জিলহজ্ব ১৪৪০ হিঃ (৩/৮)

তোমাদের পাতা

উছমানী সালতানাতের মযলূম খলীফা সুলতান আব্দুল হামীদ রহ

ভুলে যাওয়া ইতিহাস জানতে হবে আবার উছমানী সালতানাতের মযলূম খলীফা সুলতান আব্দুল হামীদ রহ ৬

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

ভুলে যাওয়া ইতিহাস জানতে হবে আবার 

 উছমানী সালতানাতের মযলূম খলীফা সুলতান আব্দুল হামীদ রহ

 ৬

ইতিহাসের পাতা এখন আমাদের সামনে তুলে ধরেছে, খেলাফাতে উছমানিয়ার বড় বড় ওযীর আমলারা কিভাবে কোণঠাসা করে রেখেছিল তরুণ খলীফা সুলতান আব্দুল হামীদকে। সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে বলা যায়, ‘বুঝে বা না বুঝে’ নিজেদের বিশ্বস্ততা তারা বিকিয়ে দিয়েছিল উম্মাহর শত্রুদের কাছে। সালতানাতের স্পর্শকাতর বিভিন্ন বিষয়ে বড় থেকে বড় এবং সুদূর প্রভাব-বিস্তারকারী একেকটি সিদ্ধান্ত তারা নিয়ে নিত। এমনকি খলীফাকে জানানোরও দায় বোধ করতো না। তারপর হঠকারী পদক্ষেপগুলোর চরম বিপর্যয়কর ফল যখন সামনে আসতো তখন তার সব দায় চাপানো হত হাত- পা বাঁধা খলীফার কাঁধে। সবচে’ কাছের এবং বিশ্বস্ত লোকদেরও যেন বিশ্বাস করার উপায় ছিল না খলীফার। এই পর্বতপরিমাণ প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রজ্ঞাবান খলীফা আব্দুল হামীদ দায়িত্ব গ্রহণের পর মুহূর্ত থেকেই, বরং তারও আগে থেকে বিশ্বস্ত ও আস্থাযোগ্য কিছু মানুষকে নিজের চারপাশে একত্র করার চেষ্টা করছিলেন। এভাবে ধীরে ধীরে তিনি তার অবস্থান কিছুটা মজবূত করার কাজে তৎপর হয়েছিলেন। সেই গুটি কয়েক ‘কাছের’ মানুষেরই একজন হলেন খলীফার একান্ত সহকারী সাইদ পাশা। খলীফা আব্দুল হামীদ যখন শাহযাদা আব্দুল হামীদ তখন থেকেই পাশাকে তিনি পাশে রেখেছিলেন এবং গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু হায়, অভাগা যেদিকে তাকায়...!

এক দিন এই সাঈদ পাশাও মুখোশ খুলে নিজের কদর্য চেহারা নিয়ে খলীফার সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন। খলীফা আব্দুল হামীদ তখন যেন অবাক হওয়ার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেললেন! তিনি শুধু ভাবলেন, কারা তাহলে فمنهم شقي وسعيد এর দ্বিতীয় দল? এখানে তো তাঁর দীর্ঘ দিনের পরিচিত ও পরীক্ষিত সাঈদও ‘শাকী’ প্রমাণিত হলো! এই কেয়ামততুল্য পরিস্থিতির মুকাবেলায় তিনি তাহলে কোথায় যাবেন, কার উপর আস্থা রাখবেন?

যথাসময়ে এই সাঈদ পাশা সম্পর্কে আমরা আরো আলোচনা  করব ইনশাআল্লাহ।

তারসানা সম্মেলনে খেলাফাতের প্রতিনিধি সাফওয়াত পাশা, আদহাম পাশা ও মিদহাত পাশাদের অদূরদর্শী (বা অতিধূর্ত) অবস্থান যখন উদ্ভূত পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে তখন তাদেরকে এড়িয়ে খলীফা আব্দুল হামীদ সরাসরি আলোচনার জন্য তার একান্ত সহকারী সাঈদ পাশাকে প্রেরণ করলেন। লক্ষ্য করুন, খলীফা তাঁর পক্ষ হতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপর আস্থা রাখতে পারছেন না, তাদের এড়িয়ে তিনি সরাসারি প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করার উদ্যোগ নিচ্ছেন। তখনকার আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে খলীফা আব্দুল হামীদের জন্য এটা ছিলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু খেলাফতের স্বার্থে এ পদক্ষেপ গ্রহণ করা ছাড়া মযলূম খলীফার তখন কোন উপায়ও ছিলো না।

যাই হোক, সর্বোচ্চ গোপনীয়তা ও সতর্কতা অবলম্বন করে সবার অজ্ঞাতে খলীফা আব্দুল হামীদ এ পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন, আর সাঈদ পাশা তারসানা সম্মেলনের মূল উদ্যোক্তা ইংল্যা-ের প্রতিনিধি লর্ড সালিসবুরীর সাথে খলীফার পক্ষ হতে সাক্ষাৎ করলেন। এভাবেই নিসঙ্গ খলীফা আব্দুল হামীদ চরম নিরুপায় অবস্থায়ও সাধ্যের সর্বোচ্চটুকু ব্যয় করে ‘কিছু একটা’ করার চেষ্টা করে গেলেন। এবং আল্লাহ্র ইচ্ছায় তিনি কিছুটা সফলও হলেন। অতুলনীয় কূটনৈতিক দক্ষতা ও প্রজ্ঞা ব্যবহার করে, নরমে এবং এমন কোমরভাঙ্গা অবস্থায় যতটা সম্ভব ততটা গরমে ইংরেজ লর্ডকে  তিনি বোঝাতে সক্ষম হলেন যে, ‘যা হতে যাচ্ছে’ তাতে খলীফা ও খেলাফতের বড় ধরনের ক্ষতি হলেও লর্ডের নিজের দেশ রাশিয়ার হাতে কতটা ‘নাজেহাল’ হবে। দীর্ঘ দরকষাকষির পর খেলাফাতের উপর চাপিয়ে দেয়া অন্যায় দাবি এবং শর্তগুলো কিছুটা লাঘব করার বিষয়ে তিনি লর্ডকে রাজী করতে সক্ষম হলেন। একটা শর্ত ছিলো, বৃহৎশক্তিগুলোর আরোপিত শর্তসমূহ সঠিকভাবে পালন করা হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য খেলাফাতের ভূখ-ে পাঁচ হাজার সৈন্যের নির্বাচিত একটা বাহিনী সার্বক্ষণিক অবস্থান করবে। বলাবাহুল্য এটা একদিকে ছিলো চরম অপমানজনক শর্ত, অন্যদিকে খেলাফতের অস্তিত্বের জন্যও ছিলো হুমুকিপূর্ণ। পরিস্থিতি তো ছিলো এমন যে, এ ‘লোকমাটাও’ চুপচাপ গিলে ফেলা ছাড়া খেলাফতের সামনে কোন বিকল্প ছিলো না। ভাবতে অবাক লাগে, এমন দুর্বল ও নড়বড়ে অবস্থানে দাঁড়িয়েও খলীফা তাঁর ব্যক্তিগত গোপন কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে উক্ত ধারাটি চুক্তি থেকে বাদ দেয়ার বিষয়ে লর্ডকে সম্মত করে ছাড়লেন। একইভাবে আরেকটি শর্ত ছিলো খেলাফাতের নিয়ন্ত্রণাধীন বসনিয়া ও হার্জেগোভেনায় খৃস্টান প্রশাসক নিয়োগ করা। এ অপমানজনক ও ক্ষতিকর শর্তটিকেও একটু সহজ করে (এক মেয়াদের জন্য) এ বন্ধনীটি যুক্ত করা হলো খলীফার অনমনীয়তার কারণে। নিজেদের যারা খলীফার চেয়ে অনেক বেশী যোগ্য ও অভিজ্ঞ ভাবছিল, সেই ঝানু পাশাদের অপরিপক্ব এবং হঠকারী সব সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ যখন খেলাফাতকে একের পর এক বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে তখন এভাবেই নিঃসঙ্গ যোদ্ধা তরুণ খলীফা আব্দুল হামীদ একক প্রচেষ্টায় অসামান্য কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দিয়ে খেলাফাতের আরো বড় বিপর্যয় কিছুটা হলেও লাঘব করতে, অন্তত বিলম্বিত করতে সফল হলেন। আফসোস! যামনা যদি খলীফা আব্দুল হামীদকে একটু সঙ্গ দিত, কিংবা অন্তত আরো কিছুকাল আগে যদি উম্মাহ্ তার সঙ্গ লাভে ধন্য হত। কিন্তু হায়! শত্রুর কালো হাত যে ততদিনে উম্মাহ্র শাহরগ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে! মিদহাত পাশার মত শত্রুর ক্রিড়নক যারা, তাদের হাতেই ছিলো তখন খেলাফাতের সব নিয়ন্ত্রণ। তাই শত্রুর থাবা থেকে খেলাফাতকে রক্ষার জন্য খলীফা আব্দুল হামীদের এই মাটি কামড়ানো প্রচেষ্টাও যেন বিলীন হয়ে গেল ধূর্ত পাশাদের হঠকারিতার চোরাবালিতে। লাগাতার স্বেচ্ছাচার ও হঠকারিতার মাধ্যমে যারা এতদিন খেলাফাতকে সর্বনাশের চূড়ান্ত পর্যায়ে এনে ছেড়েছে তারাই হঠাৎ খেলাফাতের দরদী সেজে বসলো। ‘খেলাফাতের জন্য চরম ক্ষতিকর’, ‘চরম অপমানজনক’ ইত্যাদি বিভিন্ন ধুয়া তুলে তারাসানা সম্মেলনের সকল দাবি ও শর্ত তারা প্রত্যাখ্যানের চরম হঠকারী সিদ্ধান্ত নিল, যা পাশাদের জন্য সস্তা ‘বাহবা’ বয়ে আনলেও খলীফা হয়ে পড়লেন অস্থির, পেরেশান ও দিশেহারা। কারণ এটা তো পরিষ্কার ছিল যে, ইস্তাম্বুল সম্মেলন ব্যর্থ হওয়ার অর্থ  হল খেলাফাতকে আরো বড় বিপর্যয় তথা রুশআগ্রাসনের মুখে ঠেলে দেয়া। সামরিক, অর্থনৈতিক এবং বিশ^পরিস্থিতি, কোন দিক থেকেই রুশ আগ্রাসনের মোকাবেলার সামর্থ্য তখন খেলাফাতের ছিল না।

আসলে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে যে, পাশারা যা করেছে, সেটা তাদের অজ্ঞতা ছিল না, ছিল শত্রুশক্তির প্রতি তাদের বিশ^স্ততা এবং খেলাফতের প্রতি তাদের বিশ্বাস-ঘাতকতা। ইতিহাস তো এখন দ্ব্যর্থহীনভাবে এটাও প্রমাণ করছে যে, পাশাচক্রের প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল শত্রুর পরিকল্পিত এবং নির্দেশিত।

এতে অবশ্য সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে, ইস্তাম্বুল-সম্মেলনে ইউরোপীয়রা খেলাফাতের হাতে দাবি দাওয়ার যে ফর্দ ধরিয়ে দিয়েছিল, কোন আত্মমর্যাদাশীল ও গায়রতসম্পন্ন জাতির পক্ষে তা মেনে নেয়া ছিল কঠিন, কিন্তু তিক্ত হলেও বাস্তব অবস্থা ছিল এই যে, এর কোন বিকল্পও ছিল না তখন খেলাফাতের সামনে। পাশাচক্রের লাগাতার নির্বুদ্ধিতা ও হঠকারিতা (অথবা সুপরিকল্পিত চক্রান্তের) ফলে যে মহাসঙ্কটের আবর্তে খেলাফাত তখন নিপতিত, খলীফা আব্দুল হামীদ চেষ্টা করছিলেন আলোচনার মাধ্যমে যতটা সম্ভব কম ক্ষতি স্বীকার করে খেলাফাতকে তা থেকে বের করে আনতে। সঙ্ঘাত এড়িয়ে সর্বোচ্চ কূটনৈতিক দরকষাকষির মাধ্যমে যতটা না দিলেই নয় ততটুকুই শুধু দিয়ে প্রস্তুতির জন্য কিছু সময় আদায় করে নেয়া- শত্রুর মোকাবেলায় শুরু থেকে শেষ এটাই ছিল বিচক্ষণ ও প্রাজ্ঞ খলীফা আব্দুল হামীদের সুচিন্তিত কর্মকৌশল। কিন্তু ঘরের ‘মিত্র’রাই বারবার ব্যর্থ করে দিয়েছে তার সকল প্রচেষ্ট এবং শেষ পর্যন্ত...।

ঐ সময় রাশিয়ার সঙ্গে সঙ্ঘাত কী ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ডেকে আনবে তা নিশ্চিতভাবে জেনেও পাশারা খেলাফাতকে সে দিকেই ঠেলে দিচ্ছিল। খলীফাকে অগ্রাহ্য করে, তাঁর প্রজ্ঞাপূর্ণ মতামতকে ( হ্যাঁ তাদের সমনে নিজের মতটুকুই শুধু তুলে ধরার সুযোগ ছিল খলীফার, তাদের প্রতি কোন আদেশ জারী করার নয়) উপেক্ষা করে শত্রুকে আগ্রাসনের সুযোগ করে দেয়াই যেন ছিলো পাশা-চক্রের মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্যেই ইস্তাম্বুলসম্মেলনের ‘অপমানজনক’ প্রস্তাব তারা প্রত্যাখান করলো। তাদের যুক্তিটা ছিলো বেশ চমৎকার। অর্থাৎ খেলাফাত এখন সংবিধান দ্বারা পরিচালিত। আর এসকল দাবি দাওয়া কানূনে আসাসী বা সংবিধানের অমূক অমূক ধারার পরিপন্থি। সুতরাং তা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তাছাড়া কানূনে আসাসী বা সংবিধান প্রনয়ণের  মাধ্যমে খেলাফতে উছমানীয়া এখন একটি সংবিধানিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়েছে, যেখানে জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সংসদই চূড়ান্ত ফায়সালার অধিকার রাখে। সুতরাং নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে এসব বিষয়ে কোন কিছু বলা সম্ভব নয়। খলীফার মোহরে পাশাচক্র যখন এই জবাব সম্মেলনে পেশ করলো তখন প্রধান আলোচক সালিসবুরি হতবাক হয়ে ঘোষণা করলেন, এ পরিস্থিতিতে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার তাহলে আর কোন অর্থ থাকে না।

বৃটিশ প্রতিনিধি লর্ড সালিসবুরির মত বিচক্ষণ কূটনীতিকের বুঝতে বাকি ছিলো না যে, ইস্তাম্বুল- সম্মেলন ব্যর্থ হলে ইউরোপীয়স্বার্থ কতটা হুমকির মুখে পড়বে এবং রাশিয়ার জন্য ইউরোপের মাটি কতটা ‘নরম’ হয়ে দেখা দেবে! তাই তিনি খেলাফতের স্বার্থের চেয়ে বেশী ইউরোপীয় স্বার্থের চিন্তায় উৎকণ্ঠিত হয়ে সম্মেলনের শেষ মুহূর্তে সরাসরি খলীফার সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলোচনার জন্য তোপকাপিতে উপস্থিত হলেন। খলীফার সঙ্গে তার দীর্ঘ বৈঠক হল। মুতারজিম বা অনুবাদক হিসেবে ছিলেন খলীফার একান্ত সহকারী সাঈদ পাশা। এ বৈঠকে সালিসবুরী খলীফার সামনে পরাশক্তিগুলোর পক্ষ থেকে সর্বশেষ সংশোধিত প্রস্তাবসমূহ পেশ করলেন এবং বললেন এর চেয়ে বেশী ছাড় দিতে কাউকে রাযি করানো সম্ভব নয়। যদি এ সংশোধিত প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করা হয় তাহলে কালক্ষেপণ না করে আলোচকরা ইস্তাম্বুল ত্যাগ করবে এবং পরবর্তী যে কোন পরিস্থিতির জন্য উছমানীরাই দায়ী থাকবে। তিনি আরো বললেন, ‘এ মুহূর্তে খেলাফাত সম্পূর্ণ বন্ধুহীন অবস্থায় আছে। রাশিয়ার আগ্রাসনের মুখে কাউকেই সে পাশে পাবে না। আর এককভাবে রাশিয়া এবং তার দোসর বলকান বিদ্রোহিদের মোকাবেলা করার মত অর্থনৈতিক ও সামরিক কোন শক্তিই খেলাফাতের নেই।’

খলীফা আব্দুল হামীদের জন্য এটা নতুন কোন তথ্য ছিল না এবং করণীয় সম্পর্কেও তাঁর মনে কোন দ্বিধা ছিল না। কিন্তু...।

ইস্তাম্বুলের আকাশে আসন্ন ঝড়ের  ঘনঘটার মাঝে অতল গহ্বরের দিকে ধাবমান ভাঙ্গা কিশতির নিঃসঙ্গ নাবিক খলীফা আব্দুল হামীদ তার ওযীর-আমলাদের ডাকলেন উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য। তিনি তাদের কাছে খেলাফাতের বিভিন্ন বিভাগের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলেন। বিশেষ করে সামরিক বিভাগ এবং অর্থনৈতিক বিভাগের বর্তমান অবস্থা পূর্ণ বিস্তারিত জানতে চাইলেন। এর অর্থ এ নয় যে, খলীফা এ বিষয়ে বেখবর ছিলেন। সবই তাঁর জানা ছিল। তিনি শুধু তাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে চাচ্ছিলেন। তাতেও যদি তাদের হুঁশ হয়! কিন্তু খেলাফাতের এত বড় বড় পদ দখল করে থাকা লোকগুলোর যে অবস্থা তখন প্রকাশ পেল সেটাই যথেষ্ট সমগ্র দাওলাতে উছমানিয়ার তখনকার অবস্থা বোঝার জন্য। খলীফার প্রশ্নের কোন সদুত্তর তারা দিতে পারলো না কিংবা দিতে চাইলো না। প্রশ্নের উত্তরে তারা বিশৃংখলভাবে পরস্পরবিরোধী বিভিন্ন তথ্য দিতে

থাকলো। আসলে  খলীফার কাছ থেকে এ ধরণের কোন প্রশ্ন শোনার এবং তার উত্তর দেয়ার কোন প্রস্তুতি তাদের ছিল না। এরূপ বিশৃংখল অবস্থায় খলীফা আব্দুল হামীদ খুবই অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, আপনারা পাশের কামরায় যান; প্রথমে নিজেরা একমত হোন, তারপর তা আমার সামনে পেশ করুন। খলীফার সাথে এই ছিল তাদের আচরণ এবং এই ওযীর আমলাদের নিয়েই খেলাফাত পরিচালনার মহাদায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল তরুন খলীফা আব্দুল হামীদের কাঁধে। সুতরাং রাহিমাল্লাহু আবদাল হামীদ!

কিছুক্ষণ পর কুচক্রির দল আবার হাজির হলো খলীফার সামনে এবং এই ছিল তাদের সর্বসম্মত উত্তর, ‘মহামান্য! এটা (রাশিয়ার আগ্রসনের হুমকি)) আমাদের মর্যাদার প্রশ্ন। আর এ ধরণের পরিস্থিতিতে ফায়সালা না অর্থনৈতিক সামর্থ্য বিবেচনায় হয়, না সামরিক শক্তি বিবেচনায়।

মহামান্য! আমাদের পূর্বপুরুষগণ একদিন যেমন মাত্র চারশ সৈন্যের বাহিনী নিয়ে আনাতোলিয়া জয় করেছিলেন একইভাবে আমাদের সংখ্যা আবার সেই চারশ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমরা লড়তে প্রস্তুত।

এমন সঙ্কটের মুহূর্তে একটি ভুল সিদ্ধান্ত যেখানে ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিতে পারে, এমন দুর্যোগের মুহূর্তে প্রতিটি পরামর্শ ও ফায়সালা যেখানে হওয়া উচিৎ পরিপূর্ণ প্রজ্ঞা ও সতর্কতার আলোকে তখন এ-ই ছিল খলীফার প্রতি খেলাফাতের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ওযীরে আযম মিদহাত পাশা এবং তার অনুচরদের পরামর্শ (ফায়সালা)। এ ঘটনা উল্লেখ করে সাঈদ পাশা তার আত্মজীবনতে লিখেছেন, ‘নির্বুদ্ধিতা এমনও হতে পারে! এভাবে তারা খেলাফাতের অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছিল।’

সমসাময়িক ঐতিহাসিক জুদাত পাশা যিনি কয়েক বছর আইন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং যিনি ছিলেন নর্ব্যতুর্কিদের গুরুত্বপূর্ণ একজন নীতিনির্ধারক, তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ উসমানী ইতিহাসে লিখেছেন, ‘মিদহাত পাশা ও... এরাই দাওয়লাতে উছমানীয়াকে (রাশিয়ার সাথে) যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। খলীফা আব্দুল হামীদ তো দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছিলেন, যুদ্ধ কী ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। তিনি বৃথাই মিদহাত পাশাদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করে গেলেন।

কিন্তু মিদহাত পাশারা সর্বশক্তি ব্যয় করে যুদ্ধের প্রচারণা চালিয়ে

গেল এবং পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে, যে-ই এর বিরোধিতা করতো তাকেই দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দেয়া হতো। এমনকি এক পর্যায়ে যুদ্ধের বিরোধিতার ক্ষেত্রে খলীফার সাথে একমত পোষণ করার কারণে খলীফার একান্ত সহকারী সাঈদ পাশার প্রতিও ভীরুতা ও বিশ্বাসঘাতকতার অপবাদ আরোপ করলো মিদাহাত পাশা যা আসলে খলীফার প্রতিই প্রচ্ছন্ন একটি হুমকি ছিল।

***

মোটকথা, ‘উছমানী’ প্রত্যাখ্যানের কারণ দর্শিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ইস্তাম্বুল সম্মেলনের ব্যর্থতা ঘোষণা করা হলো এবং পরদিনই অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর প্রতিনিধিরা ইস্তাম্বুল ত্যাগ করল।

ইউরোপের ভিতরে রাশিয়ার ‘প্রবেশ’ ঠেকাতে এবং আরো কিছু অলিখিত স্বার্থচিন্তায় বৃটিশ ও অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তি যেহেতু  চাচ্ছিল আপাতত সঙ্ঘাত

এড়িয়ে যাওয়ার একটা পথ বের করতে সেহেতু রাশিয়ার প্রতিনিধি ছাড়া আর সবাই হতাশা নিয়েই নিজ নিজ দেশে ফিরে গিয়েছিলেন।

এটা তো পরিষ্কার ছিলো যে, আলোচনার টেবিলে খেলাফাতই সবচেয়ে বেকায়দা অবস্থানের সবচে’ দুর্বল পক্ষ। তারপরো  বিচক্ষণ খলীফা আব্দুল হামিদ ইউরোপীয় শক্তিবর্গের স্বার্থসঙ্ঘাতকে কাজে লাগিয়ে যতটা সম্ভব সুবিধা আদায় করে নেয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন। সুতরাং বলা যায়, ইস্তাম্বুলসম্মেলনের ব্যর্থতার জন্য সবচে’ বেশী কষ্ট ছিলো স্বয়ং খলীফা আব্দুল হামীদের। তার এটা অজানা ছিলো না যে, বলকান অঞ্চলের বিদ্রোহী খৃস্টানদের রক্ষার অজুহাতে রাশিয়া খেলাফাতের উপর আগ্রাসন চালানোর জন্য যেভাবে মুখিয়ে আছে তা ঠেকানো জন্য ইস্তাম্বুলসম্মেলনই ছিল শেষসুযোগ। অন্যভাবে বলা যায়, ছোট ক্ষতি মেনে নিয়ে বড় ক্ষতি থেকে বাঁচার শেষ সুযোগ ছিল এই সম্মেলন। কিন্তু মিদহাত পাশা ও তার অনুচরদের গোঁয়ার্তুমি ও নির্বুদ্ধিতায় সেই সুযোগটি শেষপর্যন্ত হাতছাড়া হয়ে গেল, যদিও বেখবর জনসাধারণের পর্যায়ে খলীফা হলেন বদনামের উপর বদনাম, আর পাশাচক্র পেলো সস্তা সাধুবাদ ও জাতীয় বীরের সম্মান।

ইস্তাম্বুল সম্মেলনের সকল প্রস্তাব প্রত্যখ্যান করা তথা খেলাফাতকে রাশিয়ার আগ্রাসনের মুখে ঠেলে দেয়ার বিষয়ে মিদহাত পাশাদের ফায়সাল তো চূড়ান্তই ছিল কিন্তু নব্যতুর্কিদের সদ্যঘোষিত সংবিধান অনুযায়ী চূড়ান্ত ফায়সালার জন্য নির্বাচিত সংসদের সিদ্ধান্ত জরুরী ছিল। তবে সেটা যেহেতু সময়সাপেক্ষ বিষয় তাই নিজেদের সিদ্ধান্তের সঙ্গে আইনের ছাপ যুক্ত করার জন্য মিদহাত পাশা রাষ্ট্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি জরুরী অধিবেশনের আয়োজন করলেন। খেলাফাতে ইসলামিয়ার এমন মহাগুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে আলোচনার জন্য মিদহাত পাশা যাদের একত্র করেছিলেন তাদের সম্পর্কে ছোট্ট একটা ‘জানকারি’ ও তথ্য হয়ত আমাদের বুঝতে সাহয্য করবে যে, আসলে কি নাটক সেখানে মঞ্চস্থ হচ্ছিল। মিদহাত পাশার আয়োজিত সেই জরুরী অধিবেশনে দুইশ চল্লিশজন ‘বিশিষ্ট’ ব্যক্তি আমন্ত্রিত হয়েছিলেন, যাদের মধ্যে ষাটজন ছিল খৃস্টান ও ইহুদি। বাকিরা মুসলিম। সেই মুসলিমদের মধ্যে কতজনের আনুগত্য কোন্ দিকে ছিলো তা বোঝার জন্য তো মিদহাত পাশার নির্বাচনই হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক!

 (চলবে ইনশাআল্লাহ

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা