রবিউছ ছানী ১৪৪৫ হিঃ

স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা

উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক

হাকীম আজমল খান

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক

হা কী ম আ জ ম ল খা ন


খুব দূর অতীতের কথা নয়,  মোটামুটি নিকট অতীতের কথাই বলছি। তখন (পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারত মিলে) বিশাল ভারতবর্ষে ‘হাকীম আজমল খানের নাম জানে না’ এমন মানুষ কমই ছিলো, আর আজ এমনই দুঃখজনক অবস্থা যে, খুব কম মানুষেরই এ মহান নামের সঙ্গে পরিচয় আছে!তার প্রধান পরিচয় ছিলো হাকীম ও চিকিৎসকরূপে। এ্যালোপ্যাথির চিকিৎসা নয়, মুসলিম উম্মাহ্র ঐতিহ্যবাহী ইউনানী চিকিৎসায় সত্যি তখন তাঁর কোন তুলনা ছিলো না। এখন তো চিকিৎসক ও চিকিৎসা এমনই পরীক্ষানির্ভর যে, সচ্ছল রোগীরও নাভিশ^াস ওঠে, আর গরীব চিকিৎসকের কথা তো বালাই বাহুল্য!সে যুগে চিকিৎসা ছিলো শুধু দরদের সঙ্গে মনোযোগের সঙ্গে অবস্থা শুনে, নবয ও শিরার উপর হাত রেখে এবং ‘কারুরা’ দেখে। কারুরা, এই পরিভাষা এখন তো একেবারেই অপরিচিত। তখন স্বচ্ছ বোতলে ভোরের পেশাব রাখা হতো হাকীমের দেখার জন্য, সেই বোতল বা কারুরা সাদা চোখে দেখেই এমনভাবে রোগ নির্ণয় করা হতো, যা আজকের ‘ইউরিন টেস্ট’ দ্বারা ঠিকমত হতে চায় না।হাকীমদের কারুরা দেখার এমন এমন বিস্ময়কর ঘটনা আছে, যা বর্তমানে বিশ^াস করাও কঠিন। এখন তো উন্নত যন্ত্রের উন্নত পরীক্ষাও ভুল তথ্য দেয়, আর ঐ তথ্যের উপরই ভুল চিকিৎসা চলতে থাকে! ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর ঘটনা এখন আমাদের মত অনুন্নত দেশে তো বটেই, উন্নত দেশেও কম নয়। তখনো রোগীর মৃত্যু হতো, তবে হাকীমের চিকিৎসার ভুলে নয়, রোগীর হায়াত নেই বলে!কথা হচ্ছিলো নবয দেখা ও কারুরা দেখার। তো এ ক্ষেত্রে হাকীম আজমল খানের পারদর্শিতা এমনই উচ্চস্তরের ছিলো যে, সে যুগের হাকীমসমাজেও তা ছিলো বিস্ময়বিমুগ্ধ আলোচনার বিষয়। একটা কথা তখন বেশ প্রচলিত ছিলো, ‘আসমানে যদি মউতের ফায়ছালা না হয়ে থাকে তাহলে ‘আজমলী’ চিকিৎসায় রোগীর আরোগ্য লাভ অনিবার্য।’হাকীম আজমলখানের চিকিৎসা সম্পর্কে যারা লিখেছেন, তাদের মন্তব্য হলো, তিনি যখন কোন রোগীর সামনে বসতেন, মনে হতো, ইবাদতে বসেছেন! তার সামনে যেন জীবন্ত হয়ে উঠতো সেই মহান হাদীছে কুদসী, ‘আয় ইবনে আদম, আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি তো আমার ইয়াদত করোনি, যদি করতে তাহলে তো আমাকে সেখানে পেতে...!এ অবস্থা অবশ্য আমাদের সোনালী যুগের কমবেশী সমস্ত হাকীমেরই ছিলো। রোগীর চিকিৎসা তারা করতেন, সম্পূর্ণ ইয়াদাতের নিয়তে! রোগীর মৃত্যুর খবরে নিজেই রোগশয্যায় পড়ে গিয়েছেন, এমন ঘটনা আমাদের চিকিৎসার ইতিহাসে বিরল নয়।***হাকীম আজমল খান জন্মগ্রহণ করেন ১১ই ফেব্রæয়ারি ১৮৬৮ খৃস্টাব্দে (১৭ই শাওয়াল ১২৮৪ হি.)দিল্লীর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তাঁর পূর্বপুরুষ স¤্রাট বাবরের সঙ্গে হেরাত থেকে হিন্দুস্তানে আসেন। তার পরিবারে ইউনানী চিকিৎসাশাস্ত্রের চর্চা-গবেষণা শুরু থেকেই চলে এসেছে, এখনো চলছে। তখন তো ইউনানী চিকিৎসাই ছিলো সরকারস্বীকৃত একমাত্র চিকিৎসা; বলা হতো ‘রাজচিকিৎসা’।স¤্রাট আকবরের সময় থেকে হাকীম আজমলখানের পূর্বপুরুষ চিকিৎসক হিসাবে শাহী দরবারের সঙ্গে যুক্ত হন। তার দাদা হাকীম শরীফ খান মোঘল স¤্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন, তবে নিজেকে তিনি ‘শাহী হাকীম’ পরিচয়ে আবদ্ধ করেননি। দিল্লীতে তিনি শরীফ মঞ্জিল প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে সাধারণ মানুষকে নিয়মিত চিকিৎসাসেবা দেয়া হতো এবং প্রয়োজনে বিনা- মূল্যে। শাহী হাকীম একই রকম যতেœর সঙ্গে তাদের চিকিৎসা করছেন বলে মানুষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতো। শরীফ মঞ্জিল যেমন চিকিৎসা কেন্দ্র ছিলো, তেমনি ছিলো হাসপাতাল এবং তেমনি ছিলো ইউনানী চিকিৎসার শিক্ষাকেন্দ্র।পারিবারিক ও মুসলিম ঐতিহ্য হিসাবে হাকীম আজমল খান  শৈশবে কোরআন হিফয করেন, তারপর আরবী, ফারসী এবং বিভিন্ন দ্বীনী ইলম অর্জন করেন। তার চিকিৎসাঅধ্যয়ন সম্পন্ন হয় সম্পূর্ণ পারিবারিক পরিমÐলে। প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয় পরিবারের স্বীকৃত হাকীমদের তত্ত¡াবধানে। তারপর উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষা শুরু হয় পিতা হাকীম মাহমূদ খানের প্রত্যক্ষ তত্ত¡াবধানে। তাঁর কাছেই তিনি ইউনানী চিকিৎসার শাস্ত্রীয় অধ্যয়ন সমাপ্ত করেন। প্রায়োগিক চিকিৎসার অভিজ্ঞতা ও বিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেন বড় ভাই হাকীম মুহম্মদ ওয়াছিল খানের কাছ থেকে, অর্থাৎ বড় ভাই যখন রোগী দেখতেন তখন তিনি পাশে থেকে তা পর্যবেক্ষণ করতেন। বিশেষ করে কঠিন ও জটিল রোগের ক্ষেত্রে বড় ভাই তাঁকে সবকিছু বুঝিয়ে বলতেন। শেষদিকে তিনি হাকীম আজমল খানের পরামর্শও গ্রহণ করতেন। পরে তিনি তাকে আলাদা দাওয়াখানা খোলার অনুমতি প্রদান করেন।অল্পসময়ের মধ্যে পিতা ও পিতামহের মতই হাকীম আজমল খান ইউনানী চিকিৎসায় মহাপারদর্শিতা অর্জন করেন। তার চিকিৎসাখ্যাতি পুরা হিন্দুস্তানে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৯২ খৃস্টাব্দে রামপুরের নবাব তাকে নিজের ব্যক্তিগত চিকিৎসকের পদ গ্রহণের অনুরোধ করেন। আর তিনি শর্তসাপেক্ষে তা গ্রহণ করেন। শর্ত ছিলো যে, আগের মতই তিনি তার দাওয়াখানায় সাধারণ মানুষের চিকিৎসার জন্য সময় দেবেন।(চলবে ইনশাআল্লা)

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা