কাশ্মীরসংখ্যা

তোমাদের পাতা

ফিলিস্তীনের গাযা এবং কাশ্মীরের গাযা

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

ফিলিস্তীনের গাযা এবং কাশ্মীরের গাযা

প্রতিরোধের অনন্য উদাহরণ!

স্বদেশভূমির স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত বিশ্বের বিভিন্ন জাতির প্রতিরোধের ইতিহাসে ফিলিস্তীনের গাযা অনন্য প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। তেমনি অবরুদ্ধ কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরের উপকণ্ঠে অবস্থিত ছোট্ট জনপদ ‘সৌপাড়া’ ভারতীয় দখলদারির বিরুদ্ধে কাশ্মীরী মুসলমানদের প্রতিরোধের অনন্য প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। এ জন্য  সৌপাড়াকে বলা হয়, কাশ্মীরের গাযা! ভারতীয় বাহিনী বারবার সর্বাত্মক চেষ্টা করেও, এমনকি হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহার করেও সৌপাড়ায় অনুপ্রবেশ করতে পারেনি! এমনই এক ইস্পাত কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে ওখানকার জানবাজ তরুণদল, শুধু পাথর ছুঁড়ে। মরিচের গুঁড়ো ও টিয়ার গ্যাস থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রতিরোধকারীরা লবণাক্ত পানি ব্যবহার করছে। আর ছররাগুলি থেকে বাঁচার জন্য ব্যবহার করছে হেলমেট।

সৌপাড়ার প্রতিরোধের মূল কেন্দ্র হচ্ছে জেনাব সাঈ মসজিদ। মসজিদের মিনার থেকে নিয়মিত জিহাদ ও প্রতিরোধের আহ্বান এবং জিহাদি তারানা প্রচারিত হয়। লেকের পাশে অবস্থিত ঘনবসতিপূর্ণ  সৌপাড়ায় দুই হাজার পরিবার বাস করে, যার তিনদিক নিরাপত্তা বাহিনী ঘিরে রেখেছে।

প্রতিরোধে নিয়োজিত যুবক মুফীদ বলেন, ওরা কেবল আমাদের লাশের উপর দিয়েই সৌপাড়ায় ঢুকতে পারবে। গাযা যেমন দখলদার ইসরাইলকে প্রতিরোধ করছে, আমরাও সর্বশক্তি দিয়ে পিতৃভূমিকে রক্ষা করবো।

সাংবিধানিক আগ্রাসনের পর সম্প্রতি ভারতীয় বাহিনীর একটা সম্মিলিত হামলা সৌপাড়ার নিরস্ত্র জনতা সফলভাবে প্রতিহত করেছে, যদিও বহু কাশ্মীরী তাতে হতাহত হয়েছে। ঐ প্রতিরোধে নাহিদা নামের এক কাশ্মীরী মায়ের তিন সন্তান একই সঙ্গে শহীদ হয়েছেন, তিনি প্রত্যয়দৃপ্ত কণ্ঠে বলেন, ভারত আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে, কিন্তু তারা ব্যর্থ হবে। শেষপর্যন্ত আমরা তাদের পরাজিত করবো। আগ্রাসন একশ বছর স্থায়ী হলেও ওরা আমাদের হারাতে পারবে না। আমরা আত্মসমর্পণ করবো না।

সৌরাপাড়ার প্রতিরোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে সারা কাশ্মীরে একই ভাবে চলছে জানকবুল প্রতিরোধ, যদিও ভারত বিভিন্ন কৌশলে প্রচার করছে যে, কাশ্মীর শান্ত রয়েছে। হাঁ, আশিলাখ নিরস্ত্র মানুষের প্রতিরোধের মোকাবেলা করছে দশলাখ সশস্ত্র সৈন্য। পরিস্থিতি ‘শান্ত’ থাকতেই পারে।

ভারতের বিখ্যাত মানবাধিকার কর্মী অরুন্ধতী রায় যুক্তিসঙ্গত প্রশ্নই তুলেছেন, ‘৫ই আগস্ট ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের মধ্য দিয়ে কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা কেড়ে নেয়ার পর ভারত সরকার নিজেই যেখানে দাবী করছে যে, গুটিকয়েক জঙ্গী ছাড়া বেশীর ভাগ মানুষ ভারতের পক্ষে রয়েছে, সেখানে লাখ লাখ সৈন্য কী করছে? সেনাবাহিনীর জোয়ানদের মধ্যেই বা কেন আত্মহত্যার এমন আশঙ্কাজনক প্রবণতা?

উল্লেখ্য সৌরাপাড়া হচ্ছে কাশ্মীরের একসময়ের জনপ্রিয় নেতা সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শেখ আব্দুল্লাহ্র জন্মস্থান। তথাকথিত স্বায়ত্তশাসনের শর্তে তিনি কাশ্মীরকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন, যে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার এখন কেড়ে নেয়া হলো ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করার মাধ্যমে।

শেখ আব্দুল্লাহর ন্যাশনাল কন্ফারেন্স পার্টি কয়েক দশক কাশ্মীর শাসন করেছে। আব্দুল্লাহ্র পর তার ছেলে ফারুক আব্দুল্লাহ্ এবং নাতী ওমর আব্দুল্লাহ মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন।

আব্দুল্লাহ্র দুর্ভাগ্য, কাশ্মীরের জনগণকে ধোকা দিলেও নেহরু ও ভারত সরকারের কাছ থেকে তিনি জেলখানার পুরস্কারই পেয়েছেন। আর এখন তার ছেলে ও নাতি বন্দী অবস্থায় চোখের পানি ফেলছেন।

সৌরাপাড়ার প্রবীণ বাসিন্দা রফীক মানছূর শাহ যিনি শেখ আব্দুল্লাহ্র আমল দেখেছেন, বলেন, ক্ষমতার মোহে অন্ধ শেখের অমার্জনীয় ভুলের কারণে আমরা ভারতের দাসে পরিণত হয়েছি। এখন আমরা তার জন্মভূমি থেকেই তার ভুলের কাফফারা আদায়ের চেষ্টা করছি। আমরা জান দেবো, তবে গোলামির যিল্লতি কিছুতেই কবুল করবো না। *

 

এক কাশ্মীরী তরুণীর

অশ্রু দিয়ে লেখা চিঠি!

(চাঁদের উদ্দেশ্যে প্রেরিত চন্দ্রযান২ ছিলো ভারতের জন্য মর্যাদার প্রশ্ন। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণের কথা ছিলো চন্দ্রযানটির। হাজার হাজার কোটি রুপি ব্যয়ে পরিচালিত এ চন্দ্রযান২ সফলতার সঙ্গে অবতরণ করতে পারলে ইতিহাস রচনা হতো ভারতের। আমেরিকা, রাশিয়া ও চীনের পর ভারতই হতো চাঁদে অবতরণকারী তৃতীয় দেশ। তাছাড়া চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণকারী প্রথম দেশ হতো ভারত।

কিন্তু কিছুই হয়নি। চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশের পর দ্রুতগতির কারণে চাঁদের মাটিতে আছড়ে পরে চন্দ্রযানটি। গুঁড়িয়ে যায় ভারতের সবচে’ ব্যয়বহুল স্বপ্নটি। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় নিয়ন্ত্রণকারী ইসরো-এর সঙ্গে, যেমন ঘটেছিলো আরো কিছুদিন আগে ইসরাইলের ক্ষেত্রে।

এমন ‘মর্মন্তুদ’ ব্যর্থতায় ইসরো প্রধান কে শিবন কতটা যন্ত্রণাদগ্ধ হয়েছেন তা তো বলাই বাহুল্য।

তো সেকথা উল্লেখ করে ইসরো প্রধানকে একটি মর্মস্পর্শী চিঠি লিখেছেন   সৈয়দা ফায়যান বুখারী নামে কাশ্মীরের এক মুসলিম তরুণী। এখানে আমরা চিঠিটির সংক্ষিপ্ত রূপ তুলে ধরছি।)

***

শ্রদ্ধেয় ইসরো প্রধান, একজন কাশ্মীরী হিসাবে আমি অনুভব করি, প্রিয়জনের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে কতটা যন্ত্রণা হয়! আপনি এবং আপনার দল চেয়েছেন ভারতকে গর্বিত করতে, কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সফলতার এত কাছে এসে আপনি ব্যর্থ হয়েছেন। আপনি প্রকাশ্যেই ভেঙ্গে পড়েছেন। আপনার অন্তরের যন্ত্রণা আমি অনুভব করি। একজন কাশ্মীরীই শুধু আপনার যন্ত্রণা অনুভব করতে পারবে। কারণ আমি হাজার হাজার কাশ্মীরীর মত অবরুদ্ধ কাশ্মীরে মা-বাবা-ভাইবোন ও আপনজনদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি।

তবে আপনি ভাগ্যবান, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আপনাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত¡না দিয়েছেন। কিন্তু দেখুন, কতটা হতভাগ্য কাশ্মীরের মানুষগুলো। একটা শব্দ খরচ করেও কেউ আমাদের সান্ত¡না দিতে আসেনি। কেউ আমাকে জানাচ্ছে না, বা জানাতে পারছে না, কোথায় আছেন আমার মা, কেমন আছেন তিনি? বেঁচে আছেন? একটুকরো রুটি কি জুটছে তার ভাগ্যে, না...!

হতে পারে, আপনার প্রিয় চন্দ্রযান২ এর সঙ্গে বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ আপনি ফিরে পেলেন। তখন সমগ্র ভারত আপনাকে অভিনন্দন জানাবে, প্রধানমন্ত্রী আপনাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করবেন। কিন্তু তখনো আমি ছটফট করতে থাকবো আমার নিখোঁজ মায়ের জন্য! আমারই মত ছটফট করতে থাকবে হাজারো কাশ্মীরী তাদের প্রিয়জনদের জন্য! আপনার প্রতি আমার সহানুভূতি থাকলো স্যর!

 

কাশ্মীরে এতীমের সংখ্যা শুধু বাড়ছে!

অধিকৃত কাশ্মীরের বর্তমান পরিস্থিতি সম্ভবত আমাদের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। সেনাবাহিনীর ‘অবরোধ’ ১২০ দিন পার হয়ে গিয়েছে।

এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত ত্রিশ বছরে ভারতীয় বাহিনীর নির্মমতার শিকার হয়ে একলাখের বেশী মুসলিম শহীদ হয়েছে। এর মধ্যে কয়েক হাজার শিশু-কিশোরও রয়েছে, যারা সৈন্যদের প্রতি পাথর ছোঁড়ার অপরাধে গুলির নিশানা হয়েছে। অসংখ্য শিশু কিশোর কারা- নির্যাতনও ভোগ করছে।

কাশ্মীর উপত্যকার এখন সবচে’ বড় মানবিক সমস্যা হচ্ছে এতীম শিশু-কিশোরদের প্রতিপালন। কারণ ইতিমধ্যেই এতীমের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছে। একপরিসংখ্যানমতে ১৯৮৯ সালের আগে কাশ্মীরে যেখানে নয়টি এতীমখানা ছিলো সেখানে এখন ছোটবড় এতীমখানার সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। এতীমখানাগুলোর অবস্থা তেমন উন্নত না হলেও অসহায় ও নিরাশ্রয় এতীমদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসাবে সেগুলো প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করছে। কিছু এতীমখানায় বৃত্তিমূলক শিক্ষারও ব্যবস্থা করা হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে তারা স্বাবলম্বী-রূপে জীবন যাপন করতে পারে।

একথা সত্য যে, কাশ্মীর উপত্যকার অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই ভঙ্গুর। ক্ষুধা অনাহার এখন কাশ্মীরী মুসলমানদের নিত্য সঙ্গী। তবে আশা ও সান্ত¡নার বিষয় হলো, এর মধ্যে দয়া, উদারতা, বদান্যতা ও মানবতা-বোধের মহান আদর্শ কাশ্মীরের মুসলমানগণ ধরে রেখেছে। এমন বহু মানুষ রয়েছে যারা খুব নীরবে বিভিন্ন এতীমখানা প্রায় ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালনা করছেন। তারা নিজেরা অভুক্ত থেকেও এতীম ছেলেমেয়েদের দু’টুকরো রুটির ব্যবস্থা করছে এবং যথাসাধ্য শিক্ষা-দীক্ষার ইনতিযামও করছেন।

কাশ্মীরে বেশ কিছু সেবাসংস্থার উদ্যোগে বড় আকারে বহু এতীমখানা পরিচালিত হচ্ছে। বিধবা নারীদের জন্যও রয়েছে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র। একটি প্রসিদ্ধ এতীমখানা হলো সাখাওয়াত সেন্টার। ২০০৫ সালের জুনে প্রতিষ্ঠিত এই এতীমখানার ব্যবস্থাপক মীর মুহম্মদ আশরাফ বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত এখানে বহু এতীম ছেলেমেয়ের শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্থা যেমন করা হয়েছে তেমনি কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের পুনর্বাসিতও করা হয়েছে।

ব্যবস্থাপক মীর মুহম্মদ আরো বলেন, এই সেন্টারের একটি বড় কাজ হলো, এতীম মেয়েদের উপযুক্ত বিবাহের ব্যবস্থা করা। এপর্যন্ত ছয়শ পঞ্চাশজন এতীম মেয়ের বিবাহ সেন্টারের পূর্ণ তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এতীম ও বিধবাদের সংখ্যা দিনদিন যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা অত্যন্ত আশঙ্কা-জনক। আল্লাহ যাদের তাওফীক দিয়েছেন তাদের এতীম প্রতিপালনে আরো এগিয়ে আসা উচিত।

তিনি বলেন, কাশ্মীরী সামাজের একটি ভালো দিক এই যে, খান্দানের লোকেরা তাদের এতীমদের যথাসম্ভব নিজেরাই প্রতিপালনের চেষ্টা করে। খান্দানের এতীম এতীম -খানায় প্রতিপালিত হবে, নিজেদের জন্য এটাকে তারা লজ্জাজনক মনে করে। সমস্ত বিপদে দুর্যোগে আল্লাহ আমাদের হিফাযত করুন, আমীন

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা