রমযান ১৪৩০ হিঃ (১৩)

তোমাদের পাতা

গাছের মৃত্যুতে

লিখেছেনঃ নায়িমা খাতুন, গফরগাঁও

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট
গাছের মৃত্যু অনেক দেখেছি; চারা গাছের মৃত্যু, বড় গাছের মৃত্যু এবং বুড়ো গাছের মৃত্যু। এমনকি দেখেছি নিষ্ঠুর হাতে গাছকে হত্যা করার মর্মান্তিক দৃশ্যও। কিন্তু গাছের মৃত্যুতে কাউকে কলমের কালিতে শোক প্রকাশ করতে দেখিনি। পুষ্পের পাতায় লেখা ‘গন্ধরাজ গাছটি মারা গেছে’ পড়ে অনেকের চোখ থেকে অশ্রু ঝরেছে। আমিও কেঁদেছি; আমারও চোখ থেকে অশ্রু ঝরেছে। তবে অন্যের কথা জানি না, আমি মনে হয় বুঝতে পেরেছি গন্ধরাজের মৃত্যুতে আপনার হৃদয়ের ব্যথা ও শোকের পরিমাণ। কারণ আমারও একটি গাছ ছিলো। হয়ত আপনার মত নয় এবং তা ছিলো না কারো দেয়া উপহার, তবু গাছটিকে আমি ভালোবাসতাম এবং অনুভব করতাম, গাছটিও আমাকে ভালোবাসে। আপনার কষ্ট আমি বুঝতে পারি, কারণ আমার কষ্টের পরিমাণ অনেক বেশী। অবাক হচ্ছেন! আচ্ছা বলুন তো, এক মায়ের সন্তানকে কেউ নিষ্ঠুর হাতে হত্যা করলো, আর এক মা নিজের হাতে অসুস্থ সন্তানকে ঔষধ মনে করে বিষের শিশি থেকে বিষ ঢেলে ‘ঔষধ’ খাওয়ালো। দুই মায়ের সন্তান শোক কি এক হবে? এই মা কি কোন দিন পারবে নিজেকে ক্ষমা করতে! আপনার গন্ধরাজ বড় হয়েছিলো অন্যের ঘরের আঙ্গিনায়। সেই লোকটির কাছে বুড়ো গাছটির কোন মূল্য ছিলো না, তাই সে গাছটির গোড়ায় কুড়াল চালিয়েছে। আপনার অনেক কষ্ট হয়েছে। সেই মুহূর্তে যদি আপনি কাছে থাকতেন, গাছটিকে রক্ষা করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু আপনার অজ্ঞাতেই গেছে এ মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড। আপনার কষ্ট হয়েছে। আপনার হৃদয় থেকে রক্ত ঝরেছে। আপনার চোখ থেকে অশ্রু ঝরেছে। আপনার কষ্ট আমি বুঝতে পারি। কিন্তু আপনি কলমের কাছ থেকে সান্ত্বনা পেয়েছেন। আপনি তো কলমের কালিতে চোখের পানি মেশাতে পেরেছেন। আপনি তো আপনার গন্ধরাজের মৃত্যুর কথা একজনকে জানাতে পেরেছেন, একদিন যে আপনাকে গন্ধরাজের চারাটি উপহার দিয়েছিলো! আপনি তো বহু মানুষের সমবেদনা পেয়েছেন। কিন্তু আমি! সেই দুর্ভাগিনী মেয়েটি, একদিন যে ছোট্ট একটি গাছের ডাল লাগিয়েছিলো। কেউ তাকে ভালোবেসে গাছের ডালটি উপহার দেয়নি। বলেনি, নাও, তোমার বাগানে রোপণ করো; আমার স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকুক তোমার বাড়ীর বাগানে এবং তোমার হৃদয়ের উদ্যানে। সে নিজেই চেয়ে এনেছিলো তার বান্ধবীর কাছ থেকে এবং অনেক ভালোবেসে রোপণ করেছিলো বাড়ীর বাগানের এক কোণে। আদরে যত্নে ও পরিচর্যায় গাছটি বড় হয়েছিলো। ছোট্ট মেয়েটিও ধীরে ধীরে বড় হয়েছিলো এবং সেই সবুজ সজীব গাছটির প্রতি তার ভালোবাসা হয়েছিলো গভীর থেকে গভীর। গাছকে ভালোবাসলে গাছ যে কত আপন হয় তা ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছিলো দুর্ভাগিনী সেই মেয়েটি, আমি! গাছটি ধীরে ধীরে বড় হয়েছিলো আমার বাড়ীর বাগানে, কিন্তু আমার মনে হতো, গাছটি যেন সবুজের ছায়াবিস্তার করছে আমার হৃদয়ের উদ্যানে। আসলে আমি বুঝতেই পরিনি, বাড়ীর বাগান এবং হৃদয়ের উদ্যান, কোন গাছটি আসল, কোনটি ছায়া! বহু দিন পর গাছে কলি এলো এবং ফুল ফুটলো। মনে হলো, আমার হৃদয়ের উদ্যানেও কলি এসেছে এবং ফুল ফুটেছে। ফুলের নামটি এখানে অজানাই থাক। কী হবে নাম জেনে গাছই যেখানে হারিয়ে গেছে! শুধু বলতে পারি, ফুলের সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত এবং ফুলের সুবাসে সুরভিত হয়ে উঠেছিলো আমার বাড়ীর বাগান এবং আমার হৃদয়ের উদ্যান। কেউ যদি গাছ থেকে ফুল ছিঁড়তো, আমার কষ্ট হতো। যেন আমার হৃদয়-উদ্যান থেকেই ফুলটি সে ছিঁড়ে নিয়েছে! ভাবতাম, আমার মনে যত কষ্ট হচ্ছে, গাছটির নিশ্চয় তত কষ্ট হয়েছে! মানুষ কীভাবে গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে! গাছকে ব্যথা দেয়! একদিন আমার প্রিয়জন আমার কাছে চেয়ে বসলো একটি ফুল। কী করি! আমি নিজেও তো কখনো গাছ থেকে ফুল ছিঁড়িনি! সে নিজেই গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে নিতে যাচ্ছিলো; আমি বাধা দিয়ে বললাম, দাঁড়াও, আমি নিজেই দিচ্ছি। আমার মনে হলো, অন্য কেউ ছিঁড়লে গাছটি ব্যথা পাবে। আমি গাছটির ডালে কোমল- ভাবে হাত বুলিয়ে আলতোভাবে ফুলটি তুলে আনলাম এবং প্রিয়জনকে উপহার দিলাম। আমার মনে হলো, গাছটির ব্যথা লাগেনি। ফুল ছিঁড়লে গাছের ব্যথা লাগে, আলতো করে তুলে আনলে ব্যথা লাগে না। সেই গাছটি হঠাৎ একদিন মারা গেলো। না, বরং ভুল বুঝে গাছটিকে যেন আমি নিজের হাতে হত্যা করলাম, সেই হতভাগিনী মায়ের মত যে ঔষধ ভেবে অসুস্থ সন্তানের মুখে বিষের শিশি থেকে বিষ ঢেলে দেয়! গাছটি আমার চোখের সামনেই ঝিমিয়ে পড়লো। সবুজ সজীব পাতাগুলো নিস্তেজ হয়ে গেলো এবং ডালগুলো ঢলে পড়লো। গাছটি মরে গেলো। সবকিছু ঘটে গেলো আমার চোখের সামনে এবং আমার নিজের হাতে! হতবুদ্ধির মত আমি শুধু তাকিয়ে থাকলাম। আমি তখন কাঁদতেও ভুলে গেলাম। জানি না, আমার অনুতপ্ত চোখের দু'ফোটা তপ্ত পানি যদি গাছটির গোড়ায় পড়তো তাহলে গাছটি বেঁচে উঠতো কি না! কিন্তু আমার চোখে তখন পানি ছিলো না। কাউকে আমি বলতেও পারিনি, কী হয়েছিলো, কীভাবে গাছটি মারা গেলো। কেউ আমাকে সান্ত্বনা জানাতেও আসেনি। গাছের মৃতুতে গাছের বাবাকে, মাকে, বন্ধুকে সান্ত্বনা জানাতে হয়, সবার জানা থাকে না। বাড়ীর বাগানে গাছটি মারা গিয়েছিলো, কিন্তু আশ্চর্য, হৃদয়-উদ্যানের গাছটি মরেনি! এখনো আছে, তেমনি সবুজ, তেমনি সজীব। এখনো তাতে কলি আসে, ফুল ফোটে। কষ্ট যখন সহ্যের সীমানা পার হয়ে যায়, আমি আমার হৃদয়-উদ্যানের বৃক্ষটির কাছে আশ্রয় খুঁজি। যদি সেখানে সবুজের ছায়ায় একটুখানি সান্ত্বনা পাওয়া যায়! আজ এত বছর আমার হৃদয়ের ক্ষত হৃদয়েই গোপন ছিলো। আপনার লেখা গন্ধরাজের কথা আমাকে নতুন করে যেন ক্ষতবিক্ষত করলো। হৃদয়ের ক্ষত থেকে আবার যেন রক্ত ঝরলো। আমার ব্যথা থেকেই আমি বুঝতে পারলাম আপনার হৃদয়ের ব্যথা। তাই আপনাকে উদ্দেশ্য করে আমার এ লেখা। হয়ত ব্যথিত হৃদয় ব্যথিত হৃদয়কে সান্ত্বনা দিতে পারে এবং ব্যথিত হৃদয় থেকে সান্ত্বনা নিতে পারে। সম্পদক ঃ হৃদয়ের লেখা হৃদয়কে স্পর্শ করে, তোমার লেখাটি আমার হৃদয়কে স্পর্শ করেছে এবং সত্যি সান্ত্বনার পরশ বুলিয়ে দিয়েছে। একথা সত্য যে, আমার প্রিয় গন্ধরাজকে আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না, তবে এখন তার বিরহের ব্যথা হয়ত আরো সহজে সইতে পারবো। আশা করি, তোমার ক্ষেত্রেও একথা সমান সত্য। তোমাকে শেষ যে কথাটি আমি বলতে পারি, তা হলো, তোমার কোন দোষ নেই, তাকদীরের ফায়ছালা কেউ খণ্ডন করতে পারে না; মানুষের ক্ষেত্রেও, পশু-পাখীর ক্ষেত্রেও না, এমনকি বৃক্ষলতার ক্ষেত্রেও না। তবে যেভাবেই মৃত্যু ঘটে থাকুক, সেই বৃক্ষ বড় ভাগ্যবতী যে পেয়েছিলো তোমার মত মমতাময়ী ‘মা’।
শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা