শাবান ১৪৩৯ হিঃ (৩/৪)

রসের কলমদানি

কী হনুরে! মুই কার খালুরে!!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

ইহা রসে টইটুম্বুর একটি লেখা। প্রিয় পাঠক, ইহাকে বেশী কাত করিয়া পড়িও না; তাহাতে রসটুকু পড়িয়া যাইতে পারে!

 

পেয়ারে পাঠকান ও পাঠিকান! তোমাদের প্রত্যেকের জন্য একখান করিয়া সালাম, বহু দিন হইল আমার নিকট পড়িয়া আছে। আশা ছিল, পুষ্প আসিবে, আর তোমাদের সালাম তোমাদের হাওয়ালা করিয়া আমি নাখান্দা গোলাম হোসেন দায়মুক্ত হইব। বিলিভ কর, আচ্ছা, বিলিভ করিতে না পার, একীন কর, একীনও যদি করিতে না পার, বিশ্বাস কর; আমার নিয়তে কোন খারাবি ছিল না। যাহাকে বলে খালেছ দিলের খালেছ নিয়ত। কিন্তু সেই নিয়ত আর পুরা হইল না; কেন হইল না তাহাও বুঝিলাম না। শেষে এক আকেলমন্দ ব্যক্তির সঙ্গে মুলাকাত হইল। তিনি সবকিছু খোলাছা করিয়া এবং যথেষ্ট পরিমাণে ফরসা করিয়া বুঝাইলেন, সমস্যটা কোথায়! তিনি বলিলেন, দেশে এখন কোন খালেছ জিনিসের কদর নাই। খালেছ দিল, আর খালেছ নিয়তের তো বিলকুল কদর নাই! কদর শুধু জাল ও ভেজালের! সুতরাং যদি পার দিলের অন্দরে আর নিয়তের বন্দরে থোড়া জাল এবং একটু ভেজাল মিশাইবার চেষ্টা কর। দেখিবে দিলের মর্তবা এবং নিয়তের ফযিলত ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাইতেছে!

তাজ্জব কি বাত! ক্যায়সা না-খান্দা কথা! ক্যায়সি বেÑখান্দা বাত! চিরকাল বাবার মুখে এবং দাদার যবানে শুনিয়া আসিলাম, খালেছ দিলে খালেছ নিয়তে যাহা করিবে তাহাই কবুল হইবে। এখন একি কথা শুনি অরিন্দম! তবে কি ইহা দিনবদলের ফযিলত? বদলে আর বলদে তবে ফারাক রহিল কোথায়?! নাহ, দাল মেঁ কুছ কালা হায়! কিন্তু তিনি তো আকেলমন্দ! এমনকি রীতিমত দানেশমন্দ! কত সরকার আসে, কত সরকার যায়; কত কপাল ভাঙ্গে, কত কপাল জোড়া লাগে, তিনি মাগার কোথাও যান না, সুতরাং তাহাকে আসিতেও হয় না। তাহার কপাল কখনো ভাঙ্গে না, সুতরাং জোড়া লাগিবারও প্রশ্ন আসে না! কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন আসিল। আমি প্রশ্ন করিলাম, ‘বড়ই উঁচা দরজার নছিহত করিয়াছেন জনাব! তবে তাহাতেও কি জাল ও ভেজালের মিশ্রণ আছে!

তিনি হাস্য করিলেন এবং স্বীকার করিব, দাঁতের কিছু ঘাটতি আছে বটে এবং নীচের ঠোঁট অনেকটা ঝুলিয়া পড়িয়াছে বটে, তবে এই বয়সেও হাসিটি তাহার বড় সুন্দর! যাহাকে বলে বাঙ্গালের মুখে লন্ডনি হাসি!

তো তিনি হাসিলেন। হয়ত ইহা দিলখোলা হাসি নহে, তবে মুখখোলা হাসি অবশ্যই। কারণ পড়িয়া সরিয়াও যে কয়টি দাঁত অবশিষ্ট আছে ঐ একহাসিতেই সবকয়টি দাঁতের দর্শন লাভ হইল, এমনকি আক্কেল দাঁতখানিও দেখিতে পাইলাম এবং ধন্য হইলাম। ধন্য হইবার কারণ আছে। ছোটকালে আমার নাকি আক্কেল দাঁত গজায় নাই। বাবা যখন বিরক্ত হইতেন, বলিতেন, তোর আক্কেল দাঁত কি কোন কালে গজাইবে না! তো ভাগ্যদোষে যাহার আক্কেল দাঁত কোন কালেই গজাইল না, তাহার পক্ষে এমন দানেশমন্দ ব্যক্তির আক্কেলদাঁতখানি দেখিতে পাওয়া কি কম কিসমতের!

খয়ের, তিনি হাস্য করিলেন এবং কহিলেন, লম্বা কথা বলিব না, সময় কম, অর্থাৎ ‘টাইম সট’। কারণ সম্প্রতি আমি ‘জাল ও ভেজাল’ বিষয়ে একখান কেতাব লিখিতেছি। তো শোনো, আমি শুধু একটি প্রশ্ন করিব, তুমি দুইটি উত্তর দিবা। ইহাতেই সবকিছু তোমার চোখের সামনে, এমনকি চোখের পিছনেও ফরসা হইয়া যাইবে। প্রশ্নটি শোনো, দেশপ্রেম কী এবং দেশপ্রেমিক কাহাকে বলে? না, না ভুল বুঝিও না; দেখিতে এখানে প্রশ্ন দুইটি বটে, তবে আসলে ইহা একই প্রশ্নের এই পিঠ ঐ পিঠ। নাও এইবার তুমি আমার প্রশ্নের দুইটি উত্তর দাও।

আসলে দুইটি তো দূরের কথা,  দেখিতে শুনিতে মোটামুটি চলনসই একটি উত্তরও মাথায় আসিতেছিল না, তাই কিছুটা সময়ক্ষেপণের উদ্দেশ্যে বলিলাম, কিন্তু জনাব এখন তো ‘পার্সেন্টিজ’-এর যমানা। সুতরাং আগে খোলাছা করুন, কত পার্সেন্ট দেশপ্রেম এবং কত পার্সেন্ট দেশপ্রেমিক সম্পর্কে আপনার প্রশ্ন!

তিনি অবাক চোখে আমার দিকে তাকাইলেন। যেন বুঝিতে চেষ্টা করিতেছেন, কাহার মুখে কী শুনিলেন! তারপর আমার পিঠ চাপড়াইয়া বলিয়া উঠিলেন, তোফা! তোফা!! তুমি তো বাপু বহুত বড়া ছুপা রুস্তম আছ! যাও, ছুয়াল-জওয়াবের তোমার জরুরত নাই। শুধু জাল-ভেজালের মিশ্রণকৌশলটা একটু শিখিয়া লও।

তিনি ‘জাল ও ভেজাল’ কেতাব লিখিলেন আমি পড়িলাম এবং শিখিবারও চেষ্টা করিলাম। হইল না! আসলে সব কিছু সবার হয় না। হয় না মানে হযম হয় না। চোখের সামনেই তো দেখিতে পাই, কতজন কত কিছু আহার করিল এবং দস্তুর মত বড় বড় লোকমা দিয়া আহার করিল। একটা দুইটা ঢেকুর তুলিল, আর দিব্বি হযম হইয়া গেল! কিন্তু সেনকে পাইয়া বসিল শনিতে। ছোট্ট একটি লোকমা, হযম হইল না! গলায় আটকাইয়া গেল। বেচারা এখন গিলিতেও পারে না, ফেলিতেও পারে না।

না, বাবা, না; জাল-ভেজালে কাজ নাই। যাহা করিব খালেছ দিলে খালেছ নিয়তেই করিব। আজ না হয় কাল, খালেছ দিলের খালেছ নিয়তের সুফল ফলিবেই।

তত দিন অপেক্ষা করিতে আপত্তি কী! আফটার অল সবুরে মেওয়া ফলে বলিয়াই তো জানি!!

কিন্তু সমস্যা দেখা দিল। সম্প্রতি সালামের থলিয়াটি খুলিয়া দেখি, সবকয়টি সালামে মরিচা ধরিতেছে। নাহ, আর বসিয়া থাকা যায় না, পুষ্পের পাতায় না হউক, কাউছারের পাতায় তোমাদের সালাম তোমাদের হাওয়ালা করিয়া দেইÑ

আস্সালামু আলাইকুম।

আচ্ছা, তোমরা ওয়ালাইকুম সালাম বলিবার ফাঁকে একটি মজার খবর বলি। খবরটি যে মজার তাহাতে কোন সন্দেহ নাই, সন্দেহ কিঞ্চিৎ থাকিতে পারে, তবে শকশোবা বিলকুল নাই, আরে মিয়াঁ, শকশোবা যদিও বা থাকে, ডাউট একেবারেই নাই। ইডিয়ট ছাড়া কেহ ডাউট করিবে না।

খয়ের খবরের বয়ানখানা কীভাবে শুরু করিব! বরাবর দেখিয়াছি, শুরুটাই যত মুশকিল; একবার শুরু হইলে শেষ হইতে আর দেরী লাগে না! কিন্তু শুরুটাই যে হইতে চাহে না!

আচ্ছা, কিলবিল এবং ঝিলমিল দিয়া শুরু করা যায় না! যায় তো! যাক বাবা, শুরু করিবার একটা পথ যখন পাওয়া গেল শেষ হইতে আর সময় লাগিবে না।

হাঁ, কিলবিল এবং ঝিলমিল!

আমার স্ত্রী মানুষটি এমনিতে যথেষ্ট নিরীহ টাইপের। কথা বলেন আরো নিরীহ গোছের। যেন কিচ্ছুটি জানেন না, কিচ্ছুটি বোঝেন না; এমনকি রান্নাঘরে নিজে মাছ ভাজা করিলেও ভাজা মাছটি উল্টাইয়া আহার করিতে পর্যন্ত জানেন না! তবে মাঝে মধ্যে একটি দু’টি শব্দ এমন বলেন যে, তাক না লাগিয়া পারে না।

উদাহরণ চাও? সে তো তোমার সামনেই উপস্থিত। ঐ যে, কিলবিল এবং ঝিলমিল!

আচ্ছা খোলাছা করিয়া বলি,

সেদিন সন্ধ্যায় বড় আয়েশ করিয়া এককাপ চা পান করিলাম। এদিকে আমি চায়ের কাপে শেষ চুমুকটি দিলাম, ওদিকে তিনি যতœ করিয়া তৈরী করা পানের খিলিটা বাড়াইয়া দিলেন। আমি মুখে পুরিয়া বলিলাম, কি করি বল তো! হাতের কাছে পুষ্পটা নাই। কবে যে আসিবে তাহারও ঠিক নাই, এমনকি ঠিকানাও নাই! এদিকে আমার মাথায় একটি লেখা কিলবিল করিতেছে!

বলিয়াই মনে হইল, শব্দচয়ন ঠিক হইল না। লেখার শব্দগুলি, হরফগুলি কি পোকা যে মাথার অন্দরে কিলবিল করিবে? নাহ, সেই কবে দাড়িতে পাক ধরিয়াছে, এখনো শব্দচয়ন ঠিক হইল না! সাধে কি আর বলে, ‘বাচ্পান মেঁ না হো, তো পাচ্পান মেঁ ভী নেহীঁ হোতা’। বাংলায় বলে, না হয় যদি নয়ে, হয় না তবে নব্বইয়ে। নব্বই হইতে আমার দেরী আছে, তবে ‘পাচ্পান’ ইতিমধ্যেই পার হইয়া গেছে।

মনের মধ্যে এই সব ভাবিতেছি, তখন স্ত্রী বলিয়া উঠিলেন, মাথার মধ্যে লেখা কিলবিল করিবে কেন, বল ঝিলমিল করিতেছে। লেখা তো পোকা না, লেখা হইল আলো!

সত্যি তো! লেখা তো আলো! লেখা কিলবিল করে না, ঝিলমিল করে। কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে স্ত্রীর প্রতি তাকাইলাম; ভাবিলাম। আহা, এমন মানুষটি লেখক বা লেখিকা একটা কিছু হইল না কেন?!

যাক, বলিলাম, একটি লেখা ঝিলমিল করিতেছে এখন কি করি বল। এবার তিনি আরো চমক দিলেন, বলিলেন, লেখা ঝিলমিল করিতে তো বিজলী লাগে না, কম্পিউটার ‘অন’ করিতে লাগে! এদিকে কাগজ কলমের লেখা তো ভুলিয়াই গিয়াছ! সুতরাং বিজলী আসা পর্যন্ত সবুর কর।

আচ্ছা, ছবর করিলাম। তবে এই ফাঁকে লেখার শিরোনামটি চিন্তা করা যায়! .... তো আমার লেখার শিরোনাম হইল ‘খালা ও খালু’।

পেয়ারে পাঠকান ও পাঠিকান! শিরোনামটি কি পছন্দ হইল?

হয় নাই! না হউক, তবু অনুরোধ করিব, লেখাটি শেষ পর্যন্ত না পড়িয়া উঠিও না। অনেক দিন পর আমার অনেক সাধের লেখা!

কী বল! খালা ও খালু বড় বেশী মুসলমানি শব্দ! গরুর গোশতের গন্ধ! চিন্তা করিও না, আমার কাছে বিকল্প শব্দ আছে। সীমান্তে অবশ্য কাঁটাতার আছে এবং ‘পাখী’ শিকারের উৎসব চলিতেছে। তা চলুক, এত এত ফেনিসিডিল যখন নির্বিঘেœ ‘আমদানি’ হয়, দুই চারিটা শব্দ আমদানি করিতে সমস্যা কী।

 

দাদাদের পছন্দ যেন কী?! মাসী ও মেসোমশাই! এই তো, গরুর গোশতের গন্ধটা দিব্বি কাটিয়া গেল!

ঐ পারে আমাদের দাদা আছেন, প্রণবদা; দিদিও আছেন, মমতাদি! মাসী কি আছেন? মেসোমশাই? হয়ত আছেন, এখনো মঞ্চে আসেন নাই, এই যা! আসিতে কতক্ষণ! তখন হয়ত দু’তিন ঘটি জল চাহিলে পাওয়া যাইতেও পারে। অন্তত মিষ্টি একটি আশ্বাস!

ততদিনে আমি বুবুজানের লফযগুলা ইয়াদ করিয়া লই। আসলে দুই চারিটা লফয ইয়াদ করা তেমন কঠিন কিছু নহে। কঠিন ব্যাপার হইল, লফযের ইসতিমাল, মানে ইউয, ইয়ানে ব্যবহার। হাঁ, প্রতিটি লফয ব্যবহার করিবার নিজস্ব ক্ষেত্র আছে। আমাদের পাড়ায় বুবুজানের বড় বদনাম, তিনি বড় বেফাঁস লবয ইস্তিমাল করিয়া থাকেন। যতই বলি, আব্দার বল মিনতি বল, এমনকি তিরস্কার বল, খাছলতের এবং খাছিয়তের কোন রববদল নাই! ধর, সেদিন বয়সে বড়, অর্থাৎ কিনা মুরুব্বি সাইজের একজন সম্পর্কে বলিয়া বসিলেন, তার নাকি, ‘কী হনুরে, মুই কার খালুরে!’ স্বভাব!

পাড়ায় রিরি পড়িয়া গেল। গেল তো গেল, কাদামাটি হইতে আর উঠিল না। ঐ দিকে বুবুজান দিব্বি নির্বিকার, যেন বড় একখান  মজার কাণ্ড ঘটাইয়াছেন!

এইদিকে বুবুজান, লোকাল এলিকশনের চিন্তা করিতেছেন। তো এই ফাঁক দিয়া উপদেশের একটা ‘ফাল’ ঢুকাইয়া দিলাম, বুবু, সামনে ভোট, এই বার একটু সাবধান হও।

ডেমক্যায়ার হাসিটি মুখে ঝুলাইয়া বলিলেন, চিন্তা করিস না ভাই। এখন ভোটে ভোটার লাগে না! আর ব্যালটপেপার দিনের আলোতে বাক্সে ঢোকে না!!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা