মুহররম.১৪৪০হিঃ (৩/৬)

তোমাদের পাতা

ভূ .. ভূ .. ভূ .. ভূ.. ভূ.. ভূ .. ভূল!!!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

এত দূর থেকেও শোনা যায়; বানান জলসার সভাপতি হযূর তাঁর আরামের কুরসিতে আরামসে ঘুমুচ্ছেন। জলসার ছেলেরা মেয়েরা আর কী করে! ছেলেরা ছেলেদের মধ্যে, মেয়েরা মেয়েদের মধ্যে গোল হয়ে গল্পে মেতে উঠলো। তো আমরা কী করি! চলো, ছেলেদের ওখানে গিয়ে কাজ নেই। ওরা কাজের কথা বলে কম! গপ্প করে বেশী! তার চেয়ে মেয়েদের ওখানে যাই। দেখি তো, কী নিয়ে জমেছে ওদের গল্প!!নাফীসা ঃ যাই বলো, আমাদের হুযূর আজকে একটু ঘুমুতেই পারেন। কালকের বানান-জলসাটা তো ছিলো জব্বর মজাদার; এমন মজাদার যে, সরষেবাটা ইলিশের কথা মনে পড়ে যায়!(এ পর্যন্ত বলে নাফীসা সবক’টি মেয়েকে একবার দেখে নিলো, তারপর) ঃ বলো দেখি, আগে বাড়ার আগে কী করতে হবে? ঠিক ধরেছো, খেতে পাও বা না পাও, সরষেবাটা ইলিশ, বানানটা কিন্তু জানা থাকা চাই!সুরাইয়া ঃ বড় আপু! এর মধ্যে একটা সুখবর আছে। আমাদের সভাপতি হুযূর অবশ্য সুখবর বলেন না; বলেন খোশখবর। নাফীসা (কিছুটা অবাক হয়ে) ঃ তা, আমি জানি না, এমন খোশখবরটা কী শুনি? সুরাইয়া ঃ তুমি তো আজ দেরী করে এসেছো! সভাপতি হুযূর তখনো জেগে। নিজের মুখেই দিলেন খোশখবরটা। দিয়েই মাথাটা ডান দিকে কাত করে বাম দিকে ঘুমিয়ে পড়লেন। তারপর তুমি এলে!নাফীসা (কিছুটা অধৈর্য হয়ে) ঃ আহ, বলবে তো খোশখবরটা কী?!সুরাইয়া ঃ আম্মা হুযূর নাকি বলেছেন, ইলিশের বাজারে দামের আগুনটা একটু নিভুক, আমাদের সবাইকে তিনি সরষেবাটা ইলিশ খাওয়াবেন! আমার তো তখন থেকেই জিভে পানি! বুশরা ঃ আর আমাদের জলসার সবচে’ ছোট মেয়েটি, যাকে সবাই আদর করে বলি, পুষি! বানান জিজ্ঞাসা করলেই যার মুখ হয় কাঁদো কাঁদো, সে তো এখন থেকেই বলছে, আল্লাহ যেন ইলিশের দামটা তাড়াতাড়ি কমিয়ে দেন!নাফীসা (সবার অগোচরে একটা ঢোক গিলে) ঃ অত জিভে পানি আসা কিন্তু ভালো না!বুশরা ঃ তা তো হলো! এখন কাঁদো কাঁদো মানেটা বোঝাও তো বড় আপু!নাফীসা ঃ কাঁদো কাঁদো মানে হলো কান্নাটা এখনো শুরু হয়নি, চোখে মুখে কান্নার ভাবটা শুধু এসেছে। বেশী কিছু বললে এখনি কেঁদে ফেলবে, এই আর কি! তবে মনে থাকে যেন! হাসতে চন্দ্রবিন্দু লাগে না, কাঁদতে লাগে।মুশফিকা ঃ হাসতে হলে তো শুধু খিল খিল করলেই হলো। কাঁদতে হলে তোমাকে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করতে হবে! তাই চন্দ্রবিন্দু দিলেই সুবিধে!নাফীসা ঃ আনেক দূর চলে এসেছি, না! আচ্ছা, চলো আগের কথায় ফিরে যাই। হাঁ, সরষে বা সরিষা হচ্ছে একপ্রকার শস্যদানা যা পিষে তেল বের করা হয়। সরিষার তেল তো চেনোই, আছে না তোমাদের রান্নাঘরে! বানানটা শোনো। প্রথমে দন্ত্য-স, শেষে মূর্ধন্য-ষ।বুশরা (মুখে একটা লজ্জা লজ্জা ভাব) ঃ এই দেখো বড় আপু! তোমার কথায় মনে পড়ে গেলো বড় লজ্জার সেই ঘটনাটা। সবাই একসঙ্গে ঃ কী ঘটনা! কী ঘটনা!!বুশরা ঃ তাহলে খুলেই বলি। বানানের জলসায় আমি তখন নতুন মেয়ে। মেয়ে বলতে তখন শুধু আমরা দু’জন; আমি আর নাফীসা আপু। তোমরা তখনো আসোনি। সভাপতি হুযূরের মেজায-মর্জি বুঝি না। তাই কথায় কথায় কখনো খাই বকা, কখনো খাই ধমক; কখনো খাই কানমলা, কখনো নাকমলা।মুশফিকা ঃ কানমালা তো জানি, নাকমলাটা কী আপু!বুশরা ঃ আর বলো না, হুযূর তখন নতুন নতুন হুযূর। খুব কড়া। নাকমলা ছিলো তাঁর প্রিয় শাস্তি। দেয়ালের সঙ্গে নাক লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। এখন আব্বা হুযূর নিষেধ করে বলেছেন, মাঝে মধ্যে কানমলা চলতে পারে, কিন্তু নাকমলা বিলকুল না।পুষি ঃ তা কী ঘটনা!বুশরা ঃ কী একটা কথা নিয়ে নাফীসা আপুর সঙ্গে হাসাহাসি হচ্ছিলো! সভাপতি হুযূরের নযরে পড়ে গেলাম। আর যায় কোথা! জানোই তো, মক্তবেহুযূর নারায হলে ধরেন বেত। আমাদের বানানজলসার হুযূর আবার এদিক থেকে ভলো! নারায হলেই ধরেন বানান। ...মুসলিমা ঃ তার আগে বলো দেখি বুশরা আপু! হুযূর এদিক থেকে ভালো!তাহলে কোন দিক থেকে খারাপ!!নাফীসা(বুশরার পক্ষ ধরে) ঃ না, মানে সবদিক থেকেই ভালো! তবে কিনা সবক’টা রসগোল্লা একলা না গিলেআমাদেরও একটু আধটু দিলে আরো ভালো হতেন, এই যা!মুসলিমা ঃ আস্তে বলো বড় আপু, হুযূরের কানে গেলে এক্কেবারে তালব্য-শ দিয়ে সর্বনাশ!মুশফিকা ঃ তা ঘটনাটা কী! সুরাইয়া ঃ সদিনও হুযূর আমাদের বানান মুখস্তের কাজে লাগিয়ে আরামের একটা ঘুমের ইনতিযাম করছেন। সরিষার তেলটা মাত্র নাকে দেবেন, এর মধ্যে হলো আমাদের হাসাহাসি, আর হুযূরের পড়ে গেলো নযর! হুযূরের বুদ্ধিটা কিন্তু বেশ! হাতের কাছে যখন যেটা পান সেটার বানান দিয়েই শুরু করেন। তো হাতে ছিলো সরিষার তেলের বোতল। হযূর চোখ বড় বড় করে বললেন, এই নতুন মেয়ে, কী যেন নাম, সুরাইয়া। দাঁড়াও, ‘সরিষা’ বানান বলো। ওম্মা! এত  বড় বড় চোখ! আমার তখন কী যে ভয়! দাঁড়ালাম তো চন্দ্রবিন্দু দিয়ে, কিন্তু ভয়ে পা দু’টো কাঁপতে লাগলো। তাতেও সমস্যা ছিলো না। কারণ কাঁপুনিতেও চন্দ্রবিন্দু ছিলো। সমস্যা হলো কোথায় জানো, সরিষা বানানটা মনে ছিলো, কিন্তু সভাপতি হুযূরের ভয় বলে কথা! জানা বানানটাও কি না ভুলে গেলাম! বললাম, তালব্য-শ দিয়ে শুরু, মূর্ধন্য-ষ দিয়ে শেষ।এমন সুযোগটা সভাপতি হুযূর কি আর ছাড়তে পারেন! আমরা দু’টি মাত্র মেয়ে, অতগুলো ছেলের সামনেই কিনা বললেন, দাঁত দেখিয়ে হাসতে পারো, দন্ত্য-সটা বলতে পারো না!তখন ঠিক বানানটা মনে পড়লো, কিন্তু লজ্জায় পড়ে আবার ভুলে গেলাম, বললাম কী! মূর্ধন্য-ষ দিয়ে শুরু, দন্ত্য-স দিয়ে শেষ! এবার হুযূর এমন জোরে হেসে উঠলেন যে, লজ্জায় কেঁদেই ফেললাম, এক্কেবারে চন্দ্রবিন্দুর কান্না!মেয়েরা কাঁদলে হুযূরের দিলটা নরম হয়ে যায়। নরম হয়ে এক্কেবারে কিসের মত যেন গলে যায়, হাঁ, মনে পড়েছে, মোমের মত গলে যায়।তাই হুযূর মোমের মত নরম হয়ে বললেন, বারে, কান্নার কী হলো! বানানে ভুল তো হতেই পারে! আমারও তো হয়! আচ্ছা, এবার একটা সহজ বানান! বলো দেখি, শেষ কী দিয়ে শুরু, কী দিয়ে শেষ?!সভাপতি হুযূর যেমন কাঁদাতে পারেন তেমন হাসাতে পারেন। সহজ প্রশ্ন! মনটা খুশী হলো, কান্নাটাও থেমে গেলো, আর উত্তরটাও ঠিক ঠিক হলো, মানে তালব্য-শ দিয়ে শুরু, মূর্ধন্য-ষ দিয়ে শেষ। শেষ ও বিশেষ, একই বানান। উত্তর শুনে, তার চেয়ে বেশী, আমার কান্না থেমেছে দেখে সভাপতি হুযূর খুশী তো হলেন, তবে খোশ হলেন কি না, বোঝা গেলো না। কারণ মুখে হাসি এলো না, আর সরিষা’র বানানটাও ভুললেন না। প্রথমে হাতের শিশিটার দিকে তাকালেন, তারপর কড়া নযরটা ছেলেদের দিকে তাক করলেন। শফীকের বোধহয় ঝিমুনি এসেছিলো। তাকেই ধরে বসলেন, এই যে শফীক, বলি, কী হচ্ছে! আমার জলসায় ঝিমুনি! ওঠো, দাঁড়াও এবং দ-ায়মান হও।সভাপতি হুযূরের মেজাযটা যখন তেতে ওঠে, গলার ভেতর থেকে তখন কঠিন কঠিন শব্দ বের হতে থাকে। দাঁড়ানো আর দ-ায়মান হওয়া তো একই কথা! একটা হলো সহজ বাংলা, আমি-তুমি, চাষা-ভুষা সবাই বোঝে। আরেকটা হলো কঠিন বাংলা, ওটাকে ধরে আনা হয়েছে সংস্কৃত থেকে। প-িৎ ছাড়া কেউ বোঝে না; কিন্তু হুযূরের মেজায বলে কথা!নাফিসা ঃ দাঁড়াও, আগে চাষাভুষা মানেটা জেনে নাও, চাষী মানে যে চাষ করে, ফসল ফলায়, চাষা মানেও তাই। তবে কিনা, শব্দটার মধ্যে তাচ্ছিল্য আছে। মানে অশিক্ষিত মূর্খ। চাষীরা লেখা-পড়া জানে না তো, তাই।তাসলিমা ঃ লেখা পড়া না জানুক, ফসল তো ফলায়! মাটিতে ঘাম তো ঝরায়! মানুষের ক্ষুধা তো দূর করে!নাফিসা ঃ করেই তো! শহরের বাবুরা এমনই।তাসলিমা ঃ চাষা তো বুঝলাম। ভুষাটা কী বড় আপু? নাফিসা ঃ ঐ যে আমরা বলি, ভাতটাত, কাপড়চোপড়! ভুষাটা চাষার সঙ্গে এমনি এসে যায়। তাচ্ছিল্যটা তাতে আরো গাঢ় হয়। মানে হলো, চাষা ও চাষার মত মূর্খ।বুশরা ঃযাক, আমার ঘটনাটা শেষ করি। শফীক দাঁড়ালো এবং ঠিক ঠিক উত্তর দিলো। তবে কিনা, ও যখন শুরু করে, থামতে সময় লাগে। যেমন ধরো, ও বললো ঃ সরিষা, বানানটা তো সোজা, বুশরা পারলো কেন কে জানে! হয়ত হুযূরের ভয়ে ভড়কে গিয়েছে। বানানটা দন্ত্য-স দিয়ে শুরু, মূর্ধন্য-ষ দিয়ে শেষ। ...এ পর্যন্ত ঠিক ছিলো। সভাপতি হুযূরও খোশ। সর্বনাশটা হলো এর পরে। হযূরের হাতে তেলের শিশি। সেদিকে তাকিয়ে বলে বসলো, সরিষার তেলে ঝাঁজ আছে, চন্দ্রবিন্দুতে ঝাঁজটা আরো বাড়ে। নাকে দু’ ফোটা দিলে হাচি আসে জবর জবর তিনটে চারটে। তাতে ঘুমটা অবশ্য ভালো হয়।সভাপতি হুযূর খোঁচাটা ঠিকই বুঝলেন, তাই আবার বানানের চাবুকটা হাতে নিয়ে বললেন, তোমার খোঁচাটা মাফ। কারণ চন্দ্রবিন্দুটা দিয়েছো ঠিকমত। কিন্তু ফোটা!! আর চন্দ্রবিন্দু ছাড়া হাঁচি! সুতরাং একপদে দ-ায়মান হও আমি নিদ্রা থেকে জাগ্রত হওয়া পর্যন্ত।বেচারা শফীকটার জন্য মায়াই হলো। কিন্তু তুমি বাপু অত কথা বলতে যাও কেন! তুমি তো বানান জলসার পুরোনো ছেলে! জানো না হুযূরের মেজায!মুসলিমা ঃ তা বড় আপু, সে তো হলো অনেক আগের কথা। কালকের জলসাটা মজাদার হলো কিসে তা তো বললে না!নাফীসা (কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে, চোখ পাকিয়ে) ঃ এখন এসেছো মনে করাতে! জায়াগা ফুরিয়ে এসেছে দেখতে পাও! সভাপতি হুযূর এখনই হয়ত ঘুম থেকে চোখ মেলে বলবেন, আচ্ছা, আজকের মত তোমরা যাও। কালকে এসো একটু আগে ভাগে! অনেক প্রশ্ন আছে।
সরিষার শস্যদানা/বানান শিখতে নেই মানা!খুশি (ভক্তিতে গদ গদ হয়ে) ঃ হুযূর! ঐ যে বানানের ধাঁধা শিখিয়ে দিলেন, আমার বান্ধবীটা, না, তাতেই জব্দ! শেষে বলে কী, তোদের হুযূর এত্তো বানান জানে! নিবি আমাকে তোদের বানানজলসায়?!সভাপতি (ছাত্রীর ভক্তিতে আপ্লুত হয়ে) ঃ তা তুমি কী বললে, বান্ধবীকে?খুশি ঃ আমি কথাই বলিনি!! আমি কি ভুলে গিয়েছি, আমার হুযূরকে সেদিন কী বাজে কথাটা বললো!সভাপতি ঃ এটা কিন্তু ঠিক হলো না। মনের ভিতরে রাগ পুষে রাখতে নেই। বললেই পারতে, ‘আহলান ওয়া সাহলান’; তাতে তোমার বড়ত্ব প্রকাশ পেতো।খুশি (কিছুটা কুণ্ঠিত হয়ে) ঃ তাহলে তো আমার বড় ভুল হয়ে গেছে হুযূর! কালকেই ওর কাছে যাবো! বলবো, সব ভুলে গিয়ে চল্ আমরা সই হবো। আমাদের বানানের জলসায় তোকে স্বাগতম।শফীক ঃ হুযূর, শস্যের বানান তো জানি, তালব্য-শ, আর দন্ত্য-স। কিন্তু শস্যের দানা একসঙ্গে কেন?সভাপতি হুযূর (যেন খুব মজা পেয়েছেন শফীকের কথায়) ঃ শস্যের দানা একসঙ্গে কোথায় আলাদাই তো আছে!শফীক (ভুলটা বুঝতে পেরে কিছুটা যেন লজ্জিত) ঃ জ্বি, আমি আসলে বলতে চেয়েছি শস্যদানার কথা।সভাপতি ঃ তাহলে কী দাঁড়ালো! উত্তরটা তোমার কথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে। ‘শস্যের দানা’ আলাদা, আর শস্যদানা একসঙ্গে। কারণ মাঝখান থেকে ‘র’টা ফেলে দিয়ে শস্য ও দানা, দু’টো কাছাকাছি এসে পড়েছে।সভাপাতি ঃ আচ্ছা, মনে করিয়ে দিয়ো; আগামী জলসায় এসম্পর্কে কিছু জ্ঞান তোমাদের মধ্যে বিতরণ করবো, একটু যদি মিষ্টিমুখ করাও!শফীক ঃ মিষ্টিমুখের কথাটা আব্বা হুযূরকে জানাবো হুযূর?!সভাপতি ঃ না মানে, আমি তো শুধু বোঝাতে চেয়েছি, মিষ্টিমুখ একসঙ্গে লিখতে হয়!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা