রবিউল আউয়াল ১৪৪০হিঃ (৩/৭)

তোমাদের পাতা

গীবত নফসের ভয়ঙ্কর বিমারি আসুন বাঁচার চেষ্টা করি! হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তাক্বী উছমানী দা.

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

الحمد لله رب العالمين والعاقبة للمتقين؛ والصلاة والسلام على رسوله الكريم؛ وعلى آله وأصحابه أجمعين؛ أما بعد

আমাদের একটা বড় ভয়ঙ্কর বাতেনি রোগ ও বিমারি হলো গীবত। এটা এমনই এক বিমারি যে, আল্লাহর কোন বান্দাই সম্ভবত তা থেকে মুক্ত নয়। আম খাছ প্রত্যেকেই কোন কোন মাত্রায় এই বিমারিতে লিপ্ত। আল্লাহর পক্ষ হতে তাওফীক হলেই শুধু মানুষ তা থেকে বাঁচতে পারে। সবচে’ বড় চিন্তার বিষয় হলো, মানুষ গীবতের গোনাহকে গোনাহই মনে করে না, অথচ তা এতই সঙ্গিন ও খতরনাক গোনাহ যে, কোরআনুল কারীমে এর জন্য এমন কঠিন শব্দ এসেছে যা, অন্যকোন গোনাহের ক্ষেত্রে আসেনি। দেখুন-

(কারো বিষয়ে অযথা) ‘চরবৃত্তি’ করো না। আর তোমাদের কেউ যেন কারো গীবত না করে। তোমাদের কেউ কি পছন্দ করবে আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া! তা তো অবশ্যই তোমরা ঘৃণা করবে!

এখানে গীবত করাকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এর চেয়ে জঘন্য বিষয় আর কী হতে পারে! একে তো মানুষের গোশ্ত, তাও আপন ভাই এবং মৃত ভাই! সামান্যতম মনুষ্যত্ব যার মধ্যে রয়েছে তার পক্ষে তো এটা চিন্তা করাও সম্ভব না! কোরআন বলছে, গীবত করা তো আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার মতই ঘৃণ্য ও জঘন্য।

মোট কথা, গীবত সাধারণ কোন গোনাহ নয়, অনেক ভয়ঙ্কর ‘কবীরা’ গোনাহ।

গীবতের জঘন্যতা

গীবত করা এমনই গোনাহ যেমন মদ ও শরাব গলা দিয়ে নামানো, বা শুয়রের গোশত খাওয়া। বরং গীবতের গোনাহ তো আরো জঘন্য, আরো ভয়াবহ। কারণ মদ-শরাব বা শুয়রের গোশত খাওয়ার যে গোনাহ তা পুরোপুরি আল্লাহর হকের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এটা মানুষের নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ গোনাহ। হক্কুল ইবাদ বা বান্দার হকের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। সুতরাং যদি কখনো আল্লাহ তা‘আলা তাওবা করার তাওফীক দান করেন তাহলে ঐ গোনাহ মাফ হতে পারে, কিন্তু গীবত তো এমন গোনাহ যার সম্পর্ক হলো বান্দার হকের সঙ্গে। আর হক্কুল ইবাদের ক্ষেত্রে বিধান এই যে, হকদার যতক্ষণ তার হক মাফ না করবে, হাজার তাওবা-ইস্তিগফার করতে থাকো, নামায-রোযা করতে থাকো, বান্দার হক মাফ হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি নিজের হক তো মাফ করতে পারি, কিন্তু তুমি যদি কোন বান্দার জানের, মালের, বা আবরু-ইজ্জতের ক্ষতি করে থাকো, তুমি যদি তার ছোট-বড় যে কোন হক নষ্ট করে থাকো, যতক্ষণ তুমি তার হক আদায় না করবে, অথবা সে মাফ না করবে, আমি মাফ করবো না।

তো ভাই, বান্দার হক এতই সঙ্গিন, এতই খতরনাক!! অথচ আমরা সেটাকে খুবই মামুলি ও তুচ্ছ মনে করে রেখেছি, যেন নাকে মাছি বসলো, আর তাড়িয়ে দিলাম!

সুতরাং সাবধান! হক্কুল ইবাদ ও বান্দার হক থেকে সাবধান! আর গীবত হক্কুল ইবাদের মধ্যে পড়ে; সুতরাং যার গীবত করা হবে, সে যতক্ষণ মাফ না করবে, কোন তাওবা-ইসতিগফার দ্বারা মাফ হবে না।

গীবতের সংজ্ঞা ও পরিচয়

গীবতের পরিচয় কী? কাকে বলে গীবত? খুব ভালো করে বুঝে নিন, গীবত হলো, কারো পিছনে (তার অনুপস্থিতিতে) এমন ভাষা ও ভাবভঙ্গিতে তার সম্পর্কে কিছু বলা বা করা যে, যদি সে তা জানতে পারে তাহলে কষ্ট পাবে। এখন হয়ত সে জানলো না এবং না জানার কারণে কষ্টও পেলো না, তবু সেটা গীবত হবে, যা অনেক বড় কবীরা গোনাহ।

তো ভাই, এখন আমরা নিজেদের অবস্থা বিচার-পর্যালোচনা করে দেখি যে, সকাল থেকে সন্ধ্যা নিজেদের মধ্যে আমরা যত রকম কথাবার্তা ও গল্পগুজব করি তাতে গীবত হয় কি না?

কেউ কেউ এমন তাবিল-ব্যাখ্যাও করে যে, অমুক সম্পর্কে আমি যা বলেছি তা তার সামনে মুখের উপরও বলতে পারবো। যেন সে বলতে চায়, গীবত তো তখন হবে যখন বলা কথাটা তার সামনে বলতে না পারবো।

আরে ভাই, তার সামনে বলো, গীবত হবে না, কিন্তু যদি তার অগোচরে বলো, যা জানার পরে তার কষ্টের কারণ হতে পারে, তাহলে অবশ্যই গীবত হবে।

আবার অনেকে বলে, আমি যে তার সম্পর্কে এরূপ কথা বলেছি, সে তো তা জানতে পারেনি, ফলে ফলে কষ্টও পায়নি! যেন সে বলতে চায়, অগোচরে যা বলেছি যেহেতু সে জানতে পারেনি, আর কষ্টও পায়নি সুতরাং তা গীবত হবে না। হাঁ, যদি আমার বলা কথা তার কানে যায়, আর তাতে তার কষ্ট হয় তাহলে গীবত হতে পারে।

আরে ভাই সে জানুক বা না জানুক, কথাটা কষ্টদায়ক কি না এবং তোমার ভিতরে পাশবিক আনন্দ হয়েছে কি না? ব্যস, গীবত হয়ে গেলো! মুরদা ভাইয়ের গোশত খাওয়া হয়ে গেলো। আল্লাহ হেফাযত করুন, আমীন।

গীবত ও অপবাদের পার্থক্য

হাদীছ শরীফে এসেছে, এক ছাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি যা বলছি যদি তা তার মধ্যে থেকে থাকে?

বাস্তবেও যদি সে ঐ দোষে দোষী হয়ে থাকে তাহলেও কি সেটা গীবত হবে এবং গোনাহ হবে?

নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, যে কথা তুমি তার সম্পর্কে বলছো, যদি ত তার মধ্যে থেকে থাকে তাহলে তো এটা গীবত হলো, আর যদি না থাকে তাহলে তো অপবাদ হলো। তাহলে তো তাকে তুমি অপবাদ দিলে!

অর্থাৎ এখানে তো গীবতের গোনাহ এবং অপবাদের গোনাহ একত্র হয়ে গেলো! 

মনে করুন, কারো মধ্যে মিথ্যা কথা বলার দোষ আছে, আর আপনি কোন মজলিসে তার অগোচরে বললেন, লোকটা ভারি মিথ্যুক। যদি অগোচরে তাকে মিথ্যাবাদী বলা তার জন্য কষ্টের কারণ হয় তাহলে এটা হবে গীবত। আর যদি বাস্তবে সে মিথ্যাবাদী না হয়ে থাকে তাহলে এ অবস্থায় দু’টি গোনাহ হলো। প্রথমত গীবতের গোনাহ, দ্বিতীয়ত অপবাদ আরোপের গোনাহ।

সুতরাং খুব ভালো করে বুঝুন, গীবত কত সঙ্গিন ও খতরনাক গোনাহ! নিজের যবানকে সংযমের মধ্যে রাখুন! জিহ্বাকে লাগাম দিন! আর আল্লাহ তা‘আলার কাছে গবীত (ও অপবাদের) গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক চান। আল্লাহ যদি হেফাযত করেন তাহলেই মানুষ গীবতের গোনাহ থেকে বাঁচতে পারে, নইলে যে কোন অসতর্ক মুহূর্তেই গীবতের গোনাহ হয়ে যেতে পারে।

গীবত সম্পর্কে অদ্ভুত মন্তব্য

আমি একবার গীবত সম্পর্কে একটি মযমূন লিখেছিলাম। কোন ইউনিভার্সিটির এক প্রফেসর সাহেব ঐ মযমূন পড়ে আমাকে চিঠি লিখলেন, ‘গীবত সম্পর্কে আপনি লিখেছেন,

অনেক জঘন্য অপরাধ, হারাম, কবীরা গোনাহ, ইত্যাদি। সুতরাং গীবত তরক করা উচিত ...। ঠিক আছে, তবে া আমি চিন্তা করে দেখলাম, যদি জীবনের অঙ্গন থেকে গীবতকে বিদায় করে দিই তাহলে জীবন একেবার নিরস ও পানসে হয়ে যাবে; জীবনের মধ্যে আর কোন রস, প্রাণ ও আনন্দই থাকবে না। কারণ যখন আমরা দু’চারজন একত্র হই; কথাবার্তা শুরু হয়। তখন কী কথাবার্তা হবে? শুধু আল্লাহ, আল্লাহ, ছাল্লে আলা? কোন হাসিতামাশা ও হাস্যপরিহাস হবে না? কোন বিনোদনমূলক আলোচনা বা কোন তির্যক মন্তব্য হবে না? আর এগুলো হবে, অথচ আপনার কথিত গীবত হবে না, তা তো হতেই পারে না।

তো আপনি এই যে গীবতের লম্বাচওড়া নিন্দা-সামালোচনা করলেন, এর মতলব তো এই যে, আপানি চাচ্ছেন, যাবতীয় হাস্য-বিনোদন থেকে মানুষ হাত গুটিয়ে নেবে এবং জীবনের স্বাদ-আনন্দই খতম হয়ে যাবে।

যেহেতু তিনি প্রফেসর মানুষ সেহেতু আপন চিন্তা ও যুক্তি অনুসারে শেষে লিখেছেন, ‘আমি মনে করি না, ইসলাম এমন জিনিস নিষেধ করতে পারে যা মানুষ হরদম করতেই থাকে, আর না করলে যিন্দেগির কোন মজাই থাকে না।

চিঠির জবাবে আমি ভদ্রলোককে লিখলাম, ‘ঠিক আছে, আপনার যিন্দেগীর মজা তো কারো না কারো গীবত না করার কারণে বরবাদ হয়ে যাবে; তো অন্য কেউ যখন যিন্দেগির মজা ভোগ করার জন্য আপনার গীবত শুরু করবে তখন আপনার কী প্রতিক্রিয়া হবে? আপনি যখন জানতে পারবেন, অমুক ব্যক্তি অমুক মজলিসে আমার সম্পর্কে এই এই মন্তব্য করেছে তখন কি তাতে আপনি ‘যিন্দেগির মজা’ অনুভব করবেন? আসলে আপনার মনের অবস্থা তখন কী হবে? নিজের এবং অন্যের জন্য অভিন্ন মাপকাঠি রাখুন

কথা আসলে এই যে, মানুষ শুধু নিজের বিনোদন ও আমোদ-প্রমোদের কথাই ভাবে, কিন্তু ভাবে না যে, তথাকথিত আমোদ -প্রমোদের নামে যে আচরণ আমি অন্যের সঙ্গে করছি, সেই একই আচরণ যদি অন্য কেউ আমার সঙ্গে করে তাহলে আমার কী অবস্থা হবে! তাতে আমার কেমন মনঃকষ্ট ও যন্ত্রণা হতে পারে?

 

হাদীছ শরীফে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানব জীবনের এ জটিলতা নিরসনের জন্য এমন অব্যর্থ এক চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন যা নবী ও পায়গাম্বরই দিতে পারেন। তা অন্য কারো সাধ্যের মধ্যে নেই। ব্যস, যদি এই চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপত্র ঠিকমত গ্রহণ করা হয় এবং এর উপর আমল করা হয় তাহলে সমাজের সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এবং সমস্ত ঝগড়া-বিবাদ ও কাজিয়া-ফাসাদ শেষ হয়ে যাবে। যা কিছু খারাবি ও বরবাদি তা আসলে এই চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপত্র ভুলে যাওয়ার কারণেই দেখা যাচ্ছে। সেই অব্যর্থ নববী চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপত্র এই -

أحب لأخيـك مـا تـحـب لـنـفـسك

واكـره لـغـيـرك مـا تـكـره لـنـفـسـك

আপন ভাইয়ের জন্য তাই পছন্দ করো যা নিজের জন্য পছন্দ করো এবং অন্যের জন্য তাই অপছন্দ করো যা নিজের জন্য অপছন্দ করো।

(মুসনাদে আহমদ, খ. ৪ পৃ. ৭০)

এই যে আমরা দ্বৈত মাপকাঠি নির্ধারণ করে রেখেছি; এই যে আমরা নিজের বিষয়গুলো এক পাল্লায় মাপি, আর অন্যের বিষয়গুলো মাপি আরেক পাল্লায় এর কারণেই সমাজে আজ সমস্ত অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। আসলে এটাই হলো সর্বমন্দের গোড়া। সুতরাং প্রতিটি ক্ষেত্রে এভাবে চিন্তা করো যে, অন্যের সঙ্গে যে আচরণ আমি করছি, তার স্থানে আমি নিজে হলে এবং আমার স্থানে সে হলে, তখন আমার কাছে কেমন লাগতো? প্রতিটি আচরণের পূর্বে যদি এভাবে চিন্তা করা হয় তাহলে আমার দ্বারা অন্যের হক নষ্ট হওয়ার ঘটনা কমই ঘটবে। কারো সঙ্গে বে-ইনছাফি কমই হবে এবং কারো দ্বারা কারো অধিকার কমই নষ্ট হবে।

গীবত করার সময়ও একই ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করো। অর্থাৎ এটা চিন্তা করো যে, যদি তার স্থানে আমি হতাম, আর এভাবে আমার আলোচনা হতো, যদি আমার সম্পর্কে ঐ সব কথা বলা হতো যা আমি এখন অন্যের সম্পর্কে বলছি তখন এটা আমার ভালো লাগতো, না মন্দ লাগতো? যদি ভালো লাগতো না বলে মনে হয় তাহলে বুঝতে হবে, এটা গীবত। তা থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকা দরকার।

মানুষ অজুহাত বের করে যে, গীবত থেকে বাঁচাই তো যায় না। আমি বলি, গীবত করা যেমন ইচ্ছাধীন তেমনি না করাও ইচ্ছাধীন। সুতরাং গীবত থেকে বেঁচে থাকা বাধ্যতামূলক।

দোষ আলোচনার বৈধতার ক্ষেত্র

হাঁ, যেসকল ক্ষেত্রে কোন মুসলমানকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করা উদ্দেশ্য হবে তখন দোষ আলোচনা করা বৈধ হবে। যেমন কেউ আপনাকে জানালো যে, অমুক আমার মেয়ের জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছে। তারপর আপনার কাছে জানতে চাইলো যে, মানুষটা কেমন? তো যদি ঐ ব্যক্তির এমন কোন দোষ আপনার জানা থাকে যা বিবাহ-শাদির ক্ষেত্রে চিন্তা করার বিষয়; এমন ক্ষেত্রে যদি আপনি তাকে ঐ ব্যক্তির ঐ দোষের কথা বলে দেন যাতে সে এবং তার মেয়ে ক্ষতি থেকে বেঁচে যায় তাহলে এটা বৈধ হবে; এটা গীবতের মধ্যে পড়বে না।

তদ্রƒপ একলোক খুব ধোকাবাজ; ধোকা দিয়ে, করযের কথা বা প্রয়োজনের কথা বলে মানুষের পয়সা হাতিয়ে নেয়। এ অবস্থায় যদি কাউকে বলে দেন যে, এই লোকের সঙ্গে একটু বুঝেশুনে লেনদেন কর; এর মু‘আমালা ঠিক না, তাহলে এটা গীবত হবে না। কারণ এখানে তো অন্যকে ক্ষতি থেকে বাঁচানো উদ্দেশ্য।

মোটকথা, যেখানে কাউকে সতর্ক করা দরকার এবং কাউকে দুনিয়া বা আখেরাতের কোন অনিষ্ট থেকে বাঁচানোর প্রয়োজন সেখানে কারো বাস্তব দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করা গীবতের মধ্যে পড়ে না।

ফাসিক-পাপাচারীর গীবত করা

সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে এটা প্রসিদ্ধ যে, যারা ফাসিক ফাজির, ধর্মভ্রষ্ট ও পাপাচারী তাদের গীবত করা যায়, তাতে দোষের কিছু নেই। কারণ তারা তো নিজেরাই নিজেদের বদনাম করে রেখেছে।

মোটাদাগে এরূপ ধারণা ঠিক নয়। প্রকৃত সত্য এই যে, নেক ও নেককার মানুষের গীবত যেমন বৈধ নয় তেমনি ফাসিক-ফাজিরের গীবতও বৈধ নয়। হাঁ, কেউ যদি গোনাহ এমন প্রকাশ্যে করে যে, ঐ গোনাহের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার কারণে সে লজ্জিত হয় না, এমনকি এসব বদনামকে সে গায়েও মাখে না। তো এরূপ ক্ষেত্রে তার অনুপস্থিতিতে ঐ পাপাচারের বিষয়টি জড়িয়ে তার আলোচনা করা, এটা জায়েয ও বৈধ। যেমন কেউ প্রকাশ্যে মদ খায়; সবাইকে জানিয়েই শরাবের আসর জমায়। এখন যদি তার অগোচরে এরূপ আলোচনা হয় যে, অমুক তো মদখোর। তো জানা কথা, এরূপ আলোচনায় তার কষ্ট হবে না, বরং এটা তো সে গায়েই মাখবে না। কারণ সে নিজেই তো বলে বেড়ায় তার মদখোরির কথা। সুতরাং এটা গীবতের মধ্যে পড়বে না। পক্ষান্তরে যে গোনাহ সে গোপন রাখতে চায় এবং ঐ গোনাহের সঙ্গে নিজের নাম সম্পৃক্ত হওয়াকে খারাপ মনে করে এবং এধরনের আলোচনা তার মনঃকষ্টের কারণ হয় তাহলে তার অগোচরে তার নামে ঐ গোনাহের আলোচনা করা কিছুতেই বৈধ নয়, হোক তা সত্য আলোচনা ও বাস্তব ঘটনা। ভালো করে বুঝে নিন, এটা সুস্পষ্ট গীবত এবং হারাম। যদি সতর্কতার সঙ্গে যবানের উপর লাগাম না লাগানো হয় তাহলে মানুষ সহজেই এ ধরনের গোনাহে লিপ্ত হয়ে যায়। আর মনে রাখা দরকার, গীবত যেমন নিজে করা জায়েয নয়, তেমনি গীবতের আলোচনা শোনাও জায়েয নয়।

অন্যের আলোচনাই করো না!

তো যবানকে লাগাম পরানো এবং জিহ্বাকে সংযত রাখার উদ্দেশ্যেই হযরত থানবী রহ. বলতেন, ‘সতর্কতার বিষয় এটাই যে, অন্যের আলোচনাই করো না; ভালো আলোচনাও না, মন্দ আলোচনাও না। কারণ যখন তুমি কারো আলোচনা সুখ্যাতির সঙ্গেই শুরু করবে, শয়তান শেষ পর্যন্ত কোন না কোন বাহানায় তোমাকে ঐ লোকের মন্দ আলোচনায় লিপ্ত করেই ছাড়বে। যেমন, ‘অমুক মানুষটা খুব ভালো ... যদি এ দোষটা তার মধ্যে না থকতো তাহলে আরো ভালো হতো।’

শেষ পর্যন্ত হলো তো মন্দ আলোচনা! সুতরাং উত্তম এই যে, অন্য কারো আলোচনাই করো না। নিজের চিন্তায় লেগে থাকো

অন্যকে নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার, অন্যের বিষয়ে মাতামাতি করার প্রয়োজনই বা কী? ব্যস, নিজের চিন্তা করুন; নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হোন। যে নিজের দোষ-ত্রুটির চিন্তায় অস্থির হবে, তার অন্যের দোষ খোঁজার সময়-সুযোগ কোথায়?! যে নিজে অসুস্থ, বুকের  ব্যথায় অস্থির তার পক্ষে কি সম্ভব অন্যের অসুস্থতা নিয়ে চিন্তা করা! যখন মানুষ নিজের চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ে যে, আমার মধ্যে কী কী দোষত্রুটি আছে? এগুলোর সংশোধন কী ভাবে হতে পারে? কোন্ উপায়ে গোনাহের নাজাসাত থেকে পাক ছাফ হতে পারি? তো এই চিন্তাপেরেশানির মধ্যে তার দ্বারা অন্যের দোষচর্চা ও গীবত হতেই পারে না! হিন্দুস্তানের শেষ বাদশাহ বাহাদুল শাহ জাফর বড় সুন্দর বলেছেন-

নিজের দোষত্রুটি সম্পর্কে যখন ছিলাম বে-খবর/অন্যের দোষগুণের খোঁজে ছিলাম তৎপর/নিজের দোষের উপর যেই পড়লো নযর/ নযরে তখন কেউ রইলো না মন্দ ।

এমনই হয়! এটাই সত্য! এটাই হাকীকত! যখন নিজের দোষ-ত্রুটির উপর নযর পড়ে তখন কাউকে আর মন্দ ভাবার সুযোগ থাকে না, তখন তো মনে হয়, আমিই তো সবার চেয়ে খারাপ! আপন দয়াগুণে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে নিজ নিজ দোষ সম্পর্কে চিন্তা করার এবং সেগুলোর সংশোধনে সচেষ্ট হওয়ার তাওফীক দান করুন, আমীন।

গীবতের একটি প্রায়োগিক চিকিৎসা

এখানে গীবতের প্রায়োগিক ও বাস্তব চিকিৎসা সম্পর্কে হযরত থানবী রহ.-এর একটি অত্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থপত্র সম্পর্কে আলোচনা করছি। হযরত রহ. বলেন, ‘আত্মসংশোধনে সচেষ্ট সালিকের সামনে যদি কেউ গীবত বা অর্থহীন কথাবার্তা শুরু করে, আর তাকে তা থেকে বিরত রাখার শক্তি না থাকে তাহলে নিজেই সেখান থেকে উঠে যাওয়া কর্তব্য। তার মন ভেঙ্গে যাবে এরূপ চিন্তা করবে না। কারণ কারো দিল ভেঙ্গে যাওয়ার চেয়ে নিজের দ্বীন ভেঙ্গে যাওয়া অনেক বেশী চিন্তার বিষয়। যে কোনভাবে সেটাই পরিহার করা কর্তব্য।

এভাবে সরাসরি যদি উঠতে না পারে তাহলে কোন বাহানা-অজুহাতে উঠে যাবে, কিংবা ইচ্ছা করে কথার মোড় কোন ভালো বিষয়ের দিকে ঘুরিয়ে দেবে যাতে আগের আলোচনা বন্ধ হয়ে  যায়। (আনফাসে ঈসা, পৃ. ১৪৯)

একটু আগেই যেমন বলে এসেছি যে, গীবত নিজে করা যেমন নাজায়েয ও হারাম তেমনি অন্যের মুখ থেকেও কারো সম্পর্কে গীবত শোনাও হারাম।

সুতরাং প্রশ্ন হলো, মজলিসে গীবত শুরু হয়ে গেলে কী করণীয়। তো এ সম্পর্কেই হযরত রহ. একটি সুন্দর উপায় বলে দিচ্ছেন যে, যদি গীবত-কারীকে বাধা দেয়ার শক্তি সামর্থ্য থাকে তাহলে তো অবশ্যই বাধা দেবে। বাধা দেয়া পন্থা দু’টো হতে পারে। প্রথমত সাফ সাফ বলে দেবে যে, দেখো ভাই, এভাবে কথা বললে সেটা গীবত হয়ে যাবে, ছাড়ো এধরনের কথাবার্তা। যদি কোন কারণে এভাবে বলা সম্ভব না হয় তাহলে দ্বিতীয় পন্থা এই যে, নিজে উদ্যোগী হয়ে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে ফেলো এবং অন্য যে কোন ভালো প্রসঙ্গের অবতারণা করো, যাতে গীবতের গান্দেগি নিজেই খতম হয়ে যায়।

যদি বাধা দেয়ার এ দু’টি পন্থার কোনটাই সম্ভব না হয় তাহলে ব্যস, ওখান থেকে উঠে যাও, ঐ মজলিসে আর বসে থেকো না।

মন ভেঙ্গে যাওয়ার পরোয়া করো না। (কেনই বা করবে! মজলিসের বক্তা তো তোমার মনভাঙ্গার পরোয়া করেনি!)

এর পর তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ উছূল ও মূলনীতি বলে দিয়েছেন যে, তুমি উঠে গেলে তার মনঃকষ্টের কারণ হবে; তার মন ভেঙ্গে যাবে, দিলশিক্নি হবে, এ চিন্তা বিলকুল করো না। কারণ কারো দিলশিক্নি যদি হয়ই তবে তার চেয়ে অনেক বেশী ক্ষতির বিষয় হলো নিজের দীনশিক্নি হওয়া, নিজের আখেরাত নষ্ট হওয়া।

আমাদের মধ্যে ইফরাত-তাফরীত বা ‘উভপ্রান্তিকতা’ অনেক বেশী। যে কোন বিষয়ে হয় আমরা বেশীর দিকে প্রান্তিক, না হয় কমের দিকে প্রান্তিক। একদিকে তো অবস্থা এই যে, হুকূকুল ইবাদের পরোয়াই নেই, যখন যার যে হক চাইলাম নষ্ট করে বা আত্মসাৎ করে বসলাম। কখনো জানের হক, কখনো মালের হক, কখনো আবরুইজ্জতের হক। অন্যদিকে কারো মনে হক্কুল ইবাদের চিন্তা এত প্রবল যে, বান্দার হক পুরা করতে গিয়ে শরীয়তের ফরয আহকাম ও বিধানেও শিথিলতা শুরু করে দেয়।

ওয়াক্তমত নামায তো ফরয

এক ডাক্তার সাহেব ছিলেন। তার স্ত্রী যথাযথ মাধ্যমে আমাকে জানালেন, ‘আমার স্বামী তো খুবই ভালো মানুষ, তবে রোগী দেখার সময় ওয়াক্তমত নামায পড়েন না। এ বিষয়ে তাকে কিছু বললে তার উত্তর হলো, আমি তো মানুষের সেব করি, যা হক্কুল ইবাদভুক্ত। এদিকে রোগী বসে থাকবে উপশমের আশায়, ওদিকে আমি নামায শুরু করে দেবো!

তো তিনি রোগী দেখে যখন বাড়ী ফেরেন তখন আছর, মাগরিব, এশা একসঙ্গে আদায় করেন, আর বলেন, খিদমতে খালক ও মানবসেবার সময় নামায কাযা হলে কোন অসুবিধা নেই।

আরে ভাই! সবকিছুরই রয়েছে নিজস্ব সীমা সরহদ। খিদমতে খালক তোমার উপর এমন ফরযে আইন নয় যেমন ফরযে আইন হলো নামায। তাছাড়া এই খিদমতে খালকের সঙ্গে তো নামাযের কোন বিরোধও নেই। তুমি আছরের চার রাকাত পড়ে, আল্লাহর কাছে তাওফীক চেয়ে রোগী দেখা শুরু করো, তাহলে কার কী সমস্যা? যদি তোমার খিদমতে খালকের মধ্যে খালিকের মদদও শামিলে হাল হয় তাহলে তো আরো ভালো! তোমার চিকিৎসা হবে অব্যর্থ!

আসল কথা হলো, নফস নামায কাযা করার, এমনকি তরক করার বাহানা তালাশ করে নিয়েছে যে, খিদমতে খালকের মহৎ কাজে মগ্ন আছি।

এগুলো আসলে আর কিছু না, ইফরাত-তাফরীত ও প্রান্তিকতার নমুনা, যার কারণ হচ্ছে দ্বীনের প্রকৃত সমঝ ও প্রজ্ঞার অভাব। এ বিষয়ে সতর্ক করার জন্যই হযরত রহ. বলছেন যে, অন্যের দিল আবাদ করার জন্য নিজের দ্বিন বরবাদ করা গুরুতর অপরাধ। সুতরাং এরূপ চিন্তা করা কিছুতেই সঙ্গত নয় যে, যদি তাকে বাধা দিই বা উঠে যাই, তার খারাপ লাগবে; সে মনে কষ্ট পাবে। আচ্ছা, আমি না হয় ছবর করে বসে থাকি!

মনে রাখুন, মা‘ছিয়াত ও নাফরমানি থেকে বাঁচার জন্য যদি কারো মন ক্ষুণœ হয় তো হতে দিন, কোন পরোয়া নেই। আপনি শুধু এতটুকুর আদিষ্ট যে,  বৈধ সীমার ভিতরে থেকে কারো মনঃক্ষুণœতা থেকে বেঁচে থাকবেন। কিন্তু যেখানে মনঃক্ষুণœতা এড়ানোর জন্য গোনাহ ও নাফরমানিতেই লিপ্ত হতে হয় সেখানে দিল ভাঙ্গার কোন পরোয়াই করা যাবে না।

অন্যের দুনিয়া আবাদকারী

এক হাদীছ শরীফে পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যকে দুনিয়ার ফায়দা পৌঁছানোর জন্য নিজের আখেরাত নষ্ট করে, আল্লাহ তা‘আলা ঐ ব্যক্তিকেই তার উপর চাপিয়ে দেন যে, তুমি এই লোকের দুনিয়ার জন্য নিজের আখেরাত নষ্ট করেছো, এখন সে তোমার দুনিয়াও খারাব করবে। ...

যারা বিবি-বাচ্চার আরাম-আয়েশ ও সচ্ছলতার জন্য হারাম উপার্জনে লিপ্ত হয়, অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ঐ বিবি-বাচ্চাই শেষ পর্যন্ত তার মর্মপীড়া ও জীবনযন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা সে বিবি-বাচ্চাকে খুশী করার জন্য আল্লাহকে নারায করেছে এবং তাদের দুনিয়া আবাদ করার জন্য নিজের আখেরাত বরবাদ করেছে; তাই দুনিয়াতেই আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকেই তার ‘উপর’ ‘লেলিয়ে’ দেন যাতে তারা তার দুনিয়াকে যন্ত্রণাপূর্ণ করে ছাড়ে। সুতরাং কারো মনঃক্ষুণœতা থেকে বাঁচার জন্য নিজের দ্বীন ও আখেরাত ‘ক্ষুণœ’ করো না।

আসল প্রয়োজন হিম্মত ও মনোবলের

অন্য এক হাদীছে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

لا طـاعـة لـمخلوق فـي معصـيـة الـخالق

কোন মাখলূকের এমন আনুগত্য করার অবকাশ নেই যাতে খালিকের নাফরমানির প্রশ্ন এসে যায়। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ অমান্য করে, আল্লাহকে নারায করে কোন মাখলূকের কথা মান্য করার বা মনরক্ষা করার না অবকাশ আছে, না অনুমতি!

আর মনে রাখুন, কোন কাজ মেহনত ছাড়া হয় না। যে কোন কাজে কিছু না কিছু কষ্ট মেহনত  ভোগ করতেই হয়; তবেই ঐ কাজ আঞ্জাম পায়। সুতরাং যদি আপনি বিশ্বাস করেন যে, গীবত করা জঘন্য কবীরা গোনাহ এবং দুনিয়া-আখেরাত বরবাদকারী হারাম কাজ তাহলে হিম্মত ও মনোবল দেখাতেই হবে এবং কিছু ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করে আগে বাড়তেই হবে। যখন আপানি হিম্মত করবেন এবং সাহস ও মনোবলের পরিচয় দেবেন তখন আল্লাহ তা‘আলা সাহায্য করবেন, আর গীবতের গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা সহজ হয়ে যাবে।

কষ্টের কারণ হলেই গীবত...

জনৈক ব্যক্তি হযরত থানবী রহ. কে প্রশ্ন করেছেন, ‘যদি বেতাকাল্লুফি ও অন্তরঙ্গতার ভিত্তিতে কাউকে এমন কোন কথা বলা হয় যা ভাষা ও শব্দের বিচারে তো অপছন্দনীয় এবং কষ্টের কারণ, কিন্তু অন্তরঙ্গতা ও হাস্যপরিহাসের বিচারে কষ্ট হবে বলে ধারণা হয় না। (তো এটাও গীবত ও হারামের মধ্যে পড়বে, নাকি না?) (আনফাসে ঈসা, পৃ. ১৪৯)

প্রশ্নের উদ্দেশ্য এই যে, কিছু মানুষের সঙ্গে এমন অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব থাকে এবং পরস্পর হাসি-তামাশা বিনিময় হয়ে থাকে যে, সাধারণভাবে কষ্ট হওয়ার মত কথা হলেও এক্ষেত্রে কষ্ট হয় না এবং কিছু মনে করা হয় না। এখন এধরনের কথা তার অগোচরেও যদি বেতাকাল্লুফির আন্দাযে বলা হয় এই মনে করে যে, এতে তার কষ্ট হবে না; তো এরূপ কথা বলা জায়েয হবে কি না? এগুলো গীবতের মধ্যে পড়বে কি না?

উত্তরে হযরত রহ. বলেছেন, ‘যখন মূলত সেটা কষ্ট পাওয়ার মত কথা, যে কোন বিচারেই হোক, এতটুকুই যথেষ্ট নিষিদ্ধতার জন্য। এমনকি যদি অপছন্দনীয়তার বিষয়ে দ্বিধা থাকে তাহলেও অবশ্যপরিহার্য। পক্ষান্তরে অপছন্দনীয় না হওয়ার বিষয়টি যদি নিশ্চিত হয় তাহলে তা গীবতের মধ্যে পড়বে না।

হযরত রহ.-এর জবাবের খোলাছা এই যে, যদি এ বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত থাকে যে, যার সম্পর্কে এই মন্তব্য করছি, যদি সে শোনে তাহলে তার মনঃকষ্টের কারণ হবে না এবং সে খারাপ মনে করবে না। কারণ আমার সঙ্গে তার সম্পর্কের ধরনটাই এমন, তাহলে তা গীবতের মধ্যে পড়বে না। যেমন কোন অন্তরঙ্গ বন্ধুকে বলা হলো, তুমি তো বড় বে-ওয়াফা, বড় যালিম! পরে কোন মজলিসে তার অনুপস্থিতিতে বলা হলো, আরে ঐ যালিম বে-ওয়াফার কথা আর বলো না!

তো যালিম, বে-ওয়াফা এমন শব্দ যা কোন অপরিচিত, স্বল্প পরিচিত বা সাধারণ সম্পর্কের মানুষ সম্পর্কে বলা হলে তার খারাপ লাগতেও পারে, বরং খারাপ লাগতেই পারে। কিন্তু বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে এধরনের শব্দ বলা হলে সাধারণত খারাপ লাগে না এবং কষ্টের কারণ হয় না। সুতরাং যদি এরূপ নিশ্চিত বিশ্বাস থাকে যে, আমার বন্ধু যদি তার সম্পর্কে আমার এ মন্তব্য শোনে তাহলে তার খারাপ লাগবে না। এমন হলে তা গীবতের মধ্যে পড়বে না। কিন্তু যদি খারাপ লাগার বা কষ্ট পাওয়া আশঙ্কা হয়; অর্থাৎ হতে পারে, খারাপ লাগবে না, আবার হতে পারে খারাপ লাগবে, তখন এরূপ কথাবার্তা নাজায়েযই মনে করতে হবে।

হাসি-তামাশার বৈধতার সীমা

উপরের আলোচনা থেকে এ কথা বোঝা গেলো যে, বন্ধুদের মধ্যে অবস্থা কখনো এমনো হয় যে, একজন তো বেতাকাল্লুফি ও অন্তরঙ্গতার জাযবায় অপরজনের সঙ্গে হাসি-মজাক করছে এবং টিপ্পনি কেটে কথা বলছে; এতে তার উদ্দেশ্য বন্ধুকে কষ্ট দেয়া কিছুতেই নয়। কিন্তু কিছু মানুষ এমনো হয় যারা হাসিতামাশার কথা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না, বরং তাদের কষ্ট লেগে যায় এবং রেগে যায়। এমন লোককে বন্ধুরা তখন আরো পেয়ে বসে এবং আরো বেশী হাসি তামাশা ও টিপ্পনিতে মেতে ওঠে। বন্ধুকে আরো বেশী খেপাতে পেরে তারা আনন্দই ভোগ করে। তো এধরনের হাসি-মজাকও জায়েয নেই। কারণ আপনি বে-তাকাল্লুফ ভাবে বললেও অপরজন যেহেতু তাতে কষ্ট পাচ্ছে, আর কোন মুসলমানের কষ্টের কারণ হওয়া কোনভাবেই জায়েয নেই সেহেতু এধরনের বন্ধুর সঙ্গে এধরনের হাসি-মজাক করা জায়েয হবে না, যা মনঃক্ষুণœতার কারণ হচ্ছে।

হাঁ, যদি নিশ্চিত বিশ্বাস থাকে যে, বে-তাকাল্লুফি ও অন্তরঙ্গতা এত গভীর যে, সে আমার হাসি-মজাক খারাপভাবে নেবে না, বরং যদি শোনে, তার কাছে ভালোই লাগবে এবং আমার বে-তাকাল্লুফি ও অন্তরঙ্গতা অনুভব করে খুশীই হবে তাহলে এ জাতীয় হাসি-মজাকের কথা তার সামনে বলা যাবে, তার অগোচরেও বলা যাবে।

খোলাছা এই যে, তিনটি অবস্থা হলো। প্রথমত কষ্ট পাওয়া ও খারাপ লাগা নিশ্চিত হলে এরূপ শব্দ উচ্চারণ করা জায়েয নেই। দ্বিতীয়ত খারাপ লাগার সন্দেহ হলেও জায়েয নেই। তৃতীয়ত যদি খারাপ না লাগা ও কষ্ট না পাওয়া নিশ্চিত হয়, তাহলে জায়েয আছে। এগুলো যেহেতু খুবই নাযুক ও সংবেদন -শীল বিষয় সেহেতু অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।

আল্লাহ তা‘আলা গীবতের গোনাহ থেকে আমাদের বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন, আমীন।   কোরআনুল কারীমের এই যে মযমূন, গীবত করার অর্থ হলো মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া, এটা যে কত বড় সত্য তা আমাদের মত মুর্দা দিলের মানুষ হয়ত অনুভব করতে পারে না। তবে ছাহাবা কেরাম, যারা ছিলেন যিন্দা দিলের ইনসান, তাঁদের জীবনে আল্লাহ তা‘আলা এটা বাস্তবেও দেখিয়েছেন, যাতে উম্মতের শিক্ষা হয়। বর্ণিত আছে, দুই ছাহাবিয়া রোযা অবস্থায় গীবত করেছিলেন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে আদেশ করলেন থুথু ফেলার। দেখা গেলো, থুথুর সঙ্গে রক্ত এসেছে। তখন তিনি বললেন, এ রক্ত হলো মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার (অর্থাৎ গীবত করার) চিহ্ন।  

 

وآخر دعوانا أن الـحمد لله رب العـالـمـيـن

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা