আরাকান সংখ্যা (৩/১)

রোযনামচার পাতা

একটি রোহিঙ্গা শিশুর রোযনামচা

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

কল্পনা /  মুহাম্মাদ বিন মিসবাহ
কত সুন্দর দেশ আমাদের বাংলাদেশ! নদী-নালা আর খালে বিলে, ফলে ফসলে সবুজ শ্যামল এই বাংলাদেশ! এখানে আছে ছবির মত সুন্দর সব গ্রাম। কত রকম ফলের বাগান। গাছের ডালে ডালে আছে কত রকম পাখী, কত রকম তাদের গান! ছেলে মেয়েরা মনের আনন্দে ছুটে বেড়ায়। পাখীরাও কিন্তু তাদের খেলার সাথী। তাই শিশুদের কোলাহলে আর পাখীদের কলরবে কেমন মুখরিত থাকে আমাদের গ্রাম বাংলা। গ্রাম যেমন আছে তেমনি আছে দালান-কোঠায় ভরা আলোঝলমল অনেক শহর। শহরের সৌন্দর্য আবার অন্যরকম। আমাদের দেশের দক্ষিণে, মানে দক্ষিণপূর্বে একটি নদীর ঐ পারে আছে ঠিক এমনি সুন্দর একটি দেশ, যার নাম আরাকান। সেখানেও ছিলো ছবির মত সুন্দর গ্রাম। ছিলো ফলের বাগান, ফসলের মাঠ, পাখীদের গান। ছিলো শিশুদের ছোটাছুটি, খেলাধূলা ও কোলাহল! কিন্তু ধীরে ধীরে সবকিছু যেন কেমন হয়ে গেলো! বড়দের মুখে হাসি নেই, তাই ছোটদেরও আনন্দ নেই। খেলাধূলা, ছোটাছুটি ধীরে ধীরে সব বন্ধ হয়ে গেলো। অবুঝ শিশুরা ঠিক বুঝতে পারে না, হঠাৎ কী হলো, মা-বাবা, বড় ভাই-বোন শুধু বলেন বাইরে যেয়ো না, বিপদ হবে। ওরা রাক্ষস, ঘরের বাইরে পেলেই ধরে নিয়ে যাবে, মেরে ফেলবে! খেয়ে ফেলবে!! ছেলে মেয়েরা প্রথমে বুঝতে পারেনি, পরে ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছে, ওরা কারা?! আর মা- বাবাদের মনে এত ভয়! তখন ছেলে মেয়েরাও ভয়ে এতটুকনু হয়ে গেলো! একসময় ওরা দেখলো, এখানে সেখানে আগুন জ্বলে! গুলির আওয়ায এবং মানুষের আর্তনাদ ভেসে আসে। বড়রা ভয়ে কেমন যেন হয়ে যায়! তাতে ছেলে মেয়েদের মনে আরো ভয় ধরে। আরাকানের বিশাল জনপদে অনেক ছেলে মেয়ের মধ্যে একটি ছোট্ট মেয়ে ছিলো নূরে জান্নাত! যেমন সুন্দর নাম, তেমনি সুন্দর তার সবকিছু। খুব বুদ্ধিমতি! চিন্তা করে অনেক কিছু, বুঝতে পারে অনেক কিছু। তার বয়সের ছেলে-মেয়েদের চেয়ে তার চিন্তাভাবনা অনেক গভীর। তার ইচ্ছে হয়, চারপাশে যা ঘটছে, সারা গ্রামে আগুন জ্বলছে, গুলি করে জাবই করে বড়দের, মা-বাবাদের মেরে ফেলছে, মাসুম বাচ্চাদেরও মেরে ফেলছে। যা দেখে সবই তার লিখতে ইচ্ছে করে। তার মনের ভয়গুলো, ইচ্ছেগুলো, চিন্তাগুলো সব তার লিখে রাখতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু সে তো লিখতে পারে না! তাদের তো স্কলু ছিলো না, লেখা-পড়া শেখার সুযোগ ছিলো না!! তো আরাকানের সবুজ দেশের সবুজ মনের এই ছোট্ট মেয়েটির মনের কথাগুলোই আমরা পুষ্পের পাতায় আমাদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়ের জন্য লিখে দিলাম, যেন ওর দুঃখের সঙ্গে, কষ্টের সঙ্গে, ওর কান্নার সঙ্গে, অশ্রুর সঙ্গে তোমরা একাত্ম হতে পারো 
 ***
আগের দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। কত হাসিখুশি আনন্দের দিনগুলো ছিলো! সারা দিন প্রজাপতির মত বাগানে ঘুরে বেড়ানো নয়, যেন উড়ে
বেড়ানো! বিকেলে একসঙ্গে খেলতে বের হতাম। আমার ভালো লাগতো লুকোচুরি খেলতে, নূরীর ভালো লাগতো ফুলটোক্কা। এখন সবকিছু অন্যরকম! বড়রা ঘর থেকে বের হয় না, বাজারে যায় না। মসজিদে যায় ভয়ে ভয়ে, ফিরে আসে তাড়াতাড়ি। রাখাইন দস্যুরা দেখলে উপায় নেই। ধারালো দা, ছুরি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। মায়েরা পুকুর- পাড়ে যেতেও ভয়ে অস্থির! যদি ধরে নিয়ে যায়! বড়দের বলতে শুনি। আমরাও পারি দা-ছুরি নিয়ে ওদের সঙ্গে লড়াই করতে, কিন্তু মিলিটারিরা যখন গুলি করে, সারা গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দেয় তখন তো ...
 ***
আমাদের গ্রামটা খুব সুন্দর। গ্রামের পাশে ছোট্ট একটি নদী আছে। আগে নদীতে যেতাম আম্মুর সঙ্গে গোসল করতে। কোন ভয় ছিলো না। নদী থেকে পানি এনে বাগানে পানি দিতাম। গাছগুলো তখন সবুজ সজীব ছিলো। এখন শুকিয়ে কেমন হয়ে যাচ্ছে। গাছগুলো বোধহয় বাঁচবে না। ভাবলেই আমার চোখদু’টো ভিজে ওঠে। আচ্ছা, আমরা কী দোষ করেছি?! ওরা আমাদের মারতে চায় কেন? ওদেরও তো ছোট ছোট ছেলে মেয়ে আছে! ওরা তো ওদের আদর করে! 
 ***
আব্বু যখন মসজিদে যান, আমার বুকটা দুরুদুরু করতে থাকে আব্বুর ফিরে আসা পর্যন্ত। সেদিন আব্দুর-রাহীমের আব্বু নামায পড়তে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। তিনদিন পর তার লাশটা পাওয়া গেছে। ভাসছিল ডোবার পানিতে। তখন থেকে ভয়টা আরো বেড়ে গেছে। কিন্তু আব্বু মসজিদে যাবেনই। আমি দু‘আ করতে থাকি, আর আল্লাহকে ডাকতে থাকি আব্বুর জন্য। আব্দুর-রহমানের জন্য অনেক মায়া হয়। ওর মা এখন বিধবা, আর ও এতীম! এতীম মানে কী? এতীমের কষ্ট কত, সেটা কেউ এতীম না হয়ে বোঝবে না!
 ***
আগে মাঝে মধ্যে ঘর থেকে বের হতে পারতাম। আম্মু দিতেন। যেদিন পাশের গ্রামের কয়েকটি ছেলেমেয়ে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে গেলো তখন আম্মু ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন। আমারও অনেক ভয় হলো। তাই আমার এখন বাইরে যাওয়া একদম বন্ধ। কতদিন হলো বান্ধবীদের দেখি না। ওরাও হয়ত আমার মত, ঘর থেকে বের হতে পারে না। আম্মুকে বলি, মগেরা যদি আমাদের ঘরে এসে হানা দেয় তখন কী হবে মা! আম্মু ধমক দিয়ে বলেন, চুপ করো। অলক্ষুণে কথা মুখে আনতে নেই।
***
বড়রা তো দেশের অবস্থা অনেক বেশী জানেন, বোঝেন, তাই তাদের ভয় বেশী, চিন্তা বেশী। আমরা তাদের মত বুঝি না, তাই আমাদের ভয় চিন্তাও কম। আর ছোট্ট ভাইটা! ও তো কিছুই বোঝে না। তাই সারাক্ষণ হেসে খেলে ছোটাছুটি করে বেড়ায়। ওকে দেখলে আমার কষ্টটা কমে যায়। ভাবি, আমি যদি ওর মত ছোট্ট হতাম! নাহ, তাহলে আম্মুর আব্বুর কষ্টগুলো বুঝতো কে?! আম্মুকে সাহায্য করতো কে?!
***
আমাদের গ্রামের পিছনে যে পাহাড়টা, তার পিছনে অনেক দূরে নাকি একটা দেশ আছে, বাংলাদেশ! আরাকানের মতই নাকি সুন্দর। এমনই সবুজ, এমনই ফলের বাগান, ফসলের মাঠ। ওখানে সবাই নাকি মুসলমান। সবাই নাকি খুব ভালো। আমাদের মত ছোট ছোট ছেলে মেয়ে আছে। ওখানে কোন ভয় নেই। গ্রামে কেউ আগুন দিতে আসে না। গুলি করে জবাই করে, আগুনে ফেলে মানুষ মারে না। মা বলেন, আরাকানের অনেক মানুষ নাকি জানের ভয়ে সবকিছু ফেলে ঐ দেশে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। মা আরো বলেন, দিন দিন অবস্থা যেমন খারাপ হচ্ছে তাতে হয়ত আমাদেরও পালাতে হবে সব কিছু ফেলে। আমি বলি, মা, আমরা কোথাও যাবো না। আমাদের এত সুন্দর গ্রাম ছেড়ে, এত শান্তির ঘর ছেড়ে, এমন সাজানো বাগান ফেলে, আর এমন সবুজ ফসলের মায়া ত্যাগ করে, না মা, আমরা কোথাও যাবো না। যত শান্তির দেশ হোক, নিজের দেশ ফেলে অন্য দেশে যাবো না
 ***
অনেক খারাপ কী নাকি ঘটে গেছে! এশার নামায পড়ে আব্বু খুব পেরেশান হয়ে ঘরে ফিরলেন। আব্বুকে এমন পেরেশান আর কখনো দেখিনি। আমার ভয় হলো যে, আব্বু অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। আমি ছোট মানুষ কী করতে পারি! হঠাৎ মনে হলো একটু লেবুর শরবত করে দিই আব্বুকে। শরবতের গ্লাসটা নিতে গিয়ে আব্বু এমন- ভাবে আমার দিকে তাকালেন যে, আমার কান্না পেয়ে গেলো। আব্বু বললেন, মা, ইচ্ছে হয় তোমাকে নিজের হাতে মেরে ফেলি। পশুর হাতে বেআবরু হওয়া থেকে তো বাঁচবি! আব্বুর কথা শুনে এমন ভয় হলো যে, চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। একটু পরে খালা ও খালু এলেন। খালাতো ভাই-বোনেরাও এলো। সবাই নাকি আমাদের এখানেই থাকবে। কারণ যা করতে হয় একসঙ্গে করতে হবে। ইয়া আল্লাহ, একসঙ্গে কী করতে চায়?! বাড়ীঘর ছেড়ে পালাতে চায়?! তার চেয়ে এখানে থেকেই মরে যাই না কেন?! একবারই তো মারবে! মৃত্যুর পর তো সব অশান্তি দূর হয়ে যাবে! একটু সুস্থ হওয়ার পর আব্বু বললেন, আমার নানুদের গ্রাম নাকি মিলিটারি জ্বালিয়ে দিয়েছে। যাকে সামনে পেয়েছে গুলি করে, জবাই করে মেরে ফেলেছে। ছোট ছোট বাচ্চাকে ধরে ধরে মা-বাবার চোখের সামনে আগুনে ফেলে দিয়েছে। 
***
আব্বু আম্মু, খালা খালু সারা রাত জেগে থাকেন। গ্রামের কেউ নাকি ঘোমায় না। জেগে থাকে এই ভয়ে যে, কখন মিলিটারি এসে পড়ে। যদি ঘুমের মধ্যে ঘরে আগুন দিয়ে দেয় তাহলে তো বাঁচার কোন উপায় থাকবে না। যিন্দা আগুনে পুড়ে মরতে হবে। আমিও জেগে থাকতে চাই আম্মুর সঙ্গে, কিন্তু কখন যে ঘুম এসে যায়, বলতে পারি না। আগে তো ফজরের আযান শুনে ঘুম ভাঙ্গতো। এখন আযান শোনা যায় না। কেউ আযান দেয়ার সাহস পায় না। আম্মু ডেকে জাগালেন। আমি ভয় পেয়ে উঠে গেলাম। আম্মুকে বললাম, মিলিটারি এসে গেছে আম্মু? আম্মু আমার মুখে হাত রেখে কেঁদে ফেললেন। ঐ রাত থেক আম্মু কেমন যেন হয়ে গেছেন। আমার দিকে আর ছোট ভাইটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। শুধু তাকিয়ে থাকেন। মুখে কিছু বলেন না। সবকিছু আবার কবে আগের মত হবে?! 
***
ঘুমোবো না বলেও কখন নিজের অজান্তেই একসময় ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ একসঙ্গে অনেক মানুষের চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ভাগেন! ভাগেন!! মিলিটারি এসে পড়েছে। এখনি সবাই পাহাড়ের দিকে ভাগেন। এমন ভয় আর কখনো হয়নি। এমন কষ্টও আর কখনো পাইনি। মিলিটারি আর তাদের সঙ্গে মন্দ লোকেরা নাকি ছুটে আসছে। এখনই হয়ত আমাদের এত দিনের এত শান্তির গ্রামটায় আগুন জ্বলে ওঠবে। সবকিছু পুড়ে সারখার হয়ে যাবে। আমি কাউকে কিছু না বলে পেয়ারা গাছটার কাছে গেলাম। কত যত্ন করে লাগিয়েছি! আগামী বছর হয়ত ফল দেবে। কিন্তু আমরাই তো থাকবো না! গাছটার গায়ে আদর করে হাত বুলিয়ে দিলাম। আমার ভীষণ কান্না পেলো। গাছের পাতাগুলো এমনভাবে নড়ে উঠলো যেন আমার কান্নায় গাছেরও কান্না পাচ্ছে। 
***
পাহাড় থেকে দেখা যাচ্ছে, আমাদের গ্রামটা জ্বলছে। এত বড় আগুন আমি জীবনেও দেখিনি। এখান থেকেই শোনা যাচ্ছে মানুষের চিৎকার আর্তনাদ! আহারে, কত যুলমু জানি হচ্ছে মানুষগুলোর উপর!! আমরা যদি ঠিক সময়ে বের হতে না পারতাম, তাহলে আমাদের অবস্থা কী হতো! আব্বু বললেন, ঐ যে মনে হয় আমাদের ঘরেও আগুন দিয়েছে। আমি তাকিয়ে কিছু বুঝতে পারলাম না, তবু আব্বুর কথায়কান্না পেয়ে গেলো। সেদিনের কান্নায় কোন আওয়ায ছিলো না। শুধু চোখ থেকে পানি ঝরে পড়ছিলো। কল্পনায় দেখতে চেষ্টা করলাম, আমার পেয়ারা গাছটাকে। হয়ত আর কোনদিন আসা হবে না এখানে আমাদের গ্রামে, নিজেদের বাড়িতে। কিন্তু যাবো কোথায়? থাকবো কোথায়? বাংলাদেশ এখান থেকে কত দূর?! একটা কথা এখনো আমার বুঝে আসে না, মিলিটারি কেন আমাদের এভাবে মারছে?! কেন আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে? রাখাইনরা! এত দিন একই গ্রামে একসঙ্গে ছিলাম। আমরা তো তাদের সঙ্গে অনেক ভালো আচরণ করেছি। ওরা কেন মিলিটারির সঙ্গে মিলে আমাদের উপর হামলা করছে?!
 ***
নূরীর দাদু আমাদের নবীজীর ঘটনা শুনাতেন। কত সুন্দর সুন্দর ঘটনা। নবীজী কেমন ছিলেন?! মানুষের সঙ্গে তিনি কত সুন্দর আচরণ করতেন?! তাঁর দয়া মায়া ও সুন্দর আচরণের কারণে শত্রুরাও তার প্রতি ... মুসলমানরা কি রাখাইনদের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করেনি! তাহলে আমাদের প্রতি তাদের দয়া মায়া হলো না কেন?! আমাদের মনে হয় আরো সুন্দর ব্যবহার করার দরকার ছিলো। আমাদের মনে হয় উচিত ছিলো তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়া। তাদের সামনে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরা। 
***
আজকের মত কখনো আমার এত কষ্ট হয়নি। আজকের মত কখনো আমার এত কান্না পায়নি। মাগরিবের নামায পড়ে আম্মু জায়নামাযে বসে ছিলেন। আমিও আম্মুর পাশে বসে ছিলাম। আব্দুলাøহ তখন ঘুমিয়ে ছিলো। আম্মু অনেক্ষণ মুনাজাত করলেন। আমিও আম্মুর সঙ্গে মুনাজাত করলাম। মুনাজাতের পর আম্মু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, জান্নাত, আমি যখন থাকবো না তখন তুমি অনেক ভালো হয়ে থেকো, আর তোমার ভাইটির দিকে খুব খেয়াল রেখো। যে নতুন দেশে যাবে সেখানে কেউ যেন তোমার কোন দোষ না ধরতে পারে। আম্মুর কথা শুনে আমার এমন কান্না পেলো, যেন এখনই শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। আম্মুকে জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদলাম। কিছু বললাম না। কীভাবে আম্মু এমন কথা বললেন?! আমাদের ছেড়ে আম্মু কোথায় যাবেন?! আম্মুকে ছাড়া আমরা কীভাবে থাকবো?!
***
আমাদের পুরো গ্রাম জ্বলেপুড়ে একেবারে শেষ। একজনও নাকি বেঁচে নেই। যারা পালিয়েছে তারা বেঁচেছে। যারা পালায়নি বা পালাতে পারেনি তাদেরকে মিলিটারি আর মগেরা মিলে গুলি করে, জবাই করে হত্যা করেছে। বাচ্চাদের আগুনে ছুঁড়ে ফেলে যিন্দা জ্বালিয়েছে। এতে নাকি মগেরা আনন্দ পায়! আল্লাহ গো!! আমাদের ঘরটার কথা এত মনে পড়ে কেন?! এত মায়া কেন হয়েছিলো ঘরটার জন্য?! আম্মু সবসময় ঘরদুয়ার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতেন। সবাই আমাদের ঘরে এসে খুশী হতো। বলতো জান্নাতের মা ঘরদুয়ার, বিছানাপত্র এত ছাফছুতরা রাখে! আসার সময়ও আম্মু ঘরদুয়ার বিছানাপত্র সব গুছিয়ে এসেছেন। যেন একদিন পরেই আবার ফিরে আসবেন! আমরা কি আর কোনদিন ফিরতে পারবো আমাদের গ্রামে, আমাদের বাড়িতে?!
*** 
আমার বুকের ভিতরে কেমন জানি কষ্ট হচ্ছে! বুকটা মনে হয় ফেটে যাবে। আম্মু বলতেন দুনিয়ায় আসার আগে আমি আল্লাহর কাছে ছিলাম। আমার আবার আল্লাহর কাছে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। দুনিয়াটা কত খারাপ! মানুষ মানুষকে কত কষ্ট দেয়! মানুষ মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারে!! এত খারাপ কেন মানুষ!! পশুরা তো বনে কী সুন্দর মিলে মিশে থাকে! জ্বালাও পোড়াও করে না। একদল আরেকদলকে হত্যা করে না। একদল আরেকদলকে বন থেকে তাড়িয়ে দেয় না। মানুষ হতে পারে না পশুর মত! একদেশে একসঙ্গে মিলে মিশে থাকবে!
***
আম্মু-আব্বু অনেক রাতে বললেন, আমরা দু’জন একটু গ্রামে যাবো, একটা জরুরি কাজে। রাতেই আবার ফিরে আসবো। তুমি আব্দুল্লাহকে একটু দেখে রেখো। শুনেই আমার বুকটা ধড়ফর করে উঠলো। বললাম, না আম্মু, আমি তোমাদের যেতে দেবো না। এত দিন তোমাদের কথা শুনেছি আজ আমার কথা শোনো। শুনলেন না। বললেন, গ্রামের দু’জন মানুষের আমানত আছে আমাদের কাছে। যদি সেগুলো ফেরত না দিয়ে চলে যাই তাহলে তো খেয়ানত হবে! আসলে মউত তাদের টেনে নিয়েছিলো। তাকদীরের লেখা তো মোছা যায় না, আম্মু বলতেন। তারা গেলেন, আর ফিরলেন না, আর কোনদিন ফিরবেন না। কী হয়েছিলো! কে তাদের মারলো, কীভাবে মারলো কিছুই জানা গেলো না। ওরা তো কাফের। ওরা কি মেরে ফেলার পর আম্মু-আব্বুর দাফন কাফন করবে? নূরীও তার খালার সঙ্গে আশ্রয়নিয়েছে পাহাড়ে। নূরীর দিকে তাকালে মনটা আমার হু হু করে ওঠে। নূরীরও মা-বাবাকে মেরে ফেলেছে রাখাইন খুনীরা। যারা এত দিন একসঙ্গে ছিলো। তারা কীভাবে নূরীর মা-বাবাকে জবাই করলো?! আমার আম্মু-আব্বু! এমন ভালো মানুষ তো পুরো গ্রামে ছিলো না। যে কারো বিপদে সবার আগে ছুটে যেতেন। কেন এমন হলো?! কেন এমন হয়? আর কতকাল এমন হবে, হতে থাকবে?!
***
নূরীরা দরজা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে বসে ছিলো। কথা ছিলো, সন্ধ্যার পরই তারা গ্রাম ছেড়ে বের হবেন। অন্ধকারে বের হওয়া নিরাপদ। সন্ধ্যার আগেই মগেরা এসে গেলো। দরজায় আওয়াজ দিলো। নূরীর মা নূরীর বাবাকে নিষেধ করলেন যেতে। কিন্তু তিনি ততক্ষণে দরজা খুলে দিয়েছেন। খুলে দিয়েই তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন। বুকটা রক্তে ভিজে গেলো। নূরীর মা ছুটে গেলেন স্বামীর কাছে। কিন্তু তার আগেই...। নুরীর মা শুধু বলতে পেরেছিলেন, নূরী, ভাইকে নিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে পালাও। জলদি করো। নূরী বের হলো না। আম্মুকে ছাড়া ও কোথায় যাবে, কীভাবে যাবে?! নূরী, মা আমার, দয়া করে কথাটা শোনো। এখনি পালাও। ওরা কিন্তু এসে পড়ছে। নূরী বলেছিলো, জানিস জান্নাত! আমার হাতে যদি একটা বন্দুক থাকতো তাহলে কিছুতেই পালাতাম না। আগে সেই খুনীটাকে শেষ করতরাম যে আমার মা-বাবার বুকে গুলি চালিয়েছে!
***
ইচ্ছে হয়, আল্লাহকে বলি, আব্বু -আম্মু তো তোমার কাছে চলে গিয়েছেন। আমাকেও তোমার কাছে নিয়ে যাও। কিন্তু আম্মুর কথাটা মনে পড়ে, আমাকে তো ছোট ভাইটিকে দেখতে হবে! এখন তো আমাকে ওর মা হতে হবে! কিন্তু ভাইটা যখন আম্মু আম্মু বলে চিৎকার শুরু করে তখন নিজেকে এত অসহায় লাগে যে, কাঁদতেও পারি না। আমি কাঁদলে ওকে থামাবে কে?
***
কয়েকদিন পাহাড়ে লুকিয়ে থাকার পর সবাই রাতের অন্ধকারে হাঁটা শুরু করলো। নূরী ও তার খালার সঙ্গে আমি হাঁটতে শুরু করলাম ছোট্ট ভাইটিকে কোলে নিয়ে। ক্ষুধায় কাতর, শুধু আমি না, সবাই। কয়েকদিন বলতে গেলে কিছুই খাওয়া হয়নি। পাহাড়ে একরকম বুনো গাছ আছে, শেকড় কিছুটা মিষ্টি। সেটাই একদুবার খেয়েছি। নূরী এনে দিয়েছে। খেতে পারি না তবু জোর করে খেয়েছি। ভাইটিকে দু’দিন শুধু চিড়া ভিজিয়ে খাইয়েছি। আজ তো চিড়াও নেই! এত দুবর্ল হয়েছে যে, এখন কাঁদতেও পারে না। ওর শরীরটা গরম হয়ে আছে। জ্বর এসেছে। আমার খুব ভয় লাগছে। ভাইটার যদি কিছু হয়, মাকে কী বলবো?!
***
সবাই বলছে, আমরা নাকি খুব কাছে এসে পড়েছি। বাংলাদেশ নাকি খুব ভালো দেশ। সেখানে খাবার পাবো, থাকার জায়গা পাবো। আমি অতকিছু ভাবতে পারি না, শুধু ভাবি, আমার ভাইটার জন্য ওষুধ পাবো তো?! বাংলাদেশে যেতে হলে নৌকায় করে সাগর পাড়ি দিতে হবে। সাগরের ঢেউকে আমার ভীষণ ভয়। কিন্তু আমার তো ভয় পেলে চলবে না! আমার ভাইটার তো চিকিৎসা করতে হবে। আমার ভাইটাকে তো বাঁচাতে হবে! আমাকে তো হতে হবে আম্মুর মত!!
***
আমার কাছে ভাড়া ছিলো না। তাই নৌকার মাঝি আমাকে কিছুতেই নেবে না। আমার তখন মনে হলো, পৃথিবীতে আমার চেয়ে হতভাগিনী কেউ নেই। আমি যদি বাংলাদেশে না যেতে পারি তাহলে তো আমার ভাইয়ের চিকিৎসা হবে না! আমার ভাইটা তো জ্বরের ঘোরেই মারা যাবে! আমি মাঝির পায়ে পড়লাম। মাঝির মনে একটুও দয়া হলো না। বাংলাদেশের মানুষের এত দয়া- মায়ার কথা শুনলাম, কিন্তু এই মাঝির মনে তো কোন দয়া মায়া নেই। তাহলে? বাংলাদেশের ডাক্তার যদি পয়সা নেই বলে আমার ভাইয়ের চিকিৎসা না করে?! মনটা দমে গেলো। কিন্তু আমার তো দমে গেলে চলবে না। ভাইটিকে তো আমার বাঁচাতে হবে! হঠাৎ দেখি মাঝি আমার গলার চেইনটার দিকে কেমন করে তাকাচ্ছে। আমি ভয়ে এতটুকনু হয়ে গেলাম। মাঝি হাসতে হাসতে বললো, এই তো ভাড়া আছে তোমার কাছে। গলার হারটা খুলে দিয়ে দাও। বলে কি মানুষটা! এটা তো আমার মায়ের একমাত্র চিহ্ন! কিন্তু না, আমার তো ভাইটিকে বাঁচাতে হবে। কিচ্ছু না বলে মাঝির হাতে তুলে দিলাম আমার মায়ের স্মৃতি! চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়লো। তবু চেষ্টা করে কান্না চেপে রাখলাম। আগে তো আমার ভাইটা বাঁচুক!
 ***
সাগরের বড় বড় ঢেউয়ে আমাদের নৌকাটা এত দুলছে যে, এই বুঝি উল্টে যাবে! এই বুঝি উল্টে গেলো! জ্বরের ঘোরে অচেতন ভাইটিকে বুকের সঙ্গে শক্ত করে ধরে আমি এক কোণে বসেছিলাম। ভাইটাও আমাকে শক্ত করে ধরে ছিলো। মনে হয় ও ভয় পেয়েছে। লোকেরা বলাবলি করতে লাগলো, বাংলাদেশ এসে গেছে! আমার মনটা তখন খুশিতে নেচে উঠলো। আহ, আমার ভাইটার তাহলে চিকিৎসা হবে! আমার ভাইটা তাহলে বেঁচে যাবে!! আম্মুর কাছে কত শুনেছি এ দেশের গল্প! মানুষগুলো নাকি কত ভালো! মাঝিটাকে কিন্তু আমার ভালো মনে হয়নি। কীভাবে গলার হারটা নিয়ে গেলো! আমার আম্মুর স্মৃতি ছিলো আমার কাছে! আম্মু বলেছিলেন আমাকে নিয়ে বেড়াতে আসবেন এদেশে। আজ আম্মু নেই আমি এসেছি ভাইটিকে নিয়ে; বেড়াতে নয়, একটুখানি আশ্রয়ের আশায়! পাবো তো একটুখানি আশ্রয়?! ভাইটিকে না হলে বাঁচাবো কীভাবে?! একটু দেখার জন্য ভয়ে ভয়ে মাথাটা উঁচু করলাম। দেখেই বুকটা ধুকধুক করে উঠলো। বন্দুক হাতে মিলিটারি! কিন্তু ওরা যে গুলি করলো না! মিলিটারি তো দেখলেই গুলি করে! গুলি করে মেরে ফেলে! ভাইটির অনেক ক্ষুধা লেগেছে। আমারও! ভয় কী! নৌকা থেকে নামলেই তো খাবার পাবো। ভাইটিকে খাওয়াবো, নিজে খাবো। আহ, কী শান্তি!! কিন্তু একি! হঠাৎ সবার মধ্যে কান্নার রোল পড়ে গেলো। এভাবে কাঁদছে কেন সবাই?! আমাদের নাকি নামতে দেবে না! ফেরত পাঠিয়ে দেবে যেখানথেকে এসেছি সেখানে! বলে কি! ওখানে যদি থাকতে পারি তাহলে তোমাদের দেশে আসি কেন? আম্মু বলেছেন, তোমরা না কত ভালো! একে বুঝি ভালো বলে!! আমাকে যদি নামতে না দাও আমার ভাইটার কী হবে? ওকে কি তাহলে বাঁচাতে পারবো না?! আল্লাহর কী দয়া হলো! আবার বললো, আচ্ছা নেমে আসো। সবাই নামতে লাগলো কোমর পানিতে। আমি কীভাবে নামবো ভাইটিকে নিয়ে! মাঝি এমন ধমক লাগালো যে, ভয়ে কেঁদে ফেললাম। আমার কান্না দেখে ভাইটিও কাঁন্না শুরু করলো। তাড়াতাড়ি আমি চুপ হয়ে গেলাম। আমাকে তো কাঁদলে চলবে না! আমাকে তো আম্মুর মতে হতে হবে!! খালা আগেই নেমে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে আমাকে নামতে সাহায্য করলেন। খালারও তো কত কষ্ট! সবসময় কি সব মনে থাকে! একটু দূরে খাবার দিচ্ছে। সবাই হুড়াহুড়ি করছে সামান্য একটু খাবারের জন্য! করবেই তো! ক্ষুধার যন্ত্রণা কত কঠিন যন্ত্রণা! ভাইটাকে কোলে নিয়ে আমি এক কিনারে দাঁড়িয়ে আছি! কীভাবে খাবার চাইতে হয় জানি তো না! এ তো ক্ষুধার মধ্যেও লজ্জা করছে হাত পেতে দাঁড়াতে। আম্মু বলতেন, মানুষের কাছে কখনো হাত পাতবে না। কিন্তু ভাইটাকে তাহলে খাওয়াবো কী?! আম্মু বলতেন, শুধু আল্লাহর কাছে চাইবে। আমি আল্লাহর কাছে চাইলাম, ভাইটির জন্য, তারপর আমার জন্য। একটু পরে দেখি, যারা খাবার দিচ্ছে তাদের একজন এসে দু’টো রুটি দিয়ে গেলেন। আমাকে চাইতে হলো না। আমি যে আল্লাহর কাছে চেয়েছিলাম।
আম্মু আমাদের শিখিয়েছিলেন খাওয়ার আগে বিসমিল্লাহ বলতে হয়। আমাকে কিছু বলতে হলো না। ভাইটি নিজেই বললো আধো আধো করে বিসমিল্লাহ! আম্মু আজ থাকলে কত খুশী হতেন!! কোথায় এখন আমার আম্মু!! আমাদের দেখতে পাচ্ছেন?!
***
আম্মু বলেছিলেন, বাংলাদেশে আমাদের মত ছোট ছোট অনেক ছেলে মেয়ে আছে। কত দিন হলো বাংলাদেশে এসেছি। এক পাহাড়ের উপরে ছোট্ট একটি ঝুপড়িতে থাকি। কোথায়, বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের তো দেখা পেলাম না! আমাদের বাইরে যেতে দেয় না। ওদেরও হয়ত ভিতরে আসতে দেয় না। কেন? আসলে কী দোষ হবে!?
***
শুরুতে আমার খুব কষ্ট হতো। মনে হতো দম বন্ধ হয়ে আসছে। এখন অত কষ্ট হয় না। আম্মুর সঙ্গে, আব্বুর সঙ্গে মাঝে মধ্যে দেখা হয়। আম্মু বলেন, আমরা জান্নাতে আছি। এখানে অনেক আরাম, অনেক শান্তি! তোমরা ভাই-বোন জলদি করে জান্নাতে এসে পড়ো। একসঙ্গে অনেক মজা হবে। আম্মু বললেন, তুমি তো আমাদের নিষেধ করেছিলে গ্রামে যেতে। আমরা তোমার কথা শুনিনি। তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছো, না? আমাদের মাফ করে দিও। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, রাতে তো ভাইটার অনেক জ্বর ছিলো। শরীর কী গরম ছিলো! এখন দেখি বরফের মত ঠাণ্ডা! হঠাৎ আমার কেমন জানি ভয় ভয় করতে লাগলো। রাত্রে আম্মু এসে চুপি চুপি নিয়ে যাননি তো ভাইটিকে? আমি তো ভাইটির ঠিকমত চিকিৎসা করতে পারিনি!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা