যিলক্বদ ১৪৩০হিঃ (১৪)

রোযনামচার পাতা

অসহায় সেই ছেলেটি!

লিখেছেনঃ ফযলুল আমীন

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট
মানুষের জীবনে কিছু বেদনাদায়ক স্মৃতি থাকে সহজে ভোলা যায় না। তেমনি একটি স্মৃতি আজ মনে পড়লো, আর মনটা বিষণ্ন হয়ে গেলো। দু’বছর আগে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে টিকেট কেটে রাতের ট্রেনে নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। শীতের রাত। ট্রেনের ভিতরে এবং বাইরে গভীর অন্ধকার। কিছুই দেখা যায় না। শুধু ঝিক-ঝিক শব্দ শোনা যায়। ট্রেন চলছে দ্রুত গতিতে শক্ত লোহার পাতের উপর দিয়ে। জানালা খুলে বাইরে তাকাতে চেষ্টা করলাম, আর সঙ্গে সঙ্গে শীতল বাতাসের ঝাপটায় কাবু হয়ে গেলাম। ঠাণ্ডায় শরীর যেন জমে যায়। তাই তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে দিলাম। তারপর গরম চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। জেগে উঠলাম ট্রেন যখন থামলো নোয়াখালী বেগমগঞ্জ রেলস্টেশনে। এটাই আমার গন্তব্যস্থল। আল্লাহর শোকর যে, ঘুমটা সময় মত ভেঙ্গেছে, নইলে এবিষয়ে আমার তো মজার মজার অভিজ্ঞা ছিলো! যাক, তাড়াতাড়ি নেমে পড়লাম। নেমেই একটা দৃশ্য দেখে আমার পাদু'টো থেমে গেলো। কনকনে শীতে অল্প বয়সের একটি বালক বসে আছে জড়োসড়ো হয়ে। গায়ে কোন কাপড় নেই, শুধু একটা ছেড়া লুঙ্গি। অথচ আমি গরম কাপড়েও শীতে কাঁপছি! ছেলেটির কাছে এগিয়ে গেলাম। আমার চাদরটা তার গায়ে জড়িয়ে দিলাম। সে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। একটি দোকানে নিয়ে যখন নাস্তা খেতে দিলাম, ছেলেটি তখন ঝরঝর করে কেঁদে দিলো। আমি কিছুটা বিব্রত হয়ে বললাম, কী হয়েছে ভাই! অনে কষ্টে কান্না থামিয়ে বললো, আমার মায় কিছু খায় নাই! আমি স্তব্ধ হয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম অনেক্ষণ। আমার মনে হলো, এই ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকাও ইবাদত। শীতে কাঁপতে থাকা ক্ষুধার্ত একটি ছেলে সামনে খাবার পেয়েও ভাবছে তার মায়ের কথা, কাঁদছে তার মায়ের জন্য। মাদরাসায় দ্বীন শিক্ষা করা কত শত তালিবে ইলমের চেয়ে এই ছেলেটি উত্তম! আহা, কত সোনার ছেলে ছাইছাপা পড়ে লোকচক্ষুর আড়ালেই শেষ হয়ে যায়! আর কত ছেলে প্রাচুর্যে বেষ্টিত থেকেও নষ্ট হয়ে যায়! হায়, আমার যদি সাধ্য থাকতো এই ছেলেটির জন্য কিছু করার! কোথায় তোমার মা-বাবা! আমার প্রশ্নের জবাবে ছেলেটি যা বললো তাতে আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম। আমারো চোখদু'টো অশ্রুসিক্ত হলো। স্টেশনের কাছেই পলিথিনের ঝুপড়িতে ওরা থাকে। বাবা মারা গেছে কিছু দিন আগে। মা ভিক্ষা করে। ক’দিন ধরে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। মা-ছেলে আজ দু’দিন অনাহারে আছে। বড় এক দোকানে গিয়ে হাত পেতেছিলো মায়ের খাবারের জন্য। মায়ের জন্য খাবার জুটেনি, সে নিজে অবশ্য খেয়েছে, একটি চড়। দোকানদার নাকি বলেছে, ভিক্ষা করা তোদের অভ্যাস হয়ে গেছে। থলি ভরলেও তোদের পেট ভরে না। আমি আর জিজ্ঞাসা করলাম না, স্টেশনে এসে বসে আছো কেন? কারণ আমার মনে হলে, আল্লাহ তাকে এখানে বসিয়ে রেখেছেন আমার জন্য। পকেটে যে ক’টি টাকা ছিলো ছেলেটির হাতে দিলাম। তারপর অপরাধের অনুভূতি নিয়ে ছেলেটির সামনে থেকে যেন পালিয়ে বাঁচলাম। আমি কত অক্ষম, কত সামান্য আমার সামর্থ্য! যা করা আমার কর্তব্য ছিলো তা করার সাধ্য ছিলো না। সমাজে আমাদেরই চারপাশে এমন কত অসহায় ছেলে আছে, মা আছে, কে তাদের খবর রাখে?! কে জানে ছেলেটি এখন কোথায় কী অবস্থায় আছে! ওর অসুস্থ মা কি এখনো বেঁচে আছে! হে আল্লাহ ওরা যেন তোমার দয়া ও করুণা থেকে বঞ্চিত না হয়, আমীন।
শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা