় নিজেদের গড়ে তোলার চেষ্টা করো। মাদরাসার সঙ্গে ‘সন্তান-পরিচয়’ অর্জনের সাধনায় আত্মনিয়োগ করো, জীবনের প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি সঙ্কটে, প্রতিটি প্রয়োজনে মাদরাসা তোমাদের পাশে থাকার চেষ্টা করবে। এভাবেই অর্জিত হতে পারে তোমাদের পক্ষ হতে সন্তানত্বের সম্পর্ক এবং মাদরাসার পক্ষ হতে মাতৃত্বের সম্পর্ক। এটা যদি না হয়, তাহলে মাদরাসাতুল মাদীনায় আসা ও যাওয়া দু’টোই হতে পারে অর্থহীন, বরং ক্ষতি ও খাসারার কারণ; আর মাদরাসার জন্য হতে পারে বেদনাদায়ক ব্যর্থতার বিষয়।***মাদানী নেছাব ও মাদরাসাতুল মাদীনাহ তার সন্তানদের যে মহান চেতনার উপর গড়ে তুলতে চায় তার একটি হলো খেদমতে খালকের চেতনা। বস্তুত খেদমতে খালক হচ্ছে নববী আখলাকের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য, যাআমাদের পেয়ারা নবী তাঁর জীবনে ধারণ করেছেন, এমনকি নবুয়ত লাভেরও পূর্ব থেকে। মৃত্যু পর্যন্ত আমরা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ ও মানবতার সেবা করে যাবো। বিশেষ করে যে কোন বিপদে দুর্যোগে এবং সঙ্কটে ও প্রয়োজনে আমি আমার‘ভাই’য়ের পাশে দাঁড়াবো। এ চেতনা যদি তুমি জীবনের অবিচ্ছেদ্যরূপে অর্জন করতে পারো তাহলেই তুমি হতে পারো মাদানী নেছাব ও মাদরাসাতুল মাদীনাহর আত্মিক সন্তান এবং মাদরাসা হতে পারে তোমার ‘মাতৃত্বের দাবিদার’ মাদারে ইলমী! এছাড়া সবকিছু হবে নিছক ‘শব্দের জমাখরচ’। আশা করি তোমরা জানো, মাদরাসাতুল মাদীনাহ শুরু থেকেই খেদমতে খালকের চেতনাকে সমুন্নত রাখার এবং এর উপর তার সন্তানদের গড়ে তোলার লক্ষ্যে সাধ্যের ভিতরে সর্বপ্রকার চেষ্টা-মেহনত করে যাচ্ছে। আমি মনে করি, আমাদের এ কঠিন সমাজে মাদরাসাতুল মাদীনাহ যতটুকু সম্মান, মর্যাদা ও আভিজাত্য অর্জন করেছে তা সর্বপ্রথম এবং সর্বশেষ আল্লাহর তা‘আলার অশেষ ফযল ও করম। তারপর ওয়াছিলা হিসাবে যদি কিছু থাকে, সেটা হচ্ছে খেদমতে খালক। তো তোমাদের কাছে আমার আন্তরিক আহ্বান, খেদমতে খালকের চেতনার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার চেষ্টা করো এবং সারা জীবনের জন্য এটিকে পথ ও পাথেয়রূপে গ্রহণ করো এবং এর জন্য ‘প্রয়োজনীয়’ যোগ্যতা ও সামর্থ্য অর্জনের চেষ্টা করো।***মাদানী নেছাব ও মাদরাসাতুল মাদীনাহর একটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য হলো যুগসচেতনতা। এর তাৎপর্য অতি ব্যাপক ও বিস্তৃত। এককথায় চলমান জীবন ও জগত সম্পর্কে এবং মুসলিম বিশ্বের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তোমাকে পূর্ণ সচেতন হতে হবে এবং হতে হবে বাস্তব ধারণার অধিকারী। কোথায় কী ঘটছে, তার চেয়ে বড় কথা কেন ঘটছে, এসম্পর্কে তোমার থাকবে গভীর ও শেকড়স্পর্শী উপলব্ধি। এই চেতনা ও উপলব্ধি হবে মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যত বিনির্মাণের পথে তোমার জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করার প্রেরণা ও পাথেয়। এজন্য তোমাকে সর্ববিষয়ে সাতহিয়্যাতের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে এবং গভীরতা অর্জন করতে হবে।এটা যদি হয় তাহলেই মাদানী নেছাব ও মাদরাসাতুল মাদীনাহর সঙ্গে তোমার পরিচয় হবে সার্থক। এছাড়া ...!!সমাজের শ্রদ্ধা, মুগ্ধতা ও স্বীকৃতি অর্জনের জন্য যে সকল বিষয়ে জ্ঞান ও যোগ্যতার প্রয়োজন, ইখলাছ ও লিল্লাহিয়্যাতের সঙ্গে তা অর্জনে আমাদের প্রতিশ্রুবদ্ধ হতে হবে। এটা আমাদের পরিচয়-বৈশিষ্ট্য।আমার পেয়ারে তালিবানে ইলম! সময় অনেক হয়ে গেছে, অথচ প্রয়োজনীয় কথাগুলো বলা হলো না। বিশেষ করে মাদানী নেছাবের পরিচয় ও প্রকৃতি সম্পর্কে অনেক কিছু বলার আছে। তো আজ না হয় এপর্যন্তই থাকলো। তাকদীর যদি সময় ও সুযোগ দান করে তোমাদের সঙ্গে আরো কথা হবে। এই আশা ও প্রত্যাশা বুকে ধারণ করে এখন বিদায় নিলাম, ‘তোমরা হবে মাদরাসাতুল মাদীনাহর আদর্শ সন্তান, আর মাদরাসাতুল মাদীনাহ হবে তোমাদের জন্য মাতৃত্বের মহান আসনে সমাসীন।’আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবুল করুন, আমীন।

আমাদের মাদরাসী শিক্ষাব্যবস্থার একটা বড় সীমাবদ্ধতা এই যে, কিতাবের পাতায় আমরা কত হিকমত ও প্রজ্ঞার কথা পড়ি; কিন্তু কিতাবের পড়া কিতাবের পাতাতেই আবদ্ধ থেকে যায়। কিতাবের পাতা থেকে জীবনের পাতায় কখনো প্রতিফলিত হয় না আমাদের শিক্ষা। তাই কিতাবের জ্ঞানে অনেক সমৃদ্ধ হয়েও জীবনের জ্ঞানে আমরা বড় দরিদ্র।  জীবনের চলার পথে পদে পদে তাই আমাদের এত হোঁচট খেতে হয়।উদাহরণের তো অভাব নেই। বিভিন্ন উপলক্ষে, বিভিন্ন প্রসঙ্গে বিষয়টি আমি ছেলেদের সামনে প্রায় তুলে ধরি। এখন যে উদাহরণটি আমার সামনে আছে, তা হলো, শৈশবে দরসে পড়া হিকায়াতে লাতীফের ঘটনা। বাদশাহ স্বপ্নে দেখেন, ‘তার সবক’টা দাঁত পড়ে গেছে।’ দরবারের জ্ঞানী-গুণীদের ডেকে তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা ও তা‘বীর জানতে চাইলেন। সবাই নির্দ্বিধায় বলে দিলো, জাহাঁপনার সামনেই তার পরিবার-পরিজন ও সমস্ত আপনজনের মৃত্যু হবে। এরূপ নির্দয় ব্যাখ্যা বাদশাহর খুব না-পছন্দ হলো। কথা বলার ‘আন্দায’ জানা নেই বলে তিনি তাদের তিরস্কার করলেন। একই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দরবারের অতি বৃদ্ধ ও অতি বিজ্ঞ আলিমকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আর তিনি মৃদু হেসে বললেন, জাঁহাপনা, ইনশাআল্লাহ আপনি সবার চেয়ে দীর্ঘায়ু হবেন। বিচক্ষণ বাদশাহ বুঝলেন, উভয় ব্যাখ্যা অভিন্ন, তবু দ্বিতীয় জনের ‘বাচনপ্রজ্ঞা’ বাদশাহর খুব পছন্দ হলো। তাকে তিনি পুরস্কৃত করলেন।কিতাবের পাতায় এটা পড়েছি। কিন্তু জীবনের পাতায় কি আমরা এর শিক্ষাটুকু গ্রহণ করতে পেরেছি?মাদানী নেছাবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, কিতাবের পাতা থেকে অল্প কিছু যা-ই শিখি, জীবনের পাতায় যেন ঐ শিক্ষা আমরা ধারণ করতে পারি। কিন্তু হায়...!!
আমাদের মাদারেসের তালিবানে ইলম যদি চলমান সময় ও সমাজের উপর প্রভাব বিস্তার করতে চায় এবং তাদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতা লাভ করতে চায় তাহলে সেটা সহজেই সম্ভব, যদি আমরা দু’টি উপায় অবলম্বন করি। প্রথমত যদি আমরা সেই উন্নত আখলাকের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে ওঠাবসা করতে পারি যা নববী মীরাছরূপে প্রজন্ম পরম্পরায় আমাদের পূর্বসূরীদের মধ্যে চলে এসেছে, যা দুঃখজনকভাবে আমাদের থেকে হারিয়ে গিয়েছে। এই আখলাকে নববীর চারটি প্রধান শাখা রয়েছে, যথা বিনয়, দুনিয়ার সম্পদের প্রতি নির্মোহতা, মানুষের সেবা ও কল্যাণ-আকুতি এবং ধৈর্য, সহনশীলতা ও সংযম।দ্বিতীয়ত যদি আমরা চিন্তায় গভীরতা ও সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারি; সময় ও সমাজ সম্পর্কে সচেতনতা অর্জন করতে পারি; যদি ‘যুগের ভাষায়’ কথা বলতে পারি; ঐ সকল জ্ঞান সম্পর্কে অন্তত সাধারণ একটা পরিচয় অর্জন করতে পারি, যা সময় ও সমাজের দৃষ্টিতে মর্যাদার পরিচায়ক।এককথায় চরিত্রের মহত্ত্ব এবং চিন্তার আধুনিকতা, এ দু’টি পথেই আমাদের পূর্বসূরীরা সমাজে শ্রদ্ধা ও মর্যাদার আসন লাভ করেছিলেন। যুগের বিষয়গুলোতে যুগের মানুষ থেকে তাঁরা পিছিয়ে ছিলেন না, এগিয়েই ছিলেন।আরেকটি বিষয়, যদি মুখে ও কলমে আমরা বিশুদ্ধভাষী হতে পারি, তাহলে কোন কিছু ছাড়াই আমরা যুগের মুগ্ধ দৃষ্টি অর্জন করতে পারি। মুশকিল হলো, আমরা সময়ের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে প্রস্তুত নই; পরিশ্রম ও সাধনায় আমরা আগ্রহী নই।মাদানী নেছাব অর্থ কিছু আলাদা কিতাবমাত্র নয় এবং নয় ভিন্ন একটি পাঠদানপদ্ধতিমাত্র; মাদানী নেছাব হচ্ছে নতুন কিছু চিন্তা-চেতনা, জীবনের প্রতি সময়সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি ও নিয়ন্ত্রক শক্তি অর্জনের সযত্ন প্রয়াস ও নিরন্তর সাধনা।



শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা