কাশ্মীরসংখ্যা

টেকনাফ/তেতুলিয়া

ভারতীয় সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৩৭০ কী ও কেন?

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

ভারতীয় সংবিধানে অনুচ্ছেদ

৩৭০ কী ও কেন?

স্বাধীনতার প্রশ্নে উপমহাদেশের যখন ভাগবাটোয়ারা হলো তখন অনেক জটিলতা ও কুটিলতার মধ্য দিয়ে ভারত ও পাকিস্তান দু’টি স্বাধীন দেশরূপে আত্মপ্রকাশ করলো। ঐ সময় বেশ কিছু দেশীয় রাজ্য ছিলো, দু’তিনটি ছাড়া যাদের আলাদা দেশ হিসাবে অস্তিত্ব লাভ করার বাস্তব অবস্থা ছিলো না। তাদের হয় যোগ দিতে হবে ভারতের সঙ্গে, না হয় পাকিস্তানের সঙ্গে। এ বিষয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছিলেন বৃটিশ মুকুটের সর্বশেষ প্রতিনিধি লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন, যার সারমর্ম হলো, মুসলিম প্রধান রাজ্য পকিস্তানে যোগ দেবে, আর হিন্দুপ্রধান রাজ্য ভারতে যোগ দেবে। তবে জনগণের ইচ্ছা চিন্তা করে কোন রাজ্য স্বাধীনতার পথও গ্রহণ করতে পারে। হায়দারাবাদ ও জুনাগড় ছিলো হিন্দুপ্রধান, তবে মুসলিম জনসংখ্যাও ছিলো যথেষ্ট। শাসক ছিলেন মুসলিম। শাসকের ইচ্ছা ছিলো স্বাধীন থাকা। কিন্তু ভারত সামরিক আগ্রাসনের মাধ্যমে হায়দারাবাদ ও জুনাগড় দখল করে নেয়।

ঘোষিত নীতি অনুযায়ী কাশ্মীর পাকিস্তানে যোগ দেয়ার কথা এবং পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে ‘আশ্চর্যরকম’ নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু কাশ্মীর ও পাকিস্তানের মুসলিম জনতা নিশ্চিন্ত ছিলো না। তারা বুঝে নিয়েছিলো রাজা হরি সিং ও শেখ আব্দুল্লাহর গোপন মতলব। তাই দেয়ালে পিঠ ঠেকার আগেই কাশ্মীরের মুজাহিদীন প্রায় নিরস্ত্র অবস্থায় অস্ত্রসজ্জিত ও সুপ্রশিক্ষিত ডোগরা বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তান সরকারের তখন শাব্দিক অর্থেই ফকীরানা হালাত। মুসলিম সেনা ইউনিটগুলো সুপরিকল্পিত-ভাবে ছড়িয়ে রাখা হয়েছিলো সারা ভারতে, যাদের বিপর্যস্ত অবস্থায় জড়ো করা সম্ভব হয়েছে কাশ্মীর জিহাদ শেষ হওয়ার বেশ পরে। ভাঙ্গাচুরা বাহিনী যেটা ছিলো তারও কমান্ড ছিলো বৃটিশ অধিনায়কের হাতে, যিনি আবার জিন্নাহ্র আদেশ মানতে নারায। সুতরাং এ অবস্থায় পাকিস্তান ‘দস্যুতা’ করতে চাইলেও কী করতে পারতো, সবকিছু গুছিয়ে হাতে পাওয়া প্রবল শক্তিধর ভারতের বিরুদ্ধে! পাকিস্তানের সীমান্ত অঞ্চলের গোত্রগুলো থেকে বাহাদুর ও পুরজোশ হাজার হাজার জোয়ান প্রায় নিরস্ত্র অবস্থায় কাশ্মীরে ছুটে যায়, কাশ্মীরী মুজাহিদীনকে সাহায্য করার জন্য। এটা ছিলো তাদের ঈমানের দাবী ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের অটুট বন্ধনের আবেদন।

আল্লাহ্র মদদ ও গায়বি সাহায্য ছিলো মুজাহিদীনের সঙ্গে। তাই অকল্পনীয়ভাবে ডোগরা বাহিনী বিপর্যস্ত অবস্থায় জানহাতে নিয়ে পালাতে থাকে। এমনকি রাজা হরি সিংও পালিয়ে শেষপর্যন্ত দিল্লী চলে যান। হাতের কাছে অজুহাত হিসাবে পাওয়া মুজাহিদীনের জিহাদকে ‘পাকিস্তানী দস্যুতা’ বলা হলো এবং রাজা হরি সিং নেহরু ও মাউন্ট ব্যাটেনের চাপে কাশ্মীরের ভারতভুক্তির বিতর্কিত চুক্তিতে সই করেন, জনতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে যা করার কোন অধিকার তার ছিলো না। এটা ছিলো কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমীনের আবেগ-অনুভূতি ও চিন্তাচেতনার সঙ্গে সুস্পষ্ট প্রতারণা।

 

তবে রাজা নিজে হিন্দু ছিলেন বলে হিন্দুচরিত্র ও মানসিকতা তার ভালোই জানা ছিলো। তিনি ভারতের কাছে কাশ্মীরের অনুকূলে কিছু সুবিধার শর্ত আরোপ করলেন। নেহরু তখন ‘দুধকলা, ঘী-মাখন’ সবই দিতে প্রস্তুত! সেখান থেকেই মূলত ভারতীয় সংবিধানে ৩৭০ ধারার সংযুক্তির বিষয়টি আসে।

চুক্তি সই হওয়ামাত্র ভারত কাশ্মীরে বাহিনী প্রেরণ করে। তারপরো ভারত অনেকটা দিশেহারা অবস্থায় যুদ্ধবন্ধের জন্য জাতিসঙ্ঘের দারস্থ হয়। এমনকি জাতিসঙ্ঘের গণভোট প্রস্তাবও মেনে নেয় এবং গণভোট অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতিও প্রদান করে। কারণ কাশ্মীরের অন্তত ‘বাকি অংশ রক্ষার জন্য’ এর কোন বিকল্প ছিলো না। এখানেই পাকিস্তান তার ইতিহাসের সেরা ভুলটা করে। মুজাহিদীন যখন চূড়ান্ত জয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন পাকিস্তান জিহাদ স্থগিত ঘোষণা করে জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতা মেনে নেয়। সেই জিহাদেরই সুফল আজ পাকিস্তান ভোগ করছে ‘আযাদ কাশ্মীর’-এর মানচিত্র আকারে। আবার সেই জিহাদ স্থগিত ঘোষণারও খেসরাত দিয়ে যাচ্ছে ‘মাকবূযা কাশ্মীর-এর মানচিত্র আকারে। কেন পাকিস্তান এ ভুল করলো? হয়ত কোন মাজবূরি ছিলো, হয়ত ঐ পরিস্থিতিতে সাহসের অভাব হয়েছিলো। কারণ নেতৃবৃন্দ তো শুধু মুসলিম ছিলেন, কাশ্মীরের বুযদিল ও লোভী নেতা শেখ আব্দুল্লাহ্রই মত, হয়ত তার চেয়ে কিছুটা উন্নত।

শেখ আব্দুল্লাহ্ তখন রাজা হরি সিং-এর জেলে। এদিকে নেহরুর কাছে হরি সিং এর প্রয়োজন বলতে গেলে ফুরিয়ে গিয়েছে। এখন প্রয়োজন ছিলো মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য ‘তিফলে তাসাল্লি’ বা ‘শিশুসান্ত¡না’রূপে শেখ আব্দুল্লাহ্কে সামনে আনা, যে জন্য বহু আগে থেকে তাকে প্রস্তুত করা হয়েছে।

নেহরুর প্রচণ্ড চাপে রাজা হরি সিং বাধ্য হলেন শেখকে মুক্তি দিতে। একজন হিন্দু হিসাবে তিনি বুঝে গিয়েছিলেন সামনে কী হতে যাচ্ছে। তবে তখন তার করার কিছু ছিলো না। তাকে তখন জিজ্ঞাসা করার কেউ ছিলো না যে, স্বেচ্ছায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে তিনি যদি পাকিস্তানে যোগ দিতেন, তার পরিণতি কি এর চেয়ে ভালো হতো না?

‘কাশ্মীরের শের’ আসলেই ছিলেন, ‘রাজনৈতিক বাচ্চা’। তাকে লোভ দেখানো হলো, কাশ্মীরের আলাদা সংবিধান থাকবে এবং থাকবে আলাদা পতাকা। আর তিনি হবেন অন্যান্য রাজ্যের মত মুখ্যমন্ত্রী নন, রীতিমত প্রধানমন্ত্রী, বা পিএম, অর্থাৎ কিনা উযীরে আযম! তিনি বিশ্বাস করলেন এবং নিজেও প্রতারিত হলেন, কাশ্মীরের মুসলিম জনতাকেও প্রতারণার ফাঁদে ফেললেন। কাশ্মীর ভারতের অন্তভুক্ত হলো এবং সংবিধানে প্রথমে ৩৭০ অনুচ্ছেদ যুক্ত হলো; তারপর যুক্ত হলো ৩৫ক ধারা।

এতক্ষণ আমারা সঙ্গত কারণেই আগে আলোচনা করলাম ৩৭০ ধারা কেন? এখন আলোচনা করবো ৩৭০ ধারায় কী কী আছে বা ছিলো?

হরি সিং-এর ভারতভুক্তির শর্ত হিসাবেই ১৯৪৯ সালের ১৭ই অক্টোবর ভারতের সংবিধানে যুক্ত হয় ৩৭০ অনুচ্ছেদ। হরি সিং আশা করেছিলেন, এই অনুচ্ছেদবলে তিনি কাশ্মীরে প্রায়স্বাধীন শাসকের ক্ষমতা ভোগ করবেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি, হিন্দু হলেও নেহরুর কাছে কখনো তার চেয়ে বেশী মূল্য হতে পারে মুসলমান শায়খের!

৩৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে

জম্মু ও কাশ্মীরের নিজস্ব সংবিধান ও আলাদা পতাকা থাকবে। কাশ্মীরের প্রধান নির্বাহী পদের নাম হবে মুখ্যমন্ত্রী-এর পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী বা উযীরে আযম।

অন্যান্য রাজ্যের বিধানসভার মেয়াদ পাঁচবছর হলেও কাশ্মীরের বিধানসভার মেয়াদ হবে ছয় বছর। অর্থ, পররাষ্ট্র, যোগাযোগ ও প্রতিরক্ষা, এই চারটি বিষয় শুধু কেন্দ্রের হাতে থাকবে, বাকি বিষয়গুলো থাকবে রাজ্যের হাতে। রাজ্যের স্বার্থবিষয়ক কোন আইন প্রণয়ন করতে হলে রাজ্যের বিধানসভার অনুমোদন নিতে হবে।

রাজ্যসংবিধান প্রণয়নের জন্য সাংবিধানিক অ্যাসেম্বলি গঠন করা হয়। সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। তারপর অ্যাসেম্বলি বিলুপ্ত করা হয়।

১৯৫৪ সালে কাশ্মীরীদের চাপের মুখে প্রেসিডেন্টের আদেশের মধ্য দিয়ে ৩৭০ অনুচ্ছেদের অধীনে ৩৫ক নামে একটি ধারা যুক্ত করা হয়, যার মূল উদ্দেশ্য ছিলো রাজ্যকে অভিবাসী থেকে মুক্ত রাখা, জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচিতির অক্ষুণ্যতা নিশ্চিত করা। তাতে বলা হয়েছে কোন অকাশ্মীরী রাজ্যে কোন জমি খরিদ করতে পারবে না; বাইরে থেকে সরকারী চাকুরির জন্য লোকবল ভাড়া করে আনা যাবে না। কোন কাশ্মীরী নারী বাইরের কোন পুরুষকে বিবাহ করলে ঐ নারী ও তার উত্তরাধিকারী রাজ্যের অধিকার হারাবে।

এতসব সুরক্ষা কিন্তু কোন কাজেই আসেনি, নেহরুর সঙ্গে শেখ আব্দুল্লাহর সুখের সংসার দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। নেহরু ও নেহরুতনয়া বারবার তাকে জেলে নিয়েছেন। আর এখন তো তার নাতীও জেলে!

তবে আমাদের শেষ কথা, মানুষ তদবীর করে যায়, আর তাকদীর কলম চালিয়ে যায়। সেই তাকদীর সম্পর্কেই হাদীছে ভবিষ্যদ্বাণী এসেছে গাযওয়ায়ে হিন্দ নামে। কাশ্মীর জিহাদ চালিয়ে যাবে, আর তাকদীরের ইনতিযার করবে। *

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা