মুহররম.১৪৪০হিঃ (৩/৬)

তোমাদের পাতা

আ রা কা নে র ই তি হা স

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

পাক-বার্মা স্বাধীনতার মধ্যবর্তী সময়এটা তো জানা কথা যে, ভারতবর্ষ এবং বার্মা উভয় ভূখ- বৃটিশের অধীনে শাসিত হয়ে আসছিলো। ভারতের পরিচয় ছিলো বৃটিশভারত, আর বার্মার পরিচয় ছিলো বৃটিশবার্মা। এমনকি একসময় আরাকানসহ সমগ্র বার্মাভূখ-টি ছিলো বৃটিশভারতের অন্তর্ভুক্ত। আর এটাও আমরা বলে এসেছি যে, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং জাতীয়তাবাদী-দের নেতৃত্বে বার্মার স্বাধীনতার আন্দোলন প্রায় একই সময়ে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছিলো। পাকিস্তান আযাদী হাছিল করে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগাস্ট (১৩৬৬ সালের ২৭শে রামাযান জুমু‘আতুল বিদার মোবারক রাতে) বার্মা বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারী। অর্থাৎ আযাদ ইসলামী রাষ্ট্ররূপে পাকিস্তানের জন্মলাভের একবছর চারমাস কয়েকদিন পর। সত্যিকার অর্থে এটা ছিলো পাকিস্তান ও আরাকান, উভয় মুসলিম জনপদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক যুগসন্ধিক্ষণ ও ক্রান্তিকাল। এ অঞ্চলের ইতিহাস তখন নতুন মোড় গ্রহণ করছে। জাতির ভাগ্যনির্ধারণের মত মহাগুরুত্বপূর্ণ এরূপ সময়ে ঐ সকল নেতৃবৃন্দের হতে হয় অত্যন্ত প্রাজ্ঞ ও জাগ্রত, অত্যন্ত  সচেতন ও তৎপর। দুর্ভাগ্যক্রমে এ তিনটি গুণেরই ঘাটতি ছিলো উভয় ভূখ-ের মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যে।  আমরা বলতে চাই; ঐ যুগসন্ধিক্ষণে একটি শতাব্দীর সুযোগ এসেছিলো আরাকানের মুসলিম নেতৃবর্গ এবং পাকিস্তানের আযাদী আন্দোলনের নেতৃত্বের সামনে। আরাকানের কতিপয় নেতা কায়দে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জোরালো আবেদন পেশ করেছিলেন, তিনি যেন আরাকানকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা করেন। মুসলিম নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে তাকে সর্বপ্রকার সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছিলেন। ইচ্ছা করলে এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলে কায়দে আজম এ সুযোগটি গ্রহণ করে বৃটিশ কর্তৃপক্ষের নিকট আরাকানের পাকিস্তানভুক্তির জোরালো দাবী উত্থাপন করতে পারতেন। কংগ্রেস নেতৃত্বের তাতে আপত্তি উত্থাপনের দৃশ্যত কোন সুযোগ ছিলো না। কৈফিয়ত হিসাবে হয়ত কিছু বলা যায়, তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পাকিস্তানের নেতৃত্ব কাশ্মীরের জন্য তখন যা কিছু করেছে তার অর্ধেকও যদি আরাকানের জন্য করতো তাহলে আজ ইতিহাস হতো অন্যরকম। সেই অন্যরকমটি যে কী রকম তা কল্পনা করলেও শরীর-মন রোমাঞ্চিত হয়!‘নির্দেশ’ পেলে পূর্বপাকিস্তানের মুসলিম জনতা তখন আরাকানের জন্য বৈষয়িক সম্পদ ও প্রাণ-সম্পদ সর্বস্ব উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত হতো এবং আরাকান হতো এই বাংলাদেশেরই একটি সমৃদ্ধ অংশ, যেমন ‘নিকট’ ইতিহাসে ছিলো!কাশ্মীরে ছিলো ডোগরা রাজা ও তাঁর সেনাবাহিনী; ছিলো ভারতের আগ্রাসী শক্তি। বার্মার পরিস্থিতি ছিলো অন্যরকম। কিন্তু পাকিস্তানের আযাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণই করেনি। হয়ত কারণ এই ছিলো -এবং তাতে বাস্তবতাও ছিলো- যে, আরাকানের মুসলিম নেতৃবৃন্দের মূল অংশটি ছিলো বার্মার জাতীয়তাবাদী চেতনার অনুসারী। তারপরো বলতে হয়, জানকবুল আয্ম ও প্রতিজ্ঞা হলে একবার ঝাঁপ দিয়ে দেখা যেতে পারতো। অনেক কৌশলই অবলম্বন করা যেতো পরিস্থিতির বিচারে। অন্তত রোহিঙ্গা নামের লাখ লাখ দুর্ভাগা মুসলিম জনগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করে কাশ্মীরের মত পূর্ব সীমান্তেও ‘গণজিহাদ’-এর ডাক দেয়া যেতো। এটা ঠিক, বলা, আর করা এক নয়, তবে ইতিহাসের গভীর ও নির্মোহ পর্যালোচনা এ সিদ্ধান্তের দিকেই আমাদের টেনে নেয়। সন্দেহজনক নাগরিক!আগেই বলা হয়েছে, বার্মার জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের কপট ভূমিকা প্যানলং সম্মেলন থেকেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু মুসলিম নেতৃত্বের মূল অংশটি তখনো সরলতার চাদর মুড়ি দিয়ে ছিলেন। নিয়তি যেন তাদেরই চাবুক মেরে জাগাবার ব্যবস্থা করলো বৃটিশদের হাত থেকে বার্মার স্বাধীনতা লাভের ঠিক পূর্বমুহূর্তে।সেই চাবুকটির নাম হলো ‘সন্দেহজনক নাগরিক’।ঘটনার বিশদ ব্যাখ্যা এই- বার্মার স্বাধীনতার পূর্বপ্রস্তুতিরূপে সেখানকার জাতীয়তাবাদী কর্তৃপক্ষ নতুন শাসনতান্ত্রিক পরিষদ নির্বাচনের আয়োজন করলো। সেজন্য ভোটার তালিকা তৈরীর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলো। তখন অত্যন্ত কূট কৌশলের আশ্রয় নিয়ে আরাকানের প্রায় সমগ্র রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ‘সন্দেহ-জনক নাগরিক’ এই অজুহাতে ভোটার তালিকা থেকে বাদদেয়া হয়। ঠিক যেমন আজ আসামে ‘সন্দেহজনক ভোটার’ অজুহাতে চল্লিশ পঞ্চাশ লাখের বাংলাভাষী মুসলিম জনগোষ্ঠীকে তাদের যুগ যুগের বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদের নীলনকশা তৈরী করা হচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, আসামও বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীর সুবাদে হতে পারতো তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তানের অংশ। কিন্তু ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু নেতৃত্ব যতটা তৎপর ছিলো বাংলাকে ভাগ করা এবং আসামের মত ভূখ- ছিনিয়ে নেয়ার বিষয়ে মুসলিম নেতৃত্ব ছিলো ততটাই নিষ্ক্রিয় ও নিস্পৃহ। থাক সে প্রসঙ্গ এখানে। তো বলছিলাম, এভাবে সন্দেহ-জনক নাগরিক’ অজুহাতে আরাকানের পুরো মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর বিনামেঘে বজ্রপাতের মত কঠিন পরিস্থিতি নেমে এলো এবং আইনের চোখে নিজ দেশেই তারা হয়ে গেলো ‘অনুপ্রবেশকারী বিদেশী’। ভারতের তথাকথিত অখ- জাতীয়তাবাদের অনুসারী কংগ্রেসপন্থী মুসলিম নেতৃবৃন্দের মত বার্মায়ও জাতীয়তাবাদের অনুসারী মুসলিম নেতৃবৃন্দের সামনে তখন করার কিছুই ছিলো না কর্তৃপক্ষের কাছে ধর্ণা দেয়া, আর দয়াপ্রার্থনা করা ছাড়া। তারা তাই করলেন, কিন্তু কথায় কান দেয়ার যেন অবসরই ছিলো না বর্মিজ নেতৃবৃন্দের।বার্মার জাতীয় বীররূপে স্বীকৃত জেনারেল অং সান-এর নিহত হওয়ার পর তার স্থলবর্তী হন তারই দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সহকর্মী উ নূ। তার নেতৃত্বেই বার্মা স্বাধীনতা অর্জন করে ৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারী। মনে করা হয়, ‘সন্দেহজনক নাগরিক’ চক্রান্তটি তারই মস্তিষ্ক- প্রসূত। তবে তিনি ‘অনানুষ্ঠানিকভাবে’ মুসলিম নেতৃবৃন্দকে জানিয়ে দেন যে, এ বিষয়টা তিনি সমর্থন করেন না। তামাশা আর কাকে বলে!বস্তুত বার্মার প্রথম প্রধানমন্ত্রী উ নূ মুসলিম জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দের কোন দাবী আব্দারই রক্ষা করেননি। আরাকানের হতভাগ্য মুসলিম জন-গোষ্ঠীকে রক্ষা করা তো দূরের কথা, তাদের ন্যূনতম মানবিক সহায়তা প্রদানেরও তিনি চেষ্টা করেননি, বরং ব্যাপক মুসলিম নিধনযজ্ঞের পরোক্ষ ব্যবস্থা সম্পন্ন করেছেন।স্বাধীনতা অর্জনের বছরই আকিয়াবের মগ ডেপুটি কমিশনার ক্যাইউ-এ নেতৃত্বে ইঁৎসধ ঞবৎৎরঃড়ৎরধষ ঋড়ৎপব(বিটিএফ) গঠিত হয়, যার প্রায় সকল সদস্যই ছিলো মগ। এই রহস্যপূর্ণ সংস্থাটি গড়ে তোলার ‘আবরণ-উদ্দেশ্য’ ছিলো ইমিগ্রেশন অ্যাক্টের অধীনে তদন্ত পরিচালনা করা। বাস্তবে এরা কী করেছে? উত্তর আরাকানে ব্যাপক মুসিলম নিধনযজ্ঞের ‘উৎসব’ অনুষ্ঠান! গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তারা সারখার করেছে। অসংখ্য মসজিদ-মাদরাসা, ইমাম-ওলামা শহীদ করেছে। জাতীয়তাবাদী ও স্বাধীনতাকামী নির্বিশেষে বহু মুসলিম বুদ্ধিজীবী তাদের হাতে গুম-হত্যার শিকার হয়েছে। হাজার হাজার শিশু-নারী-পুরুষ ¯্রফে কচুকাটা হয়েছে।বস্তুত এ বেদনাদায়ক পরিস্থিতির পর আরাকানের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক ভীতি, ত্রাস ও হতাশা সৃষ্টি হয় এবং সব মিলিয়ে একটা চাপা পড়া ক্ষোভ ধূমায়িত হতে থাকে।পরিস্থিতি আরো গুরুতর আকার ধারণ করে যখন বর্মী সরকারের প্ররোচনায় মগসম্প্রদায় আরাকানী মুসলিম তথা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের বিরুদ্ধে এ অপপ্রচারের দাবানল ছড়িয়ে দেয় যে, রোহিঙ্গারা আরাকানের আদি বাসিন্দা ও বৈধ নাগরিক নয়, বরং নাফনদী পার হয়ে আসা অনুপ্রবেশকারী ‘কালা’।মুসলিম নেতৃবৃন্দ চরম প্রতিকূল ও বৈরী পরিস্থিতিতেও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মত বুনিয়াদি জনগোষ্ঠীরূপে সংবিধানে অন্তুর্ভুক্ত করার দাবী জানাতে থাকেন। কিন্তু বর্মী সরকার বিভিন্ন কৌশলে তাদের এ দাবী এড়িয়ে যায়। পক্ষান্তরে গুরুত্বপূর্ণ সরকারী চাকুরী হতে রোহিঙ্গা মুসলিমদের অপসারণ এবং তদস্থলে মগদের নিয়োগদান চলতে থাকে নীরবে।এভাবে এক পর্যায়ে বর্মী সরকার সুপরিকল্পিতভাবে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যাপক উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে।পরিস্থিতি এমন নাযুক পর্যায়ে উপনীত হয় যে, নেতৃত্বহীন অবস্থায়ও রুখে দাঁড়ানো ছাড়া রোহিঙ্গা মুসলমানদের কোন উপায় থাকে না। ফলে ক্রমেই বিক্ষোভ, আন্দোলন ও বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠতে থাকে।পরিস্থিতির এ প্রেক্ষাপটে অখ্যাত ও স্বল্পশিক্ষিত, তবে অত্যন্ত স্বাধীন-চেতা যুবক মুহম্মদ জাফর উঠে আসেন। আকিয়াবের অধিবাসী এ যুবক শুরু থেকে স্বজাতির দুর্গতি ও যিল্লতি প্রত্যক্ষ করে অস্থির হয়ে উঠেন, যা অনেকটা ছিলো অক্ষম অসহায় যুবকের অস্থিরতা।একসময় তিনি ও তার পরিবারও চরম নির্যাতন ও উচ্ছেদের শিকার হয়। এসময় তার ভিতরে বিদ্রোহের লাভা যেন টগবগ করতে থাকে।তিনি কাওয়ালী গাইতেন বলে তাকে কাওয়াল বলা হতো। রোহিঙ্গা মুসলমানদের চরম দুঃখ দুর্দশা ও বিপর্যয় সম্পর্কে কাওয়ালী রচনার মাধ্যমেই তিনি বিদ্রোহের সূচনা করেন। একটি পূর্ণাঙ্গ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয়ার মত গুণ বা যোগ্যতা তার ছিলো না, এটা ঠিক। তবু তার অগ্নিগর্ভ কাওয়ালি চরম বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন উন্মাদনা সৃষ্টি করে যে, তাকে কেন্দ্র করেই বিশেষ করে রোহিঙ্গা যুবকশ্রেণী জড়ো হতে থাকে। তাদেরতিনি প্রত্যক্ষ জিহাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। ‘লড়াই ছাড়া মুক্তি নাই, অস্ত্র ছাড়া উপায় নাই’ জাফর কাওয়ালের এজাতীয় জ্বালাময়ী বক্তব্যে জিহাদের বিপুল উদ্দীপনা ও জোশ-জযবা সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে বরং ‘উন্মাদনা’ শব্দটি বেশী উপযুক্ত বলে মনে হয়। তিনি মুসলমানদের জনপদের পর জনপদ চষে বেড়াতেন, জিহাদের কাওয়ালি গাইতেন। এভাবে কিছু দিনের মধ্যেই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা যুবক জাফর কাওয়ালের ‘জিহাদি আন্দোলনে’ শামিল হয়। ঐ সময়ের নথিপত্র থেকে বোঝা যায়, জাফর কাওয়াল ও তার জিহাদি আন্দোলনের সামনে সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য বা কর্মপরিকল্পনা ছিলো না। তারপরো একথা সত্য যে, তার ‘কাওয়ালি আন্দোলন’ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক জাগরণ ও সশস্ত্র বিদ্রোহের অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছে।১৯৫০ সালের ১১ই অক্টোবর অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে তিনি রহস্যজনকভাবে নিহত হন। রোহিঙ্গা যুবকদের জন্য জাফর কাওয়ালের আকস্মিক হত্যাকা- ছিলো খুব বড় একটা আঘাত, যা তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু তা হয়নি। তাদের ক্রোধ ও উন্মাদনা তাতে বরং আরো জ্বলে ওঠে। কারণ ততদিনে বিদ্রোহের ক্ষেত্র সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলো, যদিও লড়াই করার মত ন্যূনতম শক্তি বা অস্ত্র তাদের ছিলো না।মুহাম্মাদ জাফর কাওয়ালের রেখে যাওয়া আন্দোলনের হাল ধরার জন্য যোহিঙ্গা যুবকদের মধ্য হতে যিনি এগিয়ে এলেন তিনি হলেন মুহম্মদ আব্বাস।মুহম্মাদ আব্বাস একে তো তৈরী পরিস্থিতি পেয়েছেন, তদুপরি তার মধ্যে নেতৃত্বগুণ ও বিচক্ষণতা ছিলো তুলনামূলক বেশী। এর মধ্যে অভিজ্ঞতাও অর্জিত হয়েছে যথেষ্ট। সব মিলিয়ে তার নেতৃত্বে জিহাদি আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। এমনকি বার্মার ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি দেখে বিচলিত বোধ করে এবং বিভিন্ন কৌশলে আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে থাকে।এর মধ্যে পরিস্থিতির বেশ নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে যায়। কারেন জনগোষ্ঠীর একটা অংশ পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার দাবীতে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। অন্য দিকে স্বাধীনতার দশবছর পূর্ণ হওয়ার পর শান ও কায়া জনগোষ্ঠী বার্মা ইউনিয়ন হতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে। কারণ প্যানলং সম্মেলনের সিদ্ধান্তই ছিলো এই যে, স্বাধীনতার দশ বছর পর কোন জনগোষ্ঠী পৃথক হতে চাইলে তাদের সে অধিকার থাকবে। আরাকানের ভিতরেও মগ সম্প্রদায়ের স্বাধীনতাপ্রিয় ক্ষুদ্র একটি দল আরাকানের স্বাধীনতার দাবীতে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। এ বিদ্রোহী গ্রুপটি নিজেদের নাম অৎধশধহ ঘধঃরড়হধষ খরনধধঃরড়হ ঋৎড়হঃ বলে প্রচার করে।পরিস্থিতি সরকারের এতটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় যে, বাধ্য হয়ে সরকার রাজনৈতিক শঠতার আশ্রয় গ্রহণ করে। বর্মী সরকার কতটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলো, তা বোঝ যায় এ থেকেই যে, ১৯৫৪ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর রাত আটটায় প্রধানমন্ত্রী উ নু রেডিওর সামনে আসেন। নিজের প্রধানমন্ত্রী পরিচয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, বার্মার গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান থেকে আমি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করছি যে, আপনারা অবশ্যই স্বদেশী জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। তাঁর শব্দ ছিলো 'ওহফরমবহড়ঁং ঊঃযহরব ঈড়সসঁহরঃু'একই সঙ্গে মুসলমানদের জন্য সরকারী চাকুরির দুয়ার উন্মুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়। শুধু তাই নয়, ‘এখনই’ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে তাদের নিয়োগদানের প্রতিশ্রুতিও ঘোষণা করা হয়।‘ছেলে ভোলানো’ পদক্ষেপরূপে কেন্দ্রীয় সরকার আরেকটি কাজ করে। বার্মা বেতারকেন্দ্র থেকে সপ্তাহে দু’দিন রোহিঙ্গাভাষায় সম্প্রচার শুরু করে।ব্যস, গতকাল পর্যন্ত উন্মাদনায় টগবগ করা জিহাদি আন্দোলনের যুবকরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে! তারা ভাবতে শুরু করে, আন্দোলন সফল হয়ে গেছে! সশস্ত্র বিদ্রোহের ‘শপথবাক্য’ পিছনে ফেলে রোহিঙ্গা যুবকেরা দলে দলে ‘ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যেতে শুরু করে’। জাফর কাওয়ালের মাধ্যমে বিদ্রোহের  যে দাবানল জ্বলে উঠেছিলো মুহম্মদ আব্বাসের গতিশীল নেতৃত্বে তা আরো বেগবান হওয়ার পর, যখন সফলতার আলোকরস্মি মাত্র দেখা যেতে শুরু করেছে, হঠাৎ করেই যেন নিভে গেলো। তারপরো মুহম্মদ আব্বাস অল্পকিছু অনুগামীকে নিয়ে বিদ্রোহের ঝান্ডা সমুন্নত রাখার চেষ্টা করে গিয়েছেন।সবচে’ বড় যে টোপটি উ নু-এর গণতান্ত্রিক সরকার রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর সামনে তুলে ধরে তা হলো তাদের লুণ্ঠিত ভোটাধিকার ফেরত দেয়া। অর্থাৎ  ‘নৃতাত্ত্বিক আদি জনগোষ্ঠী’রূপে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত না করেও তাদের উপর বৈধ নাগরিকত্বের ছাপ লাগিয়ে দেয়া হয়। সাংবিধানিক বিষয়টিকে আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির সিকায়  ঝুলিয়ে রাখা হয়। আর এটাকেই রোহিঙ্গা নেতৃবৃন্দ ও জনগণ মনে করে, এখনকার মত যথেষ্ট! রাজনীতি ও কূটনীতির অঙ্গনে সবচে’ অনির্ভরযোগ্য বিষয় হলো নিশ্চয়তাহীন প্রতিশ্রুতি; এ কথাটা যুগে যুগে দেশে দেশে মুসলিম জনগোষ্ঠী ভুলেই এসেছে।সেযুগের চেঙ্গিস-হালাকুদের প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রে যেমন এটা সত্য ছিলো, তেমনি সত্য ছিলো এ যুগে জাতিসঙ্ঘ ও মার্কিন প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রে। বার্মার গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রেও শেষ পর্যন্ত তা সত্য হয়েছিলো।আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি আন্দোলন ও বিদ্রোহের পথে অবিচল সশস্ত্র দলটিকে কাবু করার জন্য তাদের উপর কঠোর সামরিক চাপও প্রয়োগ করা হতে থাকে। সহায়ক পদক্ষেপরূপে বিদ্রোহ দমনের নামে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান চালানো  হয়। এ কাজে ইউনিয়ন মিলিটারি পুলিশকে বিশেষভাবে ব্যবহার করা হয়।এ পর্যায়ে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন ‘গণতান্ত্রিক’ বার্মার প্রধানমন্ত্রী উ নু। ১৯৫৮ সালে দেশে বিরাজমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির কথা বলে তিনি সেনাপ্রধান জেনারেল নে উইন-এর হাতে শাসনক্ষমতা অর্পণ করেন। তার আগে এ উদ্দেশ্যে জেনারেলকে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা হয়।জেনারেল নে উইন এ সময় রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়ে ব্যাপকভাবে তাদের উচ্ছেদ সম্পন্ন করেন। তখন হাজার হাজার রোহিঙ্গা নাফনদী পার হয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে।১৯৬০ সাল পর্যন্ত জেনারেল নে উইন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানরূপে দায়িত্ব পালন করার পর প্রধানমন্ত্রী উ নুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এভাবে জেনারেল নে উইন ও তার সামরিক বাহিনীর কথিত রোহিঙ্গানির্যাতনের দায়ভার থেকে প্রধানমন্ত্রী উ নু নিজেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হন এবং একটি ‘ক্লিন ইমেজ’ নিয়ে সংখ্যালঘু সমস্যা সমাধানের লাক্ষ্যে ‘সক্রিয়’ উদ্যোগ গ্রহণ করেন।প্রধানমন্ত্রী উ নু রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে শান্তিপ্রিয় ও নির্বিবাদী  আখ্যা দিয়ে সশস্ত্র আন্দোলনকারি-দের প্রতি আত্মসমর্পণের উদাত্ত আহ্বান জানান।বলাবাহুল্য, পরিস্থিতি বিবেচনায় উ নুর আহ্বানে সাড়া দেয়া ছাড়া বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সামনে বিকল্প কিছুই ছিলো না। সুতরাং ১৯৬১ সালের ৪ঠা জুলাই এক অনাড়ম্বর-পূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মুজাহিদরা অস্ত্র সমর্পণ করে।অস্ত্রসমর্পণ-অনুষ্ঠানে বার্মার সামরিক বাহিনীর ভাইস চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার অং জি যে ভাষণ প্রদান করেন, বার্মী সরকার বেশ ফলাও করে তা প্রচার করে।ব্রিগেডিয়ার অং জি তার ভাষণে বলেন, রোহিঙ্গা মুসলমানেরা আরাকানেরই শান্তিপ্রিয় নাগরিক। এর মধ্যে দুঃখজনক যা কিছু হয়েছে তা নিছক সরকারের সঙ্গে ভুল বোঝাভুঝির ফল। এটা সত্য যে, রোহিঙ্গাদের উপর অনেক অন্যায় আচরণ করা হয়েছে। আজ এখানে সমস্ত ভুল বোঝাবুঝি এবং সকল অন্যায় আচরণের অবসান হলো।অং জি তার ভাষণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি বলেন তা হলো- ‘পৃথিবীর বহু সীমান্তে একই জাতি দুই দিকে বসবাস করে। এ কারণে কোন নাগরিকের জাতীয়তা প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া গ্রহণযোগ্য নয়।’তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানিয়ে জেনারেল নে উইনকে সামনে আনার বিষয়টিকে প্রধামন্ত্রী উ নু ভেবেছিলেন তার একটি অত্যন্ত কৌশলী চাল। কিন্তু সেটাই শেষ পর্যন্ত তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। বার্মার জাতীয় রাজনীতি থেকে চিরকালের জন্য তিনি হারিয়ে যান।এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, প্রধানমন্ত্রী উ নুর বোধোদয় ঘটেছিলো যে, তার সরকারের বৈষম্যমূলক নীতিই আসলে জাতিগত অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী এবং এর অবসান হওয়া জরুরি। এ উদ্দেশ্যে তিনি ফেডারেল কন্ফারেন্স আহ্বান করেন। এ বিষয়ে সেনাপ্রধান নে উইনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী উ নুর চরম বিরোধ দেখা দেয়। জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের প্রশ্নে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে কোন ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। তাই ১৯৬২ সালের ২রা মার্চ ফেডারেল কন্ফারেন্স শেষ হওয়ার পূর্বমুহূর্তে এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উ নু সরকারকে অপসারণ করে তিনি দেশের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে বার্মাকে নিষিদ্ধ গণতন্ত্রের দেশে পরিণত করেন। (চলবে ইনশাআল্লাহ)


শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা