রবিউল আউয়াল ১৪৪০হিঃ (৩/৭)

টেকনাফ/তেতুলিয়া

রাজনীতি কোন্ পথে? দেশ ও জাতির গন্তব্য কোথায়?!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

শাব্দিক অর্থেই আমাদের এই ছোট্ট দেশটাতে এখন জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই এবং নেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। সবচে’ ঝুঁকিপূর্ণ হলো, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে, যাদের হাতে ক্ষমতা তাদের ইচ্ছার বিপরীত কোন মত প্রকাশ করা।

নিরাপত্তার ভয়ে আমরা সবাই যদি নীরব থাকিও সময়ের গতি তো তাতে থেমে থাকবে না; বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ঝড়ের যে আলামত ঘনিয়ে আসছে তা তো বন্ধ হবে না। শেষ পর্যন্ত ঝড় যদি আসে এবং জীবনের সবকিছু তছনছ করে দিয়ে যায় তখন তো বিবেকের তিরস্কার থেকে বাঁচতে পারবো না যে, আমার মুখে যতটুকু আওয়ায ছিলো, আমার কলমে যতটুকু কালি ছিলো, আমি কেন যা বুঝেছি তা বলিনি? আমি কেন যা অনুভব করেছি তা লিখিনি? কেন আমি নিজে সতর্ক হইনি এবং অন্তত আমার চারপাশে যারা আছে তাদের সতর্ক করিনি?

অন্তত আগামী দিনে বিবেকের তিরস্কার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হলেও এখন আমি আমার কথাগুলো লিখে রাখতে চাই।

এতে দ্বিমতের কোন অবকাশ নেই যে, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানে চরম সঙ্কটের আবর্তে নিক্ষিপ্ত। সবাই বুঝতে পারছে, এ পরিস্থিতি দেশ ও জাতির ভবিষ্যতকেই হুমকির মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। শাসকদল একদিকে আর বলতে গেলে সব বিরোধী দল একদিকে, এভাবে সম্পূর্ণ মুখোমুখী এক সঙ্ঘাতপূর্ণ অবস্থান গ্রহণ করেছে। মনে হয়, উভয়পক্ষ, বিশেষ করে সুবিধাভোগী পক্ষ অপর পক্ষের অস্তিত্ব নির্মূল করে তবেই নিজের সামনে চলার পথ তৈরী করে নিতে চায়। আমাদের জানামতে এরূপ জটিল রাজনৈতিক অচলাবস্থা আর কোন জাতির জীবনে ঘটেনি।

জটিলতার শুরু কখন থেকে তা বোঝা গেলেও বলা খুব সহজ নয়। তবে বর্তমানের চেয়ে অনেক লঘু একটি রাজনৈতিক নি¤œচাপ তৈরী হয়েছিলো যখন আজকের অলিখিত বিরোধীদল  একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলো। কিন্তু মোটামুটি আইন অনুসরণ করে যাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নিযুক্ত করা হয়েছিলো তিনি হলেন, .... তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই একজন ভদ্রলোক। কিন্তু আজকের শাসকদল কোন অবস্থাতেই তাকে মানতে রাজি ছিলো না। তখনকার শাসকদল তাদের বিবেচনামত পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু আজকের শাসকদল এমন  নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করলো যে, রাষ্ট্রপতির সরকারী ভবনের বিদ্যুৎ-পানির সরবরাহ পর্যন্ত বন্ধ করে দিলো। পরিস্থিতি গড়াতে গড়াতে কোথায় গিয়ে থামলো তা সবারই জানা। আজকের ক্ষমতাসীন দলের তখনকার জনপ্রিয় শ্লোগান ছিলো, ভোট ও ভাতের রাজনীতি এবং আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশী তাকে দেবো। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস! তারাই এখন ক্ষমতায় এবং নির্বাচনের মাধ্যমে, যাতে ভোট ছিলো না। এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বলতে গেলে নির্বাচনও ছিলো না। বলা হলো এবং আশা করি আমাদের সবার স্মৃতিতে তা বিদ্যমান রয়েছে, বলা হলো, এটি শুধু নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। পরে খুব দ্রুত সকল পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে নতুন নির্বাচন হবে। সেই নিয়ম রক্ষার নির্বাচন এখন পরিণত হয়েছে নিয়মে।

মন্ত্রী মহাশয়রা যে দাপিয়ে বলে বেড়াচ্ছেন, কথাটা আসলেই সত্য; এখনকার ‘জনতার বিরোধী দলের’ আন্দোলন করার ‘হ্যাডম নাই, মুরোদ নাই’। যদি বর্তমান পরিস্থিতিতে আজকের ক্ষমতাসীন দল বিরোধী অবস্থানে থাকতো, যদি বর্তমান নির্বাচন কমিশন তখন হতো তাহলে পরিস্থিতি কী হতে পারতো!! উদাহরণ এত নিকট অতীতের যে, স্মৃতিবিমুখ বাঙ্গালীর পক্ষেও তা ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।

যাই হোক পরিস্থিতি দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হয়ে বর্তমান পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। শাসকদল মনে করছে এমন নির্জীব নিবীর্য বিরোধী দলের কোনরূপ তোয়াক্কা না করেই তারা তাদের মত করে পরিস্থিতি পার করে আবার ক্ষমতায় আসবে এবং সেটাই হবে কম ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদেরও মনে হয়, নিছক ক্ষমতার রাজনীতির দিক থেকে এটা ঠিক আছে। বরং নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, যাকে বলে ভোটের নির্বাচন, সে পথে আবার ক্ষমতায় আসা, ক্ষমতাসীন পক্ষ ভালো করেই জানে, তাদের জনপ্রিয়তা এখন এমনই তলানিতে যে, তা কিছুতেই সম্ভব নয়। সুতরাং জান যায় আর থাকে, দেশের অর্থনীতির বারটা বাজে বা তেরটা, নির্বাচন হতে হবে ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণে, তাদের নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন কমিশনের অধীনে।

পর্যবেক্ষক মহলের মতে ক্ষমতাসীন পক্ষ এদিক থেকে বড় নিশ্চিন্ত আছে যে, আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষ করে ‘মহান গণতন্ত্রের দেশ, প্রতিবেশী ভারত তাদেরই ক্ষমতায় দেখতে চায়। কারণ ‘চাহিবামাত্র পাওয়া’ এবং ‘চাহিবার আগেই পাওয়া’ এবং কিছু না দিয়েই সবকিছু পাওয়া বাংলাদেশের আর কোন দলের কাছ থেকে আশা করা যায় না। বিরোধী দল অবশ্য ঠেকে এবং ঠকে এখন বিদেশী প্রভুদের তোষণ, বিশেষ করে ভারত- তোষণের পথে হাঁটতে শুরু করেছে। কিন্তু তারা পরীক্ষিত বন্ধুকে ছাড়বে কেন? এবং প্রয়োজন ছাড়া নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথে যাবে কেন?!

সরকার ভালো করেই জানে, জনমত, আর সুসংগঠিত জনমত এক জিনিস নয়। বিরোধী দলের পক্ষে হয়ত জনমত আছে, কিন্তু সেটিকে সুসংগঠিত করে কোন পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা বিরোধী পক্ষের নেই। যাও বা ছিলো, হামলা-মামলা ও দমন-নিপীড়নে তাও শেষ করে দেয়া সম্ভব হয়েছে।

সরকারেরই একটি পক্ষ অবশ্য মনে করে, বিরোধী নেতৃত্বকে পঙ্গু করে দেয়া সম্ভব হলেও গণজাগরণ, অতপর গণবিস্ফোরণের ঝুঁকি শেষ পর্যন্ত থেকেই যায়। কোটা আন্দোলন ও নিরাপদ সড়কের দাবীতে উঠে আসা আন্দোলন-যার সঙ্গে রাজনীতির কোন সম্পর্ক ছিলো না-এর ক্ষত তাদের স্মৃতিতে এখনো দগ দগ করছে। রাজনীতির মাঠেও এর পুনরাবৃত্তি হতে পারে। তবে তারা মনে করেন, শেষ পর্যন্ত অনুগত প্রশাসন ও পুলিশবাহিনী দ্বারা গণবিস্ফোরণও দমন করা সম্ভব হবে। কারণ আন্দোল গড়ে তোলা এবং আন্দোলন নির্মূল করা উভয় অভিজ্ঞতায় প্রতিপক্ষ হতে তারা বহু দূর এগিয়ে রয়েছে।

এবং এখানেই অভিজ্ঞ মহলের দ্বিমত। তারা মনে করে, সময় থাকতে যদি উভয় পক্ষ প্রয়োজনীয় ছাড় দিয়ে সমঝোতার পথে না আসে তাহলে পরিণতি একসময় ভয়াবহ হতে বাধ্য। আর পরিণতি দায়পরিমাণই হয়ে থাকে।

***

এবার আমাদের কাওমী ঘরানা সম্পর্কে কিছু কথা। আমরা রাজনীতি করিনি, হেফাযত করেছি। তবে মাঠগরম করা বক্তব্য আমাদের পক্ষ থেকে কম ছিলো না। শেষ পর্যন্ত আমাদের জীবনে ভয়াল একটা রাত নেমে এলো। অজ্ঞাত সংখ্যক নিরীহ মানুষ শহীদ হলো, যাদের কবর পর্যন্ত নছীব হলো না। একটা তদন্ত পর্যন্ত হলো না। আমরা আল্লাহ কাছে বিচার-ফরিয়াদ দায়ের করলাম, তারপর আসমানের ফায়ছালার অপেক্ষা পর্যন্ত করলাম না। সনদ চাইলাম, কেন চাইলাম, যদিও জানি না, তবে ‘মনে হয় পেলাম’। কিন্তু সেটা তো কারো দয়ার দান নয়, আমাদের প্রাপ্য অধিকার। তাহলে এত গদগদ হওয়া কেন? কৃতজ্ঞার সীমা পার হয়ে কৃতাথতার সীমায় চলে যাওয়া কেন? মহাকালের গর্ভে একটা প্রশ্ন তো থেকেই যাবে, কেন তাহলে এত রক্ত? কাফন-দাফন ছাড়া কেন তাহলে এত নিখোঁজ লাশ? আবার কোন ‘মেহমানদারিতে’ বসার আগে এ জ্বলন্ত প্রশ্নের একটা ‘নির্বাপক’ উত্তর তো আমাদের ঠিক করে রাখতেই হবে! *

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা