মুহররম ১৪৩২ হি: (১৮)

রসের কলমদানি

বানর ও মানর

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

পেয়ারে পাঠকান ও পাঠিকান! হৃষ্ট-পুষ্ট একখান সালাম তোমাদের জন্য হাদিয়া। আশা করি, খোশদিলে উহা কবুল ফরমাইবা। ফিলহাল, মানে ‘ইনপ্রেজেন্ট’, অর্থাৎ বর্তমানে আমি না-খান্দা গোলাম হোসেন বড় বিপদে আছি। বানর এবং উহা হইতে উদ্ভূত মানর সম্পর্কে দুই দফা লম্বা লম্বা বয়ান ফরমাইলাম, তোমরা বাহবা দিলে আমিও পুলকিত হইয়া ভাবিলাম, যাক, বানর ও মানরের ঝামেলা বুঝি মিটিল, কিন্তু না! খবরে প্রকাশ, দিল্লীতে দাদাবাবুরা বানরদের উপর জবর যুলুম শুরু করিয়াছে! আর বানরেরা উপায়ান্তর না দেখিয়া আমি অধম গোলাম হোসেনকে স্মরণ করিতেছে! বল তো কী করি! মানিলাম, এই প্রাণীটি বেজায় বাঁদর এবং বাঁদরামি করা ইহার, যাহাকে বলে, পয়দায়েশি খাছলত মানে ‘হেবিট’ অর্থাৎ স্বভাব! খাছ করিয়া মানুষের সঙ্গে বাঁদরামি করিতে উহারা বহুত আরাম বোধ করে।  কিন্তু মানুষ হইয়া বানরের উপর যুলুম, ইহা কী সঙ্গত হইতে পারে! পারে না, কিছুতেই না।  

এই দেখ না, দাদারা সীমান্তে কত রকম উৎপাত করে, জোর করিয়া ঢুকিয়া পড়ে, জবরদস্তি ধরিয়া লইয়া যায়। (পরে অবশ্য দেহখানা ফেরত দেয়। যদি জিজ্ঞাসা কর, দাদা, ইহার দেহে তো অতি দুর্বল একখান রূহ ছিল, সেই রূহখানা কোথায় গেল? দাদারা গোঁফের আড়ালে মুচকি হাসিয়া বলে, ‘সোয়ার্গ মেঁ’!), পুশব্যাক করে, ‘পাখী’ শিকার করে, কত কিছু করে! কিন্তু দাদারাই সাক্ষী, আমি গোলাম হোসেম কখনো প্রতিবাদ করি নাই। কারণ দেখিতে শুনিতে দাদারা তো মানগোত্রের অর্ন্তভুক্ত, সুতরাং প্রতিবেশী মানুষের উপর, বিশেষ করিয়া উহারা যদি হয় হরিজন এবং ম্লেচ্ছ, একটু আধটু যুলুম করিতেই পারে। ইহাতে মাইন্ড করিলে তো সংসার চলে না। কিন্তু ডাইরেক্ট বানরের উপর যুলুম! মানুষ হইয়া বাঁদরামি! ইহা তো চুপচাপ হযম করা যায় না। চিঁহি চিঁহি সুরে হইলেও একটা কিছু ‘পরতিবাদ’ করিতেই হয়! তাই বেরাদারানে মিল্লাত, আজ বড় হিম্মত করিয়া দিল্লীর বানর মযলূমানের পক্ষে দুইখান কথা কহিতে চাই। বাঙ্গাল বলিয়া আমাদের না হয় মানবাধিকার নাই, কিন্তু উহারা তো ‘দিল্লী কা বান্দার’! উহাদের কি ‘বানরাধিকার’ নাই! আলবত আছে!  

তোমাদের দিলে দেমাগে এবং আরো কোন অঙ্গে প্রশ্ন জাগিতে পারে যে, দাদারা তো রীতিমত বানরপূজা করে; তো পূজারী হইয়া পূজ্যদেবের উপর যুলুম করা কীরূপে সম্ভব? প্রশ্নটার মধ্যে থোড়াবহুত আকলমন্দি আছে সন্দেহ নাই, তবে ইহাও নিঃসন্দেহ যে, দাদাদের সম্বন্ধে তোমার জ্ঞানের যথেষ্ট নোকছ, মানে ‘সর্টেজ, অর্থাৎ ঘাটতি আছে। তো আইস, প্রথমে তোমার জ্ঞানের ঘাটতি দূর করি। আরে মিয়াঁ, দাদাদের সবকিছুই তো তাজ্জব কি বাত! বেরুবাড়ী হইতে পাদুয়া-রৌমারি এবং জৈন্ত্যাপুর, দেখ না কেমন চমৎকার বন্ধুবাৎসল্য! এদিকে ফারাক্কার ফাড়া না কাটিতে টিপাইমুখে বাঁধ দিয়া মুখটিপিয়া হাস্য করিতেছে, ওদিকে উজানে চীনারা বাঁধ দেয় বলিয়া মুখভার করিতেছে। তাজ্জব কি বাত!

আর পূজার কথা বল কেন! দাদারা তো এমনই আদর্শ পূজারী যে, দেবীকে জলে ডোবাইয়া তবেই পূজা সাঙ্গ করে! সুতরাং প্রয়োজনে পূজ্যদেব বানরের লেজ কাটিয়া দিবে, দিল্লীছাড়া করিবে, ইহাতে তাজ্জবের কী আছে!

তাছাড়া বানরের সঙ্গে দাদারা যাহা কিছু করিতেছে স্বয়ং ‘ভগবানের’ আদেশেই তো করিতেছে! কী হইল, মুখ হা করিয়া চাহিয়া আছ যে! আগাগোড়া এবং গোড়াআগা কিছুই বোধগম্য হইতেছে না! তবে আইস, আগা ত্যাগ করিয়া গোড়ায় অবতরণ করিয়া ঘটনাটি বর্ণনা করি।

তোমাদের ঘটে যদি কিঞ্চিৎ বুদ্ধিও থাকে, আশা করি বিষয়টি জলবৎ তরলং হইয়া যাইবে! বাকি আল্লাহ ভরসা।

না, আমি আসমানী ভগবানের কথা বলিতেছি না, মার্কিন মুল্লুকের যমীনী ভগবানের কথা বলিতেছি। তো সম্প্রতি ভগবান এলান ফরমাইয়াছেন, সেলোয়ারের বদলে এইবার তিনি ধুতি ধারণ করিবেন। অর্থাৎ পাকিস্তানের বদলে হিন্দুস্তান সফর করিবেন। তাজ্জব কি বাত! আমেরিকার দোস্তির জন্য পাকিস্তান কী না করিতেছে! ত্রাসের মাধ্যমে সন্ত্রাস দমন করিতেছে! তালেবান ধরিয়া জবাই করিতেছে! ফউজের মাধ্যমে দেশের জনসংখ্যা ‘নিয়ন্ত্রণ’ করিতেছে! সেই পাকিস্তানের দাওয়াত না-কবুল! পিন্ডির বদলে দিল তাহার দিল্লীতে! কাঁঠাল ভাঙ্গিব আমি, কোষ খাইবে তুমি! বেচারা পাকিস্তান কিছু মাইন্ড করিতেই পারে। ভগবান অবশ্য সান্ত্বনা দিয়া বলিয়াছেন, দোস্ত! তুমি সন্ত্রাস দমন করিতে থাক, যখন শান্তি আসিবে, আমিও আসিব। আয়েন্দা, মানে ‘ইন ফিউচার, অর্থাৎ ভবিষ্যতে তোমার দাওয়াতও কবুল ফরমাইব।

ওদিকে দাদারা বগল বাজাইয়া আনন্দ করিল। বলা যাইত, ‘লেজ নাড়িয়া’, কিন্তু সমস্যা হইল, ‘পূজ্য- বানরের’ লেজ থাকিলেও বহুদিন হইল, ‘পূজারীমানরের’ লেজ নাই। থাকিলে তাহারা অবশ্য লেজ নাড়িয়াই আনন্দ করিত।

খয়ের! যাত্রার তোড়জোর যখন তুঙ্গে তখন আচানক, মানে ‘সাডেনলি’ অর্থাৎ আচমকা দাদাদের মাথায় বাজ পড়িল। ভগবান অবগত হইলেন, দিল্লীতে প্রচুর বানর বাস করে এবং উহারা কালা আদমি দেখিলে অত্যন্ত খুশি হইয়া অতিরিক্ত আদর সোহাগ করে। ভগবানের তাহাতে আপত্তি থাকিবার কথা নহে, কারণ আদর সোহাগ তিনি নিজেও করেন এবং করিতেছেন বাগদাদে, কাবুলে! কিন্তু সম্ভবত বর্ণগত কারণে এই ভগবান একটু ভিন্ন টাইপের! তিনি আদর-সোহাগ করিতে পছন্দ করেন, তবে গ্রহণ করিতে ভালোবাসেন না। তাই সাফ বলিয়া দিলেন, উহারা আমাদের পূর্বপুরুষ হইতে পারে এবং তোমাদের পূজ্য হইতে পারে, কিন্তু আমাকে যেন তাঙ্গ, মানে ‘ডিস্টার্ব’ অর্থাৎ বিরক্ত না করে।

দাদাদের তো টিকিটি খাড়া! কী করা! কী করা! কোনটি রক্ষা করা, বানরের মান, না ভগবানের মন! তো নগদ নারায়ণ বলিয়া কথা! দাদারা ভাবিলেন, আগে ভগবানের মন রক্ষা কর! আর পূজ্যবানর! পরে তাহাকে কলাটা, খোসাটা দ্বারা তুষ্ট করা যাইবে।

এদিকে হালতের অবস্থা এবং অবস্থার হালত দেখিয়া বানরকুলের তো আক্কেল গুড়ুম! মানুষের বাঁদরামি স্বয়ং বানরের বাঁদরামি হইতে কত ডিগ্রী সরেস, এইবার  তাহারা বুঝিল, কিন্তু বড় বিলম্বে!

প্রথমে তাহারা বানরাধিকারের দাবীতে আন্দোলন করিল এবং যথেষ্ট বাঁদরামি করিল, কিন্তু নতিজা, মানে রেজাল্ট, অর্থাৎ ফল কিছু হইল না। শেষে তাহারা ঐ লোকদের নিকট গেল যাহারা বানরের বংশধর বলিয়া গর্ব করে এবং নিজেদিগকে ‘মানর’ বলিয়া দাবী করে! কিন্তু এইখানে বানরেরা প্রচন্ড ভুল করিল! এখন তো তাহাদের প্রতিপক্ষ উহারা নহে, অর্ধশতাব্দি পূর্বে যাহাদিগকে এই দিল্লী শহরে কচুকাটা করা হইয়াছিল! সুতরাং মানরেরা বানরদের কোন দোহাই শুনিল না, না বংশের দোহাই, না লেজের দোহাই। বরং দার্শনিক কায়দায় বলিয়া দিল, লেজ তো এখন আমাদের নাই, আর বংশীয় বিষয়টি সম্পূর্ণ ফিলসফিক ইস্যু! তাছাড়া বিষয়টি পূজ্য ও পূজারীদের আভ্যন্তরীণ বিষয়, যাহা আলোচনার টেবিলে সুরাহা করাই বাঞ্ছনীয়। তবে হাঁ, মানর হিসাবে আমাদের হামদর্দি, মানে ‘সিমপ্যাথি’ অর্থাৎ সহানুভূতি তোমাদের সঙ্গে থাকিল।

অবশেষে বানরেরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করিল, বলিল, হুজুরের কলমের কেরামতি এবং আমাদের প্রতি হামদর্দি সম্পর্কে আমরা অবগত আছি; হুজুর, দয়া করিয়া আমাদের কথা লিখুন। আমি হিম্মত করিয়া কিছু লিখিলাম, কিন্তু এখন আর সাহস হইতেছে না। কারণ ভয় পাইতেছি না, তবে ডর পাইতেছি যে, যমিনের ভগবান যদি বলিয়া বসে, তুমি বোধ হয় ‘জঙ্গী’!

 (খবরে প্রকাশ, ওবামার ভারতসফরকালে দিল্লীতে বানরের উৎপাত বন্ধ করিতে দিল্লী কর্তৃপক্ষ বানরবিরোধী অভিযান পরিচালনা করিয়াছিল। ওবামাকে অবশ্য বানরের কবলে পড়িতে হয় নাই।)

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা