মুহাররম ১৪৪৫ হিঃ

রসের কলমদানি

পার্কের জলসা ও মোবাইলের আলাপ!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট


ইহা রসে টইটুম্বুর একটি লেখা। প্রিয় পাঠক, ইহাকে বেশী কাত করিয়া পড়িও না; তাহাতে রসটুকু পড়িয়া যাইতে পারে!পেয়ারা পাঠকান এবং পেয়ারি পাঠিকান! আমি অধম গোলাম হোসেনের পাক যবান হইতে একটি প্রশ্ন শ্রবণ কর: ‘পার্ক মানে কী?

না, না পেয়ারে পাঠকান ও পাঠিকান! ইহা বেয়াড়া কোন জিজ্ঞাসা নহে, রীতিমত গুরুতর প্রশ্ন, মানে কিনা সিরিয়াস কোয়েশ্চন, অর্থৎ কি না খতরনাক ছুয়াল।  তোমার হাতে এবং আমার পায়ে এখন যথেষ্ট সময় আছে; আর অবসর আছে যথেষ্টরও বেশী। সুতরাং এখনই এত উতালা হও কেন! ধৈর্যের আঁচল শক্ত করিয়া ধর এবং ছবরের দামান মযবূত করিয়া পকড়াও কর। অতঃপর ধীরে সুস্থে চিনতিয়া ভাবিয়া আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। অতপর প্রশ্ন এবং উহার উত্তরের মাজেযা কারামাত অবলোকন কর। অবশ্য তোমাদের দেমাগ এবং দেমাগের বুদ্ধি সম্বন্ধে ইতিপূর্বে অমি অধম যতটা গবেষণা ও জরীপ পরিচালনা করিয়াছি তাহাতে খুব একটা ভরসা করিয়া বলিতে পারি না যে, তোমাদের মস্তিষ্কপ্রসূত উত্তরগুলা খুব একটা কাজের কাজ বলিয়া প্রমাণিত হইবে। তবে কিনা শরীরচর্চার বিবিধ উপকারিতা যেমন রহিয়াছে তেমনি মস্তিষ্কচর্চারও বহু ফায়দা আছে। পার্থক্য শুধু এই যে, ব্যায়ামের উপকারিতার বয়ান যেমন বিভিন্ন কিতাবে লিখিত হইয়াছে, অদ্যাবধি কোন কিতাবে মস্তিষ্কচর্চার বয়ান তেমন করিয়া লিখিত হয় নাই। কেন হয় নাই? কারণ অতি সরল। আমি গোলাম হোসেন অদ্যাবধি এই বিষয়ে কলম ধরি নাই! প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন উঠিতেই পারে, কেন কলম ধরি নাই? কারণ আমার কলমখানি বহুদিন একনাগাড়ে চলিতে চলিতে সম্প্রতি বড্ড ক্লান্ত এবং খানিকটা শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছে। তো বেচারা ক্লান্ত শ্রান্ত কলমখানিকে আমি গোলাম হোসেন  নিজেই বিশ্রামে রাখিয়াছি। শুধু রাখি নাই, বরং সুন্দর একটি অবকাশ যাপনের নিমিত্ত উহাকে দূরে আমার বাগান বাড়ির অবকাশ কেন্দ্রে প্রেরণ করিয়াছি। এখন আমি নিজে কীভাবে উহাকে অবকাশ হইতে ডাকিয়া আনি! তবু একবারের জন্য বিষয়টি যে ভাবি নাই তাহা নহে। ভাবিয়াছি এবং অত্যন্ত ‘ডিপলি’ ভাবিয়াছি। কিন্তু হঠাৎ কী হইল? আমার মুরদা বিবেক যিন্দা হইয়া তিরস্কার করিয়া উঠিল, বেটা বুদ্ধু! বলি, তোর আক্কেল কি ঘাস চরিতে গিয়াছে? ভুলিয়া গিয়াছ বোধ হয়, এটিএমের দল এখন মহা ধুমধামে ইভিএমের নৌকায় চড়িয়া মেয়র নির্বাচনের নদী পাড়ি দিতেছে। ভাবিয়া দেখ্,  দেশ ও দশের এই রূপ কল্যাণের শুভমুহূর্তে তোর হাতের কলম যদি আঙুলের ডগায় চড়িয়া বসে, দেশের ও দশের কপালে তো বটেই, স্বয়ং তোর কপালে কী অশুভ লগ্ন উপস্থিত হইতে পারে! কারণ সবাই জানে না, তবে আমি বিলক্ষণ জানি, তোর কলমের অনেকগুলা বদ অভ্যাস আছে, তন্মধ্যে একটা হইল, তুই না চাহিলেও, পরিবেশ পরিস্থিতির তোয়াক্কা না করিয়াই তোর বেয়াড়া কলম সত্য কথা কহিতে চায়। এমনকি টুটি চিপিয়া ধরিলেও উহার যবানের, বরং নিবের ডগা হইতে চিঁহি চিঁহি করিয়া সত্যকথা নির্গত হইয়া পড়ে। বেরাদর, বুঝিয়া লও, ‘যামানা খারাব হায়’। সুতরাং ক্লান্ত শ্রান্ত কলম ইবনে কলম বিশ্রামে আছে বিশ্রামে থাকিতে দাও। এই ফাঁকে তুমিও খানকটা বিশ্রাম সারিয়া লও। কারণ ভাষার মাসের শুরুতেই ডাক পড়িতে পারে, আর তখন মায়ের ভাষার শ্রাদ্ধ করিয়া লিখিতে হইবে...

এটিএম বাবু সত্য কহিয়াছেন, ইভিএমে কোন কারচুপি হয় নাই এবং উহাদের কোন চক্রান্ত সফল হয় নাই। জনগণ উহাদের প্রত্যাখ্যান করিয়াছে এবং কিশ্তি কিস্তিমাত করিয়াছে!আমি সবিনয়ে নিবেদন করিলাম, আপনি বিবেক মহাশয়, মুরদা ছিলেন, ভালোই ছিলেন! আপনার দিলে হঠাৎ জাগিবার খাহেশ কেন জাগিল? বিবেক চোখ টিপিয়া কোন দিকে যেন ইঙ্গিত করিয়া কহিল, বৎস তোমাকে উদ্ধার করিবার নিমিত্ত। শোন, অন্তত কারপচুপি -হীন ভোটের কারচুপি সাঙ্গ হইতে দাও। তারপর না হয়...আমি অধম অধিকতর বিনয় নিবেদন করিয়া কহিলাম, আমি তো কিশতি ও কিস্তিমাত সম্বন্ধে কিছুই লিখিব না, আমি লিখব খুব নিরীহ একটি লেখা, অর্থাৎকিনা মস্তিষ্কচর্চার উপকারিতা! দেখা যাইতেছে, আমার মুরদা বিবেক যিন্দা হইয়া বড় মুন্সিয়ানা হাছিল করিয়াছে, মুচকি হাসিয়া কহিল, তোমার কলমের উপর কী ভরসা! যদি মস্তিষ্কচর্চার উপকারিতা’ লিখিতে গিয়া লিখিয়া বসে, ‘পেশিচর্চার উপকারিতা’! কিংবা আরো বেয়াড়া হইয়া যদি লিখিয়া বসে, ‘পেশিচর্চার মাধ্যমে ভোটকেন্দ্র দখল’ কিংবা ‘এটিএম ও ইভিএমসখ্য’ এবং নযিরবিহীন কারচুপি!

***

খয়ের, একটুখানি ছবর কর পেয়ারা পাঠকান ও পিয়ারি পাঠিকান! ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশী তাকে দেব’ এই আপ্ত বাক্যের গরম মৌসুমটা নির্বিঘ্নে পার হইতে দাও। তারপর জম্পেশ একখান লেখা লিখিব মস্তিষ্কচর্চার উপকারিতা সম্বন্ধে। আপাতত আমার কথা বিশ্বাস করিয়া অত্যন্ত যত্নের সহিত মস্তিষ্কচর্চা-পূর্বক আমার প্রশ্নের উত্তর চিন্তা কর, পার্ক মানে কী? আচ্ছা শোন, আমি গোলাম হোসেন নিজেই তোমাদের মুশকিল আসান করিয়া দিতেছি। পার্ক মানে গার্ডেন, গার্ডেন মানে উদ্যান, উদ্যান মানে গুলিস্তান! আরে না না, ঢাকা শহরের বেয়াড়া যানজটের গুলিস্তান নহে, রীতিমত শেখ সাদীর ফুল ও গুল-এর গুলিস্তাঁ।এখন শোনো, এই প্রশ্নের আবশ্যক কেন হইল? ঘটনা আর কিছু না! চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের ওসি সাহেবের কিনা মাথা গরম হইল, আর তিনি কী করিয়া বসিলেন? কিংবা বসিয়া কী করিলেন? না, থানায় থানায় তাহার বুদ্ধিমান সতীর্থগণ যখন ‘লক্ষীচর্চা করিতেছেন তখন তিনি কিনা একেবারে দিনে দুপুরে ‘পার্কে’ অভিযান চালাইয়াছেন প্রেমচর্চা বন্ধ করিবার অগণতান্ত্রিক উদ্দেশ্যে! কে না জানে, প্রেমের চর্চা করা বর্তমান যুগের মহৎ কার্যগুলার মধ্যে অতিউত্তম একটি কার্য। কিন্তু ওসি সাহেবের এক কথা, স্কুল ফাঁকি দিয়া পার্কে বসিয়া প্রেমচর্চা চলিতে পারে না। ইহাতে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত নষ্ট হইতে পারে! লে বাড়াক্কে গাবতল্লী! ওসির মুখে এ কী কথা আজ শুনি গো অরিন্দম! ওসির পো কি জানিত নহেন, কুছ পানে কে লিয়ে কুছ খোনা পড়তা হায়!’ কিছু অর্জন করিতে হইলে কিছু বর্জন করিতে হয়! তো প্রেম অর্জন করিবার জন্য বিদ্যাবর্জন, মন্দ ছিল কী! বিদ্যা এখন এমন কী কাজে আসে! এখন তো আর বিদ্যার সাবেকি আধিপত্য নাই, আছে শুধু সনদের দৌরাত্ম। উহা আবার অর্জন করা যায় রীতিমত দোকান হইতে ‘পণ্য’ আকারে। নাহ ওসি মহাশয় আসলেই বখিয়া গিয়াছেন। ধারণা করি তাহাকে লইয়া ওসিমহলের আড়ালে আবডালে ইতিমধ্যে যথেষ্ট হাসিতামাশা শুরু হইয়াছে। ওসির বেটার যদি ঘটে কিঞ্চিৎমাত্র বুদ্ধি থাকিত, সবকয়টা জোয়ান ছোঁড়া ছুঁড়িকে হাজতে ভরিতে পারিতেন। অতপর ‘তিজারতের মাধ্যমে ছাড়িবার ব্যবস্থা করিতে পারিতেন। কিন্তু না, তেমন বুদ্ধি ঘটে ধারণ করিয়া তিনি ধরাধামে আগমন করেন নাই। খবরে প্রকাশ, ‘যুবক ও যুবতী’ বয়সের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত এবং অভিভাবকদের মানসম্মানের কথা চিন্তা করিয়া অতিগোপনে যুবক-যুবতীদের তিনি নিজ নিজ বাড়িতে প্রেরণ করিয়াছেন। খবরে আরো প্রকাশ, প্রত্যেক যুবক যুবতীকে তিনি একটি করিয়া ‘নছীহত পুরিন্দা দান করিয়াছেন, যাহার মর্মার্থ হইল, বিদ্যা অমূল ধন, আর প্রেমরোগ সর্বনাশের মূল। সুতরাং প্রেমরোগ বর্জন কর এবং বিদ্যাধন অর্জন কর।

***

বেচারা সত্যি একখান আস্ত অপদার্থ! ইহার চেয়ে তো মোবাইল কোম্পানি গুলার ঘটে যথেষ্ট বুদ্ধি ধরে। খুব বেশী দিন আগের কথা নহে, মোবাইল কোম্পানিগুলা এমনই ‘ছাত্রবান্ধব’ ইহয়া উঠিয়াছিল যে, রীতিমত ঘোষণা দিয়া প্যাকেজ ছাড়িয়াছিল, রাত দশটা হইতে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত মোবাইল একদম ফ্রি। কপোত-কপোতি যত ইচ্ছা কথা বল, বিনা পয়সায় এবং বিনা খরচায়। কোন কোন মোবাইল কোম্পানী রীতিমত সংবাদসম্মেলন করিয়া তাহাদের মহৎ উদ্দেশ্যের বয়ান দিয়াছেন, ছাত্রদের সেবা মানে তো জাতির সেবা। তো জাতির সেবার অতি সৎ উদ্দেশ্যে তাহাদের এই মহৎ উদ্যোগ। ব্যবসা-বাণিজ্য তো কতই হয়, এখানে না হয়...মাশাআল্লাহ্ বড় উমদা নতীজা আসিয়াছিল। ঘরে ঘরে যুবক ও যুবতী শিক্ষার্থী কামরার দরজা বন্ধ করিয়া নির্ঘুম রাত্রি যাপন করে। মা-বাবা জিজ্ঞাসা করিলে মুখখানা যথাসম্ভব নিরীহ করিয়া বলে, ফ্রেন্ডের সঙ্গে ডিসকাশন করিয়াছি। মা-বাবা কিছু বুঝিলেন, কিছু বুঝিলেন না, তবে ইহা বিলক্ষণ বুঝিলেন, ছেলে বড় এবং মেয়ে সেয়ানা হইয়াছে, ‘ডিসকাশনে’ বাধা দিলে হিতে বিপরীত হইতে পারে!

তবে কিনা, এই রূপ অতি মহৎ একটি ছাত্রসেবার মধ্যে গুরুতর একখান উপসর্গ ভর করিয়াছিল। অর্থাৎ স্কুলে স্কুলে ‘কোমলমতি’ ছাত্রছাত্রীরা নাকি রীতিমত শ্রেণীকক্ষেই নিদ্রাসেবা শুরু করিয়াছিল। শেষ পর্যন্ত বিষয়টা নাকি সংসদে গড়াইয়াছিল।...আগে বাড়িয়া, নিজে যাচিয়া কাহারো উপকারের যামানাই ইহা নহে। কোথায় প্রতিটা মোবাইল কোম্পানিকে মঞ্চে আনিয়া জাতীয় পুরস্কার, নিদেন পক্ষে একুশে পদক দ্বারা সম্মানিত করা ইইবে, সেখানে কি না, লাইসেন্স বাতিল করিবার হুমকি! অবশেষে উহারা ‘ছাত্রসেবা’ প্যাকেজ বন্ধ তো করিলই, দ্বিগুণ রাজস্ব গুনিল। এমনকি লাইসেন্স রক্ষা করিবার জন্য কতিপয় দেবতাকে ‘ফুল’ দ্বারা অর্চনা করিতে হইল, তবে কিনা যে দেবতা যে ফুলে তুষ্ট!

***

খয়ের কথায় কথায় বেলা অনেক গড়াইয়া গেল। সূর্য এখন ডোবে ডোবে...বিদায়ের আগে এই ফাঁকে অদেখা অচেনা ওসি মিঁয়াছাবকে একখান কথা বলিয়া যাই- ‘আপনার নির্বুদ্ধিতার নিন্দা না করিয়া পারি না, কারণ নির্ঘাত আপনার পোষ্যগণ অনাহারে কষ্ট পাইবে, তবে কিনা আপনার বুদ্ধির এবং সততার তারিফ না করিয়াও উপায় নাই। কারণ আপনার পোষ্যপরিজনের কপালে যাহাই থাকুক, আপনার মত ওসি জাতির মুখ উজ্জ্বল করিতে পারে। এখন দূর হইতে আপনাকে-মহাশয়- সালাম করিতেছি। যদি কখনো দেখা হয়, নিকট হইতে না হয় প্রণাম করিব। তবে মনে মনে একখান কামনা, অতিসত্বর আপনাকে রাজধানীর রমনা থানায় যেন বদলি করা হয়। কারণ এখানে একটি বড় পার্ক আছে, রমনা পার্ক!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা