রবিউল আউয়াল ১৪৪০হিঃ (৩/৭)

তোমাদের পাতা

পাকিস্তানে আলী মিয়াঁর বয়ান

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

উন্নত যুবচরিত্রই

দেশ ও জাতির নিরাপত্তা ও উন্নতির নিশ্চয়তা

(করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের সমাবেশে প্রদত্ত ভাষণ। তারিখ, ২৬শে মে, ১৯৮৪)

হামদ ও ছালাতের পর-

সম্মানিত ভাইস চ্যান্সেলর, উপস্থিত শিক্ষকম-লী, প্রিয় তালিবান, শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, আস্-সালামু আলাইকুম। আমার জন্য বড় আনন্দ ও মর্যাদার বিষয় যে, করাচি বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত এ মহান সমাবেশে বক্তব্য রাখার সুযোগ হচ্ছে। জনাব ভাইস চ্যান্সেলর সাহেব বড় উদার চিত্ততা ও মহানুভবতার সঙ্গে আমার ক্ষুদ্র ব্যক্তিসত্তার পরিচয় করিয়েছেন এবং আমার বিনীত জ্ঞানগবেষণা ও ইলমি মেহনতের প্রতি অকুণ্ঠ প্রশস্তি নিবেদন করেছেন, যা আমার প্রাপ্য থেকে অনেক বেশী। মূলত এটি তাঁর নিজের জ্ঞানপ্রশস্ততা ও চিত্তঔদার্যেরই পরিচায়ক। তবে আমি মনে করি, আমার পরিচয়ের এমন একটি দিক রয়ে গেছে, যার প্রতি আজকের সমাবেশের বিশেষভাবে আগ্রহ থাকার কথা। তা এই যে, আমার সচেতন জ্ঞান-জীবনের সূচনা হয়েছে শিক্ষকতার মাধ্যমে। আমার দরসের তালিবান তা থেকে কতটা উপকৃত হয়েছে এবং তাদের কতটুকু সেবা আমি করতে পেরেছি তা তো নিশ্চয়তার সঙ্গে বলতে পারি না। তবে আমার নিজের অনেক কল্যাণ ও উপকার হয়েছে। আমার চিন্তা-চেতনা অনেক উৎকর্ষ ও ব্যাপ্তি লাভ করেছে। এর দ্বারা মনস্তত্ত্ব ও মননশীলতা বোঝার ক্ষেত্রে এবং জীবনকে খুব নিকট থেকে অনুভব করার বিষয়ে যথেষ্ট সাহায্য হয়েছে। এককথায়, আমি শেখানোর চেয়ে অনেক বেশী শিখেছি। বিশ্বব্যাপী আমার দীর্ঘ দীর্ঘ সফরে বিভিন্ন উপলক্ষে বড় বড় মজলিসে বসার এবং বড় বড় জলসায় কথা বলার সুযোগ আমার হয়; বড় বড় জ্ঞানী-গুণী ও স্কলারের সান্নিধ্য গ্রহণের সৌভাগ্যও হয়, কিন্তু আমার জন্য সবচে’ মনোরম, সবচে’ আনন্দঘন সময় হলো তখন যখন যুবকদের সঙ্গে, ছাত্র-শিক্ষার্থীর সঙ্গে এবং শিক্ষকতায় যারা আমার সহযাত্রী তাদের সঙ্গে বসার ও কথা বলার সুযোগ হয়। আল্লাহ তা‘আলা আজ এমনই একটি দুর্লভ সৌভাগ্য দান করেছেন এবং তা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে। তাই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞ।

সুধী শ্রোতাম-লী! কোন দেশের উন্নতি ও সংহতি এবং কোন সম্প্রদায় ও সমাজের মর্যাদা ও সুরক্ষা লাভের বিভিন্ন উপায় ও উৎস হতে পারে; হতে পারে বিভিন্ন মাধ্যম ও অবলম্বন। ধরুন, কোন দেশ বড় সামরিক শক্তি ও আধুনিক সেনাবাহিনীর অধিকারী। কোন দেশের রয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সম্পদ। কারো কাছে রয়েছে খনিজসম্পদ, প্রাণীসম্পদ ও কৃষিসম্পদের বিশাল ভা-ার। কোন দেশ নিজে বড় না হলেও বড় ও শক্তিমান কোন দেশের সঙ্গে রয়েছে তার সুসম্পর্ক, আস্থা ও বন্ধুত্বের বন্ধন। এবং রয়েছে নিরাপত্তাচুক্তি। কোন সমাজে রয়েছে বিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচুর্য; রয়েছে মেধা ও প্রতিভা এবং দৈহিক শক্তি ও শারীরিক সক্ষমতার ঈর্ষণীয় সম্পদ।

উপরে যা যা বলা হলো এর প্রতিটিকে কোন দেশ ও সমাজের শক্তি-সংহতি ও মর্যাদার প্রতীক মনে করা হয়। আমি সেগুলোরগুরুত্ব অস্বীকার করি না। তবে আমার সামনে যদি কোন দেশের  শক্তি ও সংহতির এবং কোন সমাজ ও সম্প্রদায়ের মর্যাদা ও প্রাগ্রসরতার আলোচনা আসে এবং এ বিষয়ে তাদের স্তুতি-প্রশংসা করা হয় তাহলে প্রথমেই আমি যে বিষয়টি জানতে চাইবো তা হলো, সেখানকার বিদ্যালয় ও বিশ্ব-বিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে, অর্থাৎ নতুন প্রজন্মের শিক্ষিত অংশের মধ্যে কোন্ পর্যায়ের দায়িত্বশীলতা পাওয়া যায়? তাদের মধ্যে সংযম ও আত্মসম্বরণের কী পরিমাণ শক্তি রয়েছে? তাদের মধ্যে আবেগ ও প্রতিক্রিয়া প্রকাশের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষার কতটা যোগ্যতা রয়েছে। তাদের মধ্যে নিয়ম-নীতি ও শৃঙ্খলা মেনে চলার মানসিকতা কী পরিমাণ? তাদের নাগরিক বোধ ও চেতনা কেমন?

আমি ইতিহাসের একজন সাধারণ ছাত্র হিসাবে-যার প্রতি জনাব ভাইস চ্যান্সেলর সাহেব একাধিকবার ইঙ্গিত করেছেন- এবং ইতিহাসের সীমানা থেকে বের হয়ে জীবন্ত ও চলমান সমাজের বাসিন্দাদের সঙ্গে ওঠা-বসার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন সচেতন মানুষ হিসাবেও আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। এটা যেমন ইতিহাসের শিক্ষা তেমনি যে কোন জীবন্ত সমাজেরও বার্তা। এ সিদ্ধান্তের ভিত্তি আমি শুধু কিতাবের পাতা এবং ইতিহাসের ছিন্নপত্রের উপর রাখতে চাই না। আমি আকবর ইলাহাবাদী মরহূমের এই কবিতা পংক্তির অনুসরণ করে থাকি-

রেখা ও নকশা নিয়ে পড়ে থেকো না/ মানুষের সমাজে মিশে দেখো/কোন জিনিস আছে জীবন্ত /আর কোন জিনিস মরতে বসেছে!

‘শুমারিয়্যাত’ ও পরিসংখ্যান তথা ঝঃধঃরংঃরপং আমাদের এ যুগে যে বিরাট গুরুত্ব অর্জন করেছে; এর জন্য যে বড় বড় সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এবং এর পিছনে মানুষের যত শক্তি ও মেধা নিয়োজিত হয়েছে তা তো সবারই জানা। তো এর প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই আমি বলতে চাই, আমার দৃষ্টিতে কোন দেশের উন্নতি ও স্থিতি, তার নিরাপত্তা ও সংহতি এবং তার মর্যাদা ও ভাবমর্যাদার মাপকাঠি পরিসংখ্যানের উচ্চ সূচক হতে পারে না। তদ্রƒপ এটাও হতে পারে না যে, অভিজ্ঞ ও পরিপক্ব এবং প্রবীণ ও বয়স্ক যে  প্রজন্ম. এখন জীবনের মঞ্চে ভূমিকা পালন করছে তারা বেশ উন্নত ও অগ্রসর; আমাদের প্রাচীন চরিত-পরিভাষায় ‘তারা সবাই অলী-বুযুর্গান’, কিংবা আধুনিক একাডেমিক পরিভাষায় তারা প্রাজ্ঞ ও পা-িত্যসম্পন্ন। তাদের প্রশংসায় আরো যা বলার বলুন, আমি শুধু বলবো, এগুলো মোটেই যথেষ্ট নয়। কারণ এ প্রজন্ম খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাবে। কামনা তো করি, আল্লাহ তাদের বয়সে বরকত দান করুন, তবে আসমানের শাশ্বত বিধান নিজের কাজ করেই চলেছে। তাতে না রয়েছে নবী-পায়গাম্বরের ব্যতিক্রম, না আলেম ও জ্ঞানী-গুণীজনের জন্য কোন ছাড়। এমনকি স্বয়ং আল্লাহর পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-

وما محمد إلا رسول قد خلت من قبلـه الرسل

মুহাম্মাদ তো রাসূলমাত্র। তার পূর্বেও রাসূলগণ বিগত হয়েছেন।

তো জন্ম-মৃত্যুর বিধান সবার উপরই (সমানভাবে কার্যকর)। সুতরাং বলতেই হবে ‘বুড়ো প্রজন্ম’ অল্প দিনের মেহমান। আশ্বস্ত হওয়ার জন্য এতটুকু যথেষ্ট নয় যে, কোন দেশের, বা সম্প্রদায়ের মধ্যবয়স্ক ও বৃদ্ধ প্রজন্ম শুভ্র চিন্তা, পবিত্র নৈতিকতা, উন্নত চরিত্র ও জীবন্ত হৃদয়ের অধিকারী। প্রখর মেধা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার অধিকারী। আসল দেখার বিষয় হলো, যে নতুন প্রজন্ম এই বুড়ো প্রজন্মের স্থান গ্রহণ করবে এবং দেশ ও সমাজের লাগাম হাতে নেবে, যাদের সঙ্গে দেশ ও জাতির ভবিষ্যত সম্পৃক্ত, যাদের মাধ্যমে  দেশ, জাতি, সমাজ ও সভ্যতার প্রম্পরা ও ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে তাদের নীতি, নৈতিকতা ও চরিত্রের মান কতটুকু? নিজেদের স্বভাব, আবেগ ও রাগ-বিরাগের উপর তাদের কতটা সংযম ও নিয়ন্ত্রণ? অন্যায়, অসত্য, অসুন্দর ও অকল্যাণ থেকে বেঁচে থাকার, তারা কতটা যোগ্যতার অধিকারী? পৌরুষপূর্ণ স্বভাব ও আচরণ এবং অন্তরঙ্গতাপূর্ণ প্রয়াস প্রচেষ্টায় তারা কতটা স্বতঃস্ফূর্ত।

আমার মতে কোন দেশ ও জাতির এবং কোন সমাজ ও সম্প্রদায়ের যোগ্যতা, শক্তি ও সক্ষমতা এবং মর্যাদা ও সম্ভাবনার এটাই হলো আসল মাপকাঠি। এমন যদি হয় যে, কোন দেশ ও সমাজের কাছে জীবনপ্রাচুর্যের সব উপায়-উপকরণ আছে, মেধা আছে, প্রতিভা আছে, উচ্চাশা আছে, ভূমির উপরে এবং ভূমি অভ্যন্তরে সর্বপ্রকার সম্পদ আছে এবং আহরণ ও ব্যবহার করার প্রযুক্তিও আয়ত্বে আছে, কিন্তু ..

যুবসমাজের মধ্যে, বিশেষ করে তাদের শিক্ষিত অংশের মধ্যে ত্যাগ ও আত্মত্যাগের আকুতি নেই, নিয়ম ও শৃঙ্খলার প্রতি আনুগত্য নেই, দেশ ও জাতির বৃহৎ স্বার্থ ও কল্যাণের জন্য ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ বিসর্জন দেয়ার যোগ্যতা নেই, বরং দেশ ও জাতির স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের মানসিকতা বদ্যিমান তাহলে আমি বলবো, ঐ দেশ ও জাতি পরিসংখ্যানগত যাবতীয় আশাবাদ সত্ত্বেও বড় বিপদের মধ্যে রয়েছে!

যদি এমন হয় যে, যে সকল রীতি-নীতি ও ঐতিহ্য জাতির বৈশিষ্ট্য এবং দেশের মর্যাদার প্রতীক, যার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা এবং প্রাণের বিনিময়ে হলেও যেগুলো রক্ষা করা সবার কর্তব্য, যদি এমন হয় যে, নতুন প্রজন্মের অন্তরে সেগুলোর প্রতি কোন মর্যাদাবোধ নেই; যদি এমন হয় যে, সংযম, সহনশীলতা ও আত্মসম্বরণের যোগ্যতা তাদের মধ্যে নেই; বরং তাদের স্বভাব হলো বারুদ ও পেট্রোলের মত, যা মুহূর্তে আগুন ধরে ফেলে; যদি এমন হয় যে, তাদের মধ্যে ধীরতা ও স্থিরতা নেই, ঠা-া দেমাগ ও শান্ত মস্তিষ্কে চিন্তা করার যোগ্যতা নেই, দাহ্যপদার্থের মত দপ করে জ্বলে ওঠে, আবার দপ করে নিভে যায় তাহলে...

একবার আমি ইউপি’র প্রসিদ্ধ শহর কানপুরের পথে ছিলাম। আমার গাড়ীর সামনে ছিলো একটা বড় টেঙ্কার। অনেক দূর পর্যন্ত ঐ ঢেঙ্কারের সঙ্গে আমাদের চলতে হয়েছে। কারণ আমাদের গাড়ীর সেটাকে অতিক্রম করার সুযোগ ছিলো না। ঐ টেঙ্কারের পিছনে লেখা ছিলো, ‘সাবধান, দাহ্যপদার্থ’। কারণ তাতে পেট্রোল ছিলো। আমি বরাবর লেখাটি দেখছিলাম। বলা যায়, বাধ্য হয়েই আমাকে দেখতে হচ্ছিলো। কারণ আগে যাওয়ার উপায় ছিলো না।

কানপুরে একটি সুধিসমাবেশে আমার বক্তব্য রাখার কথা ছিলো, যাদের সম্পর্কে বলা যায়, দেশের ক্রিম ও সারনির্যাস। তাদের অধিকাংশের সঙ্গে আমার জানাশোনা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো। আমি তাদের সামনে ঘটনাটি বললাম। বড় বড় লেখক সাহিত্যিক ও দার্শনিক ছোট ছোট ঘটনা থেকে বড় বড় সিদ্ধান্ত আহরণ করে থাকেন। আমার মতে সাহিত্য, দর্শন ও বুদ্ধিবৃত্তির ঐ অংশটুকুই শুধু মর্যাদাপূর্ণ নয় যাতে বড় বড় জ্ঞানগবেষণা সম্পন্ন করা হয়েছে; বরং মন ও মনস্তত্ত্ব এবং সাহ্যিকর্মের ঐ অংশটুকুও বড় মূল্যবান যাতে ছোট ছোট ঘটনা থেকে বড় বড় সিদ্ধান্ত আহরণ করা হয়েছে।

কানপুরের ঐ সমাবেশকে লক্ষ্য করে -যাতে যুবকশ্রেণীর উপস্থিতি ছিলো লক্ষণীয়- আমি বললাম, ‘দাহ্যপদার্থ’-এটা পেট্রোলের পরিচয় তো হতে পারে, যা দেয়াশলাইয়ের একটা কাঠি দেখালেই দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে; কিন্তু মুসলিম উম্মাহর, বিশেষ করে তার যুবশক্তির এ পরিচয় কিছুতেই হতে পারে না। মুসলিম সমাজের যে কোন তাবাকা ও শ্রেণীর অবস্থা যদি এমন হয় যে, স্বভাব ও চাহিদার বিপরীত কোন কিছু বরদাশত করা তার পক্ষে অসম্ভব; বরং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যে কোন বিষয় তার কাছে হয়ে দাঁড়ায়, ইগো ও অহং-এর প্রশ্ন তাহলে এটা বড় খতরনাক ও বিপজ্জনক বিষয়।

আবেগের বিস্ফোরণপ্রবণতার ঘটনা দেশ ও জাতির জীবনে এবং উম্মাহ ও মিল্লাতের যিন্দেগিতে শতাব্দীর ব্যবধানে একদু’বারই আসা উচিত যখন জাতীয় মর্যাদা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়ে; আল্লাহর শান ও শা‘আইর এবং দ্বীন ও শরী‘আতের মৌল বিধান যখন বিদ্রƒপ ও উপহাসের বিষয় হয়ে যায়, আল্লাহ না করুন, নবীর শানে গোস্তাখি শুরু হয়, কিংবা মুসলিমের ইয্যত-আবরু লুণ্ঠিত হওয়ার মত ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি দেখা দেয় তখন জাযবা ও গায়রতের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে পারে, বরং জ্বলে ওঠাই উচিৎ।

এ প্রসঙ্গে ইতিহাসের একটি উদাহরণ আমি প্রায় বলে থাকি। বাগদাদে আব্বাসী খলীফা মু‘তাছিম বড় জাহ ও জালাল এবং তাপ ও প্রতাপের সঙ্গে দরবারে সমাসীন। সা¤্রাজ্যের স্তম্ভপুরুষ যারা সবাই দরবারে বা-আদব উপস্থিত। এমন সময় একজন আগন্তুক এসে বলে, আমীরুল মুমিনীন, আমি ‘আমূরিয়া’ (তখনকার সময়ে ইসলামী সালতানাতের বাইরে বাইজান্টীয় শহর) থেকে আসছি। সেখানে জনৈকা মুসলিম নারীর ইয্যতের উপর এক পাপিষ্ঠ ঈসায়ী হাত দেয়ার চেষ্টা করেছে। ঐ অসহায় নারী তখন চিৎকার করে বলে উঠেছে- وا معتصماه হায়, কোথায় তুমি হে মু‘তাছিম!!

খলীফাতুল মুসলিমীন আল-মু‘তাছিম বিল্লাহ এ কথা শোনা-মাত্র বলে উঠলেন, লাব্বাইক, এই যে আমি হাযির!

তখনই তিনি মৃত্যুপূর্ব অছিয়ত-নামা লেখালেন এবং বিষয়াদি সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিলেন। তারপর মজলিস থেকে উঠে সোজা ঘোড়ার পিঠে বসলেন এবং তাঁর কিয়াদাত ও নেতৃত্বে লশকরে ইসলাম রওয়ানা হয়ে গেলো। ‘আমূরিয়া’র শাসককে তিনি যথাযথ শায়েস্তা করলেন এবং নির্যাতিতা মুসলিম নারীকে উপযুক্ত সান্ত¡না দিয়ে তারপর বাগদাদে ফিরে এলেন।

দেশ ও জাতির ইতিহাসে বহু শতাব্দীর ব্যবধানে কখনো যদি এমন নাযুক সময় আসে তখন ইসলামী গায়রাতের ফায়ছালা হলো-

‘দিলের উপর আকলের পাহারা ভালো, তবে মাঝে মধ্যে দিলকে দিলের পথে ছেড়ে দেয়া আরো ভালো।’

কিন্তু এমন যদি হয় যে, ব্যক্তির জীবনে, সমাজ ও রাষ্ট্রের জীবনে এটা হয় নিত্যদিনের ঘটনা! এমন যদি হয় যে, কথায় কথায় তারা দপ করে জ্বলে ওঠে, কোন পক্ষ থেকে ডাক শোনামাত্র ছুটে যায়, আর জ্বালাও পোড়াও-মারদাঙ্গা শুরু করে, যেমন আরব জাহিলিয়াতের কবি বলেছেন-

لايسألون أخاهم حين يندبهم

في النـايـبــات على ما قالوا برهانا

কবি তার কবিলার প্রশংসায় বলছেন, তারা এমনই গোত্রগত প্রাণ যে, কবিলার কারো পক্ষ হতে যখনই সাহায্যের ডাক তাদের কানে পৌঁছে, দলীল জিজ্ঞাসা করে না এবং কারণ জানতে চায় না যে, এ ডাক ভুল না ঠিক, ন্যায় না অন্যায়? সঙ্গে সঙ্গে তারা সাহায্যের জন্য ছুটে যায় এবং দুশমনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

কিন্তু ইসলামের শিক্ষা এটা নয়।দেখুন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক মজলিসে ইরশাদ করলেন-

انصر أخـاك ظالـما أو مظـلومـا আপন ভাইকে তুমি সাহায্য করো, সে যালিম হোক, বা মাযলূম।

ছাহাবা কেরাম এমনই সুউচ্চ ফিকরি তারবিয়াত ও চৈন্তিক দীক্ষা লাভ করেছিলেন যে, তাঁদের ফিকির ও চিন্তা-চেতনায় ভুল কিছুর অনুপ্রবেশের অবকাশই আর ছিলো না।

নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান যাত ও সত্তার সঙ্গে ছাহাবা কেরামের তো এমন অনন্য এক সম্পর্ক ছিলো যার উদাহরণ না আদব ও সাহিত্যে পাওয়া যায়, না মনস্তত্ত্ব ও নীতিনৈতিকতার ইতিহাসে, আর না সিয়াসাত ও শাসন-প্রশাসনের ইতিহাসে। একদিকে তাঁদের অন্তরে এ বিশ্বাস ছিলো যে, ‘তিনি নিজের ইচ্ছা থেকে কিছু বলেন না, যখন যা বলেন তা তাঁর অন্তরে প্রক্ষিপ্ত ওহী ছাড়া আর কিছু নয়।’

অন্যদিকে যবানে নবুয়ত থেকে নির্গত ঐ নির্দেশ ছিলো বাহ্যত ইসলামের বুনিয়াদি তা‘লীম ও মূল শিক্ষার সঙ্গে...। তাহলে?! নিশ্চয় এখানে এমন কোন রহস্য আছে যা তাঁরা বুঝতে পারেননি। সেই অনুভব থেকেই তাঁরা বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! মযলূম অবস্থায় তো সাহায্য করবো, কিন্তু যালিম অবস্থায় কীভাবে সাহায্য করতে পারি?

দেখুন, ছাহাবা কেরামের এরূপ ‘ব্যাখ্যাতলব’ প্রশ্নে আল্লাহর নবী বিলকুল নারায হলেন না, বরং সুন্দর করে বুঝিয়ে বললেন, তোমরা ঠিকই জিজ্ঞাসা করেছো। তবে যালিমকেও সাহায্য করার নির্ধারিত তরীকা রয়েছে। যালিমের সাহায্য এই যে, তার হাত ধরো, (নরমে গরমে যেভাবে পারো) তাকে যুলুম করা থেকে বিরত রাখো (যাতে সে দুনিয়ার মন্দ পরিণতি এবং আখেরাতের বরবাদি থেকে বেঁচে যায়)। এটাই ইসলামের উছূল ও নীতি যে, মযলূমের সাহায্য হলো, সাধ্যমত তাকে সুরক্ষা দান করা, আর যালিমের সাহায্য হলো, তার যুলুমের হাতকে মযলূমের গর্দান থেকে দূরে রাখা।

দেশ, জাতি, সমাজ ও সম্প্রদায়ের জীবনে উন্নতি, অগ্রগতি ও স্থিতির জন্য যেখানে অনেক কিছু জরুরি, যেখানে রয়েছে অনেক অপরিহার্য শর্ত, সেখানে একটি অপরিহার্য নৈতিক গুণ এটাও যে, তাদের যুবকদের মধ্যে যে কোন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সংযম ও আত্মসম্বরণের শক্তি থাকবে এবং গভীর প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে ঘটনা ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার যোগ্যতা থাকবে।

আফসোস, আমাদের গল্প-সাহিত্য, নাটক ও কবিতা (সর্বোপরি) আমাদের সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের নেতিবাচক ও অবিবেচক ভূমিকার কারণে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যে খোদা পানাহ! তিক্ত কথার জন্য আমাকে মাফ করুন- এমন উত্তেজনাপূর্ণ ও গরম শিরোনামের খবর প্রকাশিত ও প্রচারিত হয় যে, ধৈর্য ও সহনশীলতা এবং সংযম ও আত্মসম্বরনের সমস্ত বাঁধ ভেঙ্গে যায়। এমন তাপ, উত্তাপ, উন্মত্ততা ও টগবগ-অবস্থা তৈরী হয়ে যায় যে, মানুষ সামান্য থেকে সামান্য এবং ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র বিষয়েও চাহিদা ও স্বার্থের বিপরীত কিছু বরদাশ্ত করতেই পারে না।

এই কিছুদিন আগে পাটনা থেকে দরভাগ্না যাচ্ছি গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্মেলনে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে। পথে কিছু সমঝদার মানুষ আমাদের গাড়ী থামিয়ে বলতে লাগলেন, দয়া করে এ পথে যাবেন না। চিন্তায় পড়ে গেলাম, ঘটনা কী? যেখানে যেতে চাই তার পথ তো এটাই। তারা বললেন, এক স্কুলছাত্র সরকারী বাসের নীচে পড়ে আহত হয়েছে। তখন থেকে উত্তেজিত ছাত্ররা সমস্ত সরকারী বাস জ্বালিয়ে দিচ্ছে, ব্যক্তিগত গাড়ীও রেহাই পাচ্ছে না। সফরসঙ্গীরা বললেন, আমরা তো দাড়িওয়ালা মৌলভী মানুষ। বোঝাই যায়, সরকারী লোক নই। আমাদের কী সমস্যা? পথের লোকেরা বললেন, এখন ওখানে একেবারে নৈরাজ্যকর অবস্থা। কেউ দেখছে না, কে যাচ্ছে, বা কার গাড়ী? সামনে দিয়ে যা যাচ্ছে তাতেই আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।

আমাদের সঙ্গে বিহারের এক বড় আলিমও ছিলেন। সম্মেলনের সময়ের কথা চিন্তা করে আমার মধ্যে কিছু দ্বিধা কাজ করছিলো; তা দেখে তিনি বললেন, মাওলানা, ঝুঁকি নেয়ার কথা চিন্তাই করা উচিৎ না।

যাই হোক, আমরা সর্তকারী মানুষগুলোকে শুকরিয়া জানিয়ে পথেই অপেক্ষা করলাম। পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার খবর পেয়ে তারপর যাত্রা শুরু করলাম। ফলে তিন ঘণ্টা বিলম্বে সম্মেলনস্থলে পৌঁছলাম। প্রথম অধিবেশনে শরীক হওয়া আর সম্ভব হলো না।

এরূপ অবস্থা দিন-রাত আমাদের দেখতে হয়। দু’টি গাড়ীতে সঙ্ঘর্ষ হলো, ব্যস শুরু হয়ে গেলো হাঙ্গামা। দু’দিকে দু’টি দল দাঁড়িয়ে গেলো। সবাই নির্দ্বিধায় আইন নিজেদের হাতে তুলে নিলো। এই যে নৈরাজ্যের গণপ্রবণতা, আমাকে মাফ করুন, এটা আমাদের অসুস্থ রাজনৈতিক কর্মকা-ের এবং রাজনীতিকদের বিচ্যুত নীতি ও নৈতিকতার ফল। এটাও বড় একটা সামাজিক ব্যাধি, যা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে।

কোন দেশের টিকে থাকার, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পথে এগিয়ে যাওয়ার এবং সঠিক গন্তব্যে উপনীত হওয়ার নিশ্চয়তা ততক্ষণ পর্যন্ত দেয়া সম্ভব নয় যতক্ষণ না ঐ সমাজ ও সম্প্রদায়ের যুবকদের মধ্যে ধৈর্যশক্তি এবং পরিস্থিতি অনুধাবনের যোগ্যতা আসবে; যতক্ষণ না, অন্তত কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাহিদা ও স্বার্থের বিপরীত বিষয় দেখার, শোনার ও মেনে নেয়ার সংযম তাদের মধ্যে তৈরী হবে।

যে সকল জাতি পৃথিবীতে বিশাল বিশাল সালতানাত ও সা¤্রাজ্য স্থাপন করেছে (এক্ষেত্রে আমি ছাহাবাযুগের কথা বলবো, আরবদের কথা বলবো এবং শেষ যুগে সালতানাতে উছমানিয়ার কথা বলবো) তাদের মধ্যে, বিশেষ করে যুবসমাজের মধ্যে সংযম ও সহনশীলতা এবং প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার গুণ অত্যন্ত লক্ষণীয় পর্যায়ে বিদ্যমান ছিলো।

তুরস্কের সফরে আমি দেখেছি, আমাদের প্রাচ্যের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর তুলনায় তাদের মধ্যে  ধৈর্য, সংযম ও সহনশীলতা অনেক বেশী রয়েছে। পথে-ঘাটে  বা জন -সমাগমের স্থানে কোন শোরগোল আমি দেখিনি। হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া, দাঙ্গা-ফাসাদ ও ভাঙ্গচুর শুরু করা এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার কোন ঘটনা, অন্তত আমার সামনে ঘটেনি। এর বিপরীতে যা দেখেছি তা হলো, সবার মধ্যে রয়েছে আইন, শৃঙ্খলা এবং নেযাম ও ব্যবস্থার প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা। অন্যের প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মনোভাব দেখেছি ব্যাপক। একই ভাবে রয়েছে সমাজের সর্বত্র পরমত-সহিষ্ণুতা।

এই যে, ধৈর্যহীনতা, অসহিষ্ণুতা, অস্থিরচিত্ততা, হঠাৎ করে ক্ষোভ, বিক্ষোভ ও ক্রোধে এসে যাওয়া, এগুলো কোন সমাজের অসুস্থ হওয়ার লক্ষণ, যা আমাদের দেশে চোখ বন্ধ করেও দেখা যায়, তুরস্কে যা খোলা চোখেও দেখা যায় না।

ঘটনাক্রমে একবার লন্ডনে সাধারণ নির্বাচন দেখার সুযোগ আমার হয়েছিলো। সেখানে দেখেছি এবং দেখে অবাক হয়েছি যে, সবই দল মিছিল-শোভাযাত্রা বের করে। কিন্তু না আছে শ্লোগান, না কোন চিৎকার। সবাই নীরবে ব্যানার ফেস্টুন বহন করছে যাতে দলের দাবী দাওয়া ও কর্মসূচী লেখা রয়েছে। আর কারো নামে কারো চরিত্রহননের কথা তো কল্পনাই করা যায় না! অথচ আমার দেশে, আমাদের হিন্দুস্তানে!! যত নির্বাচন আমি দেখেছি, বিভাগের আগে এবং বিভাগের পরে; কোন রোগী শান্তিতে ঘুমোবে, কেউ মসজিদে মন্দিরে সময় যাপন করবে নিবিষ্ট চিত্তে, সে উপায় নেই। একদলের ক্যাম্প এদিকে, আরেক দলের ওদিকে। আওয়াযের যেন মুকাবেলা, কার গলায় কত জোর!

আমি বললাম, এখানে নির্বাচন তো বড় আজিব কিসিমের! পোলিং স্টেশনে গিয়ে দেখি, এক তরুণী কাগজ হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের মেযবান, যিনি ভোটার, তাকে তিনটি কাগজ দিলো। কাগজ নিয়ে তিনি ভিতরে গেলেন এবং ভোটের বাক্সে ভোট দিয়ে কাগজ নিয়ে ফিরে এলেন। একটি কাগজ নিজের কাছে রেখে বাকি দু’টি ঐ তরুণীকে ফেরত দিলেন। আমি বললাম, এটা কী হলো? তিনি বললেন, আমি যে দল ও প্রার্থীকে ভোট দিয়েছি তার কাগজটি রেখে বাকি দু’টি ফেরত দিয়েছি। তাতেই ঐ তরুণী বুঝে নেবে আমার ভোট কার পক্ষে হলো। কেউ কাউকে মুখে কিছু বলার প্রয়োজনই হয়নি।

সকালে উঠে দেখা গেলো, টেলিভিশনে ফলাফল আসতে শুরু করেছে এবং অমুক দল এত আসনে এত ভোটে জয়ী হয়েছে।

এই গণতন্ত্র, এই নির্বাচন এবং এই নির্বাচনী রাজনীতি তো আমরা তাদের থেকেই শিখেছি। কিন্তু শিষ্য গুরুকে ছাড়িয়ে কত দূর চলে গিয়েছে! আমরা তাদের কাছ থেকে রাজনীতি ও নির্বাচন শিখেছি, গণতন্ত্র শিখেছি, কিন্তু গণতন্ত্রের সহনশীলতা শিখতে পারিনি। নির্বাচনের সুস্থ প্রতিযোগিতা শিখতে পারিনি এবং শিখতে পারিনি রাজনীতির শিষ্টাচার।

প্রিয় শ্রোতাম-লী! এখন আমি আপনাদের মনোযোগ একটি ঐতিহাসিক সত্য ও বাস্তবতার দিকে আকর্ষণ করতে চাই। আমি আন্তরিকভাবে চাই, এ মহান বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ের উপর কিছু রিসার্চ ও গবেষণাকর্ম যেন পরিচালিত হয়।

বৃটেনের ইতিহাস পড়ে আমি জানতে পেরেছি, সতের শতকের শেষ পর্যন্ত বৃটেনের নৈতিক অবস্থা বড়ই দুর্বল ছিলো। বৃটিশ সমাজে এমন কোন আভাস-লক্ষণ পাওয়া যায়নি যাতে ধারণা করা যায়, একদিন বৃটেন বিশ্বশক্তিরূপে স্বীকৃতি লাভ করবে এবং ভারত-বর্ষের মত বিশাল সা¤্রাজ্য তার অধিকারে চলে আসবে এবং এমন সফলতা ও কুশলতার সঙ্গে পুরো দেশের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারবে। যদিও ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটাকে অবিচার ও স্বৈরাচার বলার সুযোগ রয়েছে এবং যদিও ভারবর্ষে তাদের শাসন -শোষণের ইতিহাস বড় মর্মন্তুদ।

আপনি যদি বৃটেনের ঐ সময়ের গল্প-সাহিত্য পড়েন এবং তখনকার সংবাদপত্রের ফাইল দেখার সুযোগ পান তাহলে পরিষ্কার বুঝতে পারবেন, এমন ভবিষ্যদ্বাণী করার কোন কার্যকারণ বিদ্যমান ছিলো না যে, ঐ সমাজ এত বিরাট ভূমিকা পালন করবে এবং বিশ্বের সবচে’ বড় শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করবে। এমনকি প্রবাদ তৈরী হবে যে, বৃটিশের সা¤্রাজ্যে কখনো সূর্য অস্ত যায় না।

হঠাৎ করেই যেন অবস্থার পরিবর্তন শুরু হলো। সমাজ যেন আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠলো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যখন ভারতবর্ষে পা রাখলো এবং বোঝা গেলো যে, ভারতবর্ষ বৃটেনের অধিকারে আসতে যাচ্ছে তখন হঠাৎ করেই যেন বৃটিশজাতির মধ্যে এ অনুভূতি জাগ্রত হলো যে, আমরা এক বিশাল সা¤্রাজ্যের অধিকারী হতে চলেছি। এখন নীচতা ও তরলতার আচরণ থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে; দেশের প্রতি, শাসকের প্রতি আমাদের বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের পরিচয় দিতে হবে। এমন কোন কাজ আমাদের করা চলবে না, যাতে বৃটিশ সা¤্রাজ্যের অপযশ হয়। খুব আচানকই পুরো সমাজে দৃষ্টিভঙ্গির এ পরিবর্তন সূচিত হয়েছিলো।

আমি যেহেতু বৃটিশ-ইতিহাসের ছাত্র বা গবেষক নই সেহেতু পূর্ণ আস্থা ও নিশ্চয়তার সঙ্গে এ বিপ্লবের উৎস নির্ধারণ করতে পারবো না এবং এর পিছনে যাদের ভূমিকা রয়েছে তাদের চিহ্নিত করতে পারবো না। কারা তখন শিক্ষার অঙ্গনে, নৈতিকতার অঙ্গনে কাজ করেছে; জাতির মধ্যে নতুন প্রাণ ও চেতনা জাগ্রত করার পিছনে কাদের ত্যাগ ও আত্মত্যাগ এবং চিন্তা ও দূরদর্শিতা কাজ করেছে তাদের পরিচয় আমি তুলে ধরতে পারবো না।

যদিও এর সমর্থনে কোন দলীল দস্তাবেয নেই, তবু আমার প্রবল ধারণা যে, এ পরিবর্তনের পিছনে এরূপ অনুভূতির ভূমিকা রয়েছে, ‘ঈশ্বর আমাদের বড় সা¤্রাজ্য দান করেছেন। এখন কর্তব্য হলো নিজেদের এর যোগ্য প্রমাণ করা।’ এ কারণে ইংরেজজাতির ঐ সময়ের পুরো সমাজজীবনে এমন ভাগগম্ভীরতা ও ধীরস্থিরতা, এমন আভিজাত্য ও রাজকীয়তা এবং এমন সুশীলতা ও চিত্তঔদার্য দেখা দিয়েছিলো যা ইংলেন্ডের বর্তমান সমাজেও দেখা যায় না। কোন নাগরিকের অন্তরে আইন ভঙ্গ করার, নিজের সীমা অতিক্রম করার, বা অর্পিত দায়িত্বে শিথিলতা করার কথা চিন্তায়ও যেন আসতো না। অফিসে আদালতে দফতরে সর্বত্র সবকাজ সময়মত হচ্ছে। প্রত্যেকের মধ্যে আশ্চর্য এক সজীবতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা! আশ্চর্য রকম দায়িত্ব -সচেতনতা ও সেবাপরায়ণতা!! স্কুল কলেজ ও ইউনিভার্সিটির কথা আর কী বলার আছে! সেগুলো ছিলো পুরো সমাজের মধ্যে প্রাণ সঞ্চারের উৎস।

আমাদের যুগের ছোট্ট একটি নমুনার কথা বলি, ঘটনাক্রমে আমিও লৌখনো ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলাম। তখন ভাই চ্যান্সেলর সাধারণত ইংরেজই হতেন। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়প্রাঙ্গণে আশ্চর্য এক শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা বিরাজ করতো। বিক্ষোভ মিছিল ও শ্লোগানের কথা তো ভাবাই যেতে না।

বৃটিশজাতির ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা আরো গভীর ও বিস্তৃত পরিম-লে আরবদের জীবনে আরো আগে ঘটেছে। মরুবাসী আরব যখন মরুভূমির সীমানা থেকে বের হলো এবং তদানীন্তন বিশ্বের দুই বৃহৎ সা¤্রাজ্য রোম ও পারস্যের উত্তরাধিকারী হলো তখন হঠাৎ করেই যেন তাদের চিন্তা-চেতনা, ভাব ও ভাবনা অত্যন্ত উচ্চতা লাভ করলো। যেমন আপনাদের পাকিস্তানের কবি এবং ইসলামের কণ্ঠ মাওলানা যাফর আলী খান মরহূম বলেছেন-

রহস্য ছিলো কী, না ভয় পেলো রোমকে না ইরানকে?/অথচ ছিলো কী তারা! কিছু বিশৃঙ্খল উটের রাখাল!!/কর্পুরকে ভাবতো যারা লবণ/মৃত্তিকাকে তারাই বানালো স্বর্ণখ-!!

হাঁ, ঠিক এটাই ঘটেছিলো মরু-জীবনে অভ্যস্ত আরবদের চরিত্রে। হঠাৎ করেই তাদের মধ্যে এ অনুভূতি জাগ্রত হলো যে, বাসূস ও দাহিস-এর যামানা এখন আর নেই। সেই অন্ধকার যুগ, যখন ঘোড়ার আগে বাড়া ও পিছিয়ে যাওয়া নিয়ে, জলাশয় কার দখলে থাকবে এই বিবাদ নিয়ে শুরু হতো লড়াই, চলতো চল্লিশ বছর, বা আরো বেশী। এত বিপুল রক্তক্ষয়! এত শত প্রাণের অপচয়! শুরু হতো কোত্থেকে, কী নিয়ে!! 

ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতায় একগোত্রপতির ঘোড়া পিছনে রয়ে গেলো, আরেকজনেরটা আগে বেড়ে গেলো। ব্যস, গোত্রপতি ভাবলেন, তার এত বড় অপমান! এই আরবদেরই আপনি দেখতে পাবেন, যখন তারা সা¤্রাজ্যের অধিকারী হলো, তাদের স্বভাব-চরিত্রে, চিন্তা-চেতনায় আমূল পরিবর্তন এসে গেলো। আগের আরব এখন তারা নেই। এখন তারা অত্যন্ত ধৈর্যশীল, সহনশীল, অত্যন্ত নীতিপরায়ণ, অত্যন্ত দূরদর্শী ও উদারচিত্ত। সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির হাত থেকে মুক্ত হওয়া আমাদের স্বাধীন দেশগুলোর অবস্থা তো এমনই হওয়া উচিত া ছিলো। মিশরে শামে, ইরাকে, আলজিরিয়ায় এবং আমাকে বলার অনমুতি দিন, পাকিস্তানে। আমাদের চিন্তা-চেতনায় আমূল এক বিপ্লব জেগে ওঠা উচিত ছিলো। দায়বোধ, দায়িত্ববোধ, আইন ও শৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, এগুলো সক্রিয় ও জীবন্তরূপে সমাজে বিদ্যমান হওয়া উচিত ছিলো।

আলফে লায়লার ঘটনা, সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে খুবই শিক্ষণীয়, বাগদাদের এক সাধারণ মানুষ অভিজাত ও প্রভাবশালী কোন ব্যক্তির কাছে  আশরাফী-ভর্তি থলিয়া এই বলে রেখে গেলো যে, আমি তো জিহাদে যাচ্ছি, জানি না, কিসমতে শাহাদাত আছে, না যিন্দা ফিরে আসবো। যদি শহীদ হয়ে যাই তাহলে এই থলিয়া অমুককে দিয়ে দেবেন।

শাহাদাত তার কিসমতে ছিলো না, গাযী হয়ে সে ফিরে এলো এবং নিশ্চিন্ত মনে ঐ অভিজাত ব্যক্তির কাছে থলি ফেরত চাইলো।

লোকটা চোখের পলকে তার আভিজাত্য ভুলে গিয়ে বলতে লাগলো, তুমি কে হে? তোমাকে তো চিনি না! তাছাড়া আমার এখানে তো এমন কিছু রাখা হয় না!

কিছ্ছা মুখতাছার, গরীব বেচারা কাযির কাছে নালিশ দাখিল করলো।

তিনি ছিলেন বিজ্ঞ বিচারক; মানব-মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে ছিলো পূর্ণ অবগতি। তিনি মজলিসে আলোচনা করলেন, ‘এই এই এই সরকারী পদের জন্য অমুক অমুক এবং অমুকের কথা ভাবা হচ্ছে।’

অমুক’র একজন ঐ তথাকথিত অভিজাত ব্যক্তিও র্ছিলো। এমন আলোচনা মজলিসে ঘুমিয়ে থাকে না। থাকলোও না।

এবার কাযী ছাহেব ঐ গরীব বেচারাকে বললেন, যাও এখন গিয়ে ঐ লোককে মনে করানোর মত বলো, তবে বিনয় ও কোমলতার সঙ্গে। লোকটি গেলো, আর গৃহস্বামী তাকে দূর থেকেদেখেই বলে উঠলো, উহ্ হো! আসুন, আসুন! আপনি তো ঠিকানাও রেখে যাননি! এদিকে আমার তো ঘটনা মনে পড়ে গেছে! দেখুন তো এটাই আপনার থলিয়া কি না!

এবং সেটাই ছিলো। খুশিতে বাগবাগ হয়ে লোকটি কাযীর কাছে গিয়ে বৃত্তান্ত জানালো এবং জানতে চাইলো, কীভাবে কী ঘটলো হুযূর?! কাযী বললেন, ঘটনা এই যে, মানুষ যখন বড় কোন প্রাপ্তির সম্ভাবনা দেখে তখন ছোট জিনিস তার নযর থেকে পড়ে যায়। তো সে যখন খবর পেলো, অমুক গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য দরবারে খেলাফতে তাকে চিন্তা করা হচ্ছে তখন তার ভয় হলো যে, সামান্য এক থলিয়ার বদনামির কারণে এত বড় সুযোগ না হাতছাড়া হয়ে যায়! যদি কোনভাবে খলীফার কানে যায়, আর তার দিলে সন্দেহ এসে যায় ...!

তাই সে তোমার থলিয়া আত্মসাৎ করে এত বড় সুযোগ হারানোর ঝুঁকি নিতে চায়নি।

বন্ধুগণ! আল্লাহ তা‘আলা আপনাদের এত বড় ‘মামলাকাত’ দান করেছেন! এত বিরাট মর্যাদার অধিকারী করেছেন! মুসলিম উম্মাহর প্রতিনিধিত্ব করার এমন সুবর্ণ সুযোগ দান করেছেন! এখন তো আপনাদের সবরকমের প্যস্তি ও নীচতা থেকে, সঙ্কীর্ণতা ও ক্ষুদ্র স্বার্থচিন্তা থেকে, অসিহষ্ণুতা ও আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা থেকে এবং দায়িত্বহীনতা ও কর্তব্যকর্মে শৈথিল্য থেকে ঊর্ধ্বে উঠে আসা উচিত!! আয়তনে যাই হোক, মর্যাদায় এত বড় একটি দেশের অধিকার এবং এত বিরাট প্রতিনিধিত্বের সৌভাগ্য আল্লাহ যাদের দান করেছেন তারা কীভাবে এত ক্ষুদ্র ও সামান্য বিষয়ে লিপ্ত হতে পারে?! আল্লাহ আপনাদের সুযোগ দিয়েছেন ইসলামের ভাবমর্যাদা উঁচুতে তুলে ধরার এবং মানুষ ও মানবতার এত বড় সেবা করার, অথচ আপনারা এত ছোট ছোট বিষয়ে সংযম হারিয়ে ফেলেন! ‘দাহ্যপদার্থ’র মত জ্বলে ওঠেন!! আপনাদের সম্পর্কেই তো আল্লামা ইকবাল বলেছেন-

‘তুমি তো হোমা-এর শিকারী! তোমার তো সবে শুরু!/এই মাছ -মুরগীর চিন্তা তো তোমাকে সাজে না!/এগুলোর সৃষ্টি তো অন্য কোন উদ্দেশ্যে!!

আপনাদের কাজ তো হলো বড় বড় দেশের, বড় বড় জাতির জটিল জটিল সমস্যার সমাধান পেশ করা! তো এজন্য আপনারা প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করুন। নিত্যদিনের শহুরে জীবনের ঝুটঝামেলায় জড়িয়ে পড়া এবং সময়, শক্তি ও মেধার অপচয় করা আপনাদের কাজ হতে পারে না। আপনাদের ইচ্ছা, চাহিদা ও স্বার্থের সামান্য খেলাফ কিছু ঘটলো, আর আপনারা ক্রোধে আত্মহারা হয়ে গেলেন; একেবারে ‘জামার বাইরে’ চলে এলেন, এটা তো মুসলিম যুবকের, বিশষ করে শিক্ষিত ও আলোকিত যুবকের শান-উপযোগী নয়!

ব্যস, আমার কথা শেষ, যা বলতে চেয়েছি হয়ত গুছিয়ে বলতে পারিনি তবে দরদের সঙ্গে বলেছি। এ কথাগুলো যদি আপনাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়, খুশী হবো।

আমি জনাব ভাইস চ্যান্সেলর ছাহেব এবং ইউনিভার্সিটির দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের প্রতি কৃতজ্ঞতা নিবেদন করছি যে তারা আমাকে এত বড় মর্যাদা দান করেছেন এবং তাদের কলিজার টুকরোগুলোকে সম্বোধন করে কিছু বলার সুযোগ দিয়েছেন। আমার মত সাধারণ এক মৌলভির প্রতি এরূপ আস্থা ও সুধারণা পোষণ করার জন্য আপনাদের প্রতি আমি শোকরগুজার। আমি আরো শোকরগুজার যে, এই গরমের মৌসুমে (গরম শব্দটি সব অর্থেই ব্যবহার করছি) আমার এরূপ ঠা-া ঠা-া কথা আপনারা ঠা-া মাথায়, ঠা-া দিলে শুনেছেন। আল্লাহ আপনাদের উত্তম বিনিময় দান করুন, আমীন।

কে জানে, আবার কবে দেখা হবে, আদৌ হবে কি না! ওয়াস্সালাম।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা