রবিউল আউয়াল ১৪৪০হিঃ (৩/৭)

তোমাদের পাতা

ভুলে যাওয়া ইতিহাস জানতে হবে আবার

উছমানী সালতানাতের মযলূম খলীফা সুলতান আব্দুল হামীদ রহ.

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

১৮৭৬ সালের ডিসেম্বরে ইতিহাসে কুখ্যাাত তারসানা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। সম্মেলনের স্থানরূপে বেছে নেয়া হলো খেলাফতের উছমানিয়ারই রাজধানী ইস্তাম্বুল। বৃটেন, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানী, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরী এবং ইতালির প্রতিনিধিরা একত্র হলো। সম্মেলনের উদ্দেশ্য বলা হলো, বলকান অঞ্চলে সৃষ্ট সঙ্কটের সমাধান। তবে আসল উদ্দেশ্য ছিলো খেলাফাতের অধীনে বসবাসকারী খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী-গুলোর ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বঞ্চনার অভিযোগ তুলে খলীফা ও খেলাফাতকে আরো কোণঠাসা করা।  ডিসেম্বরের ২৩ তারিখে শুরু হল সম্মেলন।

বড় বেদনার বিষয় ছিলো এই  যে, খেলাফাতের রাজধানীতে খেলাফাতের বিষয়ে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে খেলাফতই ছিল সবচেয়ে দুর্বল পক্ষ। দরবারে খেলাফাতের মত, অমত, ইচ্ছা, অনিচ্ছার কোন মূল্য ছিল না সেখানে। নতুন আরো কী কী যিল্লতি ও লাঞ্ছনা চাপানো হয় খেলাফাতের উপর, নীরবে দেখে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই যেন করার ছিল না খলীফার। দেখে মনে হচ্ছিলো, অসহায় শিকারকে সামনে রেখেই শিকারিদের ভাগ-বাটোয়ারার বৈঠক। সম্মেলনস্থল থেকে একটু দূরে তোপকাপি প্রাসাদ। পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া সমস্যার পর্বত-পরিমাণ বোঝা মাথায় নিয়ে তোপকাপিতে বসে আছেন নিঃসঙ্গ সুলতান আব্দুল হামীদ! যেন শুধু বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানার অপেক্ষা। সেখানে তার কোন কণ্ঠস্বর নেই। তাঁর পাশে এমন একজনও ছিল না যার যোগ্যতা ও আন্তরিকতায় বিশ্বাস রেখে তিনি বলতে পারেন, এটা করো, এভাবে করো।

চারপাশে ছিল শুধু ‘একপাল’ পাশা, যাদের পেয়ে বসেছিল পশ্চিমাদের তাবেদারির মরণ-নেশা। সা¤্রাজ্যবাদী হায়েনাদের ঘেরাওয়ের মধ্যে খেলাফাতে উছমানিয়ার অসহায়ত্বের তো কোন সীমা ছিল না, তবে তাদের  দোসর পাশাদের বেষ্টনীর মধ্যে খলীফার অসহায়ত্ব ছিলো আরো করুণ। এমনিতেই তো পিছন থেকে চলে আসা হাজারো সঙ্কটের ঘূর্ণিপাকে খাবি খাচ্ছিলো খেলাফাত। তারই মধ্যে সদ্য দায়িত্ব কাঁধে নেয়া খলীফা আব্দুল হামীদ জানতোড় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন সমস্যার লাগাম টেনে ধরার। আল্লাহ তাঁকে তেমন প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টিই দান করেছিলেন। কিন্তু তাঁর মতামত, পরামর্শ ও আদেশ-উপদেশের প্রতি অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করাই যেন ছিলো পাশাদের কাজ। খলীফার মতামত উপেক্ষা করে তারা নিজেদের মত করে পদক্ষেপ নিচ্ছিলো, আর দায়-দায়িত্ব এসে পড়ছিলো খেলাফত ও খলীফার উপর। ফলে প্রতিপক্ষের সঙ্গে দরকষাকষিতে তিনি পড়ে যাচ্ছিলেন আরো চরম বেকায়দাজনক অবস্থার মধ্যে।  খেলাফতের পক্ষ হতে সর্বপ্রকার সুযোগ সুবিধা ভোগ করার পরে বলকান অঞ্চলে খৃস্টানজনগোষ্ঠী যে বিদ্রোহ শুরু করেছিলো, তার পিছনে প্রত্যক্ষ উস্কানি ও মদদ ছিলো রাশিয়ার। মূলত রাশিয়ার চক্রান্ত ও কারসাজির কারণেই বিদ্রোহীদের শান্ত করা সম্ভব হচ্ছিলো না। পরিস্থিতির এই প্রেক্ষাপটে খলীফার সুচিন্তিত পরামর্শ ছিলো কিছুটা নময়ীতার নীতি অবলম্বন করা এবং বলকানের খুব বেশী ভিতরে তখন প্রবেশ না করা। কিন্তু পাশারা খলীফার পরামর্শ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কঠোর ও হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, পরিস্থিতির বিচারে যা ছিলো শুধু অদূরদর্শী নয়, বরং আত্মঘাতী। এককথায় বলা যায়, খলীফার লক্ষ্য ছিলো যে কোন মূল্যে, বিদ্রোহের আগুন নিভিয়ে ফেলা। নিজেরা কিছুটা জব্দ হয়েও রাশিয়াকে পূর্ণরূপে জব্দ করা। পক্ষান্তরে পাশারা যেন একের পর এক শত্রুকে সুযোগ করে দিচ্ছিলো  খেলাফতের বিষয়ে নাক গলাবার। এরই ধারাবাহিকতায় শত্রুরা যেন খেলাফাতের মাটিতে-তারসানায়-খলীফার বুকের উপর বসে খেলাফাতের ভাগ্য নির্ধারণ শুরু করেছে। তখনো যদি পাশাদের হুঁশ হতো! তখনো যদি তাদের মধ্যে চেতনা জাগ্রত হতো! তখনো া যদি খলিফা ও খেলাফতের প্রতি তারা ন্যূনতম আনুগত্য প্রদর্শন করতো!!

তারসানা সম্মেলনের মূল আহ্বায়ক ছিলেন বৃটেনের প্রতিনিধি বিখ্যাত বৃটিশ কূটনীতিক ও রাজনীতিক লর্ড সালিসবুরী১। রাশিয়ার আগ্রাসী কার্যকলাপের চরম বিরোধীরূপে পরিচিত ছিলেন তিনি। বলা হয়, ব্যক্তিগতভাবে  উছমানিদের প্রতি কিছুটা সহানুভূতি তিনি পোষণ করতেন। ইস্তাম্বুলে সম্মেলনে যোগ দেয়ার আগে বৃহৎ শক্তিগুলোর কার কি মনোভাব তা কিছুটা বাজিয়ে দেখার জন্য প্রতিটি দেশের সঙ্গে তিনি বৈঠক করেছিলেন। ইস্তাম্বুলে পৌঁছে তিনি তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছিলেন এভাবে- ‘ইস্তাম্বুলে আসার পথে আমি সম্মেলনের প্রতিটি পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি এবং কার কী স্বার্থ ও দাবি, বোঝার চেষ্টা করেছি। তাদের কারো কারো মধ্যে রাশিয়ার প্রতি চরম বিরুদ্ধ মনোভাব থাকলেও উছমানীদের প্রতি সামান্যতম সমর্থন বা সহানুভূতি আছে এমন একজনও আমি পাইনি’। সালিসবুরীর দেশও এর ব্যতিক্রম ছিল না, তবে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক বিভিন্ন স্বার্থের কারণে তাদের অবস্থান হয়ত তখন একটু ভিন্ন ছিল। এটাই ছিল তখনকার, বরং সবসময়ের বাস্তবতা। নিজ নিজ স্বার্থের বিচারে পশ্চিমা দেশগুলোর পরস্পর শত্রুতা ও বৈরিতা ছিল যথেষ্ট। কিন্তু খেলাফাতের বিরুদ্ধে সবাই ছিল বিলকুল একাট্টা, ঐ যে সতর্কবাণী ‘আলকুফরু মিল্লাতুন ওয়াহিদাহ!’

তাদের কূটনীতির মূল খেলাটা হতো, খেলাফতের সর্বোচ্চ ক্ষতি সাধনের পর বড় ভাগটা কীভাবে নিজেদের দিকে আনা যায়! এজন্য প্রয়োজনে কোন কোন পক্ষ খেলাফতকে সাময়িক কিছুটা ছাড় দিতেও প্রস্তুত হতো। আর এটাই ছিলো খেলাফতে উছমানিয়ার কূটনীতির সবচে’ সুবিধাজনক জায়গা, যদি ঠিকভাবে তা কাজে লাগানো যায়। এজন্য প্রয়োজন ছিলো আন্তরিক, বিশ্বস্ত ও সুদক্ষ কিছু মানুষের যারা খেলাফাতের প্রতিনিধিত্ব করে পশ্চিমাদের পারস্পরিক বৈরিতাকে  খেলাফাতের অনুকূলে ব্যবহার করতে পারবে। তাহলে হয়ত লাঞ্ছনা ও যন্ত্রণা কিছুটা লাঘব করা সম্ভব হত। কিন্তু ছিল তো মিদহাত পাশার মত অন্তর্ঘাতকেরা, বহিঃশত্রুর চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল যারা। আগ্রাসী শত্রুকে চিনতে তো সমস্যা হয়না, কিন্তু সংস্কার ও আধুনিকায়নের দাবীদার পশ্চিমাদের হাতের পুতুল এই শ্রেনীটাকে উম্মাহর হিতাকাক্সক্ষী বলে ভুল করেছিল বহু মানুষ। বরং সংখ্যায় তারাই হয়ত ছিল বেশী। তাদের চোখে রাষ্ট্রের সংস্কার ও উন্নয়নের পথে খলীফাই ছিলেন বড় বাধা। তারসানা সম্মেলনের চার দিন আগে অর্থাৎ ১৯ শে ডিসেম্বর ইতিহাসের এক কালো দিনে খেলাফাতের ও ষড়যন্ত্রকারী, ব্রিটিশ অনুচর, ফ্রি ম্যাশনী মিদহাত পাশা হল খেলাফাতে উছমানিয়ার ওয়াযিরে আযম!। বহুদিন থেকেই এর অপেক্ষায় ছিল নব্যতুর্কিরা। আগেই আমরা জেনেছি যে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যুবরাজ আব্দুল হামীদকে খলীফা হিসেবে ‘নিয়োগ’ দিতে বাধ্য হওয়ার আগে তথাকথিত সংস্কারবাদী নব্যতুর্কিরা কিভাবে তার কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিল যে, দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই মিদহাত পাশাকে তিনি ওয়াযিরে আযম হিসেবে নিয়োগ দেবেন। এর মাধ্যমে খলীফার পর খেলাফাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদটি এমন এক ব্যক্তির হস্তগত হল, খেলাফাত ও খলীফার শত্রুদের প্রতিই ছিল যার আনুগত্য ও বিশ্বস্ততা। খেলাফাতের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের অন্যতম ক্রীড়নক হিসেবে তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এখানে তুলে ধরা যায়। ১৮২২ সালে ইস্তাম্বুলে জন্মগ্রহণ-কারী মিদহাত পাশা ছিল খুবই প্রখর মেধা ও যোগ্যতার অধিকারী। আরবী, ফার্সি ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় খুবই পারদর্শী ছিল। নেতৃত্বগুণ ছিল তার স্বভাবজাত। তবে আফসোস, কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণের পথেই বেশি ব্যবহৃত হয়েছে তার সব গুণ ও বৈশিষ্ট্য। তৎকালীন বহু প্রতিভাবান এবং সম্ভাবনাময় উছমানী তরুণের মত জীবনের শুরতে সেও বিভ্রান্ত হয়েছিল ইউরোপের সমাজ সংস্কৃতির বাহ্যিক চাকচিক্য দ্বারা এবং ভিড়ে গিয়েছিল নব্য উছমানী/নব্যতুর্কিদের দলে। তারপর এক সময় আবির্ভূত হয়েছিল কুচক্রিদের ‘মাথা’রুপে।

খলীফা আব্দুল হামীদের চাচা খলীফা আব্দুল আযীযের যামানায় খেলাফাতের একজন সাধারণ কর্মকর্তা হিসেবে তার কর্মজীবনের শুরু। তখনও আঠারো পূর্ণ হয়নি তার বয়স, তবে যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতার বলে খুব অল্প সময়েই একের পর এক পদোন্নতি হতে থাকে তার। এক সময় খেলাফাতের বিভিন্ন প্রদেশে তাকে প্রশাসক হিসেবে প্রেরণ করা হয়। পর্যায়ক্রমে নিস (বর্তমান সার্বিয়ার একটি এলাকা) দানিয়ুব ও বাগদাদের ওয়ালী বা প্রশাসক হিসেবে অনেক ‘কৃতিত্বে’র স্বাক্ষর রাখে মিদহাত পাশা। তিন মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত খেলাফাতের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ প্রশাসকদের একজন হিসেবে গণ্য করা হত তাকে। প্রশাসনিক দক্ষতা ও যোগ্যতা তো ছিলই, তদুপরি ভবিষ্যত পরিকল্পনা সামনে রেখে তাকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য বিপুল প্রচারণা চালাতে থাকে নব্যতুর্কিরা। খেলাফাতের তথাকথিত পশ্চিমায়নের কট্টর সমর্থক হিসেবে পশ্চিমাদের কাছেও তার কদর বাড়তে থাকে। তার বন্দনায় মুখর হয়ে ওঠে ইউরোপের পত্রপত্রিকা। মিদহাত পাশাকে তুলে ধরা হয় খেলাফাতের সংস্কারপরিকল্পনা ও কার্যক্রমের প্রাণপুরুষরূপে। এভাবেই বাড়তে থাকে এবং বাড়ানো হতে থাকে তার তাপ ও প্রতাপ। ভালো ও মন্দের স্পষ্ট পার্থক্য বোঝার সামর্থ্য যদি আমাদের নাও থাকে অন্তত এটা তো নিঃসন্দেহে বোঝার কথা যে, শত্রু যার সমর্থক, হোক সে যুগের মিদহাত বা এ যুগের বিন সালমান, বিন যায়েদ, সে আর যাই হোক উম্মাহর জন্য কল্যাণ-কর হতে পারে না কিছুতেই। কিন্তু তাকদীরের গর্দিশ খ-াবে কে! ভিতর ও বাইরের চাপে  মিদহাত পাশাকে খেলাফাতের কেন্দ্রে নিয়ে আসেন খলীফা আব্দুল আযীয এবং তার হাতে তুলে দেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিভিন্ন দায়িত্ব। তবে খলীফা নিজেও তার কর্মকুশলতা ও প্রশাসনিক সাফল্যে অত্যন্ত মুগ্ধ ছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৭২ সালে এমনকি খেলাফাতের ওয়াযিরে আযমের পদও তার ‘পদানত’ হয়। নব্যতুর্কিরা তখন তার সাহায্যে খেলাফাতের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন বাহিনীর নেতৃত্বও দখল করেনেয়। এভাবেই তাকে সামনে রেখে নিজেদের চক্রান্ত বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে থাকে নব্যতুর্কি তথা পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের ক্রীড়নকেরা। দায়িত্ব গ্রহণের অল্প পরেই স্বরূপে আবির্ভূত হয় মিদহাত পাশাচক্র। বিভিন্ন বিষয়ে প্রকাশ্যেই খলীফার বিরুদ্ধাচরণ এবং খলীফার উপর চাপ প্রয়োগ শুরু করে তারা। বিশেষ করে তাদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পিত ক্বানূনে আসাসী বা সংবিধান এবং সাংবিধানিক রাষ্ট্রের রূপরেখা নিয়ে খলীফার সঙ্গে তাদের বিরোধ বাড়তে থাকে। একসময় হয়ত তাদের চক্রান্ত কিছুটা আঁচ করতে পারেন খলীফা। তাই দায়িত্ব অর্পণের মাত্র দু’মাসের মাথায় মিদহাত পাশাকে তিনি ওয়াযিরে আযমের পদ থেকে অব্যাহতি দান করেন। সেই সঙ্গে খেলফাতের আরো কতিপয় জাদরেল আমলাকেও অব্যাহতি দানের প্রস্তুতি নেন, যাতে নব্যতুর্কিদের ঔদ্ধত্য ও বাড়াবাড়ি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, কিন্তু পানি ততদিনে গড়িয়ে গিয়েছে অনেক দূর। খেলাফাতের শাহরগ পর্যন্ত  পৌঁছে গিয়েছে তাদের কালো হাত। নব্যতুর্কিরা পথের কাঁটা দূর করতে পশ্চিমাদের প্রত্যক্ষ যোগসাজেশে অভ্যুত্থান ঘটালো খলীফা আব্দুল আযীযের বিরুদ্ধে। মর্মান্তিকভাবে শহীদ হলেন  খলীফাতুল মুসলিমীন। তার রক্তে রঞ্জিত হলো বিশ্বাস- ঘাতক পাশাদের হাত। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার নেতৃত্বে ছিল মিদহাত পাশা (তৎকালীন বিচারমন্ত্রি) রশদী পাশা (ওয়াযিরে আযম) হুসাইন আওনী পাশা (যুদ্ধমন্ত্রী, সেনাপ্রধান) আহমাদ পাশা (নৌবাহিনী প্রধান) এবং সুলাইমান পাশা প্রমুখ।

হ্যাঁ এবং ছিলেন খেলাফাতের ‘শাইখুল ইসলাম’২ খায়রুল্লাহ আফেন্দি, যিনি খেলাফাতের সম্পদ অপচয়ের অভিযোগে খলীফাকে অপসারণের বৈধতা ঘোষণা করে ফতোয়া জারি করেছিলেন।  নিজেদের কাজের বৈধতা সাব্যস্ত করতে এভাবেই তাকে ব্যবহার করেছিল নব্যতুর্কিরা এবং তিনিও...। এর চেয়ে বড় মর্মান্তিক বিষয় আর কি হতে পারে যে, ইসলামী খেলাফাতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে ইউরোপের শাইখুল কুফ্রদের সহযোগী ছিল খেলাফাতের ‘শায়খুল ইসলাম’। খলীফার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান এবং তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে পশ্চিমারা বিশেষ করে বৃটিশ ও ফরাসীরা কীভাবে নব্যতুর্কিদের মদদ যুগিয়েছিল সে ইতিহাস তুলে ধরেছে ফরাসি ঐতিহাসিক চার্লস মিসমার তার “সুভেনিয়ার মোঁ মুসলিমান / মুসলিম বিশ্বের স্মৃতিকথা” বইয়ে। বিশেষ করে কুখ্যাত বৃটিশ রাষ্ট্রদূত হেনরী ইলিয়ট যে দীর্ঘ নয়বছর খেলাফাতের মাটিতে বৃটেনের রাষ্ট্রদূত ছিল তার সঙ্গে মিদহাত পাশার ছিল বিশেষ সখ্য ও সার্বক্ষণিক যোগাযোগ।

১৮৭৭ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত বৃটিশ সাময়িকী ‘নাইনটিন্থ সেঞ্চুরী’তে প্রকাশিত কলামে হেনরী ইলিয়ট সবিস্তারে লিখেছেন মিদহাত পাশার সাথে তার সখ্য এবং খলীফা আব্দুল আযীযের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানে মিদহাত পাশাকে মদদ দানের কথা। ইতিহাসের পাতা আমাদের জন্য পূর্ণ বিশ্বস্ততার সঙ্গে সংরক্ষণ করে রেখেছে মিদহাতের অপকর্মের ইতিহাস।৩

তরুণ খলীফা সুলতান আব্দুল হামীদের অবশ্য ‘পরিস্থিতির সাদা-কালো’ কিছুই অজানা ছিল না। খলীফা আব্দুল আযিযের খুনী পাশাচক্র তার সঙ্গে কী আচরণ করতে পারে তাও তার অনুমানের মধ্যেই ছিলো। তবে বাস্তব অবস্থা ছিলো আরো জঘন্য। আপন রোযনামচায় মাজলূম খলীফা তুলে ধরেছেন তার হৃদয়ের যখমগুলো। তিনি লিখেছেন কিভাবে রাত গভীরে মিদহাতের প্রাসাদে শরাবের আসর জমাতো নব্যতুর্কি আমলা, লেখক আর সাংবাদিকেরা। গভীর রাতে মদের পাত্র হাতে যখন জিহ্বার উপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে আসতো তখন নগ্ন হয়ে যেতো খেলাফাতের প্রতি তাদের ভিতরের আক্রোশ ও জিঘাংসার প্রকৃত চেহারা। এমনই এক রাতে বিলকুল মাতাল অবস্থায় বেরিয়ে এসেছিল মিদহাত পাশার থলের  বেড়াল। জড়ানো কন্ঠে সে ঘোষণা করেছিল, খেলাফাতে উছমানীয়া একদিন জুমহুরিয়্যহ ও প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত হবে, আর সে হবে প্রজাতন্ত্রের প্রধান!৪ হ্যাঁ, এটাই ছিল মিদহাত পাশা ও নব্যতুর্কিদের সংস্কার ও আধুনিকায়ন শ্লোগানের খোলাসা। সব খবরই পৌঁছতো সুলতান আব্দুল হামীদের কাছে। কিন্তু হায়, তার অসহায়ত্ব! এই মিদহাত পাশাকেই খেলাফাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাতে বাধ্য হলেন তিনি। প্রশ্ন হতে পারে, সব জানার পরও কেন তিনি এমন বিষধর সাপকে ...? কিন্তু দরবারে খেলাফাত দখল করে রাখা নব্যতুর্কি আমলা-গোষ্ঠির দাবি ও চাহিদার কাছে তিনি যে ছিলেন যিম্মি! ইতিমধ্যেই দুই সুলতানের অপসারণকারীদের পক্ষ হতে হুমকি ছিল স্পষ্ট যে, সুলতান তাদের ‘অবাধ্য’ হলে ‘পাগল’ মুরাদের বাচ্চা ছেলেকে ব্যবহার করতে তারা পিছপা হবে না। যদিও উত্তরাধিকারের বিচারে এর কোন সুযোগ নেই, কিন্তু ‘শাইখুল ইসলাম’ তাহলে আছেন কী কাজের জন্য!

ওয়াযিরে আযমের পদ দখলে আসামাত্র খেলাফাতকে ইউরোপের আদলে সাংবিধানিক রাষ্ট্রে পরিণত করার (অর্থাৎ খেলাফতের সিলসিলা খতম করে দেয়ার) দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যাপক তোড়জোড় শুরু করল মিদহাত পাশাচক্র। তাদের লক্ষ ছিল ইস্তাম্বুল সম্মেলন চলা অবস্থায় পশ্চিমা শক্তিগুলোর উপস্থিতিতেই  খেলাফাতে উছমানীয়াকে খলীফার একক শাসন থেকে মুক্ত একটি সাংবিধানিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা। খলীফাকে তারা বোঝালো এর মাধ্যমে পশ্চিমারা প্রভাবিত হবে। তারা যখন দেখবে, আইন করে খেলাফাতের সীমানায় বসবাস-কারী খৃস্টান সম্প্রদায়কে সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়েছে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের  মাধ্যমে শাসনকার্যেও তাদের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে তখন খেলাফাতের প্রতি তাদের বিরূপ মনোভাবের পরিবর্তন ঘটবে। তারা বোঝালো, খলীফাও বুঝলেন, বুঝতে বাধ্য হলেন। বলকানসঙ্কটকে কেন্দ্র করে ইস্তাম্বুলে বৃহৎ শক্তিগুলোর সম্মেলন যেদিন শুরু হল ঠিক সেদিন ২৩/১২/১৮৭৬ তারীখে, সংস্কার ও আধুনিকায়নের ধুয়া তুলে নব্যতুর্কিরা মূলত খেলাফাতবিলুপ্তির ব্যবস্থাই পাকাপোক্ত করে ফেললো। তোপধ্বনি ও সামরিক কুচকাওয়াজসহ বিভিন্ন আড়ম্বর ও নাটকিয়তার মাধ্যমে ঘোষণা করা হল, ‘একটি সাংবিধানিক রাষ্ট্র হিসেবে হিসেবে উন্নতি আর অগ্রগতির পথে আজ থেকে খেলাফাতে উছমানীয়ার নতুন পথচলার শুর হল।’

হ্যাঁ খলীফার স্বাক্ষরেই সবকিছু হল। তারা যা চাইলো, যেভাবে চাইলো খলীফা তাই মেনে নিতে বাধ্য হলেন, আর অপরিসীম ধৈর্য ও প্রজ্ঞার সঙ্গে অপেক্ষা করে গেলেন অনুকূল সময়ের। কী ছিল সেই সংবিধানে? প্রথমত খেলাফাতের সকল প্রদেশের সকল ধর্মের সকল জনগোষ্ঠী থেকে প্রতিনিধিদের নির্বাচন করা এবং তাদের দ্বারা গঠিত সংসদের মাধ্যমে খলীফার একচ্ছত্র শাসন থেকে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হওয়া। অর্থাৎ ইসলামী খেলফাতের আশ্রিত অমুসলিম সম্প্রদায় তথা আহলে যিম্মা যারা তাদের হাতেই  ইসলামী খেলাফাতের শাসনের দায়িত্ব তুলে দেয়া, এর চেয়ে হাস্যকর এবং ভয়ঙ্কর বিষয় আর কী হতে পারে! প্রতিমুহূর্তে যারা খেলাফাতের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, শত্রুর হাতে যারা ঘুঁটিরূপে ব্যবহৃত হয়ে আসছে , স্বয়ং তাদেরই মাঝে খেলাফাত পরিচালনার দায়িত্ব বণ্টনের চিন্তা! কী নামে অভিহিত করা যায় এই মূর্খতা ও নির্বুদ্ধিতাকে? তথাকথিত সংস্কারপন্থিদের প্রচারণা ছিল যে, খেলাফাতের সকল অঞ্চল ও জনগোষ্ঠী যখন ‘ন্যায্য’ অধিকার লাভ করে বৈষম্য থেকে মুক্তি পাবে তখন কোথাও আর বিদ্রোহ থাকবে না। খেলাফাতের সংসদে জনসংখ্যার ভিত্তিতে মুসলমানদের মত খ্রিস্টানদেরও সমান অংশীদারিত্ব থাকবে। সেখানে মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে সবার সব সমস্যার সমাধান হবে। তখন খ্রিস্টান প্রজাদের রক্ষার অজুহাতে আর কোন পশ্চিমা হস্তক্ষেপের সুযোগই থাকবে না। নব্যতুর্কিদের মধ্যে যারা ছিল জ্ঞানপাপী , মিদহাত পাশার মত জেনে শুনে যারা শত্রুর ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছিল তাদের কথা তো ভিন্ন। কিন্তু বহু শিক্ষিত উছমানী তরুণ, যারা এসব চটকদার চিন্তায়  বিভ্রান্ত হয়ে যোগ দিয়েছিল নব্যতুর্কি আন্দোলনে তারা ভুলে গিয়েছিল ওয়া লান তারদা আনকা...এর হুঁশিয়ারি! বহু পরে নাকে যখন পানি ঢোকা শুরু হল তখন হুশ হল অনেকের, কিন্তু অনুতাপের অশ্রু বিসর্জন ছাড়া তখন করার কিছু ছিলো না। মিদহাত পাশাচক্র  প্রচারণা চালিয়েছিল যে, ক্বানূনে আসাসী বা সংবিধান বাস্তবায়নের মাধ্যমে বলকানসঙ্কটের সমাধান হয়ে যাবে। ফলে এ নিয়ে বৃহৎ শক্তিগুলোর আর কোন বৈঠক, আলোচনার প্রয়োজন থাকবে না এবং এ অজুহাতে খেলফাতের উপর তাদের চাপ প্রয়োগের সুযোগও থাকবে না। কিন্তু তারসানায় যখন এ ‘তারানা’  পৌঁছলো তোপধ্বনির শব্দসহযোগে তখন পরস্পরের দিকে নির্মোহ দৃষ্টিতে একবার শুধু তাকিয়ে প্রতিনিধিরা আবার আলোচনায় মশগুল হল। নব্যতুর্কিদের পরম কাক্সিক্ষত সংবিধান তো ঘোষিত হল, কিন্তু পশ্চিমাদের তাতে কোন ভাবান্তর   হল না। তারা সাফ জানিয়ে দিল, এসবের প্রতি তাদের কোন আস্থা নেই। তারা যেভাবে বলবে, যেভাবে চাইবে খেলাফাতকে সেভাবেই সঙ্কটের সমাধান করতে হবে। অন্যথায়...। অথচ তারাই ছিল বিদ্রোহের পিছনে সবচেয়ে বড় উস্কানিদাতা। এভাবেই বৃহৎ শক্তিগুলো তাদের চক্রান্ত বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে গেল। কিন্তু তারপরও কি বন্ধ হল নব্যতুর্কিদের হঠকারিতা? না বরং তাতে যুক্ত হল নতুন নতুন মাত্রা। কেও বুঝে, কেও না বুঝে শত্রুর ঘুঁটি হিসেবেই ব্যবহৃত হতে থাকল।

এ সম্মেলনের কথা উল্লেখ করে খলীফা আব্দুল হামীদ তার রোযনামচায় লিখেছেন- ‘ইস্তাম্বুুলে বৃহৎ শক্তিগুলোর সম্মেলন থেকে এ সত্য আরো ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হল যে, খ্রিস্টান জনগোষ্ঠিগুলোর  তথাকথিত অধিকার রক্ষা করা তাদের মূল উদ্দেশ্য কিছুতেই নয় যেমনটা তারা দাবী করে থাকে, বরং এসব জনগোষ্ঠীকে ধাপে ধাপে খেলাফাত থেকে একেবারে  বিচ্ছিন্ন করা এবং এসব অঞ্চল খেলাফাতের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়াই তাদের মূল উদ্দেশ্য। এভাবেই তারা খেলাফাতকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করার কাজ সমাধা করতে চায়। এ লক্ষ্যে দু’টি কৌশলে তারা আগে বাড়ছিল। একটি হল খৃস্টান জনগোষ্ঠিগুলোকে লাগাতার বিদ্রোহের উস্কানি দিয়ে যাওয়া, যার মাধ্যমে তাদের সরাসরি নাক গলানোর এবং হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হয়। অন্যটা হল আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য বারবার সাংবিধানিক ব্যবস্থার প্ররোচনা দিয়ে যাওয়া। দুশমনের সৌভাগ্য আর আমাদের দুর্ভাগ্য যে, উভয় ক্ষেত্রেই তারা আমাদের মধ্যে অনেক ‘সহযোগী’ পেয়েছিল, যারা বুঝে না বুঝে তাদের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করেছিল। শত্রুর ঝুলানো রুটিতে ছিল কিছু মাখনও, যার আকর্ষণে বিভ্রান্ত হয়েছিল আমাদের ‘শিক্ষিত’ বহু তরুণ। এই সহজ সত্যটি তারা অনুধাবন করতে পারেনি যে অভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর কোন দেশে এ ধরণের শাসনব্যবস্থা চললেও চলতে পারে, কিন্তু খেলাফাতের ভূমিতে - যেখানে বিভিন্ন ধর্মের, হাজারো জনগোষ্ঠীর বসবাস- এ ব্যবস্থা চালুর অর্থ হল বহিঃশত্রুর স্বার্থের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া এসব জনগোষ্ঠীর হাতে আইনের অস্ত্র তুলে দেয়া, যা হবে চরম আত্মঘাতী কাজ”।

তারসানা সম্মেলনে খেলাফাতের প্রতিনিধি হিসেবে ছিল মিদহাত পাশা, সাফওয়াত পাশা (পররাষ্ট্র মন্ত্রী) এবং আদহাম পাশা (বিশেষ দূত)। তবে  তাদের উপস্থিতি ছিল শুধুই নিয়ম রক্ষার জন্য। নতুবা মূল আলোচনা তো হচ্ছিল পরাশক্তিগুলোর নিজেদের মধ্যেই। বিশেষ করে বৃটেন ও রাশিয়ার ম:্য।ে ভঙ্গুর খেলাফাতে উছমানীয়ার দেহ খাবলে নিজের সা¤্রাজ্যবাদী লালসা মেটাতে রাশিয়ার যেন তর সইছিল না। বিশেষ করে সীমান্তলগ্ন অঞ্চলগুলোর প্রতি ছিল তার লোলুপ দৃষ্টি। অন্যদিকে খেলাফাতের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি না থাকলেও ‘রুগ্ন পুরুষ’টিকে রাশিয়া একাই না গিলে ফেলে এ ভয়ে এবং নিজের বিভিন্ন স্বার্থের প্রতি রাশিয়ার পক্ষ হতে হুমকির আশঙ্কায় বৃটিশরা খেলাফাতের ওপর রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন এড়ানোর চেষ্টা করছিল। আপাতদৃষ্টিতে যেটাকে মনে হচ্ছিল খেলাফাতের প্রতি সমর্থন বা সহানুভূতি। বিশেষতঃ মিসরের সুয়েজ খালের আধিপত্য হারানোর আশঙ্কায় বৃটিশরা ছিল ভীত। ভারতবর্ষের সাথে বাণিজ্যে (সঠিক শব্দটি হল ভারতবর্ষ শোষণে) বৃটিশদের কাছে সুয়েজ খালের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ভারত থেকে পণ্যবহনে ইষ্ট ই-িয়া কম্পানীর জাহাজগুলোকে একসময় পুরো আফ্রিকা মহাদেশ অতিক্রম করতে হত ইংল্যা- পৌঁছতে। আর এখন এক মহাদেশ দূরত্ব কমে এসেছে মাত্র দুশ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি খালের কল্যাণে। সহজেই ধারণা করা যায় সুয়েজ খালের প্রশ্নে কতটা মরিয়া হতে পারে বৃটিশরা। ২৩শে ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে প্রায় এক মাস ধরে চলল ইস্তাম্বুলসম্মেলন। বৈঠকের পর বৈঠক হল। তারপর অবমাননাকর শর্ত ও দাবী দাওয়ার এক বিশাল ফর্দ ধরিয়ে দেয়া হল খেলাফাতের হাতে। যার বাস্তবায়ন তো পরের বিষয়, শুধু উচ্চারণই ছিল খেলাফাতের জন্য চরম বিপজ্জনক। তাদের মূল দাবীগুলো ছিল-

১- খেলাফাতের অধীনে থাকা বুলগেরিয়াকে স্বায়ত্বশাসন দেয়া হবে এবং পূর্ব ও পশ্চিমে খেলাফাতের আরো ভূখ- বুলগেরিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে তাকে দু’টি প্রদেশে বিভক্ত করা হবে এবং উভয় প্রদেশের প্রশাসক নিযুক্ত করা হবে খৃস্টান সম্প্রদায়থেকে।

২- একইভাবে স্বায়ত্বশাসন দেয়া হবে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনিয়া-কে এবং তারও প্রশাসক নিযুক্ত হবে খৃস্টান সম্প্রদায় থেকে।

৩-সার্বিয়া ও মন্টেনিগ্রোর বিশাল অঞ্চলের দাবী খেলাফাতকে ছেড়ে দিতে হবে।

৪-বলকান অঞ্চলের নিরাপত্তা বিধানে স্থানীয় অধিবাসিদের দ্বারাই মিলিশিয়া গঠন করা হবে যেখানে মুসলিম ও খৃস্টান উভয় সম্প্রদায় সমানভাবে অংশগ্রহণ করবে।

৫- তুর্কিভাষার পাশাপাশি স্থানীয় ভাষাগুলোকেও সরকারী ভাষার স্বীকৃতি দিতে হবে।

৬-বলকান অঞ্চল থেকে উশুলকৃত রাজস্বের অধিকাংশ স্থানীয়দের জন্য ব্যয় করতে হবে।

৭- এছাড়াও ছয় পরাশক্তি সম্মিলিতভাবে একটি কমিটি গঠন করবে, যার দায়িত্ব হবে এসকল দাবী ও শর্তের বাস্তবায়ন তদারক করা। তাদের নেতৃত্বে খেলাফাতের ভূমিতে পাঁচ হাজার সেনার একটি বাহিনী সার্বক্ষণিক অবস্থান করবে।

হায়! সত্যি বিশ্বাস করা কঠিন যে, সুলতান ফাতিহ, সুলতান ক্বানূনীর সন্তানদের জীবনে এমন দিন এসেছিল যখন এমন লজ্জাজনক সব দাবী ও শর্ত তাদের দিকে ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে আর তাদেরও তা নীরবে বরদাশত করতে হয়েছে। বলকান অঞ্চলে দীর্ঘদিন থেকেই খেলাফাতের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না বললেই চলে। সেখানকার খৃস্টান জনগোষ্ঠিগুলো অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বায়ত্বশাসনই ভোগ করে আসছিল। কিন্তু এ সকল দাবী মেনে নেয়ার অর্থ ছিল ভূখ-গুলো হাতছাড়া করার আয়োজন চূড়ান্ত করা। আরখেলাফাতের উপর নযরদারীর জন্য খেলাফাতের মাটিতে বিদেশী বাহিনীর অবস্থানের এ দাবী তো ছিল অপমানের চূড়ান্ত। সুলতান আব্দুল হামীদ সবই দেখলেন এবং শুনলেন । খেলাফাতের এ অপমান ও লাঞ্ছনায় সুলতান আব্দুল হামীদ স্বাভাবিক কারণেই মর্মাহত হলেন, তবে নিরাশ হলেন না। আল্লাহর গায়বী মদদের উপর ভরসা রেখে অথর্ব পাশাদের পাশ কাটিয়ে তরুণ খলীফা নিজে এবার সক্রিয় হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

(চলবে ইনশাআল্লাহ

 

১-লর্ড সালিসবুরী (১৮৩০-১৯০৩) দীর্ঘদিন তিনি বৃটিশ সরকারের ভারতবর্ষ বিষয়ক মন্ত্রি ছিলেন। পরবর্তী হয়েছিলেন বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী।       

২ শাইখুল ইসলাম, ছিল খেলাফাতের প্রধান মুফতির উপাধি এবং খেলাফাতের সর্বোচ্য ধর্মীয় পদ। কুস্তুনতূনিয়া বিজেতা মহান সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহ প্রথম এ উপাধি প্রাদান করেন। খেলাফাতের সবচেয়ে বিজ্ঞ আলেম এই পদে সমাসীন হতেন। রাষ্ট্রের সকল বিষয়ে শাইখুল ইসলামের মতামতকে অতীব গুরুত্ব প্রদান করতেন খলীফাগণ। আরো ভালোভাবে বোঝার জন্য বলা যায়, এটি বর্তমান সময়ের সর্বোচ্য সাংবিধানিক আদলতের সমতুল্য। কিন্তু হায়...!।

দেশে দেশে দ্বীনের শত্রুদের সাথে দ্বীনের ‘আমানাতদারদের’ এ ‘সখ্য’ দেখে দেখে হয়ত এখন উম্মাহর সয়ে গেছে। কিন্তু খেলাফাত এবং খলীফাতুল মুসলিমীনের বিরুদ্ধে নব্যতুর্কিদের এ ষঢ়যন্ত্রে শাইখুল ইসলাম খায়রুল্লাহ আফেন্দির এ অবস্থান ছিল তখনকার বিচারে অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক।

৩ হেনরী ইলিয়টের ভাষায়, খেলাফাতে উছমানীয়ায় বৃটিশ রাষ্ট্রদূত হিসেবে আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় আমি বুঝতে পারছিলাম যে,(আমাদের লক্ষ অর্জনে) চলমান সংস্কার কার্যক্রম যথেষ্ট নয়, বরং আরো ব্যপক ও মৌলিক পরিবর্তন জরুরী, আর তা সম্ভব হবে না যতক্ষণ না সুলতানের উপর নযরদারীর জন্য(সংবিধান প্রনয়ণের মাধ্যমে) একটি কমিটি বা সংসদ গঠন করা হচ্ছে। তাই এ বিষয়ে মিদহাত পাশার তৎপরতায় আমি খুবই উৎফুল্ল হলাম এবং আমার সাধ্যের সর্বোচ্চটুকু ব্যয় করে তাকে উৎসাহ ও মদদ যুগিয়ে গেলাম।

৪ তারিখী তুরকিয়া- লেখক: য়ালমায উযতূনাহ।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা