রবিউল আউয়াল ১৪৪০হিঃ (৩/৭)

টেকনাফ/তেতুলিয়া

ইলিশধরা যদি বন্ধ রাখি!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশ, বলা যায় সবচে’ সুস্বাদু মাছ। উপকূলের বিপুল জনসংখ্যার জেলে সম্প্রদায় ইলিশ মাছ ধরার মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করে। তাই ইলিশমৌসুমে সাগরে ইলিশ ধরা পড়লে জেলেদের মুখে হাসি ফোটে এবং আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। পক্ষান্তরে ইলিশের আকাল হলে পুরো জেলেপল্লীতে বিষাদ নেমে আসে।

ইলিশের অবাধ প্রজনন নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে প্রতিবছর প্রজনন মৌসমে ২০/২২ দিন সময় ইলিশ মাছ ধরা ও বাজারজাত করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ইলিশ সারা বছর কমবেশী ডিম দিলেও প্রধান প্রজনন মৌসুম হলো আশ্বিনের প্রথম পূর্ণিমার ভরা চাঁদ ও তার আগের পরের কিছু দিন।

(পূর্ণিমার আগে ১৭ দিন, পরে চারদিন ১৭+১+৪) এবার ৭ থেকে ২৮শে অক্টোবর (২২শে আশ্বিন থেকে ১৩ই কার্তিক, ১৪২৫ বাং) মোট বাইশ দিন নিষিদ্ধতার মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ইলিশের প্রধান প্রজননক্ষেত্র হচ্ছে প্রায় সাত-হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা।

প্রজননমৌসুমে ইলিশধরা নিষিদ্ধ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে ডিমওয়ালা ইলিশমাছের ডিম ছাড়া নিশ্চিত করা, যাতে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। সুতরাং সব বিবেচনায় এটি আমাদের জন্যই কল্যাণকর একটি পদক্ষেপ।

ইলিশ অত্যন্ত স্বাস্থ্যবান্ধব মাছ। ইলিশের চর্বি মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কোলেস্টরেলের পরিমাণ হ্রাস করে, যাতে হৃদরোগের ঝুঁকি বেশ কমে আসে। এ ছাড়া ইলিশের চর্বিতে উচ্চমাত্রায় ভিটামিন এ ও ডি থাকে।

ইলিশের জীবনচক্র বড় বিচিত্র। সাগরের নোনা পানিতে বাস করেও ডিম দেয়ার সময় উজান বেয়ে মিঠা পানির উদ্দেশ্যে তারা অভিপ্রয়াণ করে। ইলিশ হলো ঝাঁক বেঁধে চলা মাছ। একটি ঝাঁকে কয়েকশ মাছ থাকতে পারে; এমনকি হাজারের সংখ্যায় থাকাও বিচিত্র নয়। এরা স্রােতের উজানে প্রতিদিন ৭০ থেকে ৭২ কিলোমিটার পর্যন্ত অভিপ্রয়াণ করতে পারে।

ডিমের লম্বা দু’টি দলার মধ্যে দুই মিলিয়ন পর্যন্ত ডিম থাকতে পারে। ডিম পাড়ার পর বাইশ থেকে ছাব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ডিম থেকে রেণু হয়। পাঁচ/ সাত মাস এরা মিঠা পানিতে থাকে, তারপর সাগরে ফিরে যায়। পাঁচ থেকে সাত বছর আয়ুর ইলিশ এক থেকে দুই বছর বয়সে ডিম দেয়ার উপযুক্ত হয়।

 

আহরিত ইলিশের ৯০ শতাংশ ৩০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার আকারের হয়। সর্বোচ্চ দুই থেকে আড়াই কেজি হতে পারে।

ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ হলেও প্রধাণত বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারতই হচ্ছে মূল বিচরণ- ক্ষেত্র। মোট আহরিত ইলিশের প্রায় ৭০ শতাংশ হলো বাংলাদেশের  জলসীমায়, ২০ শতাংশ মিয়ানমারে এবং ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ভারতে। তবে সবচে’ সুস্বাদু হলো বাংলাদেশের জলসীমার, বিশেষ করে পদ্মার ইলিশ। পদ্মার ইলিশের জন্য কোলকাতার ‘বাবুদের’ নাকি জিভে জল পড়ে! তাই জলের আশায় ইলিশ উপঢৌকনের কূটনীতি...!

বাংলাদেশে মোট তিন প্রজাতির ইলিশ পাওয়া যায়। চন্দনা ও গোতা ইলিশ উপকূল ও সাগর এলাকায়, অন্য প্রজাতিটি মিঠা ও নোনা পানিতে বাস করে।

প্রশ্ন হতে পারে, প্রজননমৌসুমের নিষেধাজ্ঞায় কী উপকার পাওয়া যাচ্ছে? পরিসংখ্যানমতে নিষেধাজ্ঞা আংশিক কার্যকর হওয়ার ফলে প্রতিবছরই ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে।  ২০০৮ -০০৯ অর্থবছরে  দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিলো ২ লাখ ৯৮ হাজার টন। ১৬-১৭ অর্থবছরে ছিলো চারলাখ ৯৬ হাজার ৪১৭ টন, যা আগের বছর থেকে অন্তত পনেরো শতাংশ বেশী। একই পরিসংখ্যানমতে ঐ বছর প্রায় ৪৭ শতাংশ মা ইলিশ প্রজননে আসায় প্রায় ৪২ হাজার কোটি জাটকা ইলিশ-পরিবারে যুক্ত হয়েছে।

সুখের বিষয়, জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যেও ক্রমেই সচেতনতা বাড়ছে। তাই আশা করা যায়, ইলিশ-উৎপাদন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে ইনশাআল্লাহ।

ইলিশ শুধু আমাদের জাতীয় মাছই নয়, জাতীয় সম্পদও। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এটা বাংলাদেশের জলসীমার নিজস্ব সম্পদরূপে স্বীকৃত।

আমরা চেষ্টা করি, তবে সাগরের বিপুল জলরাশির অভ্যন্তরে যিনি এর প্রতিপালন ও সংরক্ষণ করেন তিনি আমাদের রিযিকদাতা আল্লাহ। তিনি চাইলে কেউ বাধা দিতে পারে না, আর তিনি যদি বাধা দেন, কেউ দান করতে পারে না। তাই আমাদের কর্তব্য, যুগের পর যুগ যে সুস্বাদূ নেয়ামত আমরা ভোগ করে আসছি তার জন্য দয়ালু রিযিকদাতা আল্লাহর শোকর আদায় করা।

এবছর ইলিশমৌসুমের শুরু থেকে প্রায় শেষ পর্যন্ত সাগরে জেলেদের জালে মাছ বলতে গেলে ধরাই পড়েনি। শেষ দিকে এসে কিছুটা ধরা পড়েছে। কী এর রহস্য! কোথায় লুকিয়ে ছিলো এ বিপুল পরিমাণ মৎসসম্পদ! যদি তাঁর আদেশে ইলিশ তার গতিপথ পরিবর্তন করে ফেলে তাহলে তো ...! আল্লাহ যেন আমাদের শোকরগুজার হওয়ার তাওফীক দান করেন, আমীন।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা