কাশ্মীরসংখ্যা

রোযনামচার পাতা

এক কাশ্মীরী বালকের রোযনামচা, যা রক্তের হরফে লেখা!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

এক কাশ্মীরী বালকের রোযনামচা, যা রক্তের হরফে লেখা!

 ১২/ ৪ /৯৯ খৃ. নিজেকে আজ একটা প্রশ্ন করলাম, পিতৃভূমিকে, কাশ্মীরকে, এই সবুজ উপত্যকাকে আমি কতটা ভালোবাসি? কাশ্মীরের মুক্তির জন্য আমি কি জানের কোরবানি দিতে পারবো!

আমার উজ্জ্বল ভবিষ্যত, আমার লেখা-পড়া, এগুলো কি কোরবান করতে পারবো কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য?

মা, কখন যে কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন বুঝতে পারিনি। ‘কী ভাবছো বাবা!’

ইতস্তত করে বললাম, ‘কই না তো, কিচ্ছু ভাবছি না তো মা!’

মা ঠিকই বুঝেছেন, তাকে এড়িয়ে যাচ্ছি। হয়ত কষ্ট পেলেন, তবে কিছু বললেন না!

আসলে এমন একটা জ্বলন্ত প্রশ্ন নিয়ে মায়ের মুখোমুখি হওয়ার সাহস আমার নেই। মায়ের স্বপ্ন, আমি বড় হয়ে পরিবারের হাল ধরবো। বিধবা মা আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছেন! ...

১৫/৪ /৯৯ খৃ. 

আজ শহরে অনেক গোলমাল হলো। মুজাহিদীন নাকি চলন্ত মোটর সাইকেল থেকে টহলরত পুলিশের উপর হামলা চালিয়েছে। দু’জন পুলিশ নিহত হয়েছে। পুলিশ নিরীহ পথচারীদের উপর এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ করেছে। ফলে পাঁচজন নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে বহু। ...

এভাবে আর কত দিন! যারা দেশের জন্য লড়াই করছে, তাদেরও তো ভবিষ্যত আছে! তাদেরও ঘর আছে, পরিবার আছে! সবাই যদি ঘর, আর পরিবারের কথা ভাবে তাহলে কাশ্মীরের মুক্তির জন্য কারা লড়াই করবে! কারা জান দেবে!! কিন্তু মায়ের বিষণ মলিন মুখটা যখন সামনে ভেসে ওঠে, আর কিছু ভাবতে পারি না। নিজের কাছেই যেন নিজে দুর্বল হয়ে পড়ি। একদিকে জ¦লন্ত কাশ্মীর, একদিকে দুঃখিনী মা! তুমি পথ দেখাও হে আল্লাহ্!

আচ্ছা, আগে লেখাপড়াটা তো শেষ করি, তারপর দেশের কথা, কাশ্মীরের মুক্তি ও স্বাধীনতার কথা চিন্তা করা যাবে। দেশের জন্য কিছু করতে হলে যোগ্যতারও তো...

১৯ / ৪ / ৯৯ খৃ.

আমার বাবা শহীদ হয়েছেন, তিন বছর হলো। মাঝে মধ্যে ভাবি, তিনি কি ঠিক কাজ করেছিলেন! শাহাদাত অনেক বড় মর্যাদার বিষয়, ঠিক আছে, কিন্তু আমার মা যে তার তিনটি এতীম সন্তানকে নিয়ে সংসার সাগরে হাবুডুবু ...!

মায়ের প্রতি, সন্তানের প্রতি কি বাবার কোন কর্তব্য ছিলো না! রাতের দস্তরখানে কীভাবে যেন সাহস করে কথাটা মাকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, বাবা কি ঠিক করেছেন, মা?! হঠাৎ  যেন মায়ের মুখম-ণ্ডল বেদনাক্লিষ্ট হয়ে পড়লো। তিনি অনুচ্চ কণ্ঠে শুধু বললেন, আগে বাবার মত হও, তারপর ...!

তারপর কী মা!

মা শুধু আমার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। মায়ের চোখের ভাষা বুঝতে পারলাম না।

২৩ / ৪ / খৃ.

আমাদের সহপাঠী মুছাদ্দেক, তার বাবা আজ শহীদ হয়েছেন। ওদের বাসায় গেলাম। আশ্চর্য, মুছাদ্দেকের মা জায়নামাযে বসে আছেন স্থির হয়ে। চোখের পাতা ভিজে আছে, তবে মুখে শব্দ নেই! কান্নাও নেই!

আমাকে দেখে শুধু বললেন, ওর বাবার জানাযা এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। সাতজন মুজাহিদ -কে ঘেরাও করে পুরো বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো। ... এমনভাবে বললেন যেন স্বাভাবিক

কোন ঘটনা! দুই মা! কত পার্থক্য! হঠাৎ ভিতরে অনুশোচনা হলো, মাকে কারো সঙ্গে তুলনা করা তো অপরাধ!

বাড়ীতে এসে ইচ্ছে করেই মাকে খবরটা দিলাম বিশদভাবে। মা শুনলেন, কিন্তু কোন মন্তব্য করলেন না! মায়ের প্রতিক্রিয়া বুঝতে চেয়েছিলাম, কিছুই বুঝলাম না! আসলে মা নিজের জগতে খুব গভীরে বাস করেন!

গভীর রাতে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো অস্ফুট কান্নার আওয়াযে! মা জায়নামাযে মুনাজাত করছেন যথাসম্ভব অনুচ্চ কণ্ঠে! তবু শুনতে পেলাম!

‘আমি কি ভুল করছি হে আল্লাহ্? এটা কি মাতৃহৃদয়ের দুর্বলতা হে আল্লাহ্! আমাকে শক্তি যোগাও, পথ দেখাও হে আল্লাহ্!’

মনে হলো, মায়ের নতুন এক রূপ দেখা হলো আজ!

২৫ / ৪ / ৯৯ খৃ.

অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়েছে। সুতরাং প্রতিটি জীবন ঘরে আবদ্ধ! প্রতিটি ঘর যেন একটি করে কারাগার!

কামরায় বসে পড়ায় মন দেয়ার চেষ্টা করছি, মা এসে দাঁড়ালেন পড়ার টেবিলটা ঘেঁষে। প্রতিটি শব্দ ধীরে ধীরে উচ্চারণ করে বললেন, ‘আমাকে ভুল বোঝো না বাবা! আসলে তোমার বোনদু’টির জন্য আমার ভিতরে বড় একটা অস্থিরতা কাজ করছে!’

আমি অবাক হয়ে মায়ের কুণ্ঠিত মুখাবয়বের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। শেষে বললাম, ‘তোমাকে ভুল বোঝবো কেন মা! তোমার ইচ্ছার বাইরে আমি কিছু করবো না মা!’

২৭ / ৪ / ৯৯ খৃ.

গেলো। তাদের একজন মুছাদ্দেক। সবকিছু চোখের পলকে ঘটে গেলো। শিক্ষক থমথমে চেহারা নিয়ে বললেন, ক্লাস বন্ধ। যার যার বাড়ী যাও।

মা জানতে চাইলেন তাড়াতাড়ি আসার কারণ!

বলতে গিয়েও চেপে গেলাম। শুধু বললাম, ‘কী কারণে যেন ক্লাস বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে!’ হয়ত মুখের কথা এবং চেহারার ছাপ একরকম হয়নি; মায়ের চেহারায় চিন্তার ছাপ পড়লো বলে মনে হলো!

২৮ / ৪ / ৯৯ খৃ.

সারাটা রাত অত্যন্ত অস্থিরতার মধ্যে অতিবাহিত হলো। বারবার ভেসে উঠছিলো মুছাদ্দেকের মুখাবয়ব! শান্ত দৃঢ়ই ছিলো। তবু, দুশ্চিন্তার কোন ছাপ কি ছিলো! মায়ের কথা ভেবে কি...! ওকি জিহাদের কাফেলায় শরীক হয়েছিলো, না বিনা কারণেই ধরে নিয়ে গেছে! আমার কি কিছু করার আছে মুছাদ্দেকের জন্য? ওর মায়ের জন্য!

ফজরের পর মা, পঁচিশ হাজার টাকা আমার হাতে দিয়ে বললেন, মুছাদ্দেকের মাকে সান্ত¡না দিয়ে এসো। আর এ অর্থটা দিয়ো। থানা মোকদ্দমার জন্য প্রয়োজন হবে।

আমি মায়ের শান্ত দৃঢ় মুখম-লের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আজ যেন মায়ের আরেক নতুন রূপ...

৩০ / ৪ / ৯৯ খৃ.

রাতে দরজায় আওয়ায হলো। মা বাবার লুকিয়ে রাখা পিস্তলটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, ভয় পেয়ো না বাবা, মৃত্যু একবারই আসে। বুক বরাবর গুলি করো! দরজা খুলে আড়ালে দাঁড়ালাম! মুছাদ্দেকের চাচা! মাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছেন।

আজ মায়ের আরেকটা নতুন রূপ দেখা হলো। মাকে আসলে আমি কতটা চিনতে পেরেছি! ...

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা