জুমাদাল আখেরা ১৪৩১হিঃ (১৬)

রসের কলমদানি

বিদ্যুতের মুশকিল আসান!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট
পেয়ারে বেরাদারান! কী ভাবিতেছ, লোডশেডিংয়ের যামানায় আমি কলম বন্ধ করিয়া, কাঁথা মুড়ি দিয়া নিদিতেছি! না পেয়ারে, না! আসল ঘটনা শোন, আমার বুবুজান এখন বিদ্যুতের মুশকিলে পেরেশান, তো তাহার মুছিবতের কালে আমি নাদান কি নাক ডাকিয়া নিদিতে পারি? কস্মিনকালেও না। আমি বরং বুবুজানের পেরেশানি দূর করিবার নিয়তে বিদ্যুতের উপর লম্বা একটা গবেষণায় দিয়াছিলাম। এই জন্য পুষ্পের কাজ বন্ধ ছিল। মিয়াঁ, আগে দেশের মানুষ বাঁচুক, বুবুজানের শানি- হউক, তারপরই না কলমের খেদমত! যাক, দীর্ঘ গবেষণার পর আমার ঘর্মাক্ত মস-ক হইতে যে আশ্চর্য সমাধান নির্গত হইয়াছে তাহাতে আশা করি বাংলাদেশে বিদ্যুত সমস্যা বলিয়া কোন পদার্থ আর অবশিষ্ট থাকিবে না। আরে রাখ, এত তাড়াহুড়া কেন? ধীরে সুসে' সব খোলাছা করিয়া বলিতেছি। দেশের মানুষগুলা আসলেই বড় বে-ছবুর! বুবুজান ঠিকই বলেন, প্রজাদের ধৈর্য নাই। রাতারাতি সমাধান চায়। আরে মিয়াঁ, আগে তো পিছিলা জঞ্জাল ছাফ কর, তার পরেই না কাজ! গতবারের ঘটনা দেখ! পাঁচ বছরে ঝাঁটা হাতে কত কষ্টে পিছিলা জঞ্জাল ছাফ করিলেন, সামনের টার্মে কাজ করিবেন বলিয়া যেই না কোমরে আঁচল গুঁজিলেন, প্রজাদের ছবরের টাঙ্কি খালি! নাহ, এইবার আর নাদানি করিও না। পয়লা ‘টার্মে’ এনালগের জঞ্জাল সাফ করিতে দাও, যাহাতে দোসরা টার্মে বুবুজান মনের সুখে ‘ডিজিটাল’ কাজ শুরু করিতে পারেন। অবলোকন কর, বুবুজান কীভাবে জঞ্জাল ছাফ করেন, অতঃপর কাজ শুরু করেন। বুবুজানের জঞ্জাল ছাফ করিবার এলেমদারি বড়ই! আন-র্জাতিক বিমানবন্দর হইতে নামের জঞ্জাল ক্যায়সা ‘জালালি’ কায়দায় ছাফ করিয়া দিলেন! দুধও খাইলেন, গোঁফেও সর লাগিল না! তওবা, খেয়াল ছিল না, এই বচনটি ত বুবুজানের শানে চলনসই নহে! মাগার দিলে আমার একটা আশঙ্কা, বুবুজানের যদি হায়াতে না কুলায়! দেশের দুর্ভাগ্য, বুবুজানের আব্বাজান জঞ্জাল ছাফ করিলেন, সংবিধান পরিষ্কার করিলেন, এখন কীর্তিকর্ম শুরু করিবেন, কিন'...! আল্লাহর রহমতে এবার অবশ্য সে আশঙ্কা নাই। মহান বন্ধুদেশ বুবুজানের হিফাযতির বিষয়ে বহু সিরিয়াস। কাহারা যেন বলাবলি করে, আব্বাজানের বেলায় বন্ধুরা যথেষ্ট সিরিয়াস ছিল না। কী কী কারণে আব্বাজানের প্রতি নাকি নাখোশ ছিল! সে যাক, এই বার ধৈর্য ধরিয়া বইস এবং অধমের বিদ্যুৎ গবেষণা ও তাহার ফলাফল শ্রবণ কর। আচ্ছা, আগে ছোট্ট একটি বানান বল, বিদ্যুতে খণ্ড ত, না আস- ত? কী বল, খণ্ড ত! নাহ, বানানে আসলেই তোমরা কাঁচা। বিদ্যুতে আস- ত। শুধু ‘বিদ্যুৎ’ লিখিলে খণ্ড ত। তোমাদিগকে ভালই জব্দ করা গেল। এবার শোন; গবেষণার শুরুতেই আমি অধম আবিষ্কার করিলাম যে, বিদ্যুৎসমস্যার প্রধান দিক দুইটি । গার্হস'্য সমস্যা ও শিল্পসমস্যা। গার্হস'্য সমস্যার বিষয়ে হঠাৎ আমার মাথায় একটি বুদ্ধি খেলিয়া গেল। প্রত্যেক মানুষের শরীরে নাকি একশ ওয়াট পরিমাণ বিদ্যুৎ আছে, তো আমরা ভিতরের বিদ্যুৎ ব্যবহার না করিয়া বাহিরের বিদ্যুতের জন্য হা-পিত্যেস করি কেন? এজন্যই ত বাঙ্গালীর উন্নতি নাই। তাহারা চিন-া করে না এবং মগজ ব্যবহার করে না। তো আমি মগজ ব্যবহার করিয়া এবং চিন-া করিয়া দেখিলাম, জলবিদ্যুৎ, কয়লাবিদ্যুৎ , তেলবিদ্যুৎ গা্যসবিদ্যুৎ ইত্যাদি হরকিসিমের বিদ্যুৎ-চিন-া বাদ দিয়া আমরা যদি ‘দেহবিদ্যুৎ’ উৎপাদন করি তবে সমস্যা অন-ত কিছুটা পাতলা হয়। গবেষণাটি যখন প্রায় চূড়ান- তখন বিবি ছাহেবা একটি সুচিনি-ত আপত্তি উত্থাপন করিলেন। সবসময় দেখি, বিবি ছাহেবার বুদ্ধিতে যথেষ্ট ধার এবং মাঝে মধ্যে উহা আমাকেও স্পর্শ করে। তিনি বলিলেন, তোমার চিন-ায় সৃজনশীলতার ছাপ আছে। থাকাই স্বাভাবিক, কত বছর একসঙ্গে আছি! তবে একটা বিষয় তুমি ভাবিয়া দেখ নাই। ভেজাল খাদ্যের কারণে আমাদের দেহের তাপমাত্রা আগের মত নাই। সুতরাং এখন অত বিদ্যুৎ পাওয়া যাইবে না, তাছাড়া ভেজাল খাদ্যের বিদ্যুতেও ভেজাল হওয়ার আশঙ্কা। খুবই চিকন বুদ্ধির কথা, না মানিয়া উপায় কী, সুতরাং দেহবিদ্যুত প্রকল্পের চিন-া বাদ দিতে হইল এবং নতুন করিয়া গবেষণা শুরু করিতে হইল। ভাবিতে ভাবিতে মস-ক যখন অত্যন-ঘর্মাক্ত হইল তখন হঠাৎ মনে পড়িল ছোট কালে পড়া শফদার ডাক্তারের কথা। যদিও কবিতাটি এখন পরিত্যক্ত, তবু আশা করি ডাক্তার মহাশয়ের গুণের কথা অনেকেরই জানা আছে। তিনি বই পড়িতেন ‘আলোটা নিভিয়ে’। কী চমৎকার ব্যাপার, বিশেষত বিদ্যুৎসমস্যার এই যুগে! ত দেশবাসীকে এবং শিক্ষার্থীদিগকে পরামর্শ দেওয়া যায়, নিজেদিগকে তাহারা যেন, মাথাভরা টাক থাকুক, বা না থাকুক, শফদার ডাক্তারের আধুনিক সংস্করণরূপে গড়িয়া তোলে এবং পড়া ও লেখাসহ যাবতীয় কর্ম আলো নিভাইয়া সমাধা করিবার কৌশল আয়ত্ত করে। অবশ্য আলো নিভাইবার প্রশ্ন আসে যখন বিদ্যুৎ থাকে। যখন থাকে না, তখন ত আরো আরাম! সুইচ টিপার কষ্টও নাই! কিন' বিবি ছাহেবা এখানেও আপত্তি করিলেন এবং এমন খতরনাক একটি আন্দেশার কথা যাহির করিলেন যে, রীতিমত আক্কেল গুড়-ম। সুতরাং বিদ্যুৎসমস্যার শফদারীয় সামাধানও বাতিল। খয়ের, আবার মাথা ঘামাইতে লাগিলাম। ঘামাইতে ঘামাইতে তে তে তে তে ‘মাথাব্যথা সারাইতে মাথা কাটিয়া ফেলা’র পুরানা প্রবচনটি মনে পড়িয়া, অমনি সুন্দর একটি সমাধান বিদ্যুতের মত আমার মগজে খেলিয়া গেল এবং খুশির বিষয়, উহাতে আছে গার্হস'্য ও শিল্প উভয় সমস্যার যুগপৎসমাধান। আগের টার্মে বুবুজানের একটি মূল্যবান বাণী ছিল, দেশের পঁচাশিভাগ মানুষ বিদুৎ পায় না, শুধু পনের ভাগ মানুষের সুবিধার জন্য এত হৈচৈ কেন? তাই ত! পঁচাশিভাগ মানুষ বিদ্যুৎ ছাড়া চলিতে পারে, মাত্র পনেরভাগ মানুষ পারিবে না? আলবৎ পারিবে, পারিতে হইবে। কাহার ঘাড়ে কয়টা মাথা যে পারিবে না! ব্যস, মাথা কাটিয়া ফেল, মাথ্যাব্যথা আপনিতেই সারিয়া যাইবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করিয়া দাও, বিদ্যুতের সমস্যা আপনিতেই চলিয়া যাইবে! তাছাড়া আমরা শুধু বিদ্যুতের আলোর দিকটাই দেখি, অন্ধকার দিকটা দেখি না। মিয়াঁ একটু চিন-া কর, সামান্য বিদ্যুতের জন্য কী বিপুল পরিমাণ কয়লা, গ্যাস ও তেল পোড়াইতে হয়। অথচ এইগুলি অতিমূল্যবান জাতীয় সম্পদ। তো জাতীয় সম্পদের অপচয় কি বরদাশতযোগ্য! হাঁ, বলিতে পার, বিদুৎ ছাড়া কলকারখানা চলিবে কীভাবে? কিন' কল-কারখানায় লাভ কোথায়? দেখ না, শ্রমিকদের কত বাড় বাড়িতেছে! কথায় কথায় আন্দোলন, ভাঙ্গচুর, অবরোধ, অগ্নিসংযোগ! তার চেয়ে কলখারখানা বন্ধ হউক, শ্রমিকগুলা শায়েস-া হউক। তাছাড়া আমি অগ্রিম আশ্বাস দিতেছি। হিন্দুস-ানের মত মহান প্রতিবেশী থাকিতে পণ্যের আমাদের অভাব হইবে না। কত লাভ দেখ ত! দাদারা করিবেন উৎপাদনের কষ্ট, আমরা করিব ভোগের আরাম! দাদাদের গাড়ীগুলা অবশ্য লক্কড়ঝক্কর। কিন-ু আগেও তো আমরা গাড়ী উৎপাদন করিতাম না। অর্থাৎ বিদ্যুতের সঙ্গে ইহার কোন সম্পর্ক নাই। সুতরাং বুবুজান ভারতের বিদ্যুৎ আরও পণ্য আমদানি করুন। আমার ধারণা, দাদারা ইহাতে অধিক আহ্লাদিত হইবেন। কী বল, বেকারসমস্যা! তোমার মাথা! আমি তো দেখি, সামনে এখন বিপুল কর্মসংস'ানের এক মহাসম্ভাব- না উঁকি দিতেছে! মুখ হা করিয়া চক্ষু বড় বড় করিয়া কী দেখিতেছ? রমেশচন্দ্র সেন বাবুকে চিন! হাঁ, আমাদের পানিসম্পদ- মন্ত্রী। সমপ্রতি তিনি অতি মূল্যবাণ একটি বাণী উদ্গিরণ করিয়াছেন। যাহাদের আকল কম, বুদ্ধি বেশী তাহারা মন্ত্রীবাবুর নিন্দা করেন, আর যাহাদের বুদ্ধি কম, আকল বেশী তাহারা তো দস'র মত জানিতে চাহেন, তিনি আসলে কোন্‌ দেশের মন্ত্রী? আমার আকলও কম, বুদ্ধিও কম। তবে আকলের চেয়ে বুদ্ধি কম, না বুদ্ধির চেয়ে আকল কম! তা জানি না, শুধু জানি, দু’টাই বেশ কম। তাই আমি মন্ত্রীবাবুর নিন্দা করি না এবং তাহার মন্ত্রিত্বের দেশ-কাল সম্বন্ধে সন্দেহ করি না। সেনবাবুর কথায় আমি বরং বিশাল কর্মসংস'ানের বিপুল সম্ভাবনা দেখিতে পাইতেছি। বিশ্বাস কর, বিদ্যুৎহীন ও কলকারখানাহীন বাংলাদেশে বেকার সমস্যা বলিয়া কোন আপদ আর থাকিবে না, এমনকি প্রবাসী শ্রমিকদের যে উল্টা শ্রোত চলিতেছে তাহারও একটা হিল্লা হইয়া যাইবে। কীভাবে? শোন! বাংলাদশের বাচ্চা-বুড়া, আম-খাছ সকলেই বলে, ফারাক্কা বাঁধ দেশের জন্য মরণফাঁদ। উহার কারণে দেশটা একবার মরুভূমি হয়, একবার বন্যায় ভাসে। কিন' সেনবাবু সেদিন মূর্খ দেশবাসীকে জ্ঞান দান করিলেন যে, ইহা বন্ধুদেশের প্রতি রীতিমত অকৃতজ্ঞতা। খরা-বন্যার জন্য বন্ধুদেশ দায়ী নহে, দায়ী এ দেশের হতভাগা নদীগুলা। আর সমাধান হইল ব্যাপক ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর তলদেশ আরো গভীর করা, যাতে বন্ধুদেশ পানি দেওয়ার পর পানি না আসিলেও নদীগুলার বুকে যেন পর্যাপ্ত পানি থাকে, আর পানি আসিলে সেই পানি বুক ভারিয়া যেন ধারণ করিতে পারে। পেয়ারে বেরাদারান, অনুরোধ করি, মন্ত্রীবাবুর কথায় তোমরা হাসিও না, কিংবা কাঁদিও না এবং তাহার দেশপ্রেম বিষয়ে কাতরা পরিমাণ শকশোবা করিও না, বরং এমন অমৃত- বচনের জন্য বগল বাজাইয়া তাহাকে সাধুবাদ জানাও। আমিও অন-রের বাহির হইতে তাহাকে বাহবা দিতেছি। কারণ তিনি আমার সামনে বিদ্যুতহীন বাংলাদেশের বিপুল কর্মসংস'া- নের রাস-াটি ফরসা করিয়া দিয়াছেন। দেশে বর্তমানে ও ভবিষ্যতে যত বেকার আছে ও থাকবে, এমনকি যত প্রবাসী বেকার হইয়া ‘আসতেছে’, কোন চিন-া নাই, সকলে মিলিয়া টুকরি-কোদাল লইয়া নদীখননে লাগিয়া যাও। হুইসেলধারী মেজরের ত বুদ্ধি ছিল না এবং শুনিতে পাই দেশপ্রেমও ছিল না, তাই তাহার চিন-া ছিলো শুধু খাল- খনন, অথচ নদীখনন উহার চেয়ে কত বড় বিপ্লবী কর্মসূচী! সুতরাং বিদ্যুতরৎ-চিন-া ত্যাগ কর, কলকারখানা বন্ধ করো এবং দেশের যত বেকার মানুষ টুকরি-কোদাল লইয়া নদীখনন শুরু কর। প্রশ্ন হইল, এত অল্প সময়ে এত টুকরি-কোদাল কোথা হইতে কীভাবে আসিবে? বন্ধুদেশ থাকিতে চিন-া কী! জরুরী ভিত্তিতে উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়াই কোন দাদা-প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ প্রদান কর। তাহারা সর্ট টাইমে উহা সরবরাহ করিবেন। কারণ তাহারাও তো চাহেন, ফারাক্কা সম্বন্ধে বাঙ্গালদের ভুল ধারণা দূর হউক। দ্বিতীয় প্রশ্ন, লক্ষ লক্ষ লোকের মজুরি! আরে মিয়াঁ, বন্ধুদেশ থাকিতে ইহাও কোন চিন-ার বিষয়! দাদারা তো ঋণ দিবার জন্য দুই পায়ে খাড়া, একশ কোটির সঙ্গে আরো কিছু যোগ কর! বিদায়ের আগে অন্য একটি কথা, সম্পর্কে ‘উহারা’ যে দাদা, ইহা আমার জানা ছিল না, মইন ইউ আহমেদ উর্দিপরা হালতে কেতাব লিখিয়া এই জ্ঞানটুকু দান করিয়াছেন, সুতরাং তাহাকেও ধন্যবাদ। প্রসঙ্গত জানিতে বড় ইচ্ছা হয়, দাদারা মইন সাহেবকে যে ছয়টি তাজা-তাগড়া ঘোড়া উপহার দিয়াছিলেন উহারা এখন কী খায়? ঘাস খায়, না ‘মানচিত্র খায়’?! কিছু একটা ত অবশ্যই খায়, কিন' খোঁজ লইবার কেহ নাই।
শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা