মুহাররম ১৪৪৫ হিঃ

স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা

বিষণ্নতা, অর্থহীন এক ব্যাধি: কারণ ও প্রতিকার।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 মানুষের মনের জগত বড় বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সহস্যময়। কখন মনের কী অবস্থা হয়, কেন হয় মানুষ নিজেও অনেক সময় তা বুঝতে পারে না। মনের তেমনি একটা অবস্থার নাম বিষণ্নতা। এটি যখন স্বাভাবিক কোন কারণে হয় এবং স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে তখন চিন্তার কোন কারণ নেই। সেই বিশেষ কারণটি দূর হলে বা মন থেকে মুছে গেলে বিষণ্নতাও চলে যায় এবং মন আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। যেমন ছাত্র বা শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে পরীক্ষার ফল আশাপ্রদ না হওয়া। চাকুরী ও ব্যবসায় কাঙ্ক্ষিত উন্নতি না হওয়া। আপন কারো কাছ থেকে আঘাত বা মন্দ আচরণ পেলে, কারো মৃত্যুসংবদ শুনলে। এগুলো সাধারণত সময়ের সাথে সাথে কেটেও যায়। এজন্যই বলা হয়, সময় হলো সবচে’ কার্যকর মলম বা উপশম।

বিষণ্নতা যখন স্বাভাবিক অবস্থা অতিক্রম করে এবং স্থায়ী রূপ ধারণ করে তখন বিষণ্নতাকে বলা হয় মানসিক রোগ বা ব্যাধি, যা বড় বড় জটিলতা সৃষ্টি করে, এমনকি ব্যক্তিজীবন ও সামাজিক জীবনে গুরুতর বিপর্যয় পর্যন্ত ডেকে আনে। বিষণ্নতা এখন ক্যান্সার ও হৃদরোগের মতই একটা ভয়ানক ব্যাধিরূপে পরিচিতি লাভ করেছে। এজন্য গড়ে উঠেছে আলাদা ও ‘পূর্ণাঙ্গ’ চিকিৎসা ব্যবস্থা। এর জন্য রয়েছে বড় বড় ডিগ্রির অধিকারী আলাদা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, বিষণ্নতাগ্রস্ত রোগী তাদের শরণাপন্ন হন এবং চিকিৎসাও গ্রহণ করেন। ‘পূর্ণাঙ্গ’ শব্দটি চিকিৎসক সমাজ ব্যবহার করে থাকেন, যদিও এ সম্পর্কে আমাদের নিজস্ব ধারণা ও অভিজ্ঞতা রয়েছে।

আমাদের মত অনুন্নত ও তৃতীয় বিশ্বে তো বটেই, উন্নত বিশ্বে, যেখানে জীবনকে মনে করা হয় সুখী সচ্ছল, সেখানেও বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন কী ভয়াবহ আকারে বিস্তার লাভ করেছে, তা বোঝার জন্য বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থা থেকে প্রকাশিত পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। তাতে বলা হয়েছে, পৃথিবীতে তিনশ মিলিয়নেরও বেশী মানুষ অতি উচ্চ পর্যায়ের বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশনে ভুগছে। এর প্রকোপটা আবার উন্নত বিশ্বেই বেশী। যতগুলো কারণে মানুষ আত্মহত্যার মত নিন্দনীয় কাজ করে, তার মধ্যে মানসিক অবসাদ ও বিষণ্নতা বেশ গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়ে কেউ যখন মনোচিকিৎসক বা সাইকোলজিস্টের কাছে যান তখন প্রথমেই তিনি বিভিন্নভাবে বুঝতে চেষ্টা করেন আসল সমস্যাটা কোথায়? মনের কোন অবস্থা থেকে বিষণ্নতার উৎপত্তি? এ জন্য তিনি রোগীকে কথা বলতে উৎসাহিত করেন এবং বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। তারপর মোটামুটি একটা ধারণা লাভ করে চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপত্র দেন। এক্ষেত্রে ঔষধের বিষয়টা আসলে আসে রোগীকে এরূপ একটা সান্ত¡নামূলক ধারণা দেয়ার জন্য যে, তার চিকিৎসা হচ্ছে। আসল চিকিৎসা কিন্তু সেটাই যা পার্শবিষয় হিসাবে পরামর্শ আকারে রোগীকে দেয়া হয়। তবে চিকিৎসার সফলতা বা ব্যর্থতা মূলত নির্ভর করে রোগীর মনের গভীরে যে জটিলতা লুকিয়ে আছে সেটা সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারা, না পারার উপর।

বিষণ্নতাগ্রস্ত রোগীর সুস্থতার ক্ষেত্রে যে কৌশলটি সবচে ভালো কাজ করে তা হলো রোগীকে এমন ধারণা দেয়া যে, সমস্যা আছে, তবে সেটা জটিল কিছু নয়। অল্পতেই আরোগ্য লাভ করা সম্ভব, যদি পরামর্শ-গুলো ঠিকমত পালন করা হয়। এখন আমরা ঐ সব পরামর্শ তুলে ধরছি যা মনোচিকিৎসকের পক্ষ হতে সাধারণত দেয়া হয়।

প্রথমেই হলো জীবন-শৃঙ্খলা। অর্থাৎ যে কোন মূল্যে জীবনকে একটা নির্দিষ্ট নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে আনার চেষ্টা করতে হবে। তবে অবশ্যই ধীরে ধীরে ও পর্যায়ক্রমে এবং একটা একটা করে। যেমন প্রথমে সময়মত আহার করার অভ্যাস করা হলো। তারপর ঘুম আসুক বা না আসুক, সমময়ত বিছানায় যাওয়া এবং বিশ্রাম করা...প্রত্যেক মানুষের জীবনেই কিছু না কিছু পছন্দের, আগ্রহের, এমনকি ভালো লাগার ও ভালোবাসার কাজ রয়েছে। কেউ বাগান করা ভালোবাসে। কেউ বই পড়তে ভালোবাসে...তো পুরো অবসর সময়টা পছন্দের ও ভালোবাসার বিভিন্ন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। এটা বিষণ্নতা দূর করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে এটা রোগীকে দিয়ে এমনভাবে করাতে হবে যাতে সে বুঝতে না পারে যে, এটা তার বিষণ্নতা দূর করার ব্যবস্থা বা চিকিৎসা।

হিতাকাক্সক্ষী, বন্ধুস্বজন আমাদের প্রায় সবার জীবনেই কমবেশী থাকে, যাদের সঙ্গ পেলে ভালো লাগে, মন এমনিতেই ভালো হতে চায়। না থাকলে প্রয়োজনে একদু’জনের সঙ্গে এমন সম্পর্ক তৈরী করাও যায়। এক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো, বন্ধুদের হাতে, দেয়ার মত এত সময় থাকে না। তাদেরও থাকে নিজস্ব কাজকর্ম ও ব্যস্ততা। এক্ষেত্রে তাদের বোঝাতে হবে যে, আপনার বন্ধু এখন মানসিক রোগী। তার আরোগ্য নির্ভর করে আপনার সঙ্গ ও পরিচর্যার উপর। বন্ধুরা যদি নিয়ম করে কিছু সময় তার সঙ্গে যাপন করে, তার পছন্দের বিষয়ে কথা বলে এবং তাকে প্রফুল্ল রাখার চেষ্টা করে তাহলে ভালো ফল হতে পারে।

ইতিবাচক চিন্তার অভ্যাস। বিষণ্নতা শুরুই হয় এবং গুরুতর হয় নেতিবাচক চিন্তা থেকে। তো প্রত্যেক বিষয়ের কিছু ইতিবাচক দিক আছে; সেগুলো সম্পর্কে চিন্তা করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এ  ক্ষেত্রে কাছের মানুষরই তাকে বেশী সাহায্য করতে পারে। নিয়মিত শরীর চর্চাও বিষণ্নতা দূর করার একটি উত্তম উপায়। এটা শরীর থেকে এমন কিছু হরমোন নিঃসরণে সাহায্য করে যা শরীর ও মন দু’টোকেই প্রফুল্ল রাখতে সাহায্য করে। কার জন্য কী ধরনের শরীরচর্চা উপযোগী তা অবশ্য বিজ্ঞ চিকিৎসকই বলতে পারেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নামে মহামারি আকারে যে জিনিসটা এখন ছড়িয়ে পড়েছে, বিষণ্নতা ও অবসাদ জটিল ও গুরুতর ব্যাধির আকার ধারণ করার জন্য এটা বহুলাংশে দায়ী। এটা থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করতে হবে।

তালিকার শেষে মনোচিকিৎসকগণ যা উল্লেখ করেন আসলে তা তালিকার শুরুতেই আসা উচিত। কারণ এটাই হলো আসল চিকিৎসা।তারা বলেন, যদি ধর্মসম্মত ও পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করা হয় তাহলে প্রথমত বিষণ্নতা-রোগ দেখা দেবে না, দ্বিতীয়ত সহজেই তা দূর হয়ে যাবে।কোরআন ও সুন্নাহ্র তো আগাগোড়া এটাই শিক্ষা! আল্লাহ্র প্রতিটি আদেশ-নিষেধ যত্নের সঙ্গে পালন করা! সর্বদা মানুষের মঙ্গল চিন্তা করে এবং মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখা। যিকির ও তিলাওয়াতে নিমগ্ন থাকা। কারণ যিকির দ্বারা দিল ইতমিনান লাভ করে এবং হৃদয়ে প্রশান্তি আসে।অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, যে যত ধর্মমুখী তার জীবন তত বিষণ্নতামুক্ত। *

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা