মুহররম.১৪৪০হিঃ (৩/৬)

তোমাদের পাতা

এ যুগে অস্ত্রের যুদ্ধ যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি গুরুত্বপূর্ণ কলমের যুদ্ধ। সৈনিকের জন্য অস্ত্রের প্রশিক্ষণ, আর লেখকের জন্য কলমের প্রশিক্ষণ একই রকম অপরিহার্য।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

আজকের আলোচনা ঃঅনুবাদ ও তরজমা প্রসঙ্গেঅনুবাদ সম্পর্কে পাক-ভারত উপমহাদেশ এবং বিশ্ব পর্যায়ে যে ক’জন বিশিষ্ট ব্যক্তি নীতিগত ও মৌলিক আলোচনা করেছেন, ঘুরে ফিরে তারা মূলের প্রতিঅনুবাদকের বিশ্বস্ততার কথাই জোরালো-ভাবে বলেছেন। ভারতের বিশিষ্ট অনুবাদ-বিশেষজ্ঞ কমর রঈস বলেন, ‘অনুবাদকের কাজ শুধু এই যে, মূলকে তিনি পূর্ণ সততা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে অনুবাদের ভাষায় উপস্থাপনের চেষ্টা করবেন, নিজের পক্ষ হতে  কোন রকম হ্রাস-বৃদ্ধি ছাড়া।’ অর্থাৎ মূলের মধ্যে যদি কোন দুর্বোধ্যতা থাকে, অনুবাদেও তা বহাল থাকবে। মূলের দুর্বোধ্যতা দূর করার জন্য অনুবাদক নিজের পক্ষ হতে কোন হস্তক্ষেপ করবেন না। অন্যকথায়, অনুবাদকে মূলের চেয়ে সুন্দর করার চেষ্টা কিছুতেই সঙ্গত নয়।’কমর রঈস তার বক্তব্যের এক পর্যায়ে বলেছেন, ‘অনুবাদের ক্ষেত্রে এ মূলনীতিই বর্তমানে বিশ্বপর্যায়ে সর্বস্বীকৃত।আমরাও মনে করি, মূলের প্রতি অনুবাদকের বিশ্বস্ত থাকা অপরিহার্য। তবে বিশ্বস্ততার অর্থ কী? এর আসল মর্ম ও তাৎপর্য কী? আমাদের মতে বিশ্বস্ততা রক্ষার মূল দাবী হলো, এমন কোন কথা যুক্ত না করা যা মূল লেখক বলতে চাননি। তদ্রƒপ এমন কথা বাদ না দেয়া যা মূল লেখক ‘বলেছেন’ বা বলতে চেয়েছেন।পক্ষান্তরে যদি মূল বক্তব্যে কোন দুর্বোধ্যতা থাকে, অসঙ্গতি ও অসম্পূর্ণতা থাকে, আর অনুবাদক পূর্ণ দায়িত্ব ও কুশলতার সঙ্গে সেটা ‘মেরামত ও সংশোধন’ করে দেন, যাতে দূর্বোধ্যতা দূর হয়ে পুরো বক্তব্যটি সহজবোধ্য হয় এবং অসঙ্গতি ও অস্পূর্ণতার অবসান হয়ে সঙ্গতি ও সম্পূর্ণতা লাভ করে তাহলে এতে মূলের প্রতি বিশ্বস্ততা তো রক্ষিত হবেই, তদুপরি এটা হবে মূল লেখা ও তার লেখকের প্রতি অনুবাদকের পক্ষ হতে ‘সর্বোচ্চ সদাচার’। তবে এটা ঠিক যে, এজন্য অনুবাদককে অবশ্যই সৃজনশীলতার অধিকারী হতে হবে, বিষয় সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী হতে হবে। সর্বোপরি মূল লেখকের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণার সঙ্গে পূর্ণ পরিচয় অর্জন করতে হবে। নবিস পর্যায়ের কোন অনুবাদকের জন্য কিছুতেই ঠিক হবে না, এরূপ জটিলতাপূর্ণ কোন মৌলিক কর্মের অনুবাদ করতে যাওয়া। নবিস অনুবাদকের জন্য এটাই বরং নিরাপদ হবে যে, তিনি মশক ও অনুশীলনের পর্যায়ে সহজ সরল ও সাদামাটা বিষয় অুনবাদ করবেন। কিংবা জটিল বিষয় অনুবাদ করবেন, প্রকাশের জন্য নয়, শুধু অনুশীলনের জন্য। এ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে কেউ কেউ আশ্চর্য রকম ‘উপরিতা’র পরিচয় দিয়েছেন। তাদের মতে, একজন আদর্শ লেখক কিছুতেই চাইবেন না, ‘আমাকে আমার চেয়ে উত্তম-রূপে উপস্থাপন করা হোক।’ বরং তিনি চাইবেন, ‘আমি যেমন আছি, আমার লেখা যেমন আছে, অনুবাদক যেন হুবহু সেভাবেই আমাকে এবং আমার লেখাকে ‘অনুবাদ- পাঠকের’ সামনে উপস্থাপন করেন। আমাকে আমার চেয়ে উত্তমরূপে উপস্থাপন করা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়।’ আমার মতে একজন সৃজনশীল ও কুশলী অনুবাদকের কর্তব্য হলো এরূপ ‘আদর্শ’ লেখককে দূর থেকে সালাম করা। নিজের অনুবাদ সাধনাকে তার সেবায় নিয়োজিত না করা।এক্ষেত্রে সিদ্ধান্তমূলক কথা এই যে, বিভিন্ন ভাষায় এমন কিছু অনুবাদ হয়েছে, যেখানে মূল লেখক অনুবাদের ভাষার সঙ্গে পরিচিত, আর তিনি অনুবাদকের সৃজনশীলতাকে প্রশংসার দৃষ্টিতেই দেখেছেন। তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘অকুণ্ঠ চিত্তে স্বীকার করবো, অনুবাদ মূলের চেয়েও প্রাণবন্ত, সজীব ও আকর্ষণীয় হয়েছে।’সুতরাং নির্দ্বিধায় বলা যায়, উপরে যে ‘আদর্শ’ লেখকের কথা বলা হয়েছে, তার বাইরেও রয়েছেন কিছু লেখক। সুতরাং আদর্শ অনুবাদকের কর্তব্য হবে এরূপ ‘অ-আদর্শ’ লেখকের সেবায় আত্মনিবেদন করা।আসলে কোন অনুবাদ সম্পর্কে মূল লেখকের তিন ধরনের অনুভূতি হতে পারে (যদি তিনি অনুবাদের ভাষার সঙ্গে পরিচিত হন)। প্রথমত, ‘আমি যা বলেছি, যেভাবে বলেছি, অনুবাদ তেমনই হয়েছে।’দ্বিতীয়ত, ‘আমি যা বলেছি অনুবাদ তেমনই হয়েছে, তবে যেভাবে বলেছি সেভাবেই হয়নি, বরং যেভাবে বলতে চেয়েছি (বা যেভাবে বলা সঙ্গত ছিলো) সেভাবে হয়েছে।’তৃতীয়ত, আমি যা বলেছিঅনুবাদ তেমনই হয়েছে, তবে যেভাবে বলেছি সেভাবে হয়নি, বরং তার চেয়ে নি¤œস্তরের হয়েছে (ফলে মূলের সৌন্দর্য অনুবাদে ক্ষুণœ হয়েছে।)আমাদের মতে প্রথম অনুবাদটি হলো গ্রহণযোগ্য, দ্বিতীয়টি হলো আদর্শ অনুবাদ, যা প্রশংসার যোগ্য। তৃতীয়টি হলো অগ্রহণ-যোগ্য অনুবাদ।এছাড়া একটি চতুর্থ প্রকারও হতে পারে, আর তা হলো, ‘আমি যা বলেছি অনুবাদে তা আসেনি, অথবা আমি যা বলিনি অনুবাদে তাই এসেছে। (এখানে অনুবাদের ভাষা ও উপস্থাপন সুন্দর কি অসুন্দর সে আলোচনাই বাহুল্য।)আমরা এ প্রকারটি উল্লেখ করিনি কারণ এটা আসলে অনুবাদই নয়, অনুবাদের নামে স্বেচ্ছাচার, যা রীতিমত ‘দ-নীয়’ অপরাধ।***দ্বিতীয় একটি বিষয় যা জোরালো ভাবেই আলোচনায় এসেছে তা হলো- ‘কোন অনুবাদ মূলের চেয়ে সুন্দর বা উত্তম হতে পারে কি না? তার চেয়ে বড় কথা হলো, এমন হওয়া  উচিত কি না?একটি মত তো এই যে, তা হওয়া  সম্ভব নয় এবং হওয়া উচিতও নয়। বরং এরূপ অনুবাদকের কর্তব্য হবে অনুবাদের পরিবর্তে নিজেই ঐ বিষয়ে মৌলিক রচনা-কর্ম শুরু করা। ভারতের সুপ্রসিদ্ধ অনুবাদ সমালোচক ডক্টর বচ্চন বলেন, ‘অনুবাদক যদি উচ্চস্তরের সৃজনশীলতার অধিকারী হোন এবং বিষয় সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হোন, তারপর মূলের মূল গতিধারাকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে অনুসরণ করে অনুবাদ করেন তাহলে তার অনুবাদকর্ম মূলের চেয়ে উন্নত শিল্পগুণসম্পন্ন হতে পারে। কারণ অনুবাদকর্মে আসলে দু’টি সৃজনশীলতার একত্র সমাবেশ ঘটে থাকে। মূল লেখকের সৃজনশীলতা এবং অনুবাদকের সৃজনশীলতা।’অন্য এক ভারতীয় অনুবাদ-সমালোচক শ্রীকান্ত বর্মা লিখেছেন- ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কতিপয় কবি কিছু নির্বাচিত হিন্দি কবিতার অনুবাদ করেছেন। এসম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জনৈক বিশেষজ্ঞ সমালোচক বলেন, কোন কোন কবিতা মূলভাষায় খুবই নিষ্প্রাণ ছিলো, কিন্তু অনুবাদের ভাষায় তা বিস্ময়কর পর্যায়ে প্রাণবন্ততা লাভ করেছে।’প্রথম মতের অনুসারীরা আরো বলেন, যদি ডক্টর বচ্চন ও শ্রীকান্ত বর্মার মন্তব্য মেনে নেয়া হয় তাহলে প্রশ্ন হবে, কোন আদর্শ লেখক কি সেটাকে তার রচনাকর্মের সফল ও বিশ্বস্ত প্রতিনিধি বলে স্বীকৃতি দেবেন? এ প্রসঙ্গে তারা অদ্ভুত এক উদাহরণ টেনে বলেছেন, যদি তিনি এটাকে নিজের বলে কবুল করেন তাহলে কি তার উদাহরণ ঐ ‘বেঈমান’ কাঠুরিয়ার মত হবে না, যে জলপরীর হাতে স্বর্ণের কুঠার দেখে বলে উঠেছিলো, হাঁ, হাঁ, এটাই আমার কুড়াল!!’এখন এই ভালো মানুষটিকে কে বোঝাবে যে, ঈমানদারির সঙ্গে তিনি একথাও তো বলতে পারেন, ‘আমার তো নয়, তবে আমার হলে খুশী হতাম।’ অর্থাৎ কত না ভালো হতো, আমার মূল রচনাটি যদি অনুবাদের সৌন্দর্য ধারণ করতো!***অনুবাদ সম্পর্কে এসব আলোচনা সত্য বলতে কী মৌলিক গুরুত্বের অধিকারীই নয়। অনুবাদের ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টিতে যে বিষয়টি সবচে’ গুরুত্বের অধিকারী সে সম্পর্কে আমরা কিছু কথা বলতে চাই। প্রথম কথা হলো, অনুবাদের প্রকার ও শৈলী সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে এবং জানতে হবে কোন্ ক্ষেত্রে কোন প্রকারের এবং কোন্ শৈলীর অনুবাদ সঙ্গত।মৌলিকভাবে অনুবাদ মোটামুটি চার প্রকার। প্রথমত শব্দানুগ তরজমা, যেখানে শব্দনির্বাচন থেকে শুরু করে, বাক্যশৈলী, বাক্যবিন্যাস, উপমা পর্যন্ত যাবতীয় বিষয়ে সম্ভাব্য পর্যায় পর্যন্ত মূলের অনুগত রাখার চেষ্টা করা হয়। অনুবাদকের পক্ষ হতে  সহজায়ন, সৌন্দর্যায়ন বা অন্য কোন শিরোনামে কোন প্রকারের হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়, বরং নিন্দনীয়। এমনকি অনুবাদকের পক্ষ থহতে অনিবার্য প্রয়োজনে কোন একটা শব্দও যদি সংযোজন করা হয় তবে সেটা হতে হবে বন্ধনীর মধ্যে, বা নীচে টিকার মধ্যে, যাতে পাঠক সহজেই বুঝতে পারেন যে, এটা মূলের অংশ নয়, অনুবাদকের পক্ষ হতে সংযোজন। তদ্রƒপ কোন একটি শব্দ বাদ দিলে সেটাও নীচে টীকার মধ্যে উল্লেখ করতে হবে। অর্থাৎ যে কোন অনিবার্য সংযোজন, বিয়োজন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সম্পর্কে পাঠকের অবগতি অপরিহার্য।এরূপর অনুবাদের আদর্শ ক্ষেত্র হলো আইন, সংবিধান ও ধর্মগ্রন্থ। এ ক্ষেত্রে যিনি যত বেশী মূলানুগ তিনি তত সফল অনুবাদক বলে বরিত হবেন।ইলমী বা একাডেমিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও গবেষণামূলক রচনার ক্ষেত্রেও এধরনের অনুবাদ জরুরি, তবে ‘অনিবার্য কারণে’ সীমিত পরিসরে শিথিলতার বৈধতা, বরং প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, যাতে মূলকে অক্ষুণœ রেখে অনুবাদে সম্ভাব্য সৌন্দর্য সৃষ্টি করা যায়।(চলবে ইনশাআল্লাহ) দ্বিতীয়ত ভাবানুগ অনুবাদ। যেখানে বিস্বস্ততা হবে মূলের বক্তব্যের প্রতি, মূলের শব্দ, বিন্যাস, শৈলী ও প্রকৃতির প্রতি নয়, বরং এসকল ক্ষেত্রে অনুবাদের ভাষা ও সাহিত্যের দাবী ও চাহিদা অনুসরণ করতে (চলবে ইনশাআল্লাহ।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা