জুমাদাল আখেরা ১৪৩১হিঃ (১৬)

রসের কলমদানি

বানর ও মানর

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

পেয়ারে বেরাদারান! আশা করি, তোমরা জানিত আছ, ইহা আমার পেয়ারা শেখ সা‘দির পেয়ারা গুলিস-াঁরররর মাহফিল। হরমাহীনা এখানে আমি ছন্দ গাঁথিয়া মনেরররর সুখে গুলিস-াঁ কিতাবের তরজমা লিখি। ত গত্যকল্য সেই বন্দোবস- করিতে গিয়া দেখি, আমার এত আদরেরররর কলমখানা গায়েবান! বিবি ছাহেবাকে জিজ্ঞাসা করিব, ‘কলমটি দেখিয়াছ’? বলিয়া বসিলাম, ‘কলমটি নিয়াছ’? ভাগ্য ভাল, তাহার তখন কাঁদিবার বা রাগিবারররর মুড ছিল না। তাই অল্পের উপর দিয়া গেল, শুধু কহিলেন, তোমার কলম নিয়া কী করিব, কাঁথা শিলাই করিব, না পিঠ চুলকাইব? ন্যায্য কথা, কিন' গেল কোথায়? জানা গেল, নাতিরররর হাতে উহা ‘শহীদান’ হইয়াছে। ইন্‌না লিল্লাহে ওয়া ইন্‌না ইলাইহে রাজেঊন! নাতি হইল মাসূম বাচ্চা, তাহাকে আর কী বলিব! কলমেরররর শোকে মনে মনেই কাঁদিলাম এবং আমারররর চক্ষু মুদিয়া আসিল। এদিকে কিছুকাল হইতে আমার হইয়াছে বড় এক দোষ; চক্ষু মুদিলেই কল্পনারররর ডানায় ভর করিয়া উড়িতে শুরু করি এবং এমন সব দৃশ্য অবলোকন করি, যাহা বয়ান করিলে লোকে বলে পাগল, আর বিবি ছাহেবা প-বর্গ হইতে সোজা চ-বর্গে চলিয়া যান এবং নাসিকাদোষে অযথা একটি চন্দ্রবিন্দু প্রয়োগ করেন! কিন' আজ চক্ষু মুদিয়া যাহা দেখিলাম তাহা বয়ান করিলে তৃতীয় কোন লকব জুটিবার জোর আশঙ্কা। তবু বয়ান করিতেছি- দেখি কী! নূরানি চেহারার এক বৃদ্ধ আসিলেন এবং বলিলেন, ‘বৎস! আমাকে চিনিতেছ? আমি মরহুম শেখ সা‘দি! অবাক-তাজ্জব! আমি কি খোয়াব দেখিতেছি! খয়ের, সালাম করিয়া বসিবার বন্দোবস- করিলাম এবং হালতে হালপুরসি করিলাম। তিনি বসিলেন এবং কহিলেন, বৎস, তুমি কি বিশ্বাস কর, মানুষ বানরেরররর বংশধর! আমি ত থ! (প্রিয় পাঠক! বর্ণমালায় ইহরা পড়শি বলিয়া ভুল করিও না, এখন ইহারা বর্ণ নহে, শব্দ।) জিভে কামড় দিয়া বলিলাম, আস্‌তাগ ফিরুল্লাহ, ইহা ত বড় গোমরাহির কথা হুযূর! তিনি মৃদু হাস্য করিয়া কহিলেন, চল, তোমাকে আজ অনেকগুলি ‘আস্‌তাগফিরুল্লাহ’ দেখাইব। -কোথায় হুযূর? -বানরখানায়। -সে আবার কী হুযূর! চিড়িয়াখানা নহে, স্রেফ বানরখানা! -প্রশ্ন করিও না বৎস! শুধু অনুগমন কর। করিলাম। বহু দূর গমন করিবার পর দেখি, সত্য সত্যই একটি বানরখানা! কারণ তথায় চিড়িয়া নাই, পশুও নাই, আছে শুধু কতগুলা বানরররর! একটি করিয়া খাঁচায় একটি করিয়া বানরররর! কিন' আজবকাণ্ড! বানরেরররর লেজ থাকে, ইহাদের লেজ নাই! আরও আজবকাণ্ড! চেহারা মানুষের মত, কথাও বলে মানুষের মত! আমি অবাক হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ইহাদের রহস্য কী হুযূর?! তিনি মৃদু তিরস্কার করিয়া বলিলেন, বৎস প্রশ্ন করিও না শুধু অবলোকন কর এবং জ্ঞান অর্জন কর। আমি বলিলাম, আচ্ছা প্রশ্ন করিব না, কিন' ইহারা এত শান-শিষ্ট কেন? বানরের মত বাঁদরামি করিতেছে না কেন? শেখ সাদি মৃদু হাস্য করিয়া কহিলেন, তুমি প্রশ্ন কর নাই, এই জন্য উত্তর দিতেছি; শোন; দুনিয়াতে ইহারা মানুষ ছিল, কিন-ু বানরের মত বাঁদরামি করিত, তাই বরযখে ইহাদিগকে বানরখানায় রাখা হইয়াছে। ইহাদের বদনখানা বরযখের, চেহারাখানা দুনিয়ার। তাই বরযখের বাসিন্দারা ইহাদিগকে বানর না বলিয়া বলে মানরররর। আমি বলিলাম, হুযূর, একটি প্রশ্ন; ইহারা ... তিনি ধমক দিয়া কহিলেন, সাবধান, প্রশ্ন করিও না। যাহা ফরমাইবার আমি নিজেই ফরমাইব। শেখ সা‘দী একটি খাঁচার সামনে আসিয়া থামিলেন। যেমন বড়সড় খাঁচা তেমন নাদুস-নুদুস বানর, কিংবা মানর! দেখিয়া আমি ত তাজ্জব! আচ্ছা, অবশেষে তবে ফান্দে পড়িয়াছেন, মিয়াছাব! শেখ সা‘দি বলিলেন, ইহা বানর- খানার সেরা মানর। দুনিয়াতে সে... -হুযূর, ছবিতে ইহাকে খুব চিনি, পাঠ্যপুস-কে ইহার বাঁদরামির কথা প্রচুর পড়িয়াছি। দুনিয়াতে ইহার শিস্যরা এখনও বলে, মানুষ বানরেরররর বংশধর। -সময় কম। চল, তোমাকে পাঞ্জাব মুলুকের মানরটি দেখাইব। অনেক দূর গিয়া তিনি একটি খঁচারররর সম্মুখে থামিলেন। মানরটি এক কোণায় গুটিসুটি বসিয়া ছিল। চেহরা দেখা যাইতেছিল না। ইচ্ছা হইল, একটু কাছে গিয়া চেহারাখানা দেখি। কারণ ইহার বাঁদরামির ছিল তুলনাহীন, একেবারে নবুয়তের উপর হামলা! কাছে গেলাম কিন-ু দুর্গন্ধে দাঁড়ান গেল না। আদবের সঙ্গে আরয করিলাম, হুযূর, আমি প্রশ্ন করিব না, কিন-ু এমন দুর্গন্ধেরররর কারণ কী? তিনি মৃদু হাস্য করিয়া কহিলেন, বৎস! তুমি প্রশ্ন কর নাই, তাই আমি একটি প্রশ্ন দ্বারা উত্তর দিব। তুমি কি জানিত আছ, কোথায় কীভাবে ইহার মউত হইয়াছিল? আমি বলিলাম, বুঝিয়াছি হুযূর! কিন' এইখানে আর দাঁড়াইলে...। শেখ সা‘দি কহিলেন, চল চল, আমারও একই অবস'া। -হুযূর, বাঙ্গাল মুলুকের একটা দুইটা মানরেরররর দেখা পাইলে ভাল হইত। -সময় অবশ্য কম; আচ্ছা, চল। মানরদের বাঙ্গালীপট্টি বেশী দূরে নহে। যাইতে দেরি হইল না, তবে ঢুকিতে বিলম্ব হইল। কারণ আবর্জনায় সারা রাস-া কাদা-কাদা প্রথম খাঁচার মানরটিকে চিনিলাম না, দ্বিতীয়টিকেও না। ইহাদের বাঁদরামি সম্পর্কে যদিও কিছুই জানি না, তবে চেহারায় বলে, একসময় খুব সেয়ানা ছিল। তৃতীয়টিকে দেখিয়াই চিনিলাম, আর আমার রক্ত গরম হইয়া গেল। কোনমতে শামাল দিয়া বলিলাম, কী কবি ছাহেব! কেমন ঠেকিতেছে? দুনিয়াতে ত বাঁদরামিরররর কবিতা এবং কবিতারররর বাঁদরামি যথেষ্ট করিয়াছেন! বাংলা কথা শুনিয়া বাঙ্গাল মুলুকের মানরটি হাউমাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, আর বলিল, দেশী ভাই রে! যেভাবে পার দুনিয়াতে ফেরত নিবার ব্যবস'া কর। কিরা কাটিতেছি। আর বাঁদরামি করিব না। আযানের সঙ্গে আর বেয়াদুবি করিব না। আযান শুনিবামাত্র মসজিদে দৌড় দিব, কখনো বলিব না, মোল্লার দৌড় মসজিদ। এখানে আসিয়া মালুম হইয়াছে, আসলে মোল্লার দৌড় বহু দূর! আমি কিছু বলিলাম না, একটুখানি মুচকি হাসিয়া সরিয়া আসিলাম। নিকটে কয়েকটি খাঁচা খালি ছিল। ভাবিতেছিলাম, এই খাঁচাগুলি... আমার মনের ভাব বুঝিয়া শেখ সা‘দি কহিলেন, তোমাদের মুলূকে সমপ্রতি নাকি খুব বাঁদরামি হইতেছে! কেহ মঙ্গল প্রদীপ জ্বালায়, কেহ ভাস্কর্যের নামে মূর্তিচর্চা করে, কেহ রবীন্দ্রসঙ্গীত দ্বারা সভা উদ্বোধন করে, আর একটি দুষ্ট গোলাম নাকি সকলকে টেক্কা দিয়া শরীয়ত বদলাইবার প্রলাপ বকে!! এই খাঁচাগুলি উহাদের জন্য আগাম বরাদ্দ করা হইয়াছে। তওবা না করিলে বরযখের বানরখানায় তাহাদিগকে মানরের যিল্লতি ভোগ করিতে হইবে। এক কাজ করিও। যাহা দেখিলে দুনিয়াতে গিয়া হুবহু বয়ান করিও, হয়ত উহারা সতর্ক হইবে। এই কথা বলিয়া শেখ সা‘দি হঠাৎ গায়েবারন হইয়া গেলেন, আমারও হঠাৎ চক্ষু খুলিয়া গেল এবং কল্পনার ঘোর কাটিয়া গেল। দেখি, বিবি ছাহেবা আমার দিকে চাহিয়া মিটিমিটি হাসিতেছেন। একটি তির্যক হাসি উপহার দিয়া তিনি বলিলেন। মেড-ইন কল্পনা, এই বার কী গল্প করিয়াছ রচনা! তবে এমন কিছু বয়ান করিও না, যাহাতে প-বর্গ ও চ-বর্গ একত্র করিতে হয়।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা