রজব ১৪৩০ হিঃ (১২)

তোমাদের পাতা

গন্তব্য কোথায়?

লিখেছেনঃ যোবায়র শামস

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট
এ মর্মানি-ক ঘটনা রক্তাক্ত ইরাকের। উম্মেকসর একটি উপত্যকার নাম। একসময় এমন ছিলো না, কিন' এখন একেবারে জনমানবহীন। তবে আগের মতই সবুজ। কারণ এখনো তার পাশ দিয়ে কুল কুল রবে বয়ে যায় সেই পুরোনো ঝর্ণাটি। আগে পাখী ডাকতো, এখন পাখী ডাকে না। মানুষ পাখী শিকার করে, গুলি করে পাখীর বুক থেকে রক্ত ঝরায়, কিন' মানুষ যখন মানুষ শিকার করে এবং মানুষের বুক থেকে রক্ত ঝরায় তখন তা পাখীদের বুকেও বাজে। গুলি খেয়ে মানুষের লুটিয়ে পড়া পাখীরা দেখতে পারে না। পাখীরা তখন সেখান থেকে পালিয়ে যায় এমন কোথাও যেখানে গোলাগুলির আওয়ায নেই এবং গুলি খাওয়া মানুষের আর্তনাদ নেই। আরো দু’একজন মানুষের সঙ্গে শেখ রফি’ এখনো রয়ে গেছেন উম্মেকসর উপত্যকায়। শৈশবে যে উপত্যকাকে তিনি ভালোবেসেছেন বৃদ্ধ বয়সে খুন ও আগুনের বিভীষিকার মাঝেও সেই প্রিয় উপত্যকাকে তিনি ছেড়ে যেতে পারেননি। এখানে এই উপত্যকার সবুজের সৌন্দর্য এবং ঝর্ণার স্নিগ্ধ সঙ্গীতের সঙ্গে যে জড়িয়ে আছে তার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের অনেক মধুর স্মৃতি! শেখ রফি’ ঝর্ণার কাছে এসে দাঁড়ালেন। চেহায় উৎকণ্ঠা, ভয় ও আশঙ্কার ছাপ স্পষ্ট। তিনি এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন, কিন' যাকে খুঁজছেন তাকে দেখতে পাচ্ছেন না। এমন তো কখনো হয়নি। মশক ভরে পানি নিতে এসে অনেকটা সময় পার হয়ে যাওয়ার পরো ঘরে ফিরে যায়নি! হঠাৎ তার নযরে পড়লো একটু দূরে পড়ে আছে চামড়ার মশকটা। যে আশঙ্কাটা এতক্ষণ বুকের ভিতরে তোলপাড় করছিলো সেটা যেন এখন তার কলজের ভিতরে কামড় বসিয়ে দিলো। মশকে রক্তের দাগ দেখা যায়। তিনি উদ্ভ্রানে-র মত চারদিকে তাকলেন। সৈন্যদের সাজোয়া গাড়ীর চাকার দাগ দেখতে পেলেন। দাগ অনুসরণ করে তিনি এগিয়ে গেলেন। যেন ঘটনার দৃশ্য দেখে ফেলেছেন এখন শুধু রক্তাক্ত মৃতদেহটা দেখতে চাইছেন! এমনই ছিলো তার শুভ্র শশ্রুমণ্ডিত মুখের এবং কম্পিত পদক্ষেপের অভিব্যক্তি। কিছু দূর গিয়ে তিনি দেখতে পেলেন ছোট্ট মৃতদেহটা। অর্ধেক ঝর্ণার পানিতে, অর্ধেক মাটিতে। যেন এখনই তিনি পড়ে যাবেন জ্ঞান হারিয়ে। তবু নিজেকে শক্ত করে রেখেছেন। টলতে টলতে তিনি মৃতদেহের কাছে গেলেন, হাঁটু গেড়ে বসলেন। তার গলা থেকে কোন আর্তনাদ বেরুলো না। শুধু চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। উপত্যকার ঝর্ণায় গিয়ে মিশতে লাগলো তার দু'চোখের নোনা অশ্রুর ঝর্ণা। তিনি যেন প্রাণহীন পাথর! সময় ও পরিপার্শ্বের সব অনুভূতি যেন তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। একসময় তিনি আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকালেন। সেখানে সাদা সাদা মেঘ ছিলো, কিন' শেখ রফি’ যেন সাদা মেঘের গায়ে দেখতে পেলেন তার দশবছরের বালক ছেলের রক্তের ছাপ! তিনি শুধু বলতে পারলেন, ইয়া আল্লাহ! তারপর তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেলো কান্নার তোড়ে। সে কান্না কিছুক্ষণ প্রতিধ্বনিত হলো উপত্যকার পাহাড়ে। অবশ্য নিজেকে সংযমে অনতে তার বেশীক্ষণ লাগলো না। হয়ত তার আশঙ্কা ছিলো শত্রুরা আশেপাশেই কোথাও লুকিয়ে আছে। ইরাকের এক মযলূম বৃদ্ধের কান্না ঐ ভীরু কাপুরুষগুলো দেখে আরো উল্লাস করবে, এটা তিনি সহ্য করতে পারবেন না। এখনো তিনি চান হায়েনার দল তার চোখে যেন অশ্রু দেখতে না পায়, বরং দেখতে পায় ক্রোধের আগুন। তিনি পরম যত্নের সঙ্গে ছেলে সালিমের মৃতদেহটি কাঁধে তুলে নিলেন এবং খুব দৃঢ়ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন। ঘটনার শুরু আরো পিছনে। কিছু দিন আগে স'ানীয় জামে মসজিদের খতীব শেখ রফি'কে ডেকে পাঠিয়েছিলো মার্কিন সৈন্যদের কমান্ডার। এলাকার সন্দেহভাজন যুবকদের তালিকা তৈরী করে দিতে হবে তাকে। বৃদ্ধ খতীব শায়খ রফি’ কিছু বলেননি, শুধু তীব্র ঘৃণা ও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন। সেই দৃষ্টির তাপ ও তীব্রতা সহ্য করতে পারেনি কমান্ডার। নিজের অজ্ঞাতসারেই যেন নামিয়ে নিয়েছিলো তার দৃষ্টি। একটি কথা না বলেই উঠে এসেছিলেন শায়খ রফি’। এর পরিণতি হলো খুবই ভয়াবহ। কমান্ডারের পক্ষ থেকে চিঠি এলা, দু’দিনের মধ্যে যেন তার আদেশ পালিত হয়, অন্যথায়...। সেই অন্যথায়টা লিখতে না পারলে ভালো ছিলো। কিন' জিসমের খুন, ইজ্জতের খুন এবং জিগর ফাটা আর্তনাদের কথা লিখতে গিয়ে যদি বুকে জ্বালা হয়, চোখ ফেটে পানি আসে তাহলে অন-ত এই সান-্বনাটুকু পাবো যে, বহু দূর থেকেও আমি ছিলাম তোমাদের পাশে। কমান্ডার হাজির হলো একদল ক্ষুধার্ত হায়েনাকে সাথে নিয়ে। শায়খ রফির স্ত্রীকে প্রথমে বেয়নেটে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হলো, তারপর তার মৃতদেহ পিষ্ট করা হলো সাজোয়া যানের নীচে। দুই যুবতী মেয়ে সামী‘আ নাহিয়াকে হত্যা করা হলো খেজুর বাগানে একটি খেজুর বৃক্ষের সাথে বেঁধে। চোখের সামনে মেয়েকে শুধু গুলি করে হত্যা করা হলে শায়খ তা সহ্য করে নিতে পারতেন। কিন' তার আগে মেয়ে দু’টি যে পাশবিকতার শিকার হয়েছিলো তা যদি বনের হিংস্র পশুদের সামনে ঘটতো, হয়ত পশুদেরও তা সহ্য হতো না। পশুরা তাদের হিংস্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তো নরপশুদের উপর। হাত-পা বাঁধা শেখ রফি’র কিছুই করার ছিলো না মেয়েদের বুকফাটা আর্তনাদ, আর নরপশুদের অট্টহাসি শোনা ছাড়া। তিনি শুধু কামনা করেছিলেন, মাটি যেন ফেটে যায়, কিংবা আসমান থেকে যেন বজ্রপাত হয়, কিন' হয়নি। বালক ছেলে সালিম সেদিন বেঁচে গিয়েছিলো উম্মেকসরের ঝর্ণা থেকে মশক ভরে পানি আনতে গিয়ে। সেদিন তার জান বেচে ছিলো পানি আনতে গিয়ে, আজ তার জান গেলো পানি আনতে গিয়ে। বৃদ্ধ শায়খ রফি’ বালকের রক্তাক্ত মৃতদেহ কাঁধে ফিরে এলেন বাড়ীতে। স্ত্রী ও দুই মেয়ের পাশে তাকেও দাফন করলেন। একা একা। হয়ত সে এলাকায় তখন কেউ ছিলো না, কিংবা দু’চারজন যারা ছিলো তারা সাহস করে এসে দাঁড়াতে পারেনি বৃদ্ধ শায়খের পাশে। শায়খ রফি আবার তাকালেন আকাশের দিকে। হয়ত জিজ্ঞাসা করলেন, আমার মৃত্যু আসতে আর কত দেরী! বাড়ী ছেড়ে তিনি উম্মেকসর ঝর্ণার কিনাসে এসে দাঁড়ালেন। তারপর একসময় হাঁটতে লাগলেন। কিন' তিনি জানেন না, তার গন-ব্য কোথায়! (সম্পাদক- কয়েকদিন আগে ওবামা মুসলিম বিশ্বের উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইসলাম শানি-র ধর্ম এবং মুসলিমগণ শানি-প্রিয় জাতি। গুটিকতেক উগ্রতাবাদী ও সন্ত্রাসীর কারণে গোটা মুসলিম জাতিকে অভিযুক্ত করা ঠিক নয়। তিনি কি চান, ইরাকে সবাই শায়খ রফির মত শানি-প্রিয় থাকুন। কোন কোন শায়খ রফি যদি, এরকম পাশবিকতার শিকার হওয়ার আগে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়, কিংবা নিজের দেহে বোমা বেঁধে মার্কিন সৈন্যবাহী সাজোয়া যানের নীচে ঝাঁপ দেয় তাহলে কী তাকে তিনি সন্ত্রাসী বলবেন? আর ইসলামকে বলবেন অশানি-র ধর্ম?)
শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা