রবিউল আউয়াল ১৪৪০হিঃ (৩/৭)

স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা

সর্পবিষ ও সর্পদংশন

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

সাপের বিষ! শুনলেই মানুষ ভয়ে আঁতকে ওঠে। কারণ সর্পদংশনের ফলে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু প্রায় অনিবার্য, যদি সময়মত উপযুক্ত চিকিসার ব্যবস্থা না করা যায়।

অবাক হওয়ার মত বিষয় হলেও এটাই সত্য যে, সাপে কাটা রোগীর জীবন রক্ষার জন্য সাপের বিষ থেকেই তৈরী করা হয় এন্টিভেনমনামক ইন্জেক্শন। উল্লেখ্য, বিশ্বে প্রতিবছর পনের লাখ মানুষ সর্পদংশনে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে দেড়লাখের মত মানুষ প্রকৃত চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করে। সর্পদংশনের একমাত্র চিকিৎসা হচ্ছে সর্পবিষ থেকে তৈরী এন্টিভেনম। সুতরাং সাপের বিষ এক দিকে যেমন মৃত্যুর কারণ তেমনি জীবনরক্ষারও উপায়। এমনই হয় সর্বপ্রজ্ঞার অধিকারী আল্লাহ তা‘আলার অপার কুদরত, হিকমত ও রহস্য।

ক্যান্সার ও হৃদরোগসহ বিভিন্ন জটিল রোগের ঔষধও তৈরী হয় সাপের বিষ থেকে। এজন্যই সাপের বিষ অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। এমনকি এ জন্য সাপের বিষকে বলা হয় লিকুইড ডায়মন্ড বা তরল হীরা।

সর্পবিষের বিশ্ববাজারের পরিধি হচ্ছে পাঁচশ কোটি ডলার। ঢাকার বাজারে

প্রতি গ্রাম স্বর্ণের মূল্য চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা, অথচ একগ্রাম প্রক্রিয়াজাত সর্পবিষের মূল্য হতে পারে পঞ্চাশ হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকা।

সর্পদংশিত রোগীর জন্য জীবনরক্ষাকারী যে ঔষধ, এন্টিভেনম, বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশ তা প্রস্তুত করতে পারে না, ফলে উচ্চ মূল্যে উন্নত বিশ্ব থেকে তা আমদানী করতে হয়। উল্লেখ্য, বিশ্ববাজারে একটি এন্টিভেনমের মূল্য প্রায় ১৫০০ ডলার। ফলে অনুন্নত দেশের সরকারগুলোকে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে এ জীবনরক্ষাকারী ভেক্সিন আমাদানী করতে হয়। তারপর বিপুল ভর্তুকি দিয়ে সাধারণের ক্রয়সীমার মধ্যে তা সরবরাহ করতে হয়। অনেক সময় এমন মর্মন্তুদ ঘটনাও ঘটে যে, সর্পদংশিত রোগীকে যথাসময়ে হাসপাতালে আনা হয়েছে, কিন্তু এন্টিভেনম ঔষধ না থাকার কারণে রোগীকে কোন চিকিৎসা দেয়া যায়নি। ফলে অসহায় চিকিৎসক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রোগীর করুণ মৃত্যু দেখে যাওয়া ছাড়া কিছুই করতে পারেন না।

সাপের বিষ দিয়ে তৈরী অন্যন্য দামী ঔষধের ক্ষেত্রেও আমাদের আমদানীর উপর নির্ভর করতে হয়।

সর্পবিষ আহরণের উৎস

বাণিজ্যিকভাবে সাপের খামার তৈরীর মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাপের বিষ আহরণ ও প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে বিরাট বিরাট আধুনিক সর্পখামার। তা থেকে আহরিত বিষ রফতানী করেই তারা বিপুল উপার্জন করছে। অথচ বাংলাদেশ বিপুল সম্ভাবনা সত্ত্বেও সরকারী অনুমোদনের অভাবে সর্পবিষ রপ্তানীর বিশ্ববাজারে প্রবেশ করতে পারছে না।

আমাদের দেশে বৈধ উপায়ে সর্পখামার তৈরীর সুযোগ নেই। সুতরাং বৈধ উপায়ে সর্পবিষ রপ্তানীরও সুযোগ নেই। ফলে বেশ কিছু অবৈধ সর্পখামার গড়ে উঠেছে প্রশাসনকে হাতে রেখে। সেখানথেকে আহরিত সর্পবিষ অবৈধ পথে পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশের বাইরে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার যদি সর্পখামার তৈরীর অনুমতি ও প্রয়োজনীয় আনুকূল্য দান করে তাহলে সহজেই বাংলাদেশ সর্পবিষ রপ্তানীর বিশ্ববাজারে প্রবেশ করতে পারে এবং পারে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে।

বাংলাদেশে ষোলটিরও বেশী প্রজাতির বিষধর সাপ রয়েছে, তার মধ্যে ছয়টি হলো ভয়ঙ্কর বিষধর, যথা- গোখরা (কোবরা) রাজ গোখরা (কিং কোবরা) চন্দ্রবোড়া (সেলস ভাইপার) সবুজ সাপ (গ্রিন ¯েœক) সামুদ্রিক সাপ (সি ¯েœক) কেউটে (ক্রেইট)

খামারে প্রতিপালনের মাধ্যমে এ সমস্ত সাপ থেকে বিপুল পরিমাণ বিষ আহরণ করা সম্ভব।

সর্পদংশনে করণীয়

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে বিশ্বে প্রতিবছর পনের লাখ মানুষ সর্পদংশনে আক্রান্ত হয়, তবে উপযুক্ত চিকিৎসার কল্যাণে অধিকাংশই সুস্থতা লাভ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। পক্ষান্তরে দেড়লাখ রোগী উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করে, যাদের অধিকাংশ বাংলাদেশসহ অনুন্নত দেশে বাস করে।

সর্পদংশনের স্থানে পাশাপাশি আধা ইঞ্চি দূরত্বে দু’টো ক্ষতচিহ্ন সৃষ্টি হয় (সাধারণত বিষধর সাপের ক্ষেত্রে। এটি আসলে বিষদাঁত বসানোর চিহ্ন)

এটাই হলো সর্পদংশন বোঝার প্রথম লক্ষণ; এছড়া বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে পারে, যেমন; ক্রমে শরীর অবশ হয়ে আসা, ঝিমুনিতে আক্রান্ত হওয়া, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া, শ্বাস ভারী হয়ে আসা।

সর্পদংশিত ব্যক্তির জীবন বাঁচানোর জন্য প্রতিটি মুহূর্ত অতি মূল্যবান। তাই যত দ্রুত সম্ভব তাকে হাসপাতালে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। সর্পদংশিত ব্যক্তিকে কখনো হাঁটিয়ে নেয়া ঠিক নয়; খাটিয়ায় শুইয়ে নিতে হবে এবং যথাসম্ভব কম নড়াচড়ার মধ্যে রাখতে হবে।

দংশিত স্থানের কিছু উপরে রশি বা কাপড় দিয়ে শক্ত করে বাঁধা দরকার, যাতে রক্ত চলাচলের মাধ্যমে বিষ ছড়িয়ে না পড়ে। (এ বিষয়ে ভিন্নমতও দেখা যায়)

রোগী মনে করতে পারে, তার মৃত্যু অবধারিত। তাতে তার মনোবল ও প্রতিরোধশক্তি ভেঙ্গে পড়ে। তাই তাকে সাহস দিতে হবে যে, হাসপাতালে নিলেই ইনশাআল্লাহ তুমি সুস্থ হয়ে যাবে। রোগীকে কিছুতেই ঘুমিয়ে পড়তে দেয়া যাবে না, যে কোন উপায়ে তাকে জাগ্রত রাখতে হবে।

সর্পদংশনের চিকিৎসা ও অপচিকিৎসা

সর্পদংশনের চিকিৎসা জটিল বা দীর্ঘ কিছু নয়; আল্লাহর ইচ্ছায় একটি এন্টি ভেনম ইংজেক্শন এবং একটি এন্টি টিটেনাস সিরাম ইন্জেক্শন দ্বারাই রোগী সুস্থ হতে পারে। প্রয়োজন শুধু যথাসম্ভব দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।

ওঝা দিয়ে সাপের বিষ নামানো এবং এ জাতীয় যা করা হয় তা কুসংস্কার বা অপচিকিৎসা ছাড়া আর কিছু নয়। এতে রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কাই শুধু বাড়ে।

হাদীছ শরীফে একটি দু‘আ আছে, ‘হে আল্লাহ, সর্পদংশনে মৃত্যু হতে আপনার কাছে পানাহ চাই।’

আল্লাহ আমাদের নিরাপদ রাখুন, আমীন।           

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা