শাবান ১৪৩১হিঃ (১৭)

রসের কলমদানি

বানর ও মানর

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

পেয়ারে পাঠকান ও পাঠিকান! আমি এখন তোমাদিগকে এমন একটি প্রশ্ন করিব যাহা শ্রবণ করিবামাত্র তোমাদের আক্কেল গুড়-ম হইয়া যাইতে পারে, তবে ঐ প্রশ্নটির কারণে আমার আক্কেল সম্পর্কে তোমরা কোন প্রকার শোবা-সন্দেহ করিও না। আল্লাহর রহমতে অতীতের মত বর্তমানেও আমার আক্কেল বিলকুল বহাল তবিয়তে আছে। এখন প্রশ্নটি শ্রবণ কর। পশুজগতে বানর নামে একটি জাতি বাস করে, উহাদের সহিত তোমাদের কি পরিচয় আছে? যদি বল, মনুষ্যজাতির সহিত বানরজাতির পরিচয় থাকিবে না, ইহা কীরূপে হইতে পারে? আচ্ছা এই বার তবে বল, কবে কোথায় উহাদের সহিত তোমাদের প্রথম পরিচয়? বলিতে পারিলে না! এখন হইল তো আক্কেল গুড়-ম! জানিতাম, এই প্রশ্নের জওয়াব তোমাদের কাছে নাই। কারণ মহামান্য বানরের সহিত সবারই কখনো না কখনো পরিচয় ঘটে, কিন' প্রথম পরিচয়ের শুভমুহূর্তটি কেহ মনে রাখে না। মাগার আমি গোলাম হোসেন মনে রাখিয়াছি। এমনকি প্রথম পরিচয়, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ পরিচয় সবই আমার সবিস-ারে মনে আছে। সেই পরিচয় কাহিনী এখন তোমাদিগকে বর্ণনা করিব, তবে একটি শর্ত। আমার মজলিসে কেহ কোন প্রকার বাঁদরামি করিতে পারিবে না। শান-শিষ্ট, ‘কী যেন বিশিষ্ট’ হইয়া চুপচাপ বসিয়া থাকিবে। আমি বলিব, তোমরা শুনিবে। নড়িবেও না, চড়িবেও না; নড়া ও চড়া যাহা করিবার আমিই করিব। বোধগম্য হইল? এই বার তবে আমি বচন শুরু করি, তোমরা শ্রবণ শুরু কর। আমি তখন গ্রামের ‘ভাঙ্গা চাল, ভাঙ্গা বেড়া’ এক মাদরাসার নয়া নয়া তালিবে ইলম। একদিন মাদরাসায় যাইতেছি। আমার সহপাঠী বলিল, ঐ দেখ গাছের ডালে বানরগুলি কেমন বাঁদরামি করিতেছে! কোথায়! কোথায়! দেখি! দেখি! আমার এত উৎসাহের কারণ, বানর জাতির ‘গুণগান’ অনেক শ্রবণ করিয়াছি। উহাদের বুদ্ধি ও দুর্বুদ্ধি সম্পর্কে বহু কিছু জ্ঞাত হইয়াছি। ‘পিঠাভাগ’ হইতে শুরু করিয়া ‘কলাভোগ’ এবং ছুতারের ফাড়া কাঠের মধ্যে লেজ আটকা পড়া, সমস- কাহিনী পাঠ করিয়াছি। ‘ঠাকুরমার ঝুলি'তে উহাদের বিভিন্ন পোজের ছবিও দেখিয়াছি, তবে এই মহামান্য জাতিটির কোন সদস্যের সহিত কখনো নিদ্রিত বা জাগ্রত কোন অবস'ায় সাক্ষাৎ-মোলাকাত নছীব হয় নাই। স্বীকার করিতে দ্বিধা করিব না যে, বাংলায় যাহাকে বলে ‘প্রথম দর্শন’, উর্দূতে বলে ‘পহেলি নযর’, আর ইংরেজিতে যেন কী, ‘ফার্স্ট সাইট’! তো প্রথম দর্শন এবং পহেলি নযর এবং ফার্স্ট সাইটেই বানরজাতিটি- কে আমার বহুতই ভদ্র-সভ্য মনে হইল। বানর যখন, ‘যেরা-থোড়া’ বাঁদরামি তো করিবেই, আদমের বেটা তো বানর না হইয়াও কত কিসিমের বাঁদরামি করে। মোটকথা, সামান্য বাঁদরামি করিলেও উহাদিগকে আমার ভদ্র-সভ্যই মনে হইল। আরও নিকট হইতে আরও উত্তমরূপে অবলোকন করিবার উদ্দেশ্যে আমি অগ্রসর হইলাম, তখন সহপাঠী কহিল, কাছে যাসনে, সাবধান! আমি তো অবাক! কেন, সাবধান হইব কেন! আমি তো তালিবে ইলম, আর শুনিয়াছি সাগরের মাছ ও বনের পশু-পাখী সকলেই তালিবে ইলমকে বহুত ইজ্জত করে এবং দু‘আ করে! সুতরাং সহপাঠীর সাবধানবাণী বে-তোয়াক্কা করিয়া আমি নির্ভয়ে অগ্রসর হইলাম। উহারা ছিল একটি বেলগাছে। আমি যেহেতু ‘ন্যাড়া’ ছিলাম না সেহেতু বেলতলা আমার জন্য সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না, কিন' সমস্যা হইল! কীরূপে? শ্রবণ কর। প্রথমে একটি বানর আমার মাথা লক্ষ্য করিয়া ছোট্ট একটি বেল নিক্ষেপ করিল। অতঃপর যাহা শুরু হইল তাহাকে তুমি বলিতে পার ‘বেলবর্ষণ’! ভাগ্য ভাল, বেলগুলি যথেষ্ট ছোট ছিল, তবে যত ছোটই হউক, বেল তো! তাই উহ বলিয়া মাথা ধরিয়া বসিয়া পড়িতে হইল! অতঃপর যাহা ঘটিল, হাস্য সম্বরণ করিয়া শ্রবণ কর। একটি বানর বলা নাই, কওয়া নাই, লম্ফ দিয়া ঝুপ করিয়া আমার কাঁধে অবতরণ করিল এবং মাথা হইতে টুপিটি হরণ করিল; শুধু হরণ করিল না, দস'রমত আপন মস-কে উহা পরিধান করিল। অতঃপর একটিমাত্র লম্ফে বেলগাছের মগডালে গিয়া বসিল। যত লম্বা করিয়া বলিলাম, এই গমনাগমন ও মধ্যবর্তী টুপিহরণে সময় কিন' ততটা লাগে নাই। এই ধর চোখের পলক, কিংবা সামান্য কমবেশী। মগডালে টুপি মাথায় বানরটিকে দেখিতে কিন' যথেষ্ট ভালো মানুষ মনে হইতেছিল। আমি তাযিম করিয়া বলিলাম, মহাশয়, দয়া করিয়া টুপিখানা ফেরত দিন এবং হাদীছের বয়ান মোতাবেক আমি অধম তালিবে ইলমের জন্য খাছ দিলে দু’আ করুন। এবং আশ্চর্য! সঙ্গে সঙ্গে বানরটি টুপিখানা আমার দিকে ছুঁড়িয়া দিল! ইহা আমার বুযুর্গি, না বানরের কেরামতি, এই বিষয়ে সহপাঠীর সহিত যথেষ্ট তর্ক হইল, কিন-ু শেষ পর্যন- কোন ফল পাওয়া গেল না, কুফল যাহা পাওয়া গেল তাহা এই যে, সাত দিন দুই বন্ধুতে আড়ি। খায়র এই হইল বানরের সহিত আমার প্রথম পরিচয়। এই বার শ্রবন কর দ্বিতীয় পরিচয়ের কথকতা, যদিও উহা প্রথম পরিচয়ের মত অতটা রসে টসটসে নহে। তখন আমি ঢাকা শহরে। গ্রাম হইতে শহরে আসা ছেলের অনেক কিছুর শখ হয়, আমার শখ হইল, চিড়িয়াখানা দেখিব। গেলাম এবং দেখিলাম, একটি খাঁচায় অনেকগুলি বানর। কিছুটা যেন পূর্বপরিচয়ের টানে কাছে গেলাম। ওম্মা, একটি বানর আমাকে রীতিমত ভেঙচি কাটিতে লাগিল। আমি তো অবাক, বানরের ভেঙচি দেখিতে এত সুন্দর! যিনি বলিয়াছেন ঠিক বলিয়াছেন, মানুষের বাঁদরামি যতটা কুৎসিত, বানরের বাঁদরামি ততটাই সুন্দর। আরেকটি বানর কোন ফাঁকে আমার হাতের আস- কলাটি থাবা মারিয়া লইয়া গেল! একটু একটু করিয়া খোসা ছাড়ায় আর একটু একটু কামড় দিয়া খায়, আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখিতে থাকি! অতঃপর কী হইল? বানর মহাশয় তৃপ্তির ঢেকুর তুলিয়া খোসাটি আমার দিকে ছুঁড়িয়া দিলেন এবং আমার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকাইলেন যাহার অর্থ হইতে পারে, ‘খোসাটা একটু ডাস্টবিনে রাখিয়া আস তো! আমি কলা খাইব, আর কেহ ‘পিছল’ খাইবে, ইহা ঠিক নহে।’ কোন মানুষ যদি এরূপ কাণ্ড করিত, রীতিমত অনর্থ বাঁধিয়া যাইত। কারণ সেই একই কথা, মানুষের বাঁদরামি কুৎসিত, বানরের বাদরামি সুন্দর। তৃতীয় পরিচয়টিকে তুমি বলিতে পার, ‘নিদ্রিত মানবের সহিত জাগ্রত বানরের মোলাকাত’। সংক্ষেপে ঘটনাটি এই। সংসদভবন এলাকায় তখন বানরের যথেষ্ট উৎপাত। উৎপাত শব্দটি অন্যদের, আমি বলি, ‘আনাগোনা’। বৈকালিক ভ্রমণকালে হঠাৎ খুব ক্লানি- বোধ হইল, বুড়া বয়সে যা হয়। একটি নিরিবিলি স'ানে একটি গাছের নীচে শুইয়া পড়িলাম। স'ান ও সময় কোনটাই নিদ্রার উপযুক্ত ছিল না, তবু নিদ্রা আসিল এবং আমাকে নিদ্রিত করিল। নিদ্রার মধ্যে একটি বানর আসিয়া আমাকে ভেঙচি কাটিতে লাগিল। বানরের বাঁদরামি আমার অপছন্দ নহে, কিন' উহারও তো একটি সীমা থাকিতে হয়! বিরক্ত হইয়া বানরটিকে তাড়াইতে গেলাম, আর নিদ্রা টুটিয়া গেল, জাগ্রত হইয়া দেখি একটু দূরে একটি বানর আমাকে ভেঙচি কাটিতেছে। মনে হইল বলিতেছে, আমাদের এলাকায় তুমি কোথা হইতে! আমি মনে মনে ‘দুঃখিত’ বলিয়া স'ানটি ত্যাগ করিলাম। সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হইলেও আমার মনে হয় নিদ্রিত ও জাগ্রত উভয় অবস'ায় আসলে আমি একই বানরকে অবলোকন করিয়াছি। কারণ আচরণে উহারা অভিন্ন ছিল! চতুর্থ পরিচয় ... কিন' সময় যে ফুরাইয়া গেল! যাক আসল কথাটি বলিয়া ফেলি। মানুষ যখন বাঁদরামি করে তখন লোকেরা তাহাকে মানর বলে। দেশে এখন মানুষের সংখ্যা কমিতেছে, মানরের সংখ্যা বাড়িতেছে। কী করা যায় বল তো!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা