মুহররম.১৪৪০হিঃ (৩/৬)

তোমাদের পাতা

ভুলে যাওয়া ইতিহাস জানতে হবে আবার

উছমানী সালতানাতের মযলূম খলীফা সুলতান আব্দুল হামীদ রহ.

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট


খেলাফাতে উছমানীয়ার যে ইতিহাস আমাদের সামনে বর্ণিত হল এবং খলীফা আব্দুল হামীদ আছ-ছানীর আগমনপূর্ব সময়ের যে চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরা হল তাতে এটা তো স্পষ্ট যে, খাদের কিনারে পৌঁছে যাওয়া খেলাফতের পিঠে শেষ ধাক্কাটা দেয়ার আগে নিছক ‘বলির পাঠা’ হিসেবে ব্যবহার করার ঘৃণ্য উদ্দেশ্যেই ‘নিভৃতচারী’ শাহযাদা আব্দুল হামীদকে খেলাফতের ‘ডুবন্ত’ মসনদে টেনে এনেছিল ইসলামী খেলাফাতের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত পশ্চিমাদের ক্রীড়নক ‘নব্য তুর্কী’ নামধারিরা। খেলাফত ও খলীফা তো তখন সম্পূর্ণভাবে তাদের ‘কব্জায়’। বলবে তারা, করবেও তারা, কিন্তু দায় বহন করবেন খলীফা। সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে তারা, সিলমোহরটা হবেখলীফা আব্দুল হামীদের, যাতে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় তাঁকে। এটাই ছিল কুচক্রীদের পরিকল্পনা, আর তা বাস্তবায়নের পথে তাদের সামনেকোন বাধাও ছিল না। ইউরোপের অনুকরণে বরং বহুক্ষেত্রে তাদের চেয়েও ‘কয়েক কাঠি’ আগে বেড়ে খেলাফতকে একটি সাংবিধানিক ও সংসদীয় শাসনে রূপান্তরিত করা এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে খেলাফতকেই বিলুপ্ত করার চক্রান্তে তো তারা আগেই বহুদূর এগিয়ে গিয়েছিল। খলীফা আব্দুল হামীদের পূর্বসূরী তাদের ‘প্রিয়পাত্র’ সুলতান মুরাদের সেই আকিস্মক মানসিক ভারসাম্য-হীনতা যদি না দেখা দিত, তাহলে হয়ত সুলতান আব্দুল হামীদকে ছাড়াই খেলাফতের গলায় ছুরি চালানর কাজটা তার করে ফেলত।কিন্তু ‘ওয়া মাকারু ওয়া মাকারল্লাহু...। তাদের সব আয়োজন যেখানে শেষ হল, তাক্বদীরের আয়োজন সেখান থেকে শুরু হল। ইতিমধ্যেই আমরা জেনেছি, আকস্মিক পরিস্থিতিতে সুলতান মুরাদকে দিয়ে কাজ হাসিলে ব্যর্থ হয়ে তাকে অপসারণ করে কিভাবে তারা যুবরাজ আব্দুল হামীদের ‘দ্বারস্থ’ হতে বাধ্য হয়েছিল এবং তাদের সব দাবী ও চাহিদা পূরণের শর্তেই শুধু তারা তাঁকে খলীফা হিসেবে মেনে নিতে সম্মত হয়েছিল। আর তিনিও কেমন হিকমত ও প্রজ্ঞা এবং ছবর ও ধৈর্যের সঙ্গে তাদের সব ঔদ্ধত্যের মোকাবেলা করেছেন। এমন তো নয় যে, শাহযাদা আব্দুল হামীদ জানতেন না, বা বুঝতেন না, সামনের দিনগুলোতেকী অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য এবং খেলাফতের মসনদকে ঘিরে থাকা উযির-পাশাদের পাশ কাটিয়ে কোন কিছু করা তাঁর জন্য কত কঠিন হবে! তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালে, এমনকি প্রাণ দিয়ে তাঁকে তার মূল্য আদায় করতে হতে পারে, যেমনটা ঘটেছিল তাঁর চাচা খলীফা অব্দুল আযীযের ক্ষেত্রে।কিন্তু দুশমনের হাতে মহান পূর্বপুরুষদের পবিত্র আমানতের এ অসম্মান এবং রাখওয়ালহীন উম্মাহর এ অসহায় অবস্থা দেখেও কীভাবেতিনি পিছিয়ে থাকবেন? তিনি তো বিশ্বাস করতেন, গায়বের পক্ষ হতে আজকের দিনটির জন্যই হয়ত তাঁকে প্রস্তুত করা হয়েছে! তাই সব বুঝে শুনে এবং ‘দিব্যচোখে’ নিশ্চিত পরিণতি দেখে নিরুপদ্রব জীবন ত্যাগ করে তিনি নিজেকে তুলে দিলেন তাদের হাতে। ১২৯৩ হিজরী মোতাবেক ১৮৭৬ খৃস্টাব্দে এমনই চরম প্রতিকূল এক পরিবেশে উম্মাহর বর্তমান ও ভবিষ্যতের ‘বোঝা’ কাঁধে নিয়ে শুরু হল অজানা গন্তব্যে তাঁর পথচলা।***দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই এক ভয়াবহ সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হল তাঁকে। চারপাশের মানুষদের অদূরদর্শিতা এবং অবাধ্যতাই ছিল যার জন্য প্রধানত দায়ী। ১৮৫২ সালে ইতিহাস বিখ্যাত ক্রিমিয়াযুদ্ধে উছমানী বাহিনীর হাতে পরাস্ত ও পর্যুদস্ত হওয়ার পর থেকেই প্রতিশোধের অপেক্ষায় ওৎ পেঁতে ছিল রাশিয়া। দীর্ঘ দিন থেকেই বলকান অঞ্চলে খেলাফতের অধীনে থাকা খৃস্টান জনগোষ্ঠিগুলোকে বিভিন্ন অজুহাতে বিদ্রোহের উস্কানি দিয়ে আসছিল মস্কোর শাসক-চক্র, যাতে এ অজুহাতে খেলফতের উপর আগ্রাসন চালানোর সুযোগ পায়।১৮৭৫ খৃস্টাব্দে খলীফা আব্দুল হামীদের আগমনের এক বছর আগে খেলাফতের পশ্চিম সীমান্তে ‘অর্থনৈতিক শোষণে’র অভিযোগে খৃস্টান অধ্যুসিত হার্জেগোভেনিয়ার একটি এলাকা বিদ্রোহ করে বসল খেলাফতের বিরুদ্ধে। দুর্বলতার চরমে পৌঁছে যাওয়া  খেলাফতের জন্য এটা অবশ্য নতুন কোন ঘটনা ছিল না। বরাবরের মত ইউরোপীয় সা¤্রাজ্যবাদিরাই ছিল এর ইন্ধনদাতা। বিশেষভাবে বর্তমান বিদ্রোহের মূল ইন্ধনদাতা ছিল খেলাফতের শতাব্দীর শত্রু রাশিয়া। দেখতে দেখতে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র বসনিয়া হার্জেগোভেনিয়াজুড়ে। সীমিত সামর্থ্য নিয়েই বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করল খেলাফতবাহিনী। আর সঙ্গে সঙ্গে খৃস্টান বিদ্রোহিদের জন্য যেন মায়া কান্না শুরু হল ইউরোপজুড়ে।কী করণীয় ছিল তাহলে খেলাফতের? শুধু হাতের উপর হাত রেখে বসে থাকা, আর চেয়ে চেয়ে দেখা? তাছাড়া বাস্তবতা তো ছিল এই যে, খেলাফতের দুর্বলতার সুযোগে স্থানীয় সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর দীর্ঘ দিন থেকেই বিভিন্ন উপায়ে চরম যুলুম-নিপীড়ন চালিয়ে আসছিল সীমান্তের বাইরে থেকে আসা অস্ত্রসাহায্যে বলীয়ান খৃস্টান-সম্প্রদায়। বিদ্রোহিদের রক্ষার উদ্দেশ্যে রাশিয়াসহ ইউরোপীয় শক্তিগুলোর পক্ষ হতেবিভিন্ন দাবী জানিয়েকড়া প্রতিক্রিয়া এল খলীফার কাছে; এই মুহূর্তে খৃস্টানদের উপর ‘নির্যাতন’ যেন বন্ধ করা হয়, তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় যেন হস্তক্ষেপ না করা হয়, তাদের ‘ন্যায়ানুগ’ দাবী দাওয়া যেন মেনে নেয়া হয় এবং আরো অনেক কিছু। তার মধ্যে একটা হল, বিদ্রোহী খৃস্টান এলাকাগুলো থেকে খেলাফতের অর্জিত রাজস্ব আয় সবটুকু যেন ঐ এলাকাতেই ব্যয় করা হয়। অর্থাৎ খেলাফত তার রাজস্বকীভাবে ব্যবহার করবে তাও নির্ধারণ করে দেবে রাশিয়া এবং ইউরোপ! এর চেয়ে নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ আর কী হতে পারে? কিন্তু হায়! আমরাই তো আসলে ডেকে এনেছি আমাদের এই লাঞ্ছনা। এসকল অপমানজনক দাবী মেনে নেয়ার জন্য বাহির থেকে এবং ভিতর থেকে বিভিন্ন উপায়ে তারা চাপ প্রয়োগ করা শুরু করল। শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হল খেলাফত। কিন্তু এখন যেমন তখনও তেমন ধর্মীয় স্বাধীনতা, মানবাধিকার, এগুলো ছিল শুধু মুখোশ। খেলাফতে উছমানীয়ার জীর্ণ দেহ খাবলে খাবলে নিজেদের সা¤্রাজ্যবাদী লালসা পূর্ণ করাই ছিল আসল উদ্দেশ্য; আর আমরা বিভেদ-বিভক্তি দ্বারা এবং বহু যুগের পুঞ্জীভূত দুর্বলতা দ্বারা তাদের এরূপ স্বেচ্ছাচারের সুযোগ করে দিয়েছি। এটাই তো দুর্বলের প্রতি সবলের চিরকালের আচরণনীতি ইউরোপের!তাই তাদের বহু দাবী দাওয়া মেনে নেয়ার পরও পশ্চিমাদের, বিশেষ করে রাশিয়ার উস্কানিতে থামতে রাজি হল না খৃস্টান বিদ্রোহিরা। ১৮৭৬ এর এপ্রিলে পার্শ্ববর্তী বুলগেরিয়া, সার্বিয়াএবং মন্টেনিগ্রোতেও বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠলো। বিদ্রোহী এলাকাগুলো রক্ষার দায়িত্বে থাকা ক্ষুদ্র খেলাফাতবাহিনী প্রথম দফাতেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। সার্ব রাজধানী বেলগ্রেড তো অনেক আগেই খেলাফতের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল, অন্যান্য অংশও এবার বিদ্রোহিদের দখলে চলে গেল। খৃস্টান বিদ্রোহিদের হাতে ভয়াবহ গণহত্যার শিকার হল সেখানে বসবাসকারী সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়। অস্ত্র দিয়ে শস্ত্র দিয়ে বিদ্রেহিদের শক্তি যুগিয়ে গেল রাশিয়া। অপর দিকে মজলূম মুসলমানদের সাহায্যের আবেদন দরবারে খেলাফতে পৌঁছতে পৌঁছতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল অসংখ্য মুসলিম বসতি। লড়াই ছাড়া আর কোন উপায় থাকল না খেলাফতের সামনে। আঠারো হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী প্রেরণ করা হল বিদ্রোহ দমনে। রাশিয়ার কাছ থেকে পাওয়া সাহায্যের কল্যাণে ‘মোটাতাজা’ হয়ে ওঠা বিদ্রোহিদের সাথে প্রচ- লড়াই শুরু হল তাদের। তবে আল্লাহর ইচ্ছায় সাজ সরঞ্জামের বিরাট ঘাটতি সত্ত্বেও ধীরে ধীরে বিদ্রোহিদের দমন করে আগে বাড়তে থাকল খেলাফাত-বাহিনী। খলীফা আব্দুল হামীদের ঠিক খেলাফাতের মসনদে আরোহণের দিন উছমানীবাহিনীর বিজয়ের সুসংবাদ এসে পৌঁছল ইস্তাম্বুলে। বেশ কয়েকটি রণাঙ্গনে বিদ্রোহিদের বিরুদ্ধে বিরাট বিজয় অর্জন করল খেলাফতবাহিনী। এর মাধ্যমে সার্ব রাজধানী বেলগ্রেডের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়ে  গেল মুসলিম বাহিনীর সামনে। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে খেলাফতের হাতছাড়া হওয়ার পর বেলগ্রেড আবার পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনায় বিপুলভাবে উদ্বেলিত হল জনসাধারণ। অপর দিকে তীব্র প্রতিক্রিয়া হল ইউরোপে। খৃস্টানদের উপর মুসলিম বাহিনীর নির্যাতন নিপীড়ন আর গণহত্যার ব্যাপক মিথ্যা প্রচারণা দ্বারা জনগণকে উত্তেজিত করে চলল ইউরোপের শাসকবর্গ। তরুণ খলীফা আব্দুল হামীদ, আল্লাহ তাঁকে দান করেছিলেন অসাধারণ প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক জ্ঞানে দক্ষতায় পোড় খাওয়া পাশাদের চেয়ে তিনি অনেক এগিয়ে ছিলেন। তিনি ভালো করেই জানতেন, উছমানী বাহিনী আবার বেলগ্রেডে প্রবেশের মুখে কিছুতেই চুপ করে বসে থাকবে না ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলো এবং তা তাদেরকে খেলাফতের বিষয়ে হস্তক্ষেপেরই সুবর্ণ সুযোগ করে দেবে। ইতিমধ্যেই একবার তো তাদের ‘সতর্কবার্তা’ এসেছে খলীফার কাছে। আর তাদের মোকাবেলার শক্তি তো আজ নয়, বহু আগেই হারিয়ে ফেলেছে খেলাফত। তাই সাধারণ বুদ্ধির দাবী ছিল, এ অবস্থায় ইউরোপের শত উস্কানি সত্ত্বেও সঙ্ঘাত এড়িয়ে চলা এবং যতদূর সম্ভব শান্তি বজায় রেখে শক্তি অর্জনে সচেষ্ট হওয়া। এই বিবেচনায় খলীফা চাইলেন উছমানীবাহিনী যেখানে আছে সেখানেই যেন থেমে যায়, যেন বর্তমান সামরিক বিজয়কে কূটনৈতিক দরকষাকষি এবং আরো বড় রাজনৈতিক বিজয়ের জন্য কাজে লাগান যায়। কিন্তু আফসোস, তাঁর কথা বোঝার মত এবং মানার মত কেউ যেন তখন ছিল না তাঁর চারপাশে। কিছু লোক বিজয়েরউন্মাদনায়, আর কিছু লোক চক্রান্তের জিঘাংসায় তখন একাট্টা হয়ে গেল। পরিস্থিতির উপর আলোচনার জন্য তৎকালীন ওয়াযীরে আযম রুশদী পাশা এবং নব্য তুর্কিদের প্রতিনিধি খেলাফতের শক্তিশালী আমলা মিদহাত পাশার সঙ্গে আলোচনায় বসলেন খলীফা। কিন্তু যুদ্ধ অব্যাহত রাখলে ইউরোপের রাজধানীগুলোতে যে চরম প্রতিক্রিয়া হবে, যা মোকাবেলাকরার ন্যূনতম শক্তি-সামর্থ্য খেলাফতেরনেই, সে বিষয়ে তারা ছিল বিলকুল বেপরোয়া। খলীফাকে তারা বরং বোঝাতে চাইল, বেলগ্রেড অভিমুখে উছমানী বাহিনীর অগ্রাভিযানের মুখে ইউরোপীয় শক্তিগুলো নিজ নিজ স্বার্থচিন্তায় বিভক্ত হয়ে থাকবে, তাই তাদের দিক থেকে খেলাফতকে বড় কোন হুমকির মুখে পড়তে হবে না। এক পর্যায়ে সুচতুর মিদহাত পাশা খলীফাকে আনুগত্যপূর্ণ সম্বোধন করে বলল, ‘মহামান্য খলীফা! এ পরিস্থিতিতে আমাদের প্রধান কর্তব্য হল, অবিলম্বে খেলাফাতের ক্বানূনে আসাসী (সংবিধান) ঘোষণা ও কার্যকর করা, যার মাধ্যমে খেলাফাতের অধীনে বসবাসকারী খৃস্টান জনগোষ্ঠী মুসলমানদের সমান অধিকার ও সুযোগ সুবিধা ভোগ করবে। এতে তাদের অবস্থার উন্নতি হবে এবং খেলাফতের প্রতি তাদের আনুগত্য ও সন্তুষ্টি নিশ্চিত হবে। তখনইউরোপীয়রাও আমাদের উপর চাপ সৃষ্টি ও হস্তক্ষেপের সুযোগ পাবে না। মহামান্য! ইউরোপের রাজধানীগুলো আমাদের সংবিধান ঘোষণার প্রতি উদগ্রীব হয়ে আছে। তাদের সবার দৃষ্টি এখন আমাদের দিকে নিবদ্ধ। খলীফার একক শাসন থেকে একবার সাংবিধানিক ও সংসদীয় শাসনে রূপান্তরিত হলে খেলাফতে এমন কোন বড় সমস্যা আর বাকি থাকবে না যার সূত্রে ইউরোপীয়রা হস্তক্ষেপের সুযোগ পাবে।’ হায়! যদি এটা হত মিদহাতের রাজনৈতিক অপরিপক্বতা তাহলে হয়ত তাকে মাফ করা যেত, কিন্তু এটা তো তার কূটিলতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। খলীফা আব্দুল হামীদ হতবাক হয়ে গেলেন তাদের চিন্তার ‘বাচপানা’ নয়, চতুরতা দেখে! তবু তিনি তাদের বোঝানোর ব্যর্থ চেষ্ট করে গেলেন যে, ইউরোপীয়রা তো সমস্যার কোন সমাধান চায় না, তারা চায়সমস্যার বাহানায় খেলাফাতের সীমানায়  হানা দিতে। তিনি তাদের বললেন, দু’দিন পর ইউরোপের চাপে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হওয়ার চেয়ে আজ বিজয়ীর অবস্থান থেকে যুদ্ধসমাপ্ত করাই সব দিক থেকে উত্তম। কিন্তু খলীফাকে ঘিরে রাখা এই শক্তিশালী পাশারা তো তখন ঔদ্ধত্যের চরমে পৌঁছে গিয়েছিল। খলীফার প্রজ্ঞাপূর্ণ অভিমতের, খলীফার আদেশের কোন গুরুত্বই ছিল না তাদের কাছে। রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাবে হোক কিংবা ইউরোপীয়দের হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দেয়ার জন্যই হোক, পাশারা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল এবং চরম ধৃষ্টতার পরিচয় দিয়ে খলীফার অজ্ঞাতেই তারা উছমানীবাহিনীর সেনাপতির কাছে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অদেশসম্বলিত চিঠি পাঠিয়ে দিল। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝার জন্য কি এতটুকুই যথেষ্ট নয়! এমনই ছিল তাদের দুঃসাহস আর তাদের সামনে খলীফারঅসহায়ত্ব। কয়েক দিন পর ওয়াজিরে আযম রুশদী পাশা উছমানী বাহিনীর অগ্রযাত্রার ‘সুসংবাদ’ এবং তাদের উদ্দেশ্যে তার পাঠানো বার্তাটির নমুনা নিয়ে এল খলীফার কাছে। খলীফার প্রতি উপহাসই হয়ত তার উদ্দেশ্য ছিল। তাদের দুঃসাহস এবং নির্বুদ্ধিতা দেখে খলীফা আব্দুল হামীদ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। অলঙ্ঘনীয় আওয়াজে রুশদী পাশাকে লক্ষ্য করে তিনি বললেন, এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে আপনি এই আদেশ প্রত্যাহারের বার্তা পাঠান, বাহিনী যে পর্যন্ত পৌঁছেছে সেখান থেকে যেন আর আগে না বাড়ে। তাদের ‘দয়া’য় টিকে থাকা খলীফার এমন অপ্রত্যাশিত রূপ দেখে তারা একটু বিচলিত হয়ে পড়ল। শেষ পর্যন্ত বাহিনীর কাছে নতুন বার্তা পাঠাতে তারা বাধ্য হল। কিন্তু তাদের এই অবাধ্যতা ও নির্বুদ্ধিতার চড়া মূল্য দিতে হল খেলাফতকে। মিদহাত পাশার আশা ও খলীফা আব্দুল হামীদের আশঙ্কাই শেষ পর্যন্ত সত্য হল। খলীফার আদেশে খেলাফত-বাহিনী থেমে যাওয়ার অল্প পরেই ইউরোপেরর কড়া হুমকি এল, সামরিক পন্থায় সমাধানের চিন্তা ছেড়ে খেলাফত যেনসঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করে। অন্যথায়...। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, পাশাদের ‘সুপরামর্শে’ যুদ্ধ যদি চলমান থাকত,পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করত এবং খেলাফাতকে আরো কঠিন মূল্য দিতে হত। শেষ মুহূর্তে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হয়ে খলীফাকঠোর অবস্থান গ্রহণ করার কারণে পাশাচক্র পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়। তারপরো খলীফার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী ইউরোপের রাজধানীগুলোতে বার্তা পাঠাতে গিয়ে আবারও হঠকারিতার পরিচয় দিল রুশদী পাশা, মিদহাত পাশাচক্র। একে তো যথেষ্ট সময় ক্ষেপণ করা হল, তার উপর নিজেদের পক্ষ হতে তারা অপ্রয়োজনীয় এবং অবাস্তব কিছু দাবী-শর্ত জুড়ে দিল। পাশাচক্রের উদ্দেশ্য ছিলো পরিষ্কার; আর সবকিছু যে পর্দার আড়াল থেকে আসা ইঙ্গিতেই সম্পন্ন হচ্ছিলো তাও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিলো না। খলীফা তখন ছিলেন অসহায়ত্বের চূড়ান্ত স্তরে। খেলাফতের তৎকালীন ‘পরিস্থিতি’ সম্পর্কে সামান্য ধারণাও যার আছে সে-ই বুঝতে পারবে কঠিন কোন দাবী ও শর্ত আরোপের মত অবস্থানে কিছুতেই ছিল না খেলাফত। রণাঙ্গনের এ বিজয়ই বরং ছিল অপ্রত্যাশিত গায়বি মদদ! সবচেয়ে বিস্ময়কর ও মর্মান্তিক বিষয় এই যে, ‘যথারীতি’ দরবারে খেলাফতের নামেই হলসব কিছু, কিন্তু খলীফাকে জানানো হল না কিছুই। এখান থেকেও কিছুটা হলেও আন্দায করা যায়, নতুন খলীফার প্রতি পাশাচক্রের অবজ্ঞা-অপমানের প্রকার ও প্রকৃতি কী ছিল!স্বাভাবিকভাবেই পাশাদের সমস্ত দাবী ও শর্ত প্রত্যাখ্যান করল ইউরোপীয় শক্তিবর্গ এবং নিঃশর্তভাবে যুদ্ধ বন্ধের দাবীজানালো। অন্যথায়...। এ পর্যন্ত এসেও যদি পাশাচক্র থামতো! কিন্তু তারা সতর্ক হল না, বা হতে চাইলো না। আবারও তারা খেলাফতকে সঙ্ঘাতের পথে টেনে নেয়ার চিন্তা করল। খলীফা আব্দুল হামীদ যথাসাধ্য তাদের বোঝাতে চেষ্ট করলেন যে, সঙ্ঘাতের যে কোন পদক্ষেপ রাশিয়াকে খেলাফাতের বিরুদ্ধে আগ্রাসন পথ করে দেবে, কিন্তু তারা তা মানতে নারাজ। তারপরো কি বলা যায় না, রাশিয়াকে পথ করে দেয়াই ছিলো পাশাচক্রের উদ্দেশ্য?অবিচল খলীফাকে বিচলিত করার জন্য বিভিন্ন উপায়ে তারা প্রবল চাপ সৃষ্টি অব্যাহত রাখল। তাদের শ্লোগানসর্বস্ব ‘জিহাদী’ প্রচারণা ও প্ররোচনায় জনমতওবিপুলভাবে বিভ্রান্ত হল। সস্তা জনপ্রিয়তার কাঁধে সওয়ার হয়ে মিদহাত পাশা হয়ে গেলে জাতীয় হিরো।বেলগ্রেড দখল করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার দাবীতে খলীফার প্রাসাদের সামনে ‘বিশাল’ গণবিক্ষোভের আয়োজন করা হল। আর শক্ত হাতে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মত শক্তি তখন ছিল না ‘হাত পা বাধা’ খলীফার। শেষ পর্যন্ত পাশাচক্রের তৈরী জনমতের প্রবল চাপের সামনে খলীফা আব্দুল হামীদ নতি স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। যুদ্ধ শুরু হল, আর পুরো সুযোগটা লুফে নিয়ে রাশিয়া ঘোষণা করল, বলকানে তুর্কী‘আগ্রাসন’ তারা চেয়ে চেয়ে দেখবে না। এই মুহূর্তে বলকান অঞ্চলে ‘নিরীহ খৃস্টান ভাইদের’ প্রতি জুলুম নির্যাতন বন্ধ করতে হবে এবং ৪৮ ঘন্টার মধ্যে উছমানী বাহিনী প্রত্যাহার করতে হবে, অন্যথায় পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য ইস্তাম্বুলই দায়ী থাকবে।শুধু হুঁশিয়ারি জ্ঞাপন করেই রাশিয়া বসে থাকল। সীমান্তে বিপুল সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে খলীফাকে বুঝিয়ে দেয়া হল, এটা কূটনৈতিক হুঁশিয়ারি নয়, সামরিক হুঁশিয়ারি। পাশাচক্র তখন সুকৌশলে খলীফার উপর দায় চাপিয়ে অভিযান স্থগিত করলো। অথচ খলীফার নির্দেশ মান্য করা হলে সম্মানজনক অবস্থান থেকে অভিযান প্রত্যাহার হতে পারতো। রাশিয়ার চরম সামরিক হুমকির বিষয়টি চেপে গিয়ে জনগণের মধ্যে এরূপ প্রচারণা চালান হল যে, উছামনী বাহিনী যুদ্ধের জন্য পূর্ণ প্রস্তুত ছিল, কিন্তু খেলাফতের পক্ষ হতে ‘প্রয়োজনীয় উৎসাহের অভাবে’ অভিযান স্থগিত করতে হয়েছে। এভাবেই একের পর এক হঠকারিতার মাধ্যমে খেলাফতকে রাশিয়ার আগ্রাসনের মুখে ঠেলে দিতে থাকলো দরবারে খেলাফত ‘দখল’ করে রাখা পাশাদের দল। লোভনীয় শিকারের বড় হিছ্ছা রাশিয়ার ভাগে চলে যাওয়ার আশঙ্কায় বিচলিত হয়ে পড়ল অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তি, বিশেষ করে ইংল্যা-। তাই পরিস্থিতি আলোচনার নামে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে কুস্তুনতুনিয়ায় (বর্তমান ইস্তাম্বুলে) একত্র হওয়ার আহ্বান জানালো তারা। ১৮৭৬ এর ডিসেম্বরে ইতিহাস বিখ্যাত তারসানা সম্মেলনে ইস্তাম্বুলে একত্র হল রাশিয়া,বৃটেন,ফ্রান্স,জার্মানী,অস্ট্রিয়া,হাঙ্গেরী এবং ইতালীর প্রতিনিধিরা। 




সুলতা আব্দুল হামীদ রহ. সেই মহান দরদী শাসক, যার জীবদ্দশার বহু  কট্টর বিরোধী মৃত্যুর পর শোক ও অনুশোচনা প্রকাশ করেছেন। তাদের একজনন হলে তাওফিক রেজা তার শোক কবিতার অংশবিশেষ-মহামান্য! নির্লজ্জভাবে আমরা আপনার উপর অপবাদ আরোপ করেছি, আপনাকে পাগল আখ্যা দিয়েছি। কিন্তু আপনি নন আমরাই ছিলাম পাগল। আপনি এ যুগের শ্রেষ্ঠ রাজনীতিক। আপনার বিরোধিতায় আমরা হিতাহিত জ্ঞানশুন্য হয়ে পড়েছিলাম। আমরা বলেছি, আপনি যালিম, আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ অপরিহার্য; সবই বলের্ছি শয়তান যা আমাদের বলিয়েছে; ন্যূনতম আখলাক ও সৌজন হারিয়ে ফেলেছিলঅম; কিন্তু মহামান্য! সত্য সবসময় আপনার পাশে থাকবে, ইতিহাস আপনার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা